সৈনিকদের চুল ছোট রাখা হয়, চুলে বাটি ছাঁটা দেয়া হয় ৷ কেন দেয়া হয়, হয়তো অনেক সৈনিক নিজেরাই সঠিক কারণটি জানেন না ৷ অথবা কারণগুলোর কোনটি জানেন, কোনটি জানেন না ।
বিশেষ করে পুরুষ সৈন্যরা বা পুরুষ সৈনিকদের চুল ছোট রাখার ব্যাপারটি সবারই চোখে পড়ে । পৃথিবীব্যাপী সৈনিকদের চুলের একই রূপটি সব জায়গায় একই । কোথাও বড় চুলের সৈন্য বাহিনী পাবেন না ।
১৯৪৮ থেকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে ১৩০ টি দেশের ৬০ এর অধিক মিশনের ৫২ টি তে যাওয়া বাংলাদেশের সৈন্য বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন দেশের কর্মরত আশি হাজারের বেশি সৈন্য বলেন, অফিসার-সৈনিক সবার চুল ছোট রাখা হয় । কিন্তু কেন ?
ইতিহাসের কিছু নিয়মের ব্যাখ্যা নিয়ে কিছু বলি ।
একটি কাজ কেন শুরু হয়েছিল, পালন করতে করতে একটা সময়ে প্রশ্ন ছাড়াই পালন করে লোকে ৷ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক কিছুই আমরা পালন করি, যার কারণটি আমরা জানি না, বা জানার চেষ্টাও করি না ।
অথবা অন্য কোন কারণকে উত্তর হিসাবে দাঁড় করায় লোকে ৷ ইতিহাসের অনেক কিছুই এমন করে হারিয়ে গেছে আড়ালে । নতুন করে তার একটি প্রয়োজন অথবা কার্যকারণ দাঁড় করায় পরে ।
মজার হলো, লোকে ভাবে এবং নিজের পরিচিত সামরিক বাহিনীর কেউকে কেউকে চুল ছোট রাখার কারণ জিজ্ঞাস করে দেখেছি, বেশিভাগের ধারনা যে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্যে চুল ছোট রাখে ৷
অনেকে আবার কিছু জোড়াতালির উত্তর দাঁড় করায় ! যেমন, কেউ কেউ তাই বলেন – চুল ছোট রাখলে ব্যাস্ত সৈনিকদের চুলের যত্ন কম নিতে হয়, মাথা ঠাণ্ডা থাকে, হেলমেট পরতে হয়, ছোট চুল ভিজলে তাড়াতাড়ি শুকায়, এমন সব হাবিজাবি উত্তর দেয় কেউ কেউ ।
এরকম অনেক কিছুই আসলে ঠিক যে কারনে শুরু হয়, সময়ে সেটা হারিয়ে যায়, কারণটি ভুলে যায়, কিন্তু কাজটি মেনে চলে লোকে এবং পরে তার অন্য আরেকটি কারণ দাঁড় করায় ।
যেমন মেয়েদের শার্টের বোতাম বাম পাশে থাকে, ছেলেদের ডানে । জিন্স প্যান্টের পকেটের ভেতর আরেকটি ছোট পকেট থাকে । ফিশের সাথে চিপস হিসাবে আলু কেন খায়, এইরকম অনেক কিছুই আছে লোকে এখনো মেনে চলে । কিন্তু প্রতিটির এক একটি কারণ থেকেই শুরু, পরে হয়ে গেলো সংস্কৃতি ।
সৈন্যরা চুল ছোট রাখে কেন – উত্তরটাও খুব ছোট করে দেব ৷
এটি রোমানরা দুই হাজার বছর আগে চালু করেছিল প্রথম । সভ্যতার অনেক কিছুই এমন করে রোমানদের কাছ থেকে পাওয়া ।
ইতিহাসের গবেষকরা এ নিয়ে গবেষণা করে দেখেছে যে – সৈন্যদের মাঝে এক ধরণের Group Psychological এফেক্ট তৈরি করতে এটা করা হতো ৷ আর সেটা হলো unity বা একতা ৷
কেউ যখন নিজেকে একটি গ্রুপের পার্ট বা অংশ মনে করে, তখন তার মধ্যে একধরণের সেক্রিফাইস বা উৎসর্গ করবার প্রেরণা আসে, প্রেরণা পায়, উৎসাহ পায়, শক্তি আসে, শক্তি পায়, এমনকি পাগলামিও বেড়ে যায় ৷ সৈন্যদের একই ধরনের পোশাক, একই ধরনের ফিজিক্যাল ইম্প্রেশন নিজেদের মধ্যে এক ধরনের একতার সাবকনশাস ইম্প্রেশন তৈরি করে ৷
যুদ্ধে একই পোশাক যুদ্ধের ময়দানে নিজেদের চিনতেও সাহায্য করতো । এটা একতার একটি প্রতীকী প্রকাশ ।
যাইহোক, সাইকোলজিক্যাল এফেক্টের যে কথা বললাম, সেটাই ছিল শুরু, সেই শুরুটা অন্য ইনস্টিটিউশনের উপরেও ব্যবহার করা হয়েছে পরে ৷ যেমন : স্কুল ড্রেস ৷ যদিও স্কুল ড্রেসের অন্য কারণ, সবাইকে একই লেভেলের ভাবাতে একটি এনভায়রনমেন্টাল ইফেক্ট দেয়া ৷
রোমানদের সময়ে চুল ছোট রাখার আরেকটি কারণ ছিল ৷ তখন যুদ্ধ হতো সামনা সামনি । দ্বন্দ্ব যুদ্ধ হতো, মুখোমুখি যুদ্ধে চুল লম্বা হলে শরীরের একটি দূর্বল জায়গা হয়ে দাঁড়ায় ৷
ঘোড়া থেকে কেউ’কে ফেলে দেবার জন্যে কিংবা সম্মুখ সমরে চুল ধরলে সহজেই যে কেউকে কাবু করা যায় ! লম্বা চুল তখন উল্টো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।
কেউ কেউ বলেন সৈনিকদের চুল ছোট রাখার এই রীতি গ্রীকরা প্রথম চালু করেন । আলেকজান্ডার তার সৈনিকদের যুদ্ধের আগে চুল ছোট করে রাখতে নির্দেশ দিতেন, যাতে করে এমন লম্বা চুল সম্মুখ যুদ্ধে বিড়ম্বনা হয়ে না দাঁড়ায় ।
এমন করে যুদ্ধের প্রয়োজনে চুল ছোট রাখার কারণটি সময়ে পরিচ্ছন্নতার প্রতীকী রূপে সৈনিকদের মাঝে এখনো পালন করা হয়, যদিও বাস্তবতায় ছোট চুল বড় চুলের সাথে পরিচ্ছন্নতার কোন সংযোগ নেই । কারণ, সেটাই যদি হতো, মেয়েদের লম্বা চুল মেয়েদের অপরিষ্কার রাখতো ।
© অপূর্ব চৌধুরী । চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক ।