-
দাম কম
-
পরিবহন সুবিধা
-
সরবরাহ ও ভ্যাক্সিন সংরক্ষণ সুবিধা
খুব সম্ভবত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের দিকে বাংলাদেশে ভারত থেকে প্রায় বিশ লক্ষ টিকার রেগুলার ডোজ এসে পৌঁছাবে। (প্রথম ২০ লক্ষ যেটা গতকাল এসে পৌঁছেছে, সেটা উপহার, আর আগামী সপ্তাহে যেটা আসবে সেটা মূল কেনা )
এটা নিয়ে থাকার কথা ছিল স্বস্তি, খানিকটা আনন্দ। কিন্তু যেহেতু টীকাটা আসছে ভারত থেকে, তাই যথারীতি শুরু হয়ে গেছে সমালোচনা, বিদ্রূপ আর সন্দেহ। ভারত থেকে না হয়ে যদি পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশ থেকে বাংলাদেশ এর চার গুন দামে টীকা আনত, তবে এতোসব কিছু হত কিনা সন্দেহ।
প্রথমেই বলি, দামের কথা। বাংলাদেশের মিডিয়া বেশ ফলাও করে প্রচার করেছে বাংলাদেশ এই টীকা প্রায় ৪৭% বেশি দাম দিয়ে কিনছে। কার সাপেক্ষে বেশি? পুনের সিরাম ইন্সটিটিউট যে দামে ভারত সরকারকে টীকা দেবে, তার চেয়ে ৪৭% বেশি। এই তথ্যটি কিন্তু মিথ্যে নয়।
তবে আমাদের সাংবাদিক ভাইয়েরা তো আমাদের দেশের মানুষের মন বোঝেন। তাই তারা গোটা তথ্যটাকে খানিকটা টুইস্ট মেরে উপস্থাপন করেছেন। যাতে মনে হয়, ভারতের কাছ থেকে টীকা এনে আমরা বিরাট ঠক খাচ্ছি।
ভারতে এই টিকার দাম প্রতি ডোজ ২.৭৪ ডলার। তাহলে আমাদের কাছে ৪ ডলার করে নিচ্ছে কেন? কারণ আছে। একটি দেশের প্রাইভের কোম্পানি তার সরকারকে যে দামে পণ্য দেবে, বাইরের দেশে সেই একই পণ্য বিক্রি করতে গেলে একই দাম অফার করবে না। কারণ, তার সরকারের কাছ থেকে সে বিদ্যুৎ, জমি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভর্তুকি পায়। পায় কর রেয়াত। ফলে তার সরকারকে এই ধরণের পণ্য কম দামে দেয়ার ক্ষেত্রে তার কিছুটা দায়বদ্ধতা আছে।
ওদিকে বাংলাদেশ সিরাম ইন্সিটিউটর কাছ থেকে যে পরিমাণ টিকা কিনবে, ভারত সরকার কিনবে তার দশ গুন। ডিমান্ড বেশি, সাপ্লাই বেশি, দাম কম। এটাই তো অর্থনীতির সূত্র। আপনি পাইকারি বাজারের চেয়ে হোলসেল বাজারে গেলে দাম কম পান এই কারণেই।
আমি এই দাম নিয়ে অভিযোগটি জানার পর খানিকটা অনুসন্ধান করে জানলাম, অক্সফোর্ডের এই টিকার আন্তর্জাতিক বাজার দর-ও ৪ ডলার। অর্থাৎ,
দামের দিক থেকে আমরা সমান দামেই পাচ্ছি, যদি আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে তুলনা করি।
বিভিন্ন দেশের কেনা ভ্যাক্সিনের দামের তুলনা দেখুন এখানে
এবারে আসি বাকি টিকাদের কথায়। অনেকেরই কথা, অভিযোগ, যুক্তি হল বাংলাদেশ কেন ফাইজার বা মডার্নার টিকা না কিনে ভারতের কাছ থেকে অক্সফোর্ডের টিকা “বেশি দামে” কিনল?
আপনি কি ফাইজার বা মডার্নার টিকার দাম জানেন? বাংলাদেশের সাংবাদিক ভাইয়েরা কিন্তু এই তথ্যটাও চেপে গেছে। কারণ, এই তথ্যটা দিলেই মানুষ বুঝে ফেলত আসল ঘটনা।
ফাইজারের টিকার এক ডোজের দাম ২০ ডলার, মডার্নার এক ডোজের দাম ৩২ ডলার। ফাইজার তাঁদের টিকাটি বানায় আমেরিকা, জার্মানি আর বেলজিয়ামের কারখানায়। মডার্নাএকটি নতুন কোম্পানি। এদের আগে কোন টিকা ছিল না। গত প্রায় একদশক ধরেই তারা নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছিল।
করোনার টিকাই তাঁদের প্রথম প্রোডাক্ট। এবং এটিও সফল হয় আমেরিকান সরকারের দেয়া বিরাট অংকের অর্থ সাহায্যের ফলে। এদের একটাই কারখানা। সেটি আমেরিকায়। ফলে এদের উৎপাদন খরচ বেশি।
ফাইজার আর মডার্নার, দুজনের টিকাতেই একটি বড় সমস্যা কোল্ড চেইন মেইনটেইন করা। এটা এতো জটিল প্রক্রিয়া যে আমেরিকান সরকারও রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। আর্মিকে নামানো হয়েছে পরিবহনে। তবুও অনেক সময়ে অঘটন ঘটছে। কারণ, ফ্যাক্টরি থেকে বিমানবন্দর, সেখান থেকে প্লেন, প্লেন থেকে অফ লোড করা, সেখান থেকে কোন স্থানীয় গুদামে নেয়া, সেখান থেকে ছোট হাসপাতালে নেয়া- এই সবগুলো পর্যায়েই কোল্ড চেইন ধরে রাখতে হবে।
এটা বাংলাদেশের মত দেশের পক্ষে আদৌ সম্ভব কিনা, এই নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এমনকি বেসরকারি পর্যায়েও সম্ভব না। অনেকে বলছেন, ফাইজার নিজেই নাকি এসবের ব্যাবস্থা বায়বস্থা করে দেয়। ফাইজার তাদের পার্টনার শিপিং কোম্পানির মাধ্যমে আপনার দেশে টিকাটি পৌঁছে দেবে। তারপর কীভাবে এই পুরো কোল্ড চেইন সামলাবেন, কাকে দিয়ে সামলাবেন, সেটা আপনার বিষয়। আমার জানামতে সেজন্য ল্যাটিন দুটি দেশ ব্যাতিত আর কোন গরীব দেশ (অন্তত এখন পর্যন্ত ) এদের টিকা কেনার সাহস করেনি।
দামের ব্যাপারেও একটা ব্যাপার ভাবার আছে। ফাইজারের টিকা যদি এক ডোজের দামই হয় ২০ ডলার, তাহলে সেই সুদূর ইউরোপ-আমেরিকা থেকে প্লেনে করে কোল্ড চেইনে আনার পর পরিবহন খরচসহ সেই টিকার দাম পড়বে প্রায় ২৫ ডলার। অর্থাৎ , দু ডোজ ৫০ ডলার। টাকায় প্রায় ৪ হাজার টাকা। যার বাড়িতে চার জন, তাকে খরচ করতে হবে ২০ হাজার টাকা।
একইভাবে মডার্নার টিকার দু ডোজের দাম পড়বে প্রায় ৮০ ডলার। টাকায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার। কজন সেই টাকা খরচ করতে পারবে? কিংবা সরকারের কাছেই কি সেই পরিমাণ টাকা আছে দেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে সেই টিকা দেবার মত?
এর বাইরে আরেক দলের যুক্তি, সরকার কেন রাশিয়া কিংবা চীনের টিকা নিল না?
রাশিয়ার টিকাটি এখনও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ধাপই পূর্ণ করেনি। তাদের ট্রায়াল তথ্যও সেভাবে অবমুক্ত নয়। ইউরপিয়ান ইউনিয়ন, জাতিসংঘের হু– এরা কেউই রাশিয়ার টিকাতে নিরাপদ বলে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি।
যদিও ঝুঁকি মাথায় নিয়েই আর্জেন্টিনা রাশিয়ার টিকা দেয়া শুরু করেছে। করেছে কারণ তাদের আর উপায় নেই। মডার্না, ফাইজারের টিকা হয়তো তাদের পক্ষে এখনই কেনা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ভারত এই মুহূর্তে কেবল তার কাছের দেশ ব্যাতিত আর কারুর কাছে টিকা বিক্রি করছে না। তাই দেয়ালে পিঠ থেকে যাওয়াতেই হয়তো হয়তো তারা রাশিয়ার টিকা স্পুটনিক কিনছে।
ও হ্যাঁ, এই টিকাটিও কিন্তু সস্তা নয়। প্রতি ডোজ- ১০ ডলার। রাশিয়া থেকে আকাশ পথে পরিবহন খরচ হয়তো হবে ৪ ডলারের মত। অর্থাৎ দু ডোজে খরচ ২৮ ডলারের। (অন্যদিকে পরিবহন খরচসহ ভারত থেকে প্রতি ডোজ আমরা পাচ্ছি ৫ ডলারে , দু ডোজ ১০ ডলার)।
একই কথা প্রযোজ্য চীনের টিকার ক্ষেত্রে। এই টিকাটিও এখনও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শেষ করেনি। সর্বশেষ ব্রাজিল থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় সেখানে এই টিকার সাফল্যের হার ছিল মাত্র ৫০%। এতো কম সাফল্যের হার নিয়ে চীন এই টিকাকে অবমুক্ত করলেও সেই টিকা গ্রহণ আদৌ যুক্তিযুক্ত হবে কি?
অনেকেই আরও প্রশ্ন তুলছেন টিকা উৎপাদন নিয়ে ভারতের সক্ষমতা নিয়ে। তাদের হয়তো অজানা- সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর যে টিকা উৎপাদিত হয়, তার একটি বড় অংশই উৎপাদিত হয় ভারতে। ভারতে সারা বিশ্বের ৬০% টিকা উৎপাদিত হয়।
ভারতের এ ক্ষেত্রে সক্ষমতা প্রমাণিত। আমেরিকার বাজারেও ভারতের বহু ওষুধ রপ্তানি করা হয়। সেকারণে ভারতের ওষুধ কারখানা কিংবা টিকা কারখানা প্রায়শই আমেরিকা এফডিএ পরিদর্শন করে। নিম্ন মান নিয়ে এমন একটি সংবেদনশীল সেক্টরে টিকে থাকা সম্ভব নয়। আর তেমন হলে অক্সফোর্ড নিজেই ভারতের সেরাম ইন্সিটিউটর সাথে চুক্তি করতো বলে মনে হয় না।
মোটের উপর, আমার কাছে মনে হয়, জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির মাঝে সাশ্রয়ী মূল্যে বাংলাদেশ যদি টিকা পেতে চাইতো, তবে তার কাছে ভারতের কাছ থেকে অক্সফোর্ড টিকাটি নেয়া ছাড়া আর কোন ভালো অপশন ছিল না।
Writter: Sanjoy Dey
California State University, San Marcos