কোন নদীটি সকল নদীর রাণী? মিশরের গৌরব নীল নাকি চীনের দুঃখ হোয়াংহো? ইউরোপের দানবী দানিয়ুব নাকি ভারতবর্ষের মাতা গঙ্গা? কিংবা ব্রাজিলের সিংহী আমাজনই হয়তোবা? এ প্রশ্নটির উত্তর সহজ নয়।
সমগ্র পৃথিবীর নানা পর্বত, হ্রদ, হিমবাহ থেকে শত শত নদনদী সৃষ্টি হয়ে সাগরে উপসাগরে মিশে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ❤ এদের মাঝে সেরার সেরাকে বাছা সত্যিই কষ্টকর।
যদি কেউ নদীর রাণী বাছাইয়ে সত্যি সত্যিই মাথা ঘামাতে চান, তবে নিশ্চয়ই প্রথমে তিনি তাকাবেন পৃথিবীর ঠিক ডানদিকে হিমালয়ের গায়ে গা ঘেঁষিয়ে থাকা চীনের দিকে।
তিব্বত নিঃস্বার্থ ভাবে চীনকে উপহার দিয়েছে দুইটি জীবনদায়িনী নদী। যার একটি হোয়াংহো, অপরটি ইয়াংসিকিয়াং।
হলদে নদী হোয়াংহো তার ঘোলা জল নিয়ে তিব্বত থেকে সৃষ্ট হয়ে ছুটে গেছে পীত সাগরের দিকে। দৈর্ঘ্য তার সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের বেশি নয়। কিন্তু তার কীর্তির কথা লেখা আছে অন্যভাবে।” চীনের দুঃখ সে।”
প্রাচীনকালে দুপার ছাপিয়ে মহাপ্লাবন ঘটিয়ে একের পর এক গ্রাম শহর ভাসিয়ে নিয়ে যেত হোয়াংহো। যেমন পলিমাটি দিয়ে দুপারে উর্বর শস্য ফলাতো, তেমনি সময়মত প্রবল রাগে সব ভেঙেচুরে কেড়েও নিত৷ সেই থেকে চীনের চোখের জল হয়ে আছে এই হোয়াংহো।
ইয়াং সিকিয়াং এতটা অভদ্র নয় অবশ্য। চীনের প্রাচীন কিন ডাইনাস্টির জন্ম হয়েছিলো এই ইয়াং এর পারেই। হোয়াংহোর মতই তিব্বতে জন্ম তার। অতঃপর পূর্ব চীনকে দুভাগ করে পূর্ব চীন সাগরে পতিত হয়েছে এই ছয়হাজার তিনশো কিমির নদী।
এশিয়ায় সবচে দীর্ঘ নদ এই ইয়াং সিকিয়াং।
তবে ইনফ্লুয়েন্সের দিক থেকে হয়ত সে পিছিয়ে যাবে।
পূণ্যভূমি ভারতবর্ষে নদনদীর অভাব নেই।
সনাতন ধর্মানুসারে
পবিত্র সপ্তনদী গঙ্গা যমুনা সিন্ধু সরস্বতী নর্মদা গোদাবরী কাবেরীর পাশাপাশি মানস সরোবরের সন্তান ব্রহ্মপুত্র কিংবা মায়ানমারের প্রাণ ইরাবতী অথবা বাংলাদেশের প্রলয়ঙ্করী মেঘনা – সকলেই স্ব স্ব মর্যাদায় আসীন। ❤
তবে এদের মাঝে দৈর্ঘ্যে হয়তো এগিয়ে থাকবে সিন্ধুই। প্রাচীন ইন্দাস সভ্যতার জন্ম দেয়া এই নদের নামেই আজকের ভারত ইন্ডিয়া। সমগ্র পাকিস্তানকে দুখন্ড করে তিব্বত হয়ে আরব সাগরে পতিত হয়েছে এই পবিত্র নদ। আজকের পাকিস্তানের সমগ্র অর্থনীতি, সমগ্র কৃষি সিন্ধু ভিত্তিক।
সিন্ধু নেই তো পাকিস্তান নেই।
এত এত নদীর মাঝে অবশ্য ইউরোপের দানবী দানিয়ুবকে বাদ দেবার জো নেই।জার্মানি অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি রোমানিয়াসহ মোট দশটি দেশে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে আছে এই দানিয়ুব।
ইউরোপের রাণী ভলগা হলেও দানিয়ুবের মত গুরুত্ব তার ভাগ্যে জোটেনি বলাই বাহুল্য। এর কারণও আছে।
মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের প্রায় দেশের বাণিজ্যই দানিয়ুব ভিত্তিক। দানিয়ুব ছাড়া দেশগুলো অচল। বিশেষ করে যাদের কোনো সমুদ্র সংযোগ নেই। তাই দানিয়ুব আন্তর্জাতিক নদী। “ইউরোপের প্রাণদাত্রী।”
তবে দৈর্ঘ্যে দানিয়ুব নিতান্তই ছোট বলা যায়। সেক্ষেত্রে হয়তো রাজার মুকুট মাথায় পড়বে আফ্রিকার সম্পত্তি নীল নদ।
নীল নদ:
কত স্মৃতি কত ইতিহাস কত সভ্যতা কত যুদ্ধ বিগ্রহ শান্তি সমৃদ্ধি সংস্কৃতির ধারক বাহক এই নদ। তানজানিয়া থেকে মিশর পর্যন্ত মোট এগারটি দেশকে অমৃত ধারায় ধন্য করেছে নীল।
এই নীলনদের তীরেই গড়ে উঠেছিলো বিখ্যাত মিশরীয় সভ্যতা। পিরামিড স্ফিংক্স আমেনহোটেপ তুতেনখামেন ক্লিওপেট্রা সব যেন এখানেই।
নীলের শাখা দুটি। ভিক্টোরিয়া হ্রদ থেকে সৃষ্ট হোয়াইট নীল আর জানা হ্রদ থেকে উৎপন্ন ব্লু নীল এসে মিলিত হয়েছে সুদানের রাজধানী খার্তুমে।
তারপর প্রবল বেগে ছুটে গেছে ভূমধ্যসাগরের দিকে।
প্রায় ছয় হাজার সাতশো কিলোমিটারের নীল বিশ্বের দীর্ঘতম নদ। যদি দৈর্ঘ্যকে আপনি রাজত্ব ধরেন, তবে সেই রাজত্বের রাজা নীলই। একমেবাদ্বিতীয়ম। ❤
কিন্তু এই জায়গায় ছোট্ট একটা কনফিউশন তৈরী করে দিতে পারে মিসৌরি মিসিসিপি।
না, এটি সিঙ্গেল কোনো নদীর নাম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি ও মিসিসিপি দুটি নদী এসে মিলেছে সেন্ট লুইসে। এমনই তাদের মিলন, আপাতদৃষ্টিতে যেন মনে হবে দুজনে একটিই নদী। বা একে অপরের শাখানদী।
একাকী হিসেবে প্রত্যেকেই নীলের কাছে হারবে। কিন্তু সম্মিলিত দৈর্ঘ্যে কিংবা শাখানদীসহ মিসৌরি মিসিসিপি বিশ্বের দীর্ঘতম নদী। প্রায় আট হাজার কিলোমিটারের এই যৌথনদীর পতনস্থল মেক্সিকো উপসাগর।
অবশ্য কেউ কেউ এটাকে চিটিং ই ভাববেন। নীলনদের সাথে অন্যায় করার ইচ্ছা আমারও নেই অবশ্য।
এতক্ষণে সকলে হয়ত বুঝে গেছেন, সত্যিকারের নদীর রাণী হয়তো নেই। এতটাই মধুরভাবে বিতর্কিত এই টপিকটা যে, যতই আলোচনা করবেন তত প্রতিযোগী বাড়বে।
তবে দৈর্ঘ্যে সবসময় নদীর মূল গৌরব ফুটে উঠেনা। ফুটে উঠে তার বিপুলতায়, বিশালতায়, আকার আয়তনে, জলস্রোতের গর্জনে।
এই গৌরবের সন্ধান পেতে হলে আপনাকে একটু কাছে আসতে হবে। কাছে বলতে বিষুবরেখার কাছে।
দক্ষিণ আমেরিকার মোট সাতটি দেশের বিপুল ভূমিকে জলস্রোতে পূর্ণ করে আমাজন মহাবনের অলিগলি প্লাবিত করে প্রবল গর্জনে আটলান্টিকের বুকে ঝাপিয়ে পড়া এই মহানদীর নাম আমাজন। 🔥
আমাজন এতই প্রকান্ড, এতই বিকটাকার যে, তার উপনদীর সংখ্যাই বিশের কাছাকাছি। আর আমাজনে পতিত নদীর সংখ্যা এগারোশোর বেশি। হ্যাঁ! এগারোশো!
আমাজন ও তার শাখানদীগুলোর বেসিন মানে জল দ্বারা পূর্ণ এলাকার পরিমাণ সত্তর লক্ষ বর্গ কিলেমিটার প্রায়। মানে পুরোপুরি পঞ্চাশটা বাংলাদেশের সমান। ভাবুন কি বিশালাকার এই আমাজন।
বিশ্বের দীঘতম আন্দিজ পর্বতমালা থেকে প্রতি সেকেন্ডে বেয়াল্লিশ লক্ষ ঘনফুট জল আটলান্টিকে নিয়ে ফেলছে সে।
একটু অন্যভাবে বললে যার পরিমাণ সেকেন্ডে এগারো কোটি লিটার। এই বিপুলতা মাথা ঘুরিয়ে দেয়।
নীলের কাছে দৈর্ঘ্যে হেরে দ্বিতীয় হলেও তাই বিশালতায় অর্থাৎ পানি প্রবাহের দিক থেকে আমাজন বিশ্বের সকল নদীর রাণী। ❤
পঞ্চাশটা বাংলাদেশকে যে জল দিয়ে ডুবাতে পারে, তার সাথে হেলাফেলা নয়!
লিখাঃ শত্রুঘ্ন অর্পিত