পরিবেশ উপদেষ্টার সেন্টমার্টিনের কোরাল নিয়ে একটা বক্তব্য শুনলাম। একজন পরিবেশ এক্টিভিস্টের বক্তব্য হিসাবে দেখলে ঠিকই আছে। তাহলে সমস্যা কোথায়?
সমস্যা সায়েন্স কমিউনিকেশনে। আমাদের দেশে যারা সায়েন্টিফিক গবেষণা করে তাদের পাবলিক কমিউনিকেশন দূর্বল। তাদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজন উচ্চমানের জার্নালে প্রকাশ করলেও, বেশির ভাগ মধ্য ও নিম্নমানের জার্নালে যা প্রকাশ করে সেটাও সাধারণের বোধগম্য ভাষায় সাধারণের কাছে পৌছাতে পারে না।
তাই যারা পরিবশ এক্টিভিজম করে তাদের তথ্য ও জ্ঞানের উৎস পত্রিকা। আর পত্রিকার সাংবাদিক সহজ ভাষায় সংবাদ লিখতে ও চটকদার শিরোনাম দিতে গিয়ে ( অনেকক্ষেত্রে সায়েন্টিফিক অজ্ঞতার কারণে) সায়েন্স কম্প্রোমাইজ হয়ে যায়। এরপর যা থাকে সেটা হয় পরিবেশ রোমান্টিসিজম নয়তো ফিয়ার মংগারিং। পরিবেশ এক্টিভিস্টরা তাই এই স্পেক্ট্রামেই অপারেট করে। ফিয়ার মংগারিং টাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের মত অধিক জনসং্খ্যা ও সুশাসনের অভাব-ভিত্তিক দেশে পরিবেশ এক্টিভিজমের মুল ফাউন্ডেশন হয়ে দাড়িয়েছে।
এই জায়গায় সায়েন্টিফিক এবং একাডেমিক কমিউনিটির সাথে এক্টিভিস্ট কমিউনিটির একটা ইগো যুদ্ধ ও আছে। একাডেমিক কমিউনিটি মনে করে এক্টিভিস্টরা সায়েন্সের কি বুঝে? আর এক্টিভিস্টরা মনে করে একাডেমিক কমিউনিটি যেসব রিসার্চ করে এইগুলোর মান যেমন ভালো না, তেমন সাধারণ মানুষের কাছে আপিল নাই। এই ডিসকানেক্ট হয়ে উঠেছে আমাদের পরিবেশ চর্চার মুল প্রাকটিস।
এইক্ষেত্রে পত্রিকার ও একটা ভুমিকা আছে।।এক্টিভিস্টদের যেহেতু পাবলিক ডিলিং বেশি, তাই তাদেরকেই পরিবেশবিদ হিসাবে মানুষের সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমাদের দেশে তাই পরিবেশ চ্যাম্পিয়ান বলতে যাদের দেখি ও বুঝি তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সায়েন্টিফিক ব্যাকগ্রাউন্ডের না। এছাড়া সর্বক্ষন আলোচনায় থাকতে তারাও রাজনীতিবিদদের মত ফিয়ার মংগারিং করতে থাকে। চটকদার কথাবার্তা বলে।
যেহেতু তাদের সায়েন্টিফিক ট্রেনিং দূর্বল কিংবা থাকে না- তাই তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবেশকে দুই একটা BUzz ওয়ার্ডে সরলীকরণ করে ফেলে। এক অর্থে এটা তাদের পাবলিক কমিউনিকেশনে সুবিধা হয়।।মানুষ সহজে কানেক্ট হয়।, আরেক অর্থে এটা সত্যিকারের পরিবেশ চর্চা হয় না।
এর ফলে গত ত্রিশ বছরে আমাদের দেশে নানা ক্ষেত্রে স্পেশালাইজড পরিবেশ এক্টিভিজম গ্রুপ গড়ে উঠলেও ( নদী, খাদ্য, গাছ, বন, শব্দ দূষণ, প্লাস্টিক দুষণ, পানি, বন্যপ্রানী রক্ষা, বায়ুমান, আবর্জনা) সত্যিকারের পরিবেশ উন্নয়ন হয়েছে কিনা সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
আর সায়েন্টিফিক কমিউনিটি তাদের জ্ঞান ও গবেষণা সহজ ভাষায় সাধারণের কাছে তুলে ধরতে পারছে না। এই গ্যাপটাই ফিল আপ করছে এমন সব এক্টিভিস্ট যাদের সায়েন্টিফিক আন্ডারস্টান্ডিং থেকেও এই এক্টিভিজম হয়ে উঠে রুটি রুজির প্রশ্ন।।তাই এই ফিল্ডে টিকে থাকার জন্য তাকে সব সময় চটকদার আলোচনায় থাকতে হয়।
ডেভিড এটেনবরা, রিচার্ড ডকিন্স কিংবা নিল ডিগ্রেস টাইসনের মত সায়েন্টিফিক কমিউনিকেটর আমাদের দেশে নাই।।যারা একই সাথে সায়েন্টিস্ট ও এক্টিভিস্ট। তারা সায়েন্সটা জানে এবং সাধারণ মানুষের সাথে কিভাবে তাদের বোধগম্য ভাষায় এনগেজ হবে সেই টেকনিকটাও জানে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে পত্রিকা, ম্যাগাজিনে যেমন তাদের বিচরণ,তেমনি সায়েন্টিফিক জার্নালেও তাদের বিচরণ। তাই তাদের আন্ডারস্টান্ডিং টা যেমন সলিড, তেমনি ডেসিমিনেশন টাও কারেক্ট সায়েন্স।
এখন দেখবেন জার্নালগুলো অথরের কাছে গ্রাফিকাল এবস্টার্ক্ট চায়।।ফেসবুকে, টুইটার ( বর্তমান এক্স) এ তারা এইগুলো ডেসিমিনেট করে। নানা সায়েন্স ম্যাগাজিন বের হচ্ছে সেখানে সায়েন্টিস্টরা লিখে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা গ্রুপ সায়েন্স কমিউনিকেশন করছে। কিন্ত আমাদের দেশে সায়েন্স ও এক্টিভিজমের মধ্যে ডিসকানেক্ট এখনো আশংকাজনক পর্যায়েই আছে।।
আমাদের শিক্ষিত সমাজ ও পরিবেশ এক্সপার্ট বলতে পরিবেশ এক্টিভিস্টকেই বুঝে। যাদের পড়ালেখা ট্রেনিং থেকে শুরু করে কার্য্যক্রম কোনটাই হয়তো পরিবেশ সংরক্ষন রিলেটেড না।।বরং ফিয়ার -মংগারিং বিজনেস তার এক্টিভিজমের ও এই ফিল্ডে টিকে থাকার একমাত্র টেকনিক।
বাস্তব জীবনে তার চাল চলন হয়তো পরিবেশ বিধ্বংসী। এসি রুমের সেমিনার, এক মিটিং থেকে বের হয়ে দামী পাজেরোতে আরেক মিটিং এ যাচ্ছে। দামী হোটেলে সেমিনার করে বেড়াচ্ছে জেলেদের নিয়ে আর জেলেরা না খেয়ে ধুকে ধুকে মরতেছে। এই হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। পরিবেশ এক্টিভিজমের এই বিজনেস মডেল আমাদের দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়।
মাননীয় উপদেষ্টার কথায় ফিরে আসি। উনি কি কোরাল নিয়ে ভুল বলেছেন? যেকোন সায়েন্টিস্ট শুনলে প্রথমেই টাস্কি খাবে। কোরাল ক্ষয় হয়ে সেন্টমার্টিন ডুবে যাবে এই তথ্য কি আসলেই সঠিক? উনি যেভাবে বলেছেন সেটা কোরাল বায়োলজিস্ট শুনলে হাসবে। আবার জলবায়ু বিজ্ঞানী শুনলেও হাসবে।।অন্তত ক্লিপটা শুনলে হাসবে। কিন্ত একজন এক্টিভিস্ট হিসাবে উনি কি ভুল বলেছেন? আমি মনে করি উনি ভুল বলেননি।
কারণ এক্টিভিস্টদের কাজ যেখানে সচেতনতা তৈরি করা এবং তাদের টার্গেট অডিয়েন্স সাধারণ মানুষ যাদের সায়েন্টিফিক নলেজ নাও থাকতে পারে– তাই তাদের সাথে কমিউনিকেট করতে হলে সহজ ও তাদের বোধগম্য ভাষায় করতে হয়। আগেই বলেছি আমাদের এক্টিভিস্টরা ফিয়ার মংগারিং স্টাইলটা বেছে নেয়।।
কারণ এটা ইজি রাউট আর আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য মানুষ ফিয়ার মংগারিং স্টাইলে অভ্যস্ত।।মানুষের সেন্স অব ইনসিকিউরিটি ও ইন্সটিংটিভ ফিয়ার হচ্ছে তাকে সচেতন করার সহজ ও কমদামী টেকনিক। সেইভাবে দেখলে উপদেষ্টা তার এক্টিভিজম মোডে ভুল বলেননি কিংবা উনার উদ্দেশ্যে ও সমস্যাজনক নয়।
কিন্ত এখানে সায়েন্স কম্প্রোমাইজ হয়ে গেছে। একজন পরিবেশ এক্টিভিস্ট রিজওয়ানা ও একজন উপদেষ্টা রিজওয়ানার অডিয়েন্স সে এখন এক না- সমস্যা সেখানে দেখা দিছে।
উপদেষ্টা রিজওয়ানার অডিয়েন্স বিজ্ঞানী, পলিসিমেকার, আন্তর্জাতিক কমিউনিটি, সাধারণ মানুষ সবাই।।তাই এই পদে থেকে কথা বলতে হলে তাকে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। পলিটিকালি, সায়েন্টিফিকালি, পলিসিগতভাবে যথাসম্ভব কারেক্ট হতে হয়। যেহেতু একজন সাধারণ মানুষ থেকে একজন মন্ত্রী কিংবা উপদেষ্টার এক্সেস টু ক্লাসিফায়েড ইনফরমেশন বেশি থাকে, তার এডভাইজারি প্যানেল থাকে, তাই সঠিক তথ্য দেয়া তার পক্ষে অন্যদের থেকে সহজ এবং উচিতও।
কোরাল ক্ষয় হয় ওশান এসিডিফিকেশনের কারণে।। কারণ ওশান এডিফিকেশন হলে সাগরের কার্বন ডাই অক্সাইড এবসর্বশন বেড়ে যাওয়া। এতে সাগরে কার্বনিক এসিড বেশি তৈরি হতে পারে যেটা সাগরে কার্বনেট আয়ন এভেলএবেলিটি কমিয়ে দেয় ও পিএইচ র মাত্রা ও কমিয়ে দেয়।
এতে কোরাল রা তাদের আউটার শেল যেটা ক্যালসিয়াম কার্বনেট দিয়ে তৈরি সেটা ঠিকমত তৈরি করতে পারে না। তাদের কোরাল রীফের স্ট্রাকচার দূর্বল হয়। অর্থাৎ গ্রীনহাউজ গ্যাস নি:সরণ বেড়ে গেলে ওশান এসিডিফিকেশনের সম্ভাবনা বেড়ে যায় ও কোরাল স্ট্রাকচার দূর্বল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
কিন্ত উপদেষ্টা এই সায়েন্সকে সাধারণের ভাষায় ও ফিয়ার মংগারিং স্টাইলে বলতে গিয়ে যেভাবে বললেন সেন্টমার্টিনের সব কোরাল ২০৪৫ এর মধ্যে ক্ষয়ে যাবে এতে সেন্ট মার্টিন ডুবে যাবে কিংবা বিলিন হয়ে যাবে – এতে সায়েন্স কম্প্রোমাইজ হয়ে গেছে। একই সাথে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে– উপদেষ্টা এই তথ্য কই পেলেন?
সেন্ট মার্টিন নিয়ে এমন কোন রিসার্চ হলে সেটার রেফারেন্স কি? বংগোপসাগরে ওশান এসিডিফিকেশনের মাত্রা কি রকম? এটা কি ডেড কোরাল স্ট্রাকচারেও ক্ষতি করে কিনা? এখানে সি লেভেল রাইস এর ভুমিকা কতটুকু? একজন সায়েন্টিস্টের কাছে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ছাড়া উপদেষ্টার কথাটা হঠাত শুনলেও হাস্যকর মনে হতে পারে।
আমার কাছে উনার বক্তব্য শুনে মনে হলো– বাংলাদেশ স্টান্ডার্ডে এবং এই দেশের মানুষের তথ্য রিসিভ করার যে স্টাইল ( ফিয়ার মংগারিং ছাড়া সে গুরুত্ব দিতে চায় না) তাতে একজন এক্টিভিস্ট হিসাবে উপদেষ্টার বক্তব্য ঠিকই আছে।।কিন্ত উনাকে এক্টিভিস্ট হিসাবে না দেখে যদি একজন সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে দেখি- তখন এই ধরনের গ্রস কথা প্রবলেমেটিক৷ সমস্যা এখানে রিজওয়ানা হাসান না,সমস্যা আমাদের দেশের সায়েন্স কমিউনিকেশন ও এনভায়রনমেন্টাল এক্টিভিজমের পলিটিকাল কালচার।
– বাতেন মোহাম্মদ