ভূমিকম্পের দেশ জাপানের তিন ভাগের দুই ভাগই অজস্র পাহাড়, বনভূমি, ছোটবড় নদীঝরনায় পূর্ণ। মাত্র এক ভাগে জনবসতি ও কৃষির আবাদ। চারপাশে সাগরঘেরা এদেশের মানুষ তাই ভূমিকম্পকে বেশ ভয় করে। একেকবার মাটি কেঁপে ওঠে আর তাদের যেটুকু আবাস তার অনেকটুকুই চুরমার হয়ে যায়। তারোপর সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা প্রবল প্রতাপশালী সুনামি তো আছেই। মোটকথা জাপান যেন বসেই আছে একটা হট ফ্রাইপ্যানের ওপর। 🔥
তাই জাপানিরা ভয় করে চলে প্রকৃতিকে। করে শ্রদ্ধাও। তাদের সংস্কৃতি জুড়েও রয়েছে প্রকৃতির বন্দনা। প্রতিটি গভীর অরণ্য, প্রতিটি সুুউচ্চ পাহাড়ের জন্য আছেন আলাদা আলাদা দেবতা। প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট করতে নিত্য পূজিত হন তাঁরা। জাপানি সমাজের এরূপ বিশ্বাসের খুব সুন্দর একটা উদাহরণ হলো তাদের জাতীয় পাখি।
সবুজ ফিজেন্ট, নাম শুনলেও অনেকে চিনবেননা, অনেকটা মুরগী কিছুটা ময়ুর চেহারার পাখি, মুখখানা মুরগীর, শরীরটা ময়ুরের আর লেজটা হাড়িচাচার। পৃথিবীতে যত জাতের ফিজেন্ট আছে, তার মাঝে সবুজ জাতটা কেবল পাওয়া যায় জাপানে। অনেকটা আমাদের বোস্তামী কচ্ছপের মতন, এন্ডেমিক। জাপানের বিস্তৃত অরণ্য সহ মফস্বল বা গ্রাম এলাকাতেও ঘুরে ঘুরে থাকে ওরা, খুঁটে খাবার খায়, লোকের সঙ্গ নেয়।
তো জাপানে এমন বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে এই সবুজ ফিজেন্ট ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারে। ভবিষ্যৎ বিপদ নাকি সবার আগেই টের পায় ওরা এবং চেঁচাতে শুরু করে যা দেখে জাপানি গ্রামবাসীরা আগাম প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হয়। মোটকথা একপ্রকার ভবিষ্যেতদ্রষ্টা এরা। 💚
এরকম বিহেভিয়ার আদৌ প্রমাণিত কিনা জানা নেই। কিন্তু যুগ যুগ থেকেই এরূপ সবুজ ফিজেন্ট বন্দনা চলে আসছে জাপান জুড়ে। ভূমিকম্পের দেশ জাপানে তাই সবুজ ফিজেন্ট কে দেয়া হয়েছে জাতীয় পাখির মর্যাদা।
জাপানের পাশেই কোরিয়া উপদ্বীপ কিন্তু এক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম। দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় পাখি বরং ম্যাগপাই। বাংলায় বলা চলে বড় দোয়েল।
অর্থাৎ আমাদের দোয়েল (ম্যাগপাই রবিন) এর মতই, কিন্তু সাইজে যথেষ্ট বড়, প্রায় কাকের সমান।
জাতেও কাকেরই আত্নীয় এরা। তবে সাদা কালো রং দেখে যে কেউ দোয়েলের বড়ভাই বলে ভুল করবেন।
কোরিয়াতে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে শিশুদের জন্য, যদি তোমার দাঁত পড়ে যায়, তবে সেই দাঁত জানালায় রেখে ম্যাগপাইয়ের জন্য একটা গান গাইবে, তখন ম্যাগপাই তোমাকে নতুন দাঁত উপহার দিয়ে যাবে। ❤
অনেকটা ছেলেভুলানো গল্পের মত হলেও এ থেকে বুঝা যায় কোরিয়ান দের চোখে ম্যাগপাই সৌভাগ্যের প্রতীক। সমগ্র কোরিয়া জুড়ে জাতীয় পরিচয়ের সাথে মিশে আছে এই সাদাকালো পাখি। তাদের বিশ্বাস এ পাখি সুখবর বয়ে আনে, নিয়ে আসে প্রাচুর্য ও উন্নতি। তাই যথোপযুক্ত সম্মানও দেয় তারা এই পাখিটিকে।
জাতীয় পাখি রূপে।
জাপানি ও কোরিয়ানদের সংস্কৃতিতে যেমন প্রকৃতি, ফরাসীদের সংস্কৃতিতে তেমনি যুদ্ধ ও ধর্ম।
কেল্টিক জাতিদের প্রতিষ্ঠিত রাজ্য গল ই আজকের ফ্রান্স। আর তার লোকদের বলা হত গলস।
যখনই প্রতিপক্ষের সাথে গলস ওরফে ফরাসীদের যুদ্ধ হতো, বিরোধীপক্ষ ঠাট্টা তামাশা করতো এই নাম নিয়ে। কারণ ল্যাটিনে Gauls (গল দেশের লোক) আর Gallus ( মোরগ) প্রায় সমোচ্চারিত শব্দ! সুতরাং তখনকার ফরাসীদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিকনেম হয়ে গিয়েছিলো মোরগ! 🐔
ফরাসীরা কিন্তু এই পরিচয় খুশিমনেই মেনে নিয়েছিলো।
অতঃপর খ্রিস্টান ধর্ম ফ্রান্সে আসার পর মোরগ আরও জনপ্রিয়তা পায় কারণ সেইন্ট পিটার ও যীশু খ্রিস্টকে নিয়ে খ্রিস্টান ইতিহাসের এক কাহিনীতে এই মোরগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
কথিত আছে যীশুকে গ্রেপ্তার করার পর সেন্ট পিটার আকষ্মিকভাবে যীশুর পরিচয় ভুলে গিয়েছিলেন। পরপর তিনবার অস্বীকার করার পর এক মোরগ ডেকে উঠে এবং পিটার তার স্মৃতি ফিরে পান। এই ঘটনা প্রচলিত ‘Repentance of Peter’ নামে।
সে থেকে ফ্রান্সে মোরগকে শুভ ও ন্যায়বুদ্ধির উদয়কারী হিসাবে দেখা হয়। তাছাড়া সকালে সূর্যোদয়ে মোরগের ডেকে ওঠাকে ফরাসীরা দেখে রাতের অন্ধকার শেষে সূর্যের পুনরাগমন হিসেবে, যা তাদের যীশুর মৃত্যুর পর আবার সূর্যের মত পুনরুজ্জীবিত হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ফ্রান্স তাই তাদের জাতীয় পাখির মর্যাদা দিয়েছে মোরগকে।
এভাবেই জাতীয় পাখির বিষয়টি যুক্ত হয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে।
দুর্বার জার্মানদের সোনালী ঈগল থেকে বৈচিত্র্যময় ভারতের রাজসিক ময়ুর, কিংবা বাংলার অতি আপন ছোট্ট দোয়েল থেকে ইতালীয়দের বহুবছরের প্রতিবেশী চড়ুইপাখি – সব ক্ষেত্রেই জাতীয় পাখি বহন করে চলেছে একটি দেশের ধর্ম – সংস্কৃতি, জাতিগত বৈশিষ্ট্যের নিদর্শন।
বোরিং ‘জাতীয় পাখি’ নামক টপিকের পিছনে থাকা এত এত বৈচিত্র্যময় ইতিহাস তাই মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। ❤
লিখাঃশত্রুঘ্ন অর্পিত