মাতৃভাষা বাংলায় আবহাওয়া বিজ্ঞান চর্চা: পর্ব ৭ (মেডেন-জুলিয়ান স্পন্দন বা সংক্ষেপে এমজেও চক্র এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের সক্রিয় দশা ও নিষ্ক্রিয় দশা ব্যাখ্যা )
আপনাদের অনেকের মনে আছে হয়ত আমার “মাতৃভাষা বাংলায় আবহাওয়া বিজ্ঞান চর্চা: পর্ব ৭” এ বাংলাদেশের বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের সক্রিয় দশা ও নিষ্ক্রিয় দশা ব্যাখ্যা করেছি। মেডেন-জুলিয়ান স্পন্দন বা সংক্ষেপে এমজেও চক্র এর মাধ্যমে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের সক্রিয় দশা ও নিষ্ক্রিয় দশা ব্যাখ্যা করা যায়। ঐ পর্বটি আজ আবারও দিলাম যাতে করে আপনারা বুঝতে পারেন গত ২ সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত কম বৃষ্টিপাত হচ্ছে কেন কিংবা কোন কোন বিভাগে বৃষ্টি হয়নাই বললেই চলে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় গত ৩ দিন ধরে যে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে তা প্রতিদিন একটু-একটু করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে। আগামী ১/২ দিনের মধ্যে রংপুর, রজাশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে বৃষ্টিপাত শুরু হবে।
বাংলাদেশে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বেশ কিছুদিন দেশব্যাপী নিয়মিত বৃষ্টির পরে এক থেকে তিন সপ্তাহ প্রায় বৃষ্টিহীন থাকে। এ অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির চক্রটা আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেন এমজেও নামে একপ্রকার আবহাওয়া চক্রের মাধ্যমে (MJO is an eastward moving disturbance of clouds, rainfall, winds, and pressure that traverses the planet in the tropics and returns to its initial starting point in 30 to 60 days, on average.)। আবহাওয়া চক্রটি আবিষ্কার করেন রোনাল্ড মেডেন ও পাউল জুলিয়ান নামে দুজন বিজ্ঞানী, ১৯৭০ সালে। আবহাওয়া চক্রটি বিষুবীয় অঞ্চলের সমুদ্র ও তৎসংলগ্ন আকাশের মধ্যে একটি মিথস্ক্রিয়া।
এমজেও আবহাওয়া চক্রটিকে প্রথমত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়: সক্রিয় বাষ্পীভবন দশা ও নিষ্ক্রিয় বাষ্পীভবন দশা। শীতকালে সকালবেলা পুকুরের পানির তাপমাত্রা পুকুরের পানির উপরের বাতাসের তাপমাত্রা থেকে বেশি থাকার কারণে পুকুরের পানি থেকে ধোঁয়া (বাষ্প) উঠতে দেখা যায়। ঠিক একই কারণে শীতকালে নিঃশ্বাস ছাড়লে মুখ থেকে বের হওয়া আর্দ্র গরম বাতাস ঠাণ্ডা বাতাসের সংস্পর্শে এলে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর রূপ নেয়।
এ ধোঁয়াকে আমরা মানুষ-সৃষ্ট মেঘও বলতে পারি। ঠিক একই প্রক্রিয়ার সমুদ্রপৃষ্ঠের গরম পানি বাষ্পায়িত হয়ে আকাশে উড়ে যায়। পদার্থবিজ্ঞান বা ভূগোল বিষয়ে পড়েছি, বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তরে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে উঠতে থাকলে বায়ুর চাপ কমতে থাকার কারণে বাতাসের তাপমাত্রাও কমতে থাকে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বাষ্পায়িত হয়ে আকাশে উড়ে যাওয়া জলীয়বাষ্পের তাপমাত্রাও কমতে থাকে এবং একসময় ওই জলীয়বাষ্পের কণাগুলো ঘনীভূত হয়ে মেঘের সৃষ্টি হয়।
এমজেও আবহাওয়া চক্রটির দশা দুটিকে যথাক্রমে অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি বলা হয়। কারণ সক্রিয় বাষ্পীভবন দশা যখন সমুদ্রের কোনও স্থানে অবস্থান করে তখন ওই স্থানের সমুদ্রের পানি বেশি পরিমাণে বাষ্পায়িত হতে থাকে। ফলে বেশি মেঘের সৃষ্টি হয় এবং বেশি বৃষ্টিপাত ঘটায়। নিষ্ক্রিয় বাষ্পীভবন দশায় বিপরীত ঘটনা ঘটে।
এমজেও আবহাওয়া চক্রটিকে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় বাষ্পীভবনের ওপর ভিত্তি করে আটটি দশায় ভাগ করা হয়। এমজেও যখন ২ ও ৩ নম্বর দশায় (ফেস) থাকে, তখন উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগরের পানিতে প্রচণ্ড সক্রিয় বাষ্পীভবন হয়ে থাকে। ফলে আকাশ ভর্তি থাকে মেঘে। গ্রীষ্মকালে এমজেওর অবস্থান কিছুটা উত্তর দিকে সরে যায়। ফলে এমজেও যখন ২ ও ৩ নম্বর দশায় (ফেস) থাকে, তখন বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারি বৃষ্টি হয়ে থাকে।
জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত এমজেও ২ নম্বর দশায় ছিল এবং ১০ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত ৩ নম্বর দশায় ছিলও যার কারণে জুলাই মাসের প্রথম ২ সপ্তাহ দেশব্যাপী নিয়মিত বৃষ্টিপাত হয়েছে। ১৪ তারিখ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত ৪ নম্বর দশায় ছিলও যে সময় থেকে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত কমা শুরু হয়েছে। এর পরে যখন এমজেও চক্রটি ১৭ তারিখ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত ৫ নম্বর ও ২১ তারিখের পর থেকে আজ ২৮ শে জুলাই পর্যন্ত ৬ নম্বর দশায় অবস্থান করছে।
আবহাওয়া পূর্বাভাষ মডেলগুলোর সর্বশেষ পূর্বাভাষ অনুসারে এমজেও চক্রটি আগস্ট মাসের ৩ তারিখের মধ্যে ৭ ও ৮ নম্বর দশা অতিক্রম করে আবারও ১ নম্বর দশায় প্রবেশ করবে। ১ নম্বর দশায় প্রবেশ করার পর থেকে আবারও দেশব্যাপী বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার সম্ভাবনার কথা নির্দেশ করতেছে। এই বৃষ্টিপাত প্রায় ১ সপ্তাহ ব্যাপী চলতে পারে। দেশব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাত অবস্থা বিরাজ করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত এমজেও আবহাওয়া চক্রটি আবারো ২ ও ৩ নম্বর দশায় ফিরে আসে।
প্রথম চিত্রে লাল লাইনটি নির্দেশ করতেছে আগামী ৭ দিন MJO কবে কোন দশায় অবস্হান করতে পারে। প্রথম চিত্রে লাল ও নীল লাইনটি কালো বৃত্তের পরিধির ভিতেরে অবস্থান করলে এমজেও আবহাওয়া চক্রটিকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলে গণ্য করা হয়। পক্ষান্তরে লাল ও নীল লাইনটি কালো বৃত্তের পরিধির বাহিরে যত দূরে অবস্থান করবে এমজেও আবহাওয়া চক্রটিকে তত শক্তিশালী বলে গণ্য করা হয়।
বর্ষা মৌসুমে লাল ও নীল লাইনটি যখন বৃত্তের পরিধির বাহিরে ১, ২, ৩, ও ৪ নম্বর দশায় (ফেজ) অবস্থান করে তখন বাংলাদেশ ও ভারতে ভারি বৃষ্টিপাত হয় ১ থেকে ২ সপ্তাহ ধরে। বিশেষ করে যখন ২ ও ৩ নম্বর দশায় অবস্থান করে সেই দিন গুলিতে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে।
দ্বিতীয় ছবিতে সবুজ লাইনটি নির্দেশ করতেছে MJO কোন ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ঘুরে এক দশা থেকে অন্য দশায় প্রবেশ করে।
বঙ্গোপসাগরে যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় তার সাথে এমজেও আবহাওয়া চক্রটির সাথে সম্পর্ক রয়েছে। এমজেও আবহাওয়া চক্রটি কোন দশায় অবস্থান করছে তার উপর নির্ভর করে ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের পূর্ব উপকূলে নাকি, বাংলাদেশের সুন্দরবন উপকূলে নাকি মায়ানমার উপকূলে আঘাত হানবে তা সম্বন্ধে পূর্বাভাষ জানা যায়।