বাংলাদেশে অনেক মানুষ, এমন কি লাইফ সায়েন্সে পিএইচডি করা মানুষও ভ্যাকসিনের ম্যানুফ্যাকচারিং ও রেগুলেশান বোঝেন না। না বোঝার কারণে তারা অবাস্তব আশাবাদে আক্রান্ত হন। বিষয়টা আজকে একটু বুঝিয়ে বলি।
ল্যাবে ভ্যাকসিন বানানো আর আপনার ফার্মেসীতে বিক্রয়যোগ্য ভ্যাকসিনের পার্থক্য হোলো শেখ হাসিনা ও জেসিন্ডা আর্ডারনের মতো। দুইজনই মেয়ে – দুইজনই প্রধানমন্ত্রী – কিন্তু এছাড়া দুজনের মাঝে আর কোনোই মিল নাই। এই পার্থক্যটা মাথায় রাখবেন।
মনে রাখবেন যে ল্যাবে এমন অনেক কিছু বানানো যায়, যেগুলো ফার্মা ইন্ডাস্ট্রী চোখ তুলেও দেখবে না। আমি নিজেই একটা ক্যান্সার ভ্যাকসিন বানিয়েছিলাম। হ্যা – ইঁদুরে এটা কাজ করে – পেপারও পাবলিশ করেছি – পিএইচডিও হয়েছে – সব ঠিকাছে।
কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে এই ভ্যাকসিন নিয়ে গেলে আমার চোখে চোখ না রেখেই তারা বলতো – যা ফোট শালা – আইছে কৈত্থেকে আবাল কোথাকার।
ল্যাবে আপনার কোনো ভুল হলে মরবে ইঁদুর – যার দাম ১০ ডলার। আপনার বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করা ভ্যাকসিনে একজন মানুষ মরলে কিংবা ভ্যাকসিনটা কাজ না করলে পরের দিন সেটা নিউজ হবে টোকিও থেকে টিম্বাকটু – সব জায়গায়। দেয়ার ইজ এ ডিফ্রেন্স – এন্ড এ বিগ ওয়ান।
আপনি যখন পেপার পাবলিশ করেন – সেটা মূলত একটা প্রশ্নের উত্তর দেয়। আপনি একটা এনিমাল মডেলে (ইঁদুরেই মূলত) শুধুমাত্র এইটা দেখালেই হবে যে নেগেটিভ কন্ট্রোলের তুলনায় আপনার ভ্যাকসিন কার্যকর।
আর আপনি in vitro টেস্টিং করে ব্যাখ্যা দিবেন যে আপনার ভ্যাকসিন কীভাবে কাজ করে। ব্যস – মোটামুটি এই হোলো আপনার রিসার্চ এবং মান অনুযায়ী পাবলিকেশানও হবে।
ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু এতো সরলরৈখিক ভাবে দেখে না। সে হাজারো দিক চিন্তা করে – লিট্রেলি হাজারো দিক। কীভাবে বানানো হবে, কোন দেশে বানানো হবে, ভ্যাকসিনের দাম কতো হবে, টক্সিসিটি কেমন, ইমিউন রেস্পন্স কতোটা স্থায়ী, প্রোডাক্টের স্ট্যাবিলিটি কেমন।
শুধু এই ডিসিশানের কনসিডারেশানের ওপরই অনায়াসে বই লেখা সম্ভব – আছেও।
আমি কোভিডের ভ্যাকসিন এপ্রোচ নিয়ে প্রায় তেমন কিছুই পড়ি নি। কিন্তু ২-৩ ঘন্টা পড়েই একটা টেন্টেটিভ এপ্রোচ বলতে পারবো – যেটা নিয়ে লেগে থাকলে পেপার পাবলিশ করা যাবে।
যেমন ধরুন moderna যে mRNA ১২৭৩ নিয়ে কাজ করছে এই mRNA বা কাছাকাছি কোনো mRNA কোনো একটা ভালো ন্যানোপার্টিকেলে ঢুকিয়ে আপনি যদি ইমিউন সেল টার্গেট করতে পারেন – কিছু না কিছু রেস্পন্স হওয়ারই কথা।
যেকোনো মলিকিউলার থেরাপিউটিক্সে কাজ করা মানুষ আপনাকে মোটামুটি একটা রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারবে। এর মধ্যে কোনো বাহাদুরি নাই।
ভাগ্য একটু সহায় হলে পেপার না পাবলিশ হওয়ার কথা না। কিন্তু সেই সাথে এটাও গ্যারান্টি দেয়া যায় যে সেই ভ্যাকসিন মার্কেটে আসবে না।
সমস্যা হোলো জার্নালিস্টরা যেহেতু এই কাজটার কমপ্লেক্সিটি বোঝে না, পরের দিন রিপোর্ট করে দেবে যে “ছোটোবেলায় টাকার অভাবে জাঙ্গিয়া কিনতে না পারা বিজ্ঞানীর ভ্যাকসিন আবিষ্কার”।
গ্লোব ফার্মার ভ্যাকসিনের কথাটা একবার চিন্তা করুন। আমি জানি যে আপনারা অনেকেই খুবই উত্তেজিত এই ভ্যাকসিন নিয়ে এবং অনেস্টলি, আপনাদের এই যে ইনোসেন্ট আশাবাদ – এটা ধ্বংস করতে আমার মোটেও ভালো লাগে না।
কিন্তু রিয়ালিটি হোলো – এখান থেকে কিছুই আসবে না। দশ বছর সময় দিলেও আসবে না।
কেন? মার্কেট রিয়ালিটির জন্য।
আপনারা জানেন যে বাংলাদেশের টিকিট চেকার ওষুধ প্রশাসন বিভাগের ক্লিনিক্যাল ডেটা বা কোয়ালিটি ডেটা এসেস করার কোনো মুরোদ নাই (আগেই ব্যাখ্যা করেছি)।
তারা বিদেশী রেগুলেটরদের দিকে তাকিয়ে থাকে (অবশ্য ভ্যাকসিনের নাম মজিব ভ্যাকসিন দিলে এবং যেহেতু আপনাদের ঔকাদ ল্যাবের ইঁদুরের চেয়ে নীচে – সেহেতু ওষুধ প্রশাসন ভ্যাকসিনের ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দিলেও দিতে পারে)।
স্বাভাবিকভাবে চললে গ্লোবের ভ্যাকসিনকে আগে FDA, TGA – এই ধরনের কোনো রেপুটেড রেগুলেটরকে ক্লিয়ার করতে হবে। সুতরাং তাদের দৃষ্টিকোণে দেখি।
আমি কোনো টেকনিক্যাল দিকে যাচ্ছি না। এক্কেবারে প্রাথমিক প্রশ্ন তুলছি – মানে য়ুনিভার্সিটির প্রোফেসর পদের চাকরির জন্য চেক করছি আপনি ক্লাস ওয়ান পাশ করেছিলেন কি না?
প্রশ্নটা হোলো আপনি যে প্ল্যান্টে ভ্যাকসিনটা বানাচ্ছেন সেটার GMP ক্লিয়ারেন্স আছে কি না। আমি প্রায় নিশ্চিত যে গ্লোবের সেটা নাই (কারণ তাদের কোনো প্রোডাক্ট বাজারে নাই)।
প্রথমবার GMP ক্লিয়ারেন্স নিতে হলে কোনো একটা রেগুলেটর ফিজিক্যালি বাংলাদেশে এসে আপনার প্ল্যান্ট পরিদর্শন করবে। বাংলাদেশের যেই কোভিডাবস্থা – আগামী দুই বছরেও আপনি ইন্সপেক্টর আন্তে পারবেন না।
আগেও এরকম হয়েছে। হোলি আর্টিজান ঘটনা ঘটার পর বাংলাদেশে কোনো GMP ইন্সপেক্টর আসতে চাচ্ছিলো না। বাংলাদেশের বড় একটা ফার্মা নিশ্চয়তা দিয়েছিলো বাংলদেশে তারা মিলিটারি আর্মার্ড ভেহিকলে ইন্সপেক্টরদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাবে।
সাত-আট মাস ধরে লেগে থাকার পরেও তারা বাংলাদেশে ইন্সপেক্টর আনতে পারে নাই।
বাংলাদেশে খুব বড় কয়েকটা ফার্মা ছাড়া কারোরই কোনো ড্রাগের রেগুলেটরী এপ্লিকেশন তৈরী করার সক্ষমতা নাই। এই কাজটা যে করে নাই তাকে বোঝানো সম্ভব না যে কতোটা ভয়াবহ কঠিন ও টেকনিকাল।
এখনো বাংলাদেশে বানানো কোনো বায়োলজিকাল ড্রাগ কোনো বিদেশী মার্কেটে ঢোকে নাই এবং বাংলাদেশে কোনো বায়োলজিকাল ড্রাগ সম্ভবত এখনো তৈরী হয় নি। রেগুলেটরী এপ্লিকেশন করার সক্ষমতাটা বাংলাদেশে যাদের আছে তারা প্রত্যেকেই কেমিক্যালি সিন্থেসাইজড স্মল মলিকিউল নিয়ে কাজ করেন।
কোভিডের ভ্যাকসিন, বায়োলজিকাল প্রোডাক্টই হওয়ার কথা (নিশ্চিত না – হওয়ার উপায় নাই)। বায়োলজিকাল মেডিসিনের এপ্লিকেশন, স্মল মলিকিউলের এপ্লিকেশান থেকে শতগুণ কঠিন।
আমি বাজি ধরে বলতে পারি স্কয়ার বলেন কিংবা বেক্সিমকো – যারা প্রচুর স্মল মিলিকিউলের জেনেরিক মেডিসিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠায় – তারাও এই কাজটা করতে পারবে না।
কেন?
বায়োলজিকাল প্রোডাক্ট বানাতে হলে আপনাকে ক্লিনিক্যাল স্টাডি করে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা দেখাতে হবে। বাংলাদেশের ফার্মা ইন্ডাস্ট্রি যেহেতু কোনো নতুন ড্রাগ বানায় না – অর্থাৎ শুধু জেনেরিক ড্রাগ বানায় তাদের কোনো ক্লিনিক্যাল স্টাডি করতে হয় না।
একটা নভেল ভ্যাকসিন বানালে – অর্থাৎ গ্লোব যা দাবী করছে – সেরকম কিছু বানালে আপনাকে সম্পূর্ণ ক্লিনিক্যাল স্টাডি করতে হবে (যেটা Moderna এখন করছে)।
বাস্তবতা হল:
- বাংলদেশে বায়োলজিকাল প্রোডাক্টের ক্লিনিক্যাল স্টাডি করার সক্ষমতা কারো নাই।
- এই কাজটা করতে বেয়ার মিনিমাম একশ মিলিয়ন ডলার লাগার কথা – ঊর্ধ্বে পাঁচশ মিলিয়ন ডলারও লেগেছে বলে শুনেছি। একশ মিলিয়ন ডলার গ্লোবের থাকলে আরো দুয়েকটা প্রোডাক্ট তাদের বাজারেই থাকতো। আমার ধারণা গ্লোব বায়োটেকের নিজের দাম দশ মিলিয়ন ডলারও হবে না। তো ক্লিনিকাল স্টাডির টাকাটা কি হাওয়া থেকে আসবে?
একটা রেগুলেটরী এপ্লিকেশানের কোয়ালিটি সাইড হোলো মাত্র একটা দিক অর্থাৎ ম্যানুফ্যাকচারিং কীভাবে করেছেন?
বায়োলজিকাল প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে অনায়াসে এই দিকটা ২ হাজার পৃষ্ঠা অতিক্রম করে। স্মল মলিকিউলের ক্ষেত্রে হয়তো কয়েকটা ফার্মার এই সক্ষমতা আছে কিন্তু বায়োলজিকাল প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোনো কম্পানির এই ডকুমেন্ট তৈরী করার সক্ষমতাটাই নাই।
আমার কথা আপনার বিশ্বাস করার দরকার নাই (আমি বাংলাদেশে কোনো কাজ করি নি)। যারা বাংলাদেশে একচুয়ালি এই ধরনের কাজ করেছে – তাদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আসিফ নামের গ্লোবের এই ছেলেটা – ল্যাবওয়ার্ক হয়তো জানে, দেশপ্রেমেও হয়তো টইটম্বুর – কিন্তু ড্রাগ ডেভেলাপমেন্ট কী জানে না, সার্টেনলি ড্রাগ রেগুলেশান কী মোটেও বোঝে না। সেজন্যেই সে দেশপ্রেমে হাই হয়ে গিয়েছিলো। মায়া লাগে – হাসিও লাগে।
তাহলে কি বাংলাদেশের উচিত হবে না ভ্যাকসিন ডেভেলাপ করা?
না, উচিত হবে না। এইসব ছাগলামি বন্ধ করেন। বাংলাদেশের উচিত কোভিড পেশেন্টদের স্বাভাবিক চিকিৎসা পৌঁছে দেয়া।
ভ্যাকসিন তৈরীর পরিকল্পনা থাকলে আগে অন্য বায়োলজিকাল জেনেরিক ড্রাগ – মানে বায়োসিমিলার ডেভেলাপ করেন।
ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার চিন্তা বাদ দেন। আপনার ক্যাপাসিটি বাড়ান – স্টেপ বাই স্টেপ। দশটা বায়োসিমিলার বানিয়ে তারপর নভেল ড্রাগ বানিয়েন।
Moderna যে ক্লিনিক্যাল স্টাডি করছে সেখানে ফেজ ওয়ানে ২৫ ও ১০০ মাইক্রোগ্রাম ডোজের mRNA ইনজেক্ট করেছে।
এই মাইক্রোগ্রাম লেভেলে mRNA যদি আপনি অর্ডার দিয়ে সিন্থেসাইজ করেন – সেটার দাম এই মুহূর্তে মিনিমাম ২-৩ হাজার ডলার হবে।
এর উপর আছে ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেম (মানে ন্যানো-পার্টিকেল)। যেভাবেই যেদিক দিয়েই বানান – এই ভ্যাকসিন শস্তা হবে না।
আপনার কি ধারণা একটা বাংলাদেশী, বাংলাদেশে তৈরী নভেল ভ্যাকসিন পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে কিনবে? আপনাকে কি কিছু কামরায় – ভাই?
আমার অমূল্য একটা উপদেশ প্লিজ মাথায় রাখবেন:
কোভিডের টিকা হবে শেষমেশ কিন্তু বলদামির কোনো টিকা কোনোদিনও বাজারে আসবে না।
এইসব ভ্যাকসিন বানানোর পিসিং কন্টেস্ট বাদ দেন। যেগুলো করা যাবে যেমন অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানো, হাসপাতাল তৈরী, আমেরিকার অভিজ্ঞতার আলোকে দ্রুত ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস এলাইন করা – এসব করেন।
লেখক: ফাহাম আব্দুস সালাম
স্টেম সেল গবেষক