হারিয়ে যাওয়া আমাদের জ্ঞাতিভাই হোমিনিনদের জেনেটিক্স নিয়ে গবেষণা করে এ বছর নোবেল পেয়েছেন সুভান্তে প্যাবো।
দু পায়ে দাঁড়াতে পারে টিকে থাকা একমাত্র হোমিনিন আমরা। আমাদের কাছাকাছি অন্য সব হোমিনিন কাজিনদের মধ্যে নিনডারথ্যালরা সবচেয়ে কাছের জন।
সে এক লাখ লাখ বছরের বিবর্তন বিরহের কাব্য। জেনেটিকসের এই গবেষণা লব্ধ তথ্যের সাথে হুট করে তৈরি হয়ে টুপ করে পৃথিবীতে মানব প্রজাতির নেমে আসা তাও মাত্র আট দশ হাজার বছর আগে পুরোই সংঘর্ষিক এবং রূপকথার গপ্পোর মতো।
নানা গোষ্ঠীর মানব (Human) জাতির মধ্যে শুধু আমরা Homo sapiens রাই টিকে আছি । আমাদের জ্ঞাতিভাই অন্য মানবগন এই গ্রহ থেকে বিলীন হয়ে গেছেন ।
তাদের মধ্যে সবচেয় নিকটজন বা close cousin ছিলো নিনডারথ্যাল (Neanderthal) রা । ৪০-৫০ হাজার বছর আগে তারাও আমাদের একা করে অথবা আমাদের কারনে হারিয়ে গেছে ।
হারিয়ে যাবার আগে হাজার হাজার বছর ধরে তারা ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য চষে বেড়িয়েছে । আর আধুনিক মানুষ বা আমরা তখন বিকশিত হচ্ছিলাম আফ্রিকা মহাদেশে ।
উভয়েই (আমরা ও নিনডারথ্যালরা) একই পূর্বপুরুষ homo rhodesiensis থেকে উত্তরিত হয়ে দু শাখায় ভাগ হয়ে যাই । তারাই ছিলো আমাদের নিকট প্রতিেবেশী (ওরা ইউরেশিয়ায়, আমরা আফ্রিকায়) বা প্রতিদ্বন্ধী ।
শারীরিক গঠন ও মস্তিস্কের আকারে তারা ছিল আমাদের খুব কাছাকাছি ।
সেই আফ্রিকা থেকে উদ্গত আমরা আজ ধরিত্রীর একচ্ছত্র অধিপতি । অন্য ভার্সনের মানুষেরা আর কোথাও কেউ নেই । কেন নেই, কেন হারিয়ে গেল- সে বিবর্তনের অদ্ভূত লীলা ।
বিজ্ঞান এনিয়ে অনেকদুর এগিয়ে গেছে, তবে সম্পূর্ণ উত্তর তারা এখনো খুজছেন ।
তারা কেন বিলুপ্ত? আমরা কি তাদের প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিয়েছি? তাদের কি পরির্তনের সাথে অভিযোজন ক্ষমতা কম ছিল?
জলবায়ূ বদলের সাথে টেক্কা দিতে তারা কি ছিল অক্ষম? এসব কার্যকারন নিয়ে চলছে গবেষনা ।
৬০ হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষেরা আফ্রিকার গন্ডি ছেড়ে ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে । কয়েক হাজার বছর নিনডারথ্যালদের সাথে আমাদের সহবস্হান হয়। এসময় এদুই আত্মীয়ের মধ্যে কিছুটা আন্তঃযৌনসম্পর্কও হয় ।
তার সাক্ষ্য হিসাবে দেখি, এখনো আমাদের জিনের শতকরা ২ থেকে ৫ ভাগ নিনডারথ্যাল থেকে আসা । পরে আমাদর জ্ঞাতি ভাইরা বিলুপ্ত হয়ে যায় । আমাদের ইউরোশিয়াতে অনুপ্রবেশের আগেই অবশ্য তারা হারিয়ে যেতে শুরু করে ।
মানবগনকে অন্য প্রানীদের কাছ থেকে আলাদা করেছে যে সব বৈশিষ্ট্য তা হলো দুপায়ে দাড়াতে ও হাটতে পারা, বড় মস্তিস্ককে ধারন করার জন্য বড় আকারের করোটি, হাত দিয়ে দৃঢ়ভাবে কিছু ধরার সক্ষমতা, হাতকে মুষ্ঠিবদ্ধ করতে পারা, সুক্ষ্ম কর্ম সম্পাদনের জন্য বৃদ্ধাঙ্গুলীকে অর্ধবূত্তাকারে ঘোরাতে পারা- এসব ।
Homo erectus মানবকুল ২০ লাখ বছর আগ থেকেই এসব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিল । তাদের বাস ছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় । এই ২ লাখ বছর আগেও তাদের অস্তিস্ত ছিল ।
তাদের বেঁচে থাকা অবস্হাতেই ইউরোপ ও আফ্রিকায় ১২ লক্ষ বছর আগে বিচরন শুরু করে আমাদের ও নিনডারথ্যাল (Neanderthal) দের একই পূর্বপুরুষ homo antecessor রা ।
তাদের মধ্য থেকে Homo rodensies হয়ে আড়াই লাখ বছর আগে ইউরোপে নিনডারথ্যাল (Homo neanderthalensis)রা এবং লাখ দেড়েক বছর আগে আফ্রিকায় আমরা (Homo sapiens) বিকশিত হতে শুরু করি ।
আমাদের ছাড়া বাকী সব মানবকুলের কেউ আর টিকে নেই ।
আগেই বলা হয়েছে নিনডারথ্যালরা আমাদের সবচেয়ে নিকটতম মানবাত্মীয় বা close cousin । তাই তাদের সঙ্গে আমাদের মিলও অনেক বেশী ।
তাদের বিলুপ্তির কার্যকারনের কথা উঠলেও আমাদের বুদ্ধিমত্তা, তাদের ভূমিতে আমাদের বহির্গমন(exodus)- এসব প্রসঙ্গে কথা উঠে ।
নিনডারথ্যালরা আকারে, গতরে, করোটির ব্যবচ্ছেদে আমাদের কাছাকাছি হলেও কিছু পার্থক্যও বেশ দৃশ্যমান । তারা তুলনামুলক বেটে, কিন্ত বেশ বলিষ্ঠ ও পেশীবহুল ।
তাদের থুতনি ছোট ,বক্ষপিঞ্জর বর্গাকৃতির, অক্ষিকোটর বেশ বড় বড়, কপাল উলম্ব নয়- উপরের দিকটা পিছনের দিকে বেকে গেছে । তখনকার ইউরোপের তীব্র শীত ও কম দিবালোকের সাথে অভিযোজনের জন্য মুলত: দেহ গাঠনিক এসব পরিবর্তনের কারন ।
আর পূর্বপুরুষদের অনেক বৈশিষ্ট্যই আমরা যেমন আমূল বদলে ফেলেছি, তারা সেটা পারেনি ।
লাখ খানেক বছর আফ্রিকায় কাটানোর পর টিকে থাকা একমাত্র এ মানবজাতির একাংশ ৬০ হাজার বছর আগে আফ্রিকার সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ, এশিয়া, অষ্ট্রেলিয়ার দিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে বিচরন করতে থাকে ।
আজকের পৃথিবীতে যত জাত-পাত-হুতো-তুতসী-বাঙ্গালী-রেড ইন্ডিয়ান-ব্রিটিশ-জার্মান-আরব-অনার্য-জিউস-ফিলিস্তিন-শিয়া-সুন্নী-ব্রাম্মন-রবি দাস, সবার উৎপত্তি ও বিকাশ ঐ আফ্রিকাতে। যারা একসময় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ।
সেই বহির্গমনের সময় দৈহিক ভাবে পরিপুষ্ট ও বলিষ্ঠ, লম্বা চওড়া, তুলনামুলক বড় মস্তিস্কাকৃতির একদল মানুষ ইউরোপে অবস্হান নেয় । তারা পরিচিত Cro-magnon নামে । আজকের ইউরোপীয়ান ও তাদের অনেক উপনিবেশের লোকরা তাদেরই বংশধর ।
তবে cro-magnon রা ছিল তামাটে বর্নের । আজকের ইউরোপীয়দের শ্বেতকায় হয়ে যাবার ঘটনা ঘটে গত ৬ থেকে ১২ হাজার বছরের মধ্যে ।তো এই Cro-magnon রা ইউরোপে থেকে যায় । নিনডারথ্যালরা কোথায় যেন হারিয়ে যায় ।
তবে কি এই প্রাচীন (তখনকার নবাগত) ইউরোপীয়রা তাদের হত্যা বা উচ্ছেদ করেছিলো? নাকি কার্যকরন অন্য খানে?
আড়াই লক্ষ বছর আগে উৎপত্তি হয়ে এই ২০-৩০ হাজার বছর আগ পর্যন্ত নিনডারথ্যাল (Neanderthal) রা বিচরন করতো ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় ।
কখনো বরফ যুগের তীব্র শৈত্য, কখনো অতি উষ্ণতার বৈরীতা, ভয়াবহ অগ্নুৎপাতের ছাইয়ে ছেয়ে যাওয়া অন্ধকার আকাশ- এসবের মধ্যেও তারা টিকিয়ে রেখেছিল তাদের । তারা এখন আর নাই ।
যা আছে তা হলো সে ভূখন্ডে তাদের পদচারণার চিহ্ন, তাদের হাতিয়ার, হাড়গোর কংকাল আর গুহা-শিল্পের ফসিল স্মৃতি । আর আছে আমাদের মধ্যে নিরন্তর বয়ে চলা তাদের কিছু ডিএনএ ।
৫০-৬০ হাজার বছর আগে সেই প্রাথমিক যুগের মডার্ন মানুষেরা আফ্রিকা থেকে যখন বেরিয়ে পড়ে নিনডারথ্যালরা চোখে যেন এলিয়েন দেখলো ।
যে হাজার দশেক বছর তারা আমাদের সাথে যৌথভাবে ইউরেশিয়ায় কাটালো- একালটা তাদের জন্য অন্যরকম অধ্যায়। এসময়ে এমন কি ঘটলো যার ফলে তারা এই গ্রহচ্যুত হয়ে যায় চিরতরে?
কারো মতে যোগ্যতমের উর্ধ্বতন হিসাবে আমরা উদ্বর্তিত হই, আবার কারো ধারনা ঐ সময়ে ঘটেছিল মানবেতিহাসের আরেক হলোকাষ্ট ।
একথা সত্য,অচেনা এই নবাগত অর্থ্যাৎ আমাদের ভাষা, প্রকাশ ক্ষমতা, সংস্কৃতি, শিকার যন্ত্র সবই ছিল স্হানীয় আদিবাসীদের চেয়ে পরিনত।
বাস্তুসংস্হান বা ecology র সুত্র হল, দুটি প্রজাতি যদি একই স্হান ও সম্পদের জন্য মুখোমুখী হয় তবে যারা, এমনকি সমান্য হলেও, বুদ্ধি,শারীরিক গঠন বা শক্তিতে এগিয়ে থাকে তারা টিকে থাকবে ।
অন্যরা হয় বিলুপ্ত হবে অথবা অন্য কোন বাস্তুসংস্হানের অংশ হয়ে যাবে । মেধায় ও সমরাস্রে কিছুটা পিছিয়ে থাকা নিনডারথ্যালরা একারনে শেষমেষ টিকে না থাকতে পারে ।
মস্তিস্কের গঠনের যোগ্যতমতা এখানে ভূমিকা রেখেছে ।
অক্সফোর্ডে সম্প্রতি ৩২ টা আধুনিক মানব ও ১৩টি নিনডারথ্যাল করোটি(Skull)র তুলনামুলক বিশ্লেষন করা হয় । দেখা গেছে তাদের অক্ষিকোটরদ্বয় বেশ বড় ।
মস্তিস্কের পেছনের যে অংশে দৃষ্টিপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় তাও ছিল প্রশস্ত। ইউরোপের লম্বা নিকষ কালো রাতের দৃষ্টির অভিযোজনের জন্য এটা হয়েছে ।
অন্যদিকে সূর্যকরলাকিত আফ্রিকায় তিলেতিলে বেড়ে উঠা আমাদের পূর্বপুরুষদের সে অন্ধকার-অভিযোজনের দরকার ছিলনা । তার পরিবর্তে আমাদের মস্তিস্কের সামনের অংশ বা Frontal lobe টি বিকশিত হয়েছে যার দ্বারা ভাষা, বুদ্ধিমত্তা, সামাজিকতা, নেতৃত্ব- এসব উচ্চতর কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রিত হয় ।
উদাহরনস্বরূপ, এর ফলে আমরা জটিল ভাষা ও বাক্যে ভাব প্রকাশে সমর্থ হই । নিজেদের মধ্যে চিন্তা ও ধারনা বিনিময় করে নতুন কিছু(যেমন উন্নত হাতিয়ার) আবিস্কার করতে সমর্থ হই ।
তাই মগজের আকার সমান থাকা সত্ত্বেও সম্পদ সংগ্রহ, উৎপাদন, বন্টন, শ্রমবিভাজন, নবতর আবিস্কার- সব ক্ষেত্রে আমরা তাদেরকে ছাড়িয়ে যাই ।
শিকার ও খাদ্যসংগ্রহেও তারা আমাদের সাথে পেরে উঠছিলনা । প্রকৃতির বৈরীতা, নবাগত মনুষদের সাথে প্রতিযোগিতা, অনুন্নত হাতিয়ার এসব কারনে এক পর্যায়ে তারা অনাহার, অপুষ্টিতেও ভূগছিলো ।
আমাদের মত তীর-ধনুক তাদের ছিলনা । ফলে শিকারের পশ্চাদ্ধাবন করার সময় বুনো প্রানীদের খুব কাছাকাছি আসতে হতো তাদের । কখনো প্রতি আক্রমনে কাবু হতো ।
খর্বকায় গাট্টাগোট্টা হাত-পায়ের কারনে তাদের হাটা বা দৌড়ানোর ক্ষমতাও ছিল আমাদের চেয়ে কম । ফলে প্রানীদের নখের আচড়, থাবার দাগ, থ্যতলে যাওয় মুখ এসব চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছৈ তাদের ফসিল ।
আমরা লতা গুল্ম, শাকসব্জী, পশুর গোশত সবই খেতাম । তারা ছিল শুধুই মাংসাশী । সে মাংসের সন্ধানে এমনও গেছে ক্ষুধার্ত সন্তানদের গুহায় রেখে এসে সারাদিন তারা শিকারে ব্যাস্ত থাকত । দিনশেষে খাদ্য নিয়ে আবার গুহায় ফিরতো ।
নতুন অস্রশস্র তৈরীর উদ্যম বা শক্তি তাদের মধ্যে আর থাকতোনা। নারী পুরুষ উভয়েই এ খাদ্যের জন্য যুদ্ধে সমভাবে অংশ নিতো । তাদের মধ্যে কোন শ্রমবিভাজন ছিলনা । এমন একটা সময় আসে যখন তাদের অনাহারেও থাকা শুরু হয় ।
পুষ্টিহীনতার চিহ্ন নেমে আসে শরীরে । বয়স পঞ্চাশের মধ্যেই তারা মরে যেতে থাকে। চল্লিশ পার হতো অল্প কয়েকজন । কিছু ফসিল কংকাল ছিল ভিটামিন ডি অভাবজনিত রিকেটাক্রান্ত ।
কেউ কেউ তাদের নাই হয়ে যাবার পিছনে ”দ্বান্দ্বিক প্রতিস্হাপন” কে একটা কারন হিসাবে মনে করেন । তাদের মতে আমরা যখন ইউরোপে নবাগত তখন সেখানকার পুরাতন মানুষ নিনডারথ্যাল দের দিকে ঘৃনা আর হিংসা নিয়েই তাকিয়ে ছিলাম ।
আজো উন্নত সমরাস্রের কোন দেশ দূর্বল কোন জাতিকে পেলে যা করে, ২০-৪০ হাজার বছর আগে তেমনটাই আমরা তাদের সাথে করেছিলাম ।
কলম্বাসের আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের বিলুপ্তির সাথেও কেউ মিল দেখেন ঐ ঘটনার । কারো ধারনা, মানবেতিহাসের অন্যতম হলোকাষ্ট হয়েছিল সে সময়ের ইউরোপে ।
এত সীমাবদ্ধতা, অভাব অনটন, অনাহার সত্ত্বেও তাদের মানবিক গুনাবলী ছিল । ছোট ছোট দল ছিল, অপরের প্রতি কেয়ারিং ছিল, মৃতদেহকে সন্মান করতো, শিকারে আহত সঙ্গীটাকে রক্ষা করার প্রানপন চেষ্টা করতো ।
আসলে ঠিক একটি বিশেষ কারনে তারা এ গ্রহ থেকে হারিয়ে গেছে তা নয়। হয়তো এর পিছনে ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন কার্যকারণ কাজ করেছে ।
মোদ্দাকথা হলো, আফ্রিকা থেকে আগত দৈহিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শিকার ঊপকরনে অগ্রসর সেই close cousin দের মোকাবেলা করে টিকে থাকার প্রস্তুতি তাদের ছিলনা ।
কারন যাই হোক, হারিয়ে যাওয়া সে স্বজনদের খোঁজে কালের কপোলতলে আজো যেন ভেসে উঠে রবীন্দ্রনাথের সেই সুর
”কোথায় তারা, কোথায় তারা, কেঁদে কেঁদে কারে ডাকি, আমি শুধু আমায় নিয়ে কোন প্রানেতে বেঁচে থাকি, আমি শুধু রইনু বাকী ।”
লেখক: ডাঃ আমিনুল ইসলাম
(২)
চল্লিশ হাজার বছর আগের নেয়ানডার্থাল মানবের জীন ও পরে ডেনিসোভান জীন এর ম্যাপিং করে তিনি মূলতঃ বিবর্তনের প্রক্রিয়া বিষয়ক জ্ঞানকাণ্ডে অবদান রেখেছেন।
ডেনিসোভান জীন বহনকারীরা তিব্বতে বসবাস করে ও কম অক্সিজেনে বাস করে সহজে।
এটা তার আবিস্কার। নেয়ানডার্থাল জীনের সাথে রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে তার কাজ বেশি আলোচনায় আসে কোভিডের সময়।
তার মানে এই লোকের নোবেলের পেছনে কোভিড 19 এর অবদান আছে। কোভিডের সময় এই নেয়ানডার্থাল জিন ও ইম্যুনিটির সম্পর্কে এতো আলোচনা হয়েছে ও কিছু বিষয় প্রমাণিত হয়েছে যে এই লোক নোবেল পেয়ে গেছেন।
তবে এই গবেষণা এখনো কারো প্রাণ বাঁচাতে বা মানবজাতির বৃহৎ কোনো উপকারে আসে নাই। এটা কেবল বিবর্তনের সময় হোমো স্যাপিয়েন্সদের সাথে নেয়ানডার্থালদের সন্তান উৎপাদনশীলতা ও তাতে আমাদের শরীরে নেয়ানডার্থাল জীনের ভূমিকার একটি অংশ বোঝা গেছে।
মেডিসিনের নোবেল আসলে বায়োলজিকাল সায়েন্স এর নোবেল। ইদানিং এই পুরস্কার জেনেটিকসে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সেলুলার লেভেল থেকে ক্রোমোজোম… অতি ক্ষুদ্রে এখন বেশি আগ্রহ।
তবে একদল লোক যারা ইউজেনিকসের পক্ষে ও যারা জিন ম্যানিপুলেশন করে ভবিষ্যতে জেনেটিক মডিফিকেশনের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধী দীর্ঘায়ু সুপার হিউম্যান তৈরীর ইচ্ছা পোষণ করেন তাদের জন্য এই গবেষণা অনেক পছন্দসই।
যাই হোক ; স্ফান্তে পাবোর গবেষণা কি কাজে লাগবে সেটা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।
ব্যক্তিগত যৌনাচরণের জন্যও বেশ আলোচিত এই বিজ্ঞানী। আপাতত তিনি তার নোবেল এর টাকা গুনতে থাকুন। (তিনি একসময় সমযৌনতায় অভ্যস্ত হলেও পরে বিবাহ করেছেন একজন বয়িশ চার্ম আছে এমন নারীকে)। উনি নিজেই এটা বলেছেন।
কে জানে এর পেছনেও নেয়ানডার্থাল জীনের প্রভাব আছে হয়তো!
লেখকঃ ডাঃ আব্দুন নূর তুষার
(৩)
আমরা, বর্তমান মানুষ জাতি জীববিজ্ঞানে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতি। হোমো (দ্বিপদী) গণের অন্তর্ভুক্ত নিয়েন্ডার্থাল ও ডেনিসোভান নামে দুইটা আলাদা প্রজাতি ছিল, যারা আলাদা প্রজাতি হিসাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগে হোমো স্যাপিয়েন্স এর সাথে কিছুটা সময় সমসাময়িক ছিল।
নিয়েন্ডার্থাল ও ডেনিসোভান ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ডঃ প্যাবো দেখিয়েছেন আধুনিক মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্স কীভাবে নিয়েন্ডার্থাল ও ডেনিসোভানদের চাইতে আলাদা।
ডেনিসোভান প্রজাতি আবিষ্কারের কৃতিত্বও ডঃ পাবু-র। রাশিয়ার সাইবেরিয়ার এক গুহায় পাওয়া হাড়ের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান, ঐ ডিএনএ আগে পাওয়া অন্য ডিএনএর চাইতে আলাদা অর্থাৎ এটা একটা নতুন প্রজাতি, এবং তারপর ঐ এলাকার নামে সেই প্রজাতির নাম দেয়া হয় ডেনিসোভান।
তার গবেষণা থেকে আমরা আমাদের বিবর্তনের ইতিহাস এবং নিয়েন্ডার্থাল ও ডেনিসোভানর কীভাবে নেই হয়ে গেল, আমরা কীভাবে টিকে গেলাম, সেটার জেনেটিক ইতিহাস জানছি।
পাদটীকা:
ক) নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভানদের সাথে হোমো স্যাপিয়েন্স এর প্রজনন হয়েছিল। তাই আধুনিক মানুষের শরীরেও ঐ ডিএনএ আছে। যেমন বাংলাদেশের মানুষের শরীরে ডেনিসোভান ডিএনএ আছে।
খ) আলাদা প্রজাতি হলে প্রজনন সম্ভব? নিয়েন্ডার্থাল ও ডেনিসোভানরা আলাদা প্রজাতি কি না সেটা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, কারন এতে প্রজাতির সংজ্ঞা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।
গ) তার নামের উচ্চারণ স+ভান্তি প্যাবো। প্রথম অক্ষরটা বাংলায় টাইপ করা যায় না। আগ্রহীরা এখানে সুইডিশ উচ্চারণ শুনতে পারবেন
https://www.youtube.com/watch?v=M7VdRKQuAa8
এবং এখানে অ্যামেরিকান উচ্চারণ ও এক ঘন্টার একটা চমৎকার বক্তৃতা
https://www.youtube.com/watch?v=M7VdRKQuAa8
লেখকঃ জাভেদ ইকবাল
(৪)
সান্তে পেবোর জন্ম ১৯৫৫ সালে সুইডেনের স্টকহোমে। সুইডেনের উপশালা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন ১৯৮৬ সালে।
এরপর পোস্টডক্টরেট রিসার্চ করেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখ ইউনিভার্সিটি এবং আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে।
১৯৯০ সালে তিনি জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১৯৯৯ সালে তিনি জার্মানির লাইপজিগে প্রতিষ্ঠা করেন ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট ফর এভুলিউশানারি অ্যানথ্রোপোলজি।
বর্তমানে তিনি সেখানেই কর্মরত। জাপানের ইন্সটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির তিনি সংযুক্ত অধ্যাপক।
কোটি বছরের জৈব-বিবর্তনের ফসল আমরা, মানে মানুষ – বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় হোমো স্যাপিয়ান্স। আধুনিক ডিএনএ টেকনোলজির মাধ্যমে আমরা আজ আমাদের পূর্বপুরুষদের জীন এবং তাদের বিবর্তন সম্পর্কে অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারছি।
প্রফেসর সান্তে পেবো হোমো স্যাপিয়েন্স এর বিলুপ্ত পূর্বপুরুষ নিয়ানডার্থালদের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর আবিষ্কার মানব বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক প্রমাণকে আরো শক্ত ভিত্তি দিয়েছে।
অভিনন্দন নোবেলজয়ী প্রফেসর সান্তে পেবো।
লেখাঃ প্রদীপ দেব