যথাযথ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়া শুধু রাশিয়া কেন, কারো ভ্যাকসিনই গ্রহনযোগ্য নয়।
চীনের উহান শহরে বাঁদুর থেকে আবির্ভূত হওয়া করোনাভাইরাসটি গত আট মাসে ছড়িয়ে পরেছে ২১৩ টি দেশে, সংক্রমিত করেছে ২ কোটি ১১ লক্ষ মানুষকে এবং মৃত্যু ঘটিয়েছে সাড়ে সাত লক্ষের উপরে।
১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর পর এতবড় মহামারী এই প্রথম। চলতি বছরের মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই করোনাভাইরাসের বিস্তারকে মহামারী হিসেবে ঘোষনা দিয়েছে, যা এখনও চলমান।
করোনা মহামারীর কেন্দ্র ইউরোপ আমেরিকা ঘুরে এখন অবস্থান নিয়েছে ল্যাটিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায়। মৃত্যুহার পূর্বের চেয়ে কিছুটা কমে আসলেও, সংক্রমণের হার এখনও উর্ধগতি।
এ থেকে পরিত্রানের একমাত্র উপায়ই হচ্ছে একটি নিরাপদ এবং কার্যকরী ভ্যাকসিন।
ভ্যাকসিন দৌড়ে কে কোথায়?
আবির্ভাবের পরপরই চীন করোনাভাইরাসটির জেনম সিক্যুয়েন্স করে ফেলে দ্রুত গতিতে এবং তা উন্মুক্ত করে দেয় সবার জন্য।
এই সিক্যুয়েন্সকে ভিত্তি করে চলতি বছরের শুরু থেকেই কয়েকটি দেশ ভ্যাকসিন তৈরীর কাজে নেমে পরে সর্বশক্তি নিয়ে; যার মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং জার্মানী অগ্রগামী।
ভ্যাকসিন উৎপাদন একটি জটিল এবং লম্বা প্রক্রিয়া, যেখানে সফলতার হার মাত্র ৬-৭ শতাংশ। ভ্যাকসিন দৌড়ে এখন পর্যন্ত অংশ নিয়েছে মোট ১৬৫ টি ভ্যাকসিন, যার মধ্যে ১৩৫ টি রয়েছে ল্যাবরেটরি পর্যায়ে এবং ৩১ টি রয়েছে বিভিন্ন ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকা ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে শেষ ধাপ বা ফেইজ-৩ ট্রায়ালে রয়েছে অক্সফোর্ডের চ্যাডক্স-১, মর্ডানার এমআরএনএ ভ্যাকসিন, জার্মানির বায়োন্টেক এবং চীনের সিনোভ্যাক ও ক্যানসিনোবায়ো ভ্যাকসিন।
অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন তাদের ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করবে সেপ্টেম্বরে এবং অক্টোবরেই তারা ভ্যাকসিনটি বাজারে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অন্যদিকে মর্ডানা এবং সিনোভ্যাক তাদের ভ্যাকসিন এবছরের শেষে বা আগামী বছরের প্রথমে বাজারে আনতে পারে। ক্যানসিনোবায়ো মাত্র তাদের ফেইজ-৩ ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছে সৌদি আরবে।
রাশিয়ার ভ্যাকসিন এবং মিডিয়া হাইপ!
আগস্টের আগ পর্যন্ত রাশিয়ার ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় ছিলনা।
হঠাৎ করেই রাশিয়া ঘোষণা দিলো যে তারা সফল করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছে এবং তা সর্বসাধারনের উপর ১২ আগস্ট থেকে প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে।
অভিনব ভাবে ভ্যাকসিনটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কন্যাকে টিকা প্রদানের মাধ্যমে! এভাবেই ভ্যাকসিন দৌড়ে সবাইকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হয় রাশিয়া। তারা তাদের ভ্যাকসিনটির নাম দেয় স্পুটনিক-ভি!
স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনটি উদ্ভাবন করেছে মস্কোর গ্যামালেয়া ইনষ্টিটিউট। ভ্যাকসিনটি তারা তৈরী করেছে তাদের উদ্ভাবিত দ্বৈত-অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ব্যাবহার করে।
এই পদ্ধতিতে তারা সম্প্রতি ইবোলাভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরী করে এবং তা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়।
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি তৈরী শিম্পাঞ্জির অ্যাডিনোভাইরাস (সিএইচ-অ্যাড) ভেক্টরে এবং চীনের ক্যানসিনোবায়ো ভ্যাকসিনটি তৈরী হিউম্যান অ্যাডিনোভাইরাস (অ্যাড-৫) ভেক্টরে।
তবে গ্যামালেয়া এক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে একটির বদলে দুইটি অ্যাডিনোভাইরাস। একটি অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর (অ্যাড-২৬) ব্যবহার করা হবে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিনে এবং আরেকটি অ্যাডিনোভাইরাস (অ্যাড-৫) ব্যবহার করা হবে ২১ দিন পরে দেয়া দ্বিতিয় ডোজে।
তাদের দাবী অনুযায়ী এভাবে দুই ধরনের অ্যাডিনোভাইরাস ব্যবহার করলে ইমিউন রেসপন্স বেশী হয় এবং ভ্যাকসিনটি দীর্ঘমেয়াদী (প্রায় ২ বছর) সুরক্ষা দেয়।
ভ্যাকসিন তৈরীর এই পদ্ধতিতে রিকম্বিনেন্ট টেকনোলজির মাধ্যমে অ্যাডিনোভাইরাসের মধ্যে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জিন প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়।
এতে করে অ্যাডিনোভাইরাসটি যখন টিকার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে, তখন আমাদের ইমিউন সিস্টেম এই ভাইরাসটিকে করোনাভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করে এর বিপরীতে রোগপ্রতিরোধ ব্যাবস্থা গড়ে তোলে, যা পরবর্তিতে আমাদেরকে আসল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়।
তবে জনসাধারনে ব্যবহারের পূর্বে এভাবে তৈরীকৃত ভ্যাকসিনের কার্যকারীতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
ভ্যাকসিনের কার্যকরীতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ:
একটা ভ্যাকসিন কতটুকু নিরাপদ এবং কার্যকরী তা দেখার জন্য তিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়। প্রথম ধাপের (ফেইজ-১) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয় স্বল্পসংখ্যক (২৫-১০০ জন) সুস্থ্য মানুষের উপর।
এই ধাপের ট্রায়ালে দেখা হয় প্রয়োগকৃত ভ্যাকসিনটি শরীরে কোনরূপ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে কি না এবং কতটুকু ইমিউন রেসপন্স করে।
দ্বিতীয় ধাপের(ফেইজ-২) ট্রায়াল করা হয় অপেক্ষাকৃত অধিক সংখ্যক (১০০-৫০০ জন) সুস্থ্য ভলান্টিয়ারের উপর।
এই ধাপে নির্ধারণ করা হয় ভ্যাকসিনটির কার্যকরী ডোজ এবং তা শরীরে কতটুকু নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি এবং টি-সেল বা ইমিউন সেল রেসপন্স ঘটাতে পারে।
এই দুটো ধাপে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেলে শুরু করা হয় শেষ ধাপের (ফেইজ-৩) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এই ধাপের ট্রায়ালটি করা হয় ১০-৩০ হাজার সুস্থ্য মানুষের উপর।
এই ট্রায়ালটি হতে হবে প্ল্যাসিবো-কন্ট্রোল্ড ডাবল-ব্লাইন্ড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, যেখানে ট্রায়ালে অংশগ্রহনকারী অর্ধেকের শরীরে দেয়া হয় ভ্যাকসিন এবং বাকী অর্ধেককে দেয়া হয় প্ল্যাসিবো।
এরপর তাদেরকে মুক্তভাবে চলাফেরা করতে দেয়া হয় জনমানুষের ভেতরে, যেখানে করোনা মহামারী চলমান। ট্রায়াল শেষে দেখা হয় আসল ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের ভেতরে কতজন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে।
ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের ভেতরে যদি ৬০-৭০ শতাংশ করোনা থেকে মুক্ত থাকে তাহলে ধরে নেয়া হয় যে ভ্যাকসিনটি কার্যকরী। এই ফলাফলের পরেই একটা নতুন ভ্যাকসিন সর্বসাধারণে প্রয়োগের অনুমতি দেয়া হয়।
অক্সফোর্ড, মর্ডানা, বায়োন্টেক এবং সিনোভ্যাক তাদের ভ্যাকসিনের সফল ফেইজ-১/২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর এখন চালাচ্ছে ফেইজ-৩ ট্রায়াল।
অন্যদিকে রাশিয়ার গ্যামালেয়া ইন্সটিটিউট তাদের ভ্যাকসিনের কোন প্রকার ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না করেই জনসাধারণের উপর প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাশিয়াতে নতুন আইন অনুযায়ী ভ্যাকসিন অনুমোদনের জন্য ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রয়োজন নাই।
গ্যামালেয়া ইন্সটিটিউটের দাবি তারা তাদের ভ্যাকসিনটি সর্বপ্রথম বানরের উপর পরীক্ষা করে সফলতা পেয়েছে। এরপর তারা তাদের ভ্যাকসিনের ফেইজ-১/২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করে ১৭ জুন ৭৬ জন ভলান্টিয়ারের উপর যা শেষ হয় ১ আগস্ট।
গ্যামালেয়ার দাবি অনুযায়ী তাদের ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং পর্যাপ্ত নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি ও ইমিউন সেল রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম। তবে এই ব্যাপারে গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানী মহল রয়েছে অন্ধকারের ভেতর!
যেখানে অক্সফোর্ড, মর্ডানা, বায়োন্টেক বা ক্যানসিনোবায়ো সবাই তাদের ভ্যাকসিন গবেষণার ফলাফল বিভিন্ন বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেছে, সেখানে রাশিয়া তাদের ভ্যাকসিনটির কোন বৈজ্ঞানিক ফলাফল কোন বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেনি।
অবশ্য সম্প্রতি তারা তাদের ওয়েবসাইট স্পুটনিকভ্যাকসিন ডট কমে কিছু তথ্য সংযুক্ত করেছে!
তবে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যের অনুপস্থিতির কারণেই তাদের ভ্যাকসিনটি নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে তৈরী হয়েছে উৎকন্ঠা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে এবং তরিঘরি সর্বসাধারণে প্রয়োগে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
আমেরিকার করোনা মহামারী টাস্কফোর্স প্রধান বিজ্ঞানী অ্যান্থনি ফাউচি রাশিয়ার ভ্যাকসিনটির যথাযথ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না করেই সর্বসাধারনে প্রয়োগের সিদ্ধান্তকে অবৈজ্ঞানিক হিসেবে আক্ষ্যা দিয়েছেন।
অনীরাপদ বা অকার্যকর ভ্যাকসিন প্রয়োগের সাথে স্বাস্থ্যহানি বা জীবণনাশের সম্পর্ক রয়েছে।
ত্রুটিপূর্ণ ভ্যাকসিনের ক্ষতিকর দিক:
পর্যাপ্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া তরিঘরি করে উৎপাদিত ত্রুটিপূর্ণ ভ্যাকসিন বয়ে আনতে পারে বিপর্যয়। যেমন ১৯৫৫ সালে তড়িৎ গতিতে উৎপাদিত কিছু পোলিও ভ্যাকসিনে জীবন্ত পোলিও ভাইরাস ছিল।
এই ত্রুটিপূর্ণ ভ্যাকসিন যে ৭০ হাজার শিশুকে দেয়া হয়েছিল তাদের সবার মাংসপেশিতে দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল, ১৬৪ টি শিশু প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল এবং মৃত্যুবরণ করেছিল ১০ টি শিশু।
এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫৫-১৯৬৩ সালে দেয়া ৩০ শতাংশ পোলিও ভ্যাকসিনে জীবন্ত সিমিয়ান ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই ভাইরাসের দূষণটি ঘটে ল্যাবরেটরিতে বানরের কিডনী কোষ ব্যবহার করে ভ্যাকসিন প্রস্তুতির সময়।
এসব ঘটনার কারনে ইদানীং ভ্যাকসিন উৎপাদনে অত্যাধিক সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।
শুরুতে করোনাতে মৃত্যুহার বেশী থাকলেও এখন কিন্তু মৃত্যুহার অনেকটা কমে এসেছে। বাংলাদেশ এই হার এখন মাত্র ১.২ শতাংশ, ভারতে ২ শতাংশ এবং ব্রাজিলে প্রায় ৩ শতাংশ। ভ্যাকসিনও উৎপাদন করতে যাচ্ছে বেশ কয়েকটা নামী কোম্পানী।
অতএব, সমূহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে আমাদের উচিত হবে শুধুমাত্র তাদের কাছ থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা যারা তা উৎপাদন করেছে যথাযথ নিয়ম মেনে পর্যাপ্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে।
ডাঃ খোন্দকার মেহেদী আকরাম,
এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি,
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট,
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য