র্যাবিস। আতঙ্কের সবচেয়ে বড় প্রতিশব্দ অন্তত আমার কাছে। জীবনে একবারই এক জলাতঙ্কের রোগী দেখেছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা কোনো পাপ নয়। সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিলো ওই বাচ্চাটিকে খুন করে ফেলা যায়!
একটি অন্ধকার রুমে তাকে আটকে রাখা হয়েছিলো। জানালা গুলো কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। এক কোনায় তাকে বেধে রাখা হয়েছে যেন শব্দ কম যায়। আমরা দরজা খুলে ঢোকা মাত্রই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো।
আমি দেখছিলাম যেন মানুষরূপী কুকুর। আমাদের দিকে তেড়ে আসছে। বিকট মুখভঙ্গি, বাঁধন টাধন খুলে ফেললো। সাথে ওয়ার্ডবয়রা ছিল- তারা কিভাবে কিভাবে ম্যানেজ করলো জানি না। যে স্যারের সাথে গিয়েছিলাম উনি একটু পানি নিয়েছিলেন ‘জলাতঙ্ক’ দেখাবেন বলে।
এটি খুব প্যাথেটিক কিন্তু বাস্তব কথা এ প্রফেশনে সবকিছুই একেকটি ‘কেস’। আমরা বের হয়ে যাবার পর ওর মা এসে আমাদের কাছে বলেছিলেন ‘বাবা আমার ছেলেটা কবে মারা যাবে?’ সম্ভবত এরচেয়ে কঠিন প্রশ্ন আর কখনো কোনদিন কাউকে শুনতে হয় নি।
হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফ্যাটালিটি। র্যাবিসের রোগী মারা যাবেই। এবং খুব দ্রুত। পরেরদিন গিয়ে আর পাই নি। নীরবতার শান্তি সেদিন বুঝেছিলাম। একটি দানব লাগে নিজের ভেতরের দানবটিকে চেনার জন্য। আজ এতদিন পর র্যাবিসের কথা মনে পড়লো এক বন্ধুর দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়ে।
সে গত পরশু এক বিয়ে বাড়িতে গেলে বিড়াল তাকে আঁচড় দেয়। পোষা বেড়াল নয়। একদম রক্ত বেরিয়ে আসে। সে চিকিৎসা নিচ্ছে। এ বিষয়টি সবার জানা প্রয়োজন। র্যাবিসের চিকিৎসা ভ্যাক্সিন এবং এটি নিলে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া যায়।
না নিলে মৃত্যু স্বয়ং ঈশ্বরও ঠেকাতে পারবেন না। সেও পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু। যেখানে মা বাবাও একসময় চোখ বুজে মৃত্যু কামনা করা শুরু করেন।
প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার মৃত্যু হয় র্যাবিসে। যার ৫৫ শতাংশ এশিয়ায়। ভারতে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ২০ হাজার জন করে। বাংলাদেশ তুলনামূলক ভাল অবস্থানে আছে। যদিও WHO পুরো দেশকেই র্যাবিসের এন্ডেমিক বলছে।
ধারণা করা হয় বাংলাদেশে ঠিকমতো কেস রিপোর্টিং হয় না। র্যাবিস নিয়ে কিছু জিনিস জানা প্রয়োজন সবার। অন্তত করোনা ভাইরাস এর চেয়ে অনেক ভদ্রলোক!
জলাতঙ্ক হতে পারে কুকুর, বানর, বিড়াল, শেয়ালের কামড়ে। বাদুড়ের কামড়েও হয় কিন্তু সে ভ্যাম্পায়ার বাদুড় আমাদের দেশে নেই। ইঁদুরের কামড়ে হয় না। খরগোশের কামড়ে হয় না।
অহেতুক ভয় পাওয়ার দরকার নেই। অনেক রোগী দেখেছি ইঁদুরের কামড় খেয়েও ভ্যাক্সিন দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। স্টাডি বলছে ৯৯ শতাংশই কুকুরের কামড় থেকে হয়। এটি প্রাণী থেকে প্রাণী ছড়ায়, মানুষ থেকে মানুষ ছড়ায় না।
র্যাবিড কুকুরে সাধারণত এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই সাইন সিম্পটম এপেয়ার করে। সিম্পটম আসার দশ দিনের মধ্যেই মারা যায়। তখন সে প্রচণ্ড উত্তেজিত থাকে, লালা ঝড়তে থাকে অনবরত।
শুধু দৌড়াতে থাকে এবং যাকে পায় তাকেই কামড়ায়। মানুষের প্রতি ভয় ডর প্রাণীটির উবে যায়। আক্রান্ত কুকুর কামড়ালেই র্যাবিস ছড়ায় না। লালায় ভাইরাস ক্ষণে ক্ষণে বের হয়। লালায় ভাইরাস থাকতে হবে।
এরপর আসুন মানুষে। দুই ধরনের লক্ষন হতে পারে। ভয়ঙ্কর মূর্তি যা দুই তৃতীয়াংশ। নেতিয়ে পড়া মূর্তি যা এক তৃতীয়াংশ। কামড় খাওয়ার কতদিন পর সমস্যা শুরু হবে তা অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে।
তবে সাধারণত এক থেকে তিন মাসের মধ্যে। ৮৩ শতাংশের উপর রাস্তার কুকুর দায়ী র্যাবিসের জন্য। কিন্তু পোষা প্রাণীর ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকা উচিত। কারন প্রাণীটি র্যাবিড প্রাণীর সংস্পর্শে এসে থাকতে পারে।
কুকুরের স্পর্শ বা চাটাকেও সিরিয়াসলি নিতে হবে। কামড় হোক, আঁচড়, বা চাটা- জায়গাটিকে ফেনা তোলা সাবান দিয়ে পাক্কা ১৫ মিনিট ধুতে হবে। WHO র মতে শুধু ধুয়েই ৭০- ৮০ শতাংশ ঝুঁকি কমিয়ে ফেলা যায়। যদি তীক্ষ্ণ ক্ষত হয় তবে ভেতরেও সাবানের ফেনা যেতে হবে।
‘ফেনা’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ বলে দিচ্ছি। সেজন্য কাপড় কাঁচার সাবান সর্বোত্তম। টেপের পানি ছেড়ে রেখে ধুতে হবে। যদি আঁচড় বা কামড় হয় তাহলে ভ্যাক্সিনের প্রশ্ন আসবে। দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।
২০১১ সালের আগে আমাদের দেশে নাভীতে ভ্যাক্সিন দেয়া হতো। ভ্যাক্সিনটির সাইড ইফেক্ট ছিল অনেক। এখন টিস্যু কালচার ভ্যাক্সিন দেয়া হয়। ১৪ টি লাগে না, চারটি অথবা পাঁচটি। সাধারণত চারটি ডোজই প্রেফার করা হয়। সেটি ইন্ট্রাডার্মাল।
মনে আছে যক্ষ্মার ভ্যাক্সিন ইন্ট্রাডার্মাল? মটরদানার মতো জায়গাটি একটু ফুলে যাবে, সামান্য ব্যাথা করবে। না গেলে আবার দিয়ে নিবেন। খেয়াল রাখবেন ভ্যাক্সিন যদি বের হয়ে যায় দেয়ার সময় আবার দিবেন। মাংসপেশিতে দিলে শিডিউল ০,৩,৭,১৪, ২৮ তম দিন।
ইন্ট্রাডার্মাল দিলে ০,৩,৭,২৮ তম দিন। প্রথমটি রবিবার হলে দ্বিতীয়টি বুধবার, তারপর রবিবার, এক সপ্তাহ পর পরের রবিবার। দেরী করা যাবে না। একদিন দেরী হলে পুরো কোর্স আবার করতে হবে।
রক্ত ঝরলে র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেয়া লাগবে। এটি ওজন হিসেব করে দেয়া হয়। ক্ষতস্থানের চারপাশে। আর বাকি চিকিৎসা স্বাভাবিক ভাবে চলবে। ডাক্তার সাহেবরা যেরকম মনে করেন। হাসপাতালে গেলে সাধারণত আবার ২০ মিনিট ধোয়ানো হয়।
এটি রোগীর উপকারের জন্য। মনে রাখবেন এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। হলে মৃত্যুর হাত থেকেও রক্ষা নেই। ভ্যাক্সিন নেয়ার পর অবশ্যই কার্ড রাখবেন।
এটি পরে আবার কামড়ালে কাজে আসবে। এবং রিপোর্টিংয়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
আরও অনেক কথা আছে। গর্ভবতী মা, ডায়েবেটিক রোগী, শিশুদের ক্ষেত্র, বা আবার কামড়ালে কি করা উচিত- সব তথ্য বেশি হয়ে যাবে এক স্ট্যাটাসের জন্য। আরও কিছু তথ্য যেমন র্যাবিস ডে ২৮ সেপ্টেম্বর। বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের মৃত্যুদিন স্মরণে। এবং র্যাবিস পৃথিবীর প্রাচীনতম সংক্রামক রোগ।
চার হাজার বছর আগেও এটি ছিল- প্রমাণ পাওয়া গেছে। মোট আক্রান্তের ৪৫ শতাংশের উপর ১৫ বছর বয়সীদের কম।
তারা সাধারণত বলতে চায় না। যেহেতু সমাধান নেই, তাই অর্থ লজ্জা আলসেমি বাদ দিয়ে সবার সিরিয়াস হওয়া ভাল।
আর যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীদের ভ্যাক্সিনের আওতায় আনা লাগবে। এটিই সবচেয়ে সহজ সমাধান। হার্ড প্রোটেকশন দেয়া সম্ভব এভাবে। ধরে ধরে কুকুর হত্যা করা কোনো অপশন হতে পারে না।
দ্বিতীয়ত শিশুদের প্রাণীকে ভালোবাসতে শেখাতে হবে। অন্তত ভালোবাসা না থাকুক, তাকে উত্যক্ত না করলে সে এমনি কামড়াতে আসবে না।
আর প্রয়োজন সচেতনতা। শুধু টেপের পানি ছেড়েই এক যুদ্ধে সত্তর থেকে আশি শতাংশ জেতা যায়- এ ম্যাসেজটা ছড়াতে হবে।
ভয়ডরহীন ভাবে ভ্যাক্সিন নিতে হবে। ইমিউনোগ্লোবিউলিন নিতে হবে। আর কোন কারনেই না হোক, এ কারন ঘটলেও অন্তত হাসপাতালে যেতে হবে- এ তথ্যটা ছড়াতে হবে।
সামান্য সচেতনতাই যথেষ্ট। কুকুর হত্যা কোনো সমাধান নয়। ভ্যাক্সিন দেয়া হোক সব কুকুরকে। সবাই মিলে এ পৃথিবী। এক দানব দিয়ে আরেক দানব প্রতিস্থাপন করা কোনো সমাধান হতে পারে না।
আরো পড়ুনঃ জলাতঙ্কঃ চিকিৎসক যেখানে অসহায়