ফেসবুকে আমি কষ্ট এর কথা শেয়ার করতে চাইনা, কিন্তু জলাতঙ্ক এর এই ঘটনা শেয়ার করে সবাইকে সতর্ক করছি।
শিশুটির নাম আব্দুল্লাহ, মুন্সিগঞ্জ থেকে এসেছে।প্রথম দেখেই বই এ পড়া র্যাবিস বা জলাতঙ্ক এর সব কিছু চোখে ভাসছিল।
পানি খাবো,আমাকে পানি দাও। আর পানি দিলেই ভয় পাওয়া।
শিহরন জাগানিয়া পরিস্থিতি। কারন আমাকে এখন নিষ্ঠুর হতে হবে এই শিশুটির প্রতি। চিকিৎসক হয়েও বৃহৎ স্বার্থে শিশুটিকে ফিরিয়ে দিতে হবে খালি হাতে।আমি যে অসহায়।
আমার যে করার কিছুই নেই।
ঢাকা মেডিকেল এর শিশু ওয়ার্ড এ তিল ধারনের জায়গা নেই, এদিকে জলাতঙ্ক এর মত ভয়াবহ রোগী এখানে মারা গেলে তা হবে অন্যান্য সব শিশুদের জন্য খুব খুব ভয়ানক।
কারন আমি জানি, এ রোগের লক্ষন প্রকাশ পেয়ে গেলে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা শতভাগ।শিশুটিকে একটি বিড়াল কামড়ে দিয়েছিলো, তিন মাস আগে। এই কামড়ের জন্যে পাঁচটি ভ্যাক্সিন দেয়া উচিত ছিলো,গরীব বাবা মা দিয়েছে একটি।
বাংলাদেশে গরিব হয়ে জন্ম নেয়াটা কেন জানি আমার অভিশাপ মনে হয়।
থাক সে কথা, শিশুটির বাবা মা ভেবেছিল যেহেতু একটি ভ্যাক্সিন দেয়ার ফলে কিছু হয়নি, পরবর্তীতে হয়তোবা কিছুই হবেনা, আল্লাহ তো আছেই বাংলাদেশে, আর আছে সরকারী হাস্পাতাল।
আসলে টাকার অভাবেই তার বাবা মা আর ভ্যাক্সিন দেয়নি। পাঁচটি ভ্যাক্সিন দিতে একমাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা কে দিবে। সাড়ে ছয়শো টাকা দিয়ে র্যাবিপুর নামে একটি ভ্যাক্সিন দিয়েছে, এটাই তো বেশি।
শিশুটির বাবা মা এতটাই গরিব, এলাকা থেকে চাঁদা তুলে শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। শিশুটি কিছুক্ষন পরে মরে যায় বাড়ীতে নেবার পথে। খুব খারাপ লাগছিলো।
আর হাস্পাতালের আয়াদের ধমক দিচ্ছিলাম’ এক্ষুনি শিশুটি যেই বিছানায় শুয়েছে, যেখানে সে বমি করেছে তা ভালোভাবে এন্টিসেপ্টিক দিয়ে পরিষ্কার করার জন্যে।
জীবানু যাতে কোনভাবেই হাস্পাতালে আমার ওয়ার্ড এর আর কাউকেই আক্রান্ত করতে না পারে। বারবার মনে হচ্ছিল কি কষ্টই না পাচ্ছিলো শিশুটি।
এবার ফেসবুকে আমার নন মেডিকেল বন্ধুদের কিছু বিদ্যা বিতরন করি জলাতঙ্ক বিষয়ে;
শুধু যে কুকুর কামড়ালে জলাতঙ্ক হয় তা নয়, বিড়াল, শুকর, শেয়াল, বানর আরও অনেক প্রানী কামড়ালেও হয়।
ক্ষত জায়গা মানে যেখানে চামড়া নেই সেখানে এসব আক্রান্ত প্রানির স্যালাইভা বা লালা লাগলে এই রোগ হতে পারে।
এই রোগের জীবানু শরীরে প্রবেশ করে রোগের লক্ষন পেতে এক বছর পর্যন্ত লাগতে পারে, সাধারনত তিন মাস এর মধ্যেই রোগের লক্ষন প্রকাশ পায়, মাঝের সময় রোগীর শরীরে কোন লক্ষন নাও দেখা দিতে পারে।
লক্ষন :
প্রথমে কামড়ের জায়গায় সুই দিয়ে গুতোচ্ছে, জ্বলছে এরকম মনে হতে পারে, যখন মস্তিষ্কে আক্রমণ করে তখন প্রচন্ড পাগলামি শুরু করে। বোঝা যায় তার শরীরে খুব ব্যাথা হচ্ছে।
আর কনফার্ম হওয়া যায়,যখন দেখা যায় রোগী পানির পিপাসায় ভুগছে কিন্তু পানি কাছে আনলেই পানি ভয় পাচ্ছে এবং রোগি বাতাস এর উতপত্তি হচ্ছে যেমন ফ্যান দেখলে ভয় পাচ্ছে।
প্রতিরোধঃ
সাধারনত সুস্থ প্রানী স্পর্শ করলে, বা প্রানীকে খাওয়ালে ভ্যাক্সিন নেয়া লাগেনা,
তবে যেসব স্থানে জলাতঙ্ক এর প্রাদুর্ভাব বেশি, যারা এসব প্রানী নিয়ে কাজ করেন, আগে থেকেই চিকিৎসক এর পরামর্শ মত ভ্যাক্সিন নিয়ে নেয়া উচিৎ ।
যে প্রানী কামড় দেয়, তাকে ১০ দিন চোখে চোখে রাখতে পারলে ভালো। প্রানী টিতে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষন প্রকাশ পায় কিনা কিংবা প্রানীটি মরে গেছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে।
যদি উপরোক্ত লক্ষন প্রকাশ পায়, অবশ্যই প্রানীটির সংস্পর্শ এ থাকা সবাইকে ভ্যাক্সিন নিতে হবে।
সামান্য আচড়, যেখানে কোন রক্তপাত হয়নি, ভ্যাক্সিন নিতে হবে এবং আক্রান্ত জায়গা ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
এখানে এন্টি র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন নেয়ার প্রয়োজন নেই।
যদি বেশ গভীর কামড় কিংবা ক্ষত জায়গায় প্রানীর লালা লাগে, সেখানে অবশ্যই ভালোভাবে ধুতে হবে, ভ্যাক্সিন নিতে হবে এবং এন্টি ইমিউনোগ্লোবিউলিন নিতে হবে।
আক্রান্ত জায়গা ধুবেন কিভাবে- অনতি বিলম্বে অন্তত ১৫ মিনিট পরিষ্কার পানি প্রবাহে ধুতে হবে সাথে ডেটল, স্যাভলন,পভিডোন সলিউশন ব্যাবহার করতে হবে।
গভীর ক্ষত হলেও, না পারতে সেলাই করা যাবেনা । কারন এখানে রেগুলার ড্রেসিং জরুরী।
ভ্যাক্সিন কতটা:
ভ্যাক্সিন এর পাচটি ডোজ এর একটিও বাদ দেয়া যাবেনা। সময়মত নিতে হবে।প্রয়োজনে এন্টি র্যাবিস ইমুউনোগ্লোবিন নিতে হবে।
এতক্ষন অনেক বকবক করলাম।এবার কিছু বাস্তব প্রেক্ষাপট বলি।
খেয়াল করবেন, পথের শিশুরা রাস্তার কুকুর, বিড়াল দেখলেই কেন যেন উত্তেজিত হয়ে পড়ে, ঢিল মারে, তখন কুকুর কামড় দিয়ে বসে।
আবার যখন কুকুর বাচ্চা জন্ম দেয়, তখন মা কুকুর তার বাচ্চার আশেপাশে মানুষ দেখলেই উত্তেজিত হয়ে কামড় দিয়ে বসে।এক্ষেত্রে কুকুরের গতিবিধি ১০ দিন ব্যাপী পর্যালোচনা সম্ভব হয়না, আমাদেরকে এসব শিশুদের অবশ্যই সম্পুর্ন ভ্যাক্সিন এর ব্যবস্থা করতে হবে।
হতে পারে আপনার বাসার কাজের যে মহিলাটি কাজ করছে তার সন্তান কে কামড় দিয়েছে।
আজ ২৮ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস।
-Dr.Syed Muhammad Tawhid