ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছুদিন আগে হাইড্রক্সি ক্লোরো কুইনিন ( C18H26ClN3O) নিয়ে ব্যাপক হম্বিতম্বি শুরু করেছিল,মনে আছে? তার দাবি ছিল, এই হাইড্রক্সি ক্লোরো কুইনিন খেলেই করোনা সেরে যাবে। নিজের দেশে এই ওশুধ কম ছিল। ইন্ডিয়া থেকে হুমকি ধামকি দিয়ে এই ওশুধ আনার ব্যবস্থা করেছিলেন।
জানেন কি, এই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনিন উদ্ভাবনে অবদান ছিল খুলনার পাইকগাছার বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এর (১৮৬১-১৯৪৪)? তার প্রতিষ্ঠা করা বেংগল কেমিক্যালস বহুদিন ধরেই ম্যালেরিয়ার ওশুধ ক্লোরোকুইনিন এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনিন বানাচ্ছে। সেই উতপাদন এখনো অব্যাহত আছে। সেখান থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে এখন বিক্রি করা হবে । যদিও, বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা নিশ্চিত নন যে এই ওষুধ করোনা সারাতে পারবে কি না!
প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সেই জমানায় ইংল্যান্ডে স্কলারশিপ পেয়ে এডিনবরা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়েছিলেন। কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে আবার দেশেই ফেরত এসেছিলেন ( অবিভক্ত ভারতে). বাগেরহাটে পি সি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন বেংগল ক্যেমিকালস নামক বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। মারকিউরাস নাইট্রাইট ( HgNO2) সহ ১৭ টা নতুন রাসায়নিক পদার্থ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে আত্মপরিচয়ে পরিচিত করতে যে ক’জন মহাপুরুষ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের অন্যতম স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি শুধু রসায়নবিদ ছিলেন না , ছিলেন দার্শনিক, শিক্ষক, লেখক, শিল্পোদ্যোক্তা, সমবায়ী ও সমাজসেবক।
বৃটিশ গোয়েন্দ দপ্তরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নাম লেখা ছিল ‘বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী’। ১৯১৯ সালে ১৮ জানুয়ারি রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে টাউন হলে চিত্তরঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে এক সভা হয়। স্যার পিসি. রায় সেখানে যোগ দিয়ে বলেন—
‘আমি বৈজ্ঞানিক, গবেষণাগারেই আমার কাজ। কিন্তু এমন সময় আসে যখন বৈজ্ঞানিককেও দেশের আহবানে সাড়া দিতে হয়। আমি অনিষ্টকর এই আইনের তীব্র প্রতিবাদ করিতেছি।’
শিক্ষক হিসেবে তাঁর কিছু নিজস্ব দর্শন ছিল। রসায়ন তিনি এমনভাবে পড়াতেন যেন মনে হতো তিনি সাহিত্যের বিরাট কোনো উপাখ্যান বর্ণনা করছেন। তিনি বলতেন যে একজন শিক্ষক “সর্বত্র জয় অনুসন্ধান করিবে কিন্ত পুত্র ও শিষ্যের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়া সুখী হইবে।”
তাঁর আত্মচরিতে তিনি তাঁর শিক্ষকজীবন সম্পর্কে বলেন,
“প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার ২৭ বছর অধ্যাপনা জীবনে আমি সচেতনভাবে প্রধানত নিচের ক্লাসেই পড়াতাম। কুমোর যেমন কাদার ডেলাকে তার পচ্ছন্দমত আকার দিতে পারে হাই স্কুল থেকে সদ্য কলেজে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের তেমনি সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায়। আমি কখনও কোন নির্বাচিত পাঠ্যবই অনুসরন করে পাঠদান দিতাম না।”
পাঠ্যবইয়ের বাইরের জ্ঞানকে তিনি সবসময়ই প্রাধান্য দিতেন।শিক্ষক পিসি রায়ের অনেক ছাত্ররাই পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানী হিসেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সে কারনেই পিসি রায়কে বলা হতো “বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী।’’
তার কৃতি ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ড: মেঘনাথ সাহা, হেমেন্দ্র কুমার সেন, বিমান বিহারী দে, ড: কুদরত-ই-খুদা, প্রিয়দা ভন্জন রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায়, জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্র লাল দে, প্রফুল্ল কুমার বসু, বীরেশ চন্দ্র গুহ, অসীমা চ্যাটার্জী প্রমূখ। প্রেসিডেন্সি কলেজে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকও তাঁর ছাত্র ছিলেন।
তাঁর এই কর্মময় জীবনের নানান কীর্তির জন্য তিনি বেশকিছু সম্মাননা পেয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে প্রথমে ‘সিআইই (কম্প্যানিয়ন অফ ইন্ডিয়ান এম্পায়ার)’ এবং পরবর্তীতে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। দেশবিদেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছে সম্মানসূচক ডক্টরেট। আর শিক্ষকতায় অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য আমরা তাঁর নামের সামনে এখন লেখি ‘আচার্য।’
রবীন্দ্রনাথ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সম্পর্কে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন,
“বস্তুজগতকে প্রচ্ছন্ন শক্তিতে উদঘাটিত করে বৈজ্ঞানিক, প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর চেয়ে গভীরে প্রবেশ করেছেন কত যুবকের মনোলোকে। ব্যক্ত করেছেন তাঁর অনভিব্যক্ত দৃষ্টিশক্তি, বিচারশক্তি ও বোধশক্তি।”
অসাম্প্রদায়িক চেতনার চিরকুমার এই বিজ্ঞানী ১৯৪৪ সালের ১৬ জুন ৮৩ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে তার অর্জিত সমস্ত সম্পত্তি মানবকল্যানে দান করে গেছেন।
সেই ১৫৯ বছর আগে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় গরুর হাড় দিয়ে সুপার ফসফেট অফ লাইম বানাতে গিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন। ১৫৯ বছর পরে আমরা কি একটুও এগিয়েছি? নাকি আরো পিছিয়েছি? আজ আমরা চিটাগাং এ হিন্দু মন্দিরে গরুর হাড় আমরা রেখে দিচ্ছি জাত মারার জন্য ! দিল্লীতে গরুর মাংস ক্যারি করার সন্দেহে হাতুড়ি দিয়ে মহিষের মাংসের ব্যবসায়ীকে পিটাচ্ছি!
প্রফুল্লচন্দ্রের আবিষ্কার কে সহজেই আমরা গ্রহন করেছি।
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনিন খাচ্ছি। কিন্তু তার মতাদর্শ কে সহজে নিতে পারছি কি? তাঁর একটি উদ্ধৃতি দিয়েই বলি।
একবার প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন, “আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম, যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ।”
আজ, ২রা আগস্ট এই গুনী মানুষটার জন্মদিন। ১৫৯ বছর আগের এই দিনে তিনি জন্মেছিলেন অবিভক্ত ভারতের যশোর জেলায় ( বর্তমান খুলনার পাইকগাছার রাড়ুলি গ্রামে)
জন্মদিনে তার প্রতি অযুত শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র –
লিখাঃজহিরুল ইসলাম