রসায়নে এবার নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে যে তিনজনকে, তাদের একজন হলেন প্রফেসর বেরি শার্পলেস।
শার্পলেস সম্পর্কে আমি প্রথম জানতে পারি ২০০১ সালের নোবেল পুরস্কারের সংবাদ থেকে। তিনি সে বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন যে বিষয়ে, সে বিষয়টা গভীরভাবে বুঝতে পারি তার প্রায় ৮-৯ বছর পর।
যখন স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা শুরু করি তখন। এসিমেট্রিক ক্যাটালাইসিস—অর্গানিক কেমেস্ট্রির একটা গুরুত্বপূর্ণ শাখা। শার্পলেস ২০০১ সালে নোবেল পেয়েছিলেন সে শাখায়।
গত বছর (২০২১) যে দুজন কেমিস্ট নোবেল পেয়েছেন তারাও একই শাখায় নোবেল পেয়েছেন। তবে সেটাকে আরো স্পেসিফিক ভাবে আমরা বলি “এসিমেট্রিক অর্গানো ক্যাটালাইসিস”।
অর্থাৎ ধাতব মৌলের পরিবর্তে জৈব যৌগকে ক্যাটালিস্ট হিসেবে ব্যাবহার করে স্টেরিও সিলেক্টিভ বিক্রিয়ার পদ্ধতি। পিএইচডির সময় আমার শেষ দুইটা প্রজেক্ট ছিলো এসিমেট্রিক অর্গানো ক্যাটালাইসিসের উপর।
একটা কাজ পাবলিশ করেছিলাম JACS এবং অন্যাটা Angewandte Chemie জার্নালে।
শার্পলেস তার যে কাজের জন্য ২০০১ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, সেগুলো (এসিমেট্রিক এপক্সিডেশন ও হাইড্রক্সিলেশন) অনেক আগেই উচ্চতর পর্যায়ের টেক্সট বইয়ে জায়গা করে নিয়েছিলো।
মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্সে সেগুলো পড়তে হয়েছে। তখন তার কাজের সাথে পরিচয় হয়।
স্টকহোম ইউনিভার্সিটির অর্গানিক কেমেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সাথে বেরি শার্পলেসের একটা ভিন্ন সম্পর্ক আছে। পিএইচডির সময় সে ডিপার্টমেন্টের যিনি রিসার্চ হেড ছিলেন, প্রফেসর ইয়ান ব্যাকভাল, তিনি পোস্টডক করেছিলেন বেরি শার্পলেসের ল্যাবে।
ইয়ান ব্যাকভালের স্টুডেন্ট যিনি এখন রিসার্চ হেড, তিনিও পোস্টডক করেছেন শার্পলেসের সাথে। তাছাড়া আরো দুই-তিনজন প্রফেসর ছিলেন যারা শার্পলেসের সাথে কাজ করেছেন।
সুতরাং শার্পলেস সম্পর্কে যতটুকু বইয়ে পড়েছি, তারচেয়ে বেশি গল্প শুনেছি। সুপারভাইজরদের নিয়ে গল্প—সাইন্টিফিক এরিয়াতে এটা খুবই কমন একটা কালচার।
শার্পলেস কাজ করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্ট্রিটিউটে(TSRI)। স্ক্রিপস হলো বায়োম্যাডিকেল রিসার্চের জন্য জন্য দুনিয়ার বিখ্যাত এক প্রতিষ্ঠান।
২০০১ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কয়েক মাস আগে Angewandte Chemie জার্নালে তিনি একটা রিভিউ আর্টিকেল প্রকাশ করেন। সেই আর্টিকেলে প্রথম “ক্লিক বিক্রিয়া” টার্মটা ব্যবহার করেন।
বুঝানো হয়, এমন রাসায়নিক বিক্রিয়া উদ্ভাবন করতে হবে, যেটা হবে খুবই সিম্পল। অপারেশন হবে সহজ। বিক্রিয়ার সময় বাই প্রোডাক্ট তৈরি হবে কম, ইত্যাদি।
বিমানের সিটে বসে দুই পাশ থেকে বেল্ট নিয়ে বাঁধার সময় যেমন ক্লিক করে একটা শব্দ হয় এবং বেল্ট লেগে যায়, ঠিক তেমনই সহজ হতে হবে। সহজ কথায়, কাকলি ফার্নিচারের মতো—দামে কম মানে ভালো!
শার্পলেস ক্লিক বিক্রিয়ার স্বপ্ন দেখেছেন ঠিকই, কিন্তু তখনও (২০০১) সে ধরণের বিক্রিয়া তিনি উদ্ভাবন করতে পারেননি। ঠিক এক বছর পর (২০০২ সালের জুলাই মাসে) তার ল্যাব থেকে একটা রাসায়নিক বিক্রিয়ার পদ্ধতি Angewandte Chemie জার্নালে প্রকাশিত হয়।
এবং সে বছরের এপ্রিল মাসে, ডেনমার্কের একজন কেমিস্ট, মর্টেন ম্যালডাল ঠিক একই ধরণের বিক্রিয়ার পদ্ধতি প্রকাশ করেন। সহজ ভাষায় বিক্রিটা ছিলো, কপার মৌলকে ক্যাটালিস্ট হিসেবে ব্যবহার করে, ট্রাইয়াজল নামক যৌগ তৈরির বিক্রিয়া।
২০০১ সালে শার্পলেস নোবেল পেলেন। সে বছরই ক্লিক বিক্রিয়ার স্বপ্ন দেখলেন। তার পরের বছরই একটা ক্লিক বিক্রিয়া তার ল্যাবে উদ্ভাবিত হলো। —কিএক্টাঅবস্থা!
এদিকে প্রফেসর ক্যারোলিন বার্টোজি চিন্তা করলেন, রাসায়নিক বিক্রিয়াকে শুধুমাত্র গ্লাস ভায়াল (শিশি) বা টিউবে না করে, লিভিং বডিতে করা যায় কিনা! আমাদের শরীরে তো অসংখ্য রাসায়নিক বিক্রিয়া হচ্ছেই।
তাহলে ল্যাবরেটরির রাসায়নিক বিক্রিয়াকে কি করে লিভিং বডিতে করা যায়! সেটার একটা নামও তিনি দিলেন—বায়ো অর্থগোনাল (Bio-orthogonal)!
অর্থাৎ যে সকল রাসায়নিক বিক্রিয়াকে কোন প্রকার সমস্যা ছাড়া লিভিং বডিতেও করা যায়, সেগুলো হলো বায়ো অর্থগোনাল রিয়েকশন। মূলত লিভিং বডি হলো গ্লাস ভায়ালের তুল্য।
রিয়েকশনকে গ্লাস ভায়ালে না করে লিভিং সিস্টেমে রান করা। বার্টোজি দেখলেন, শার্পলেস এবং ম্যালডাল যে বিক্রিয়ার উদ্ভাবন করেছেন, সেটাকে লিভিং সিস্টেমে করে গবেষণার নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানা যায়।
শার্পলেস এবং ম্যালডাল ট্রাইয়াজোল নামাক রাসায়নিক যৌগ তৈরি করলেন কাঁচের শিশিতে (গ্লাস ভায়াল)। আর বার্টোজি কাঁচের শিশি ব্যবহার না করে, সে বিক্রিয়া করলেন জীবন্ত বস্তুর মধ্যে।
বিশ বছর পর নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনজন। শার্পলেস রাসায়নে দুইবার নোবেল পেলেন।
এ বছর রসায়ন নোবেল পুরস্কার ঘোষণার শিরোনামে দুইটা কি ওয়ার্ড ছিলো—ক্লিক রিয়েকশন ও বায়ো-অর্থগোনাল। ভবিষ্যতে আরো অনেক বিক্রিয়াই তৈরি হবে যেগুলোকে ক্লিক বিক্রিয়া বলা যাবে।
বলা যাবে বায়ো-অর্থগোনাল বিক্রায়াও। তাদের কাজ কনসেপচুয়ালি দুইটা শাখারও জন্ম দিয়েছে।
…………………
Rauful Alam
গবেষক