আজ থেকে প্রায় ১৩.৭৫ বিলিয়ন বছর আগে এই মহাবিশ্ব একটি অতি ঘন এবং উত্তপ্ত অবস্থা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরে ধীরেধীরে তৈরি হয়েছে সকল পদার্থ, কণা ও প্রতিকণা।
আরো সময় নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন গ্রহ, নক্ষত্র ও ছায়াপথ। এই তত্ত্বকে বলা হয় বিগ ব্যাগ তত্ত্ব বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব।
এক কথায় বলতে হলে, একটি বিন্দু থেকে (বিস্ফোরিত হয়ে) আমাদের এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে বিগ ব্যাং তত্ত্বই সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য। এই বিগ ব্যাং তত্ত্বের প্রবক্তা জর্জ লেমিত্রি।

১৯২৭ সালে তিনি প্রথম এই তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। অনেকেই মনে করেন বিগ ব্যাং তত্ত্বের প্রবক্তা স্টিফেন হকিং।
এটা ভুল ধারণা। স্টিফেন হকিং পরে বিগ ব্যাং তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রথম ধারণা দেন জর্জ লেমিত্রি।
যাইহোক, আজ আমরা বিগ ব্যাং তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করবোনা। আজকের আলোচনার বিষয় জর্জ লিমিত্রি। আজ এই মহান বিজ্ঞানীর জন্মদিন।
জর্জ হেনরি জোসেফ এডোয়ার্ড লেমিত্রি ১৮৯৪ সালে ১৭ জুলাই বেলজিয়ামের চারলেরোই শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
লেমিত্রির পিতা জোসেফ লেমিত্রি এবং মাতা মাগুয়েরাইট ল্যানয়। ১৯১১ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির জন্য লুভাইনের ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন লেমিত্রি।
তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। ১৯১৪ সালে স্নাতক পড়া অবস্থায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
যুদ্ধকালীন সময়ে প্রথমে বেলজিয়ামের সেনাবাহিনীর সাথে সেচ্ছাসেবকের কাজ করেন। পরে সেখানেই অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন লেমিত্রি।
যুদ্ধে তিনি বীরের মত লড়াই করেছিলেন। সে জন্য বেলজিয়াম সরাকার থেকে তাকে সম্মান সূচক পদক ‘ওয়ার ক্রস’ দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু যুদ্ধের ময়দানের হত্যাকাণ্ড লেমিত্রিকে গভির ভাবে অস্থির করে তোলে। এই যুদ্ধই তাঁর জীবনে পরিবর্তন এনেছিল।
যুদ্ধের পরে তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। আবার শুরু করেন পড়াশুনা। এবার অবশ্য গণিতের প্রতি ঝোঁকটা আগের তুলনায় বেড়ে যায়।
১৯২০ সালে ‘অ্যাপ্রক্সিমেশন ডেস ফোনেশনস ডি প্লাসিওয়েস ভেরিয়েবল রেলস’ নামে একটি থিসিস পেপার জমা দেন। একই বছর তিনি গণিতে ‘ডক্টর এন সায়েন্স’ ডিগ্রি লাভ করেন।
যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর জীবনে আরো একটি পরিবর্তন ঘটে। ১৯২৩ সালে তিনি মাইসিন সেন্ট রোম্বাট নামে একটি মিশনারিতে ভর্তি হন।
ফলে তাঁর নামেও আসে পরিবর্তন। জর্জ লেমেত্রি পরিবর্তন হয়ে হয় অ্যাবে লেমিত্রি।
লেমেত্রি বরাবরই গনিতে ভালো ছাত্র ছিলেন। এবার তিনি গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যার দিকে ঝুঁকলেন।
ম্যালিন শহর ছেড়ে ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে চলে আসেন ক্যামব্রিজে। এখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেলেন আর্থার এডিংটনকে। ক্যামব্রিজ শেষ করে আসেন হাবার্ড কলেজে।
১৯২৫ সালে লুভাইন ক্যাথোলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালিন প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন লেমিত্রি। এই কলেজ থেকেই এক সময় ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়েছিলেন তিনি।
প্রভাষকের দায়িত্ব নিলেও তিনি বেশিরভাগ সময় কাটাতেন হার্ভার্ডে এবং আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে।
দুই বছর পর ‘দ্য গ্রাভিটেশনাল ফিল্ড এন আ ফ্লুইড’ নামে একটি থিসিস জমা দেন এমআইটিতে (MIT). সে বছর ১৯২৭ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
লেমিত্রির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন Harlow Shapley (যিনি ছায়াপথে সূর্যের অবস্থান নির্ণয় করেছিলেন)।
লেমিত্রি হাবার্ড, এমআইটি ও লুভেইনে আংশিক গবেষণা করেছিলেন।
এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে একই বছর Un Univers homogène de masse constante et de rayon croissant rendant compte de la vitesse radiale des nébuleuses extra-galactiques একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন।
এই গবেষণা পত্রটি পরে লেমিত্রিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। এই পেপারে তিনি বর্ণনা করেন, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। ১৯২৭ সালে তাঁর এ ধরনের চিন্তাধারা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
১৯২৭ সালে বিখ্যাত সলভয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে বেশিরভাগ শীর্ষস্থানীয় পদার্থবিদরা অংশ নিয়েছিলেন।
সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইনও।
আইনস্টাইন বললেন, লেমেত্রি তাঁর বইয়ে যে ধরনের সমাধান উল্লেখ করেছেন তা ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান করেছিলেন। তবে আইনস্টাইন আরো বলেছিলেন,
‘যদিও আমি মনে করেছিলাম সাধারণ আপেক্ষিকতার ক্ষেত্রে লেমিত্রির সূত্রগুলো গাণিতিকভাবে সঠিক, তবে তা বাস্তবে অসম্ভব। লেমেত্রির গণনা সঠিক, তবে পদার্থবিদ্যার জন্য জঘন্য।’
আইনস্টাইনই যে শুধু লেমিত্রির ধারণাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করতেন তা কিন্তু নয়। সে সময়কার প্রায় সকল বিজ্ঞানী এই একই কথা বললেন।
লেমিত্রির সমাধান পদার্থবিদ্যায় খাটেনা। যেখানে স্বয়ং আইনস্টাইন লেমিত্রির সমাধান গ্রহনযোগ্য মনে করছেন না সেখানে লেমিত্রির আর আশা থাকে কি করে।
এর অন্যতম কারণ, তখনো বিজ্ঞনীরা মনে করতেন মহাবিশ্ব স্থির। আইনস্টাইন লেমিত্রির প্রসারিত মহাবিশ্বের ধারণা মানতে পারেননি।
দুই বছর পর আশার আলো হয়ে দেখা দিল হাবলের বিস্তৃত মহাবিশ্বের ধারনা। বড়সড় ধাক্কা খেলেন বিজ্ঞানীরা।
লেমিত্রির এক সময়কার শিক্ষক আর্থার এডিংটনের তখন রয়েল সোসাইটির সভাপতি। এডিংটন ও রয়েল সোসাইটির অন্যান্য সদস্যারা তখন এর সমাধান করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন।
কাজের কাজ কিছুই হলোনা।
লেমিত্রি তখন ১৯২৭ সালে লেখা তাঁর একটি কপি এডিংটনকে পাঠান। সেই পেপার পরে এডিংটনের চোখ ছানাবড়া।
এই পেপারেই তো আছে সমস্যার সমাধান। তিনি তৎক্ষনাক এর ইংরেজি অনুবাদ করান এবং ১৯২৯ সালের মার্চে প্রকাশ করেন।
লেমিত্রির তত্ত্বের একটি বিষয় কেউ মানতে চাইছিল না। লেমিত্রি বলেছিলেন, মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হয়েছে।
কিন্তু অন্য বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ছিল, মহাবিশ্বের কোন শুরু আর শেষ নেই।
মহাবিশ্ব সব সময়ই ছিল। এটাই ছিল বিগ ব্যাং তত্ত্বের প্রথম সুস্পষ্ট ধারনা। তবে বিগ ব্যাং নামটা কিন্তু লেমিত্রির দেওয়া না।
ধীরেধীরে প্রায় সকল বিজ্ঞনী বিগ ব্যাং তত্ত্বে বিশ্বাস করলেও ফ্রেড হোয়েল বিশ্বাস করতেন না।
১৯৫০ সালে এক রেডিও সম্প্রচারে তিনি উপহাস করেই লেমিত্রির তত্ত্বকে বিগ ব্যাং বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
সেখান থেকেই এই তত্ত্বের নাম হয় বিগ ব্যাং তত্ত্ব।
আইনস্টাইন প্রথমে লেমিত্রির তত্ত্বকে অস্বীকার করলেও হাবলের আবিষ্কার প্রকাশিত হওয়ার পরে তিনি দ্রুত এবং প্রকাশ্যে লেমিত্রির তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন।
তত্ত্ব এবং এর প্রস্তাবদাতা উভয়কেই দ্রুত স্বীকৃতি পেতে সহায়তা করেছিলেন। সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্বের তত্ত্বকে কাজে লাগানোর পথিকৃৎ ছিলেন লেমিত্রি।
আইনস্টাইন ও লেমিত্রি ক্যালিফোর্নিয়ায় একাধিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালের এক বক্তৃতায় লেমিত্রি বিগ ব্যাং তত্ত্ব আলোচনা করার পরে আইনস্টাইন উঠে বলেন,
‘এটা আমার শোনা সবচেয়ে সুন্দর এবং সন্তোষজনক ব্যাখ্যা’।
১৯৩৩ সালে লেমিত্রি পুনরায় গবেষণা শুরু করেন। তাঁর সেই গবেষণা পত্রটি এম এ এইচ ম্যাককালাম ইংরেজীতে অনুবাদ করে ১৯৯৭ সালে প্রকাশ করেছিলেন।
সেই বছর করা লেমিত্রির গবেষোণাপত্র বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ধীরেধীরে তাকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মহাকাশতত্ত্ববীদ হিসেবে চিনতে শুরু করে মানুষ।
নিউইয়র্ক টাইমস আইনস্টাইন ও লেমিত্রির একত্রে থাকা একটি ছবি প্রকাশ করে ক্যাপশন দিয়েছিলো, একে অপরের প্রতি রয়েছে তাদের গভীর শ্রদ্ধা ও প্রশংসা।

লেমিত্রি একই সাথে একজন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী ছিলেন আবার একজন ক্যাথোলিক যাজক ছিলেন। এ কারনে সমস্যাও পড়তে হয়েছিল তাকে।
১৯৫১ সালে পোপ পিয়াস লেমিত্রির গবেষণাকে ধর্ম বিরোধী বলে ঘোষণা দেন। লেমিত্রি তাঁর বিরোধীতা করে বলেন, এই তত্ত্বটি নিরপেক্ষ। ধর্ম ও এই তত্ত্বের মধ্যে কোন যোগসূত্র বা দ্বন্দ নেই।
পোপের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড্যানিয়েল ও’কনেল লেমিত্রিকে বিশ্বজগতের ব্যাপারে ঘোষণা বন্ধ করতে প্রচরিত করেছিলেন।
লেমিত্রি একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক ছিলেন। তবে বিজ্ঞানের সাথে ধর্মকে মিশ্রিত করার বিরোধিতা করেছিলেন।
তিনি সে সময়কার টিভি চ্যানেলের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন। লেমিত্রির মতে, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
লেমিত্রি বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৩৪ সালের ফ্রান্সকুই পুরস্কার । এই পুরস্কার বেলজিয়ামের সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানীক সম্মান।
লেমিত্রির হাতে পুরস্কার দিয়েছিলেন রাজা তৃতীয় লিওপোল্ড। ১৯৩৬ সালে তিনি পন্টিফিকাল একাডেমি অফ সায়েন্সে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
এখানেই ১৯৬০-৬১ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তিনি ১৯৪১ সালে রয়্যাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস অ্যান্ড আর্টস অফ বেলজিয়ামের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৪৬ সালে তাঁর বই ‘দ্য প্রাইভাল এটম হাইপোথিসিস’ প্রকাশিত হয়। বইটি সেই বছর স্প্যানিশ ও ১৯৫০ সালে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।

১৯৫১ সালে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি কর্তৃক প্রথম অ্যাডিংটন মেডেল লাভ করেন জর্জ লেমিত্রি।
প্রথম তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে ১৯৫৪ সালে নোবেলের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। মৌলিক পরমাণু তত্ত্বের জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি কোন বারেই নোবেল পাননি।
আগেই বলেছি, ১৯২৫ সালে লুভাইন ক্যাথোলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালিন প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন লেমিত্রি।
দুই বছর পর ১৯২৭ সেখানেই প্রফেসর হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ক্যারিয়ারের বাকী দিনগুলো এই বিশ্ববিদ্যালয়েই কর্মরত ছিলেন।
লেমিত্রি তার পুরো ক্যারিয়ার ইউরোপে কাটিয়েছেন। তাই তার বৈজ্ঞানিক কাজ-কর্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাবল বা আইনস্টাইনের মতো তেমন পরিচিত ছিল না।
তা সত্ত্বেও, লেমিত্রির এই তত্ত্ব বিশ্বজগতের গতিপথ পরিবর্তন করেছিল।
২০ জুন ১৯৬৬ সালে বেলজিয়ামের নিজ জন্মস্থানে শেষ নিঃশ্বাস তাগ করেন জর্জ লেমিত্রি।
সূত্র: ম্যাথ হিস্ট্রি ডট এসটি