গণিতে নোবেল দেওয়া হয় না। তাতে কী? আবেল পুরস্কার আছে না! গণিতের সর্বোচ্চ পদক আবেল। আবেল ইতোমধ্যেই গণিতের নোবেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
বিজ্ঞান নোবেলে যেমন নারীদের খরা, আবেলেও এতদিন তেমনটাই ছিল। ১৬ বছরের আবেল ইতিহাসে এবারেই প্রথম একজন নারীর হাতে উঠলো গণিতের সর্বোচ্চ এই পুরষ্কার।
মার্কিন অধ্যাপক কারেন কেসকালা উলহেনবেখ বিশ্লেষণ, জ্যামিতি ও গাণিতিক পদার্থবিদ্যার মধ্যে সেতুবন্ধনে অবদান রাখায় নরওয়ে সরকার উলহেনবেখকে এই পুরষ্কারের জন্য নির্বাচন করেছেন।
২০১৯ সালের ১৯ মার্চ দ্য নরওয়ে অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স অ্যান্ড লেটারস এ বছর আবেলজয়ী হিসেবে কারেনের নাম ঘোষণা করে। প্রতিবছর গণিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এক বা একাধিক বেক্তিকে এই পুরষ্কার দেওয়া হয়।
২০০৩ সাল থেকে নরওয়ে সরকার আবেল পুরষ্কার চালু করেছে। নরওয়ের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ নিলস হেনরিক আবেলের ২০০ তম জন্মদিনের (১৮০২-১৮২৯) সম্মানে এই পুরষ্কার প্রবর্তণ করা হয়েছে।
প্রথম তিন বছর ২ জন করে গণিতবীদ এই পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত একজন করে পেয়েছে এই পুরষ্কার। এর মধ্যে নারী এই প্রথমবার।
৭৬ বছর বয়সী কারেন কেসকালা ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে দীর্ঘ তিন দশক ধরে অধ্যাপক থাকাকালীন সময়ে গণিত নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বর্তমানে ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি এর ভিজিটিং প্রফেসর। পাশাপাশি তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র গবেষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
আবেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ বছর জ্যামিতিক আংশিক অন্তরীকরণ সমীকরণ, গজতত্ত্ব ও যোগজীকরণযোগ্য পদ্ধতিতে যুগান্তকারী অর্জনের স্বীকৃতি স্বরুপ উলহেনবেখকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে।
জ্যামিতি ও গাণিতিক পদার্থবিদ্যায় কিভাবে সেতু বন্ধন করেছেন কারেন? সাবানের ফেনা নিয়ে কাজ করতে করতে এই অসাধ্য সাধন করেছেন কারেন উলহেনবেখ। আমরা সাধারণত চার মাত্রার সাথে বেশি পরিচিত।
ডাইমেনশন বা মাত্রা বলতে কোন স্থান বা বস্তুর প্রতিটি বিন্দুকে নির্দিষ্ট করতে সর্বনিম্ম যতগুলো স্থানাংকের প্রয়োজন হয় তাকে বুঝায়। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এবং সময় এই চার মাত্রা বা ডাইমেনশনের সাথে আমরা বেশি পরিচিত।
এর মধ্যে প্রথম তিনটি মাত্রা বাস্তবে দেখা মিললেও চতুর্থ মাত্রা বা সময়কে আমরা দেখি না। সময় ধরা ছোয়ার বাইরে। এমনকি সময়কে অনুভবও করা যায় না। কিন্তু মহাবিশ্বতো আর চারটি মাত্রা নিয়ে বসে নেই। মহাবিশ্বের এখন পর্যন্ত ১০ মাত্রিক বলে আমরা জানি। চার মাত্রার বেশি হলে তাকে বহুমাত্রিক বলা হয়।
এবার কাজের কথায় আসা যাক। চার ডাইমেনশনাল মহাবিশ্বে সাবানের ফেনা কেমন হয় তা আমরা জানি। কিন্তু বহুমাত্রিক মহাবিশ্বে সাবানের ফেনার আকার দেখতে কেমন তা কারেন উলহেনবেখই প্রথম দেখিয়েছেন।
সমতলের কাছকাছি থাকা দুটি বিন্দুকে যোগ করলে একটি সরলরেখায় পরিণত হবে। এই সরলরেখা একমাত্রিক। কিন্তু সমতলের পরিবর্তে বিন্দু দুটি পৃথিবীর উপরে কোনো স্থানে হলে তা আর সরলরেখা থাকবেনা। বরং বৃত্তের ব্যাসে পরিণত হবে। এই ব্যাসই দ্বিমাত্রিক (2D)।
আর সাবানের ফেনা বা বুদবুদ হলো ত্রিমাত্রিক (3D)। এখানেই (ত্রিমাত্রিকে) দেখা মিলবে বিভিন্ন জটিলতার। মাত্রা যত বাড়বে, জটিলতাও তত বাড়বে। এই জটিলতারই সমাধান করেছেন কারেন উলহেনবেখ।
সেই সমাধানে যাওয়ার আগে জানতে হবে সাবানের ফেনা কেন গোলকের আকার হয়? কোন বস্তু যত বেশি যায়গা দখল করে তার পৃষ্ঠটান তত বেশি। পৃষ্ঠটানকে কমাতেই সাবানের ফেনা গোলকের আকার ধারন করে। ফলে একটি নির্দিষ্ট আয়তনের সমচেয়ে কম জায়গা নিয়ে সাবানের ফেনা নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে।
কিন্তু সাবানের ফেনাকে যখন চারপাশ থেকে আরো কয়েকটি সাবানের ফেনা ধাক্কা দেয়, তখন বাধে বিপত্তি। ধাক্কা খেয়ে সাবানের ফেনার চেহারায় ব্যাপক অদলবদল ঘটে। এতকিছুর পরও সাবানের ফেনা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সামান্য যায়গাটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করে। এই ঘটনাটাই দেখিয়েছেন কারেন উলহেনবেখ।
কারেনের দেখানো পথ ধরেই গড়ে উঠেছে কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ভিত। এভাবেই জ্যামিতি, বিশ্লেষণ আর গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে সেতু বন্ধন করেছে কারেন।
২১ মে অসলোতে কারেনের হাতে পুরষ্কার তুলে দেন নরওয়ের পঞ্চম রাজা হেরাল্ড। আবেলের অর্থমূল্য ৬০ লক্ষ নরওয়েজীয় ক্রোনা। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ।
কারেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আবেলের জন্য আমাকে মনোনীত করেছে। আমি খুবই খুশি আমার আবিষ্কার নিয়ে। আমার এই পুরষ্কার নারীদের গণিতের প্রতি আগ্রহ বাড়াবে। নারী পুরুষের বৈষম্য কমবে। নারীরা এগিয়ে যাবে তাদের আপন শক্তিতে।’
সূত্র: ফিজিক্স ডট ওআরজি