মাইকেল ফ্যারাডেের জন্ম ১৭৯১ সালের ২২ সেপেটম্বর ইংল্যান্ডের নিউটন বাটসে। তাঁর পিতা জেমস পেশায় ছিলেন একজন কামার। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করলেও দারিদ্র্যতা তাকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত যাত্রা পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি।
এ দারিদ্র্যতার কারণে তাঁর বাবা জেমস লন্ডনের এক পুরনো আস্তাবলে গিয়ে সপরিবারে বাসা বাধলেন অর্থ উপার্জনের টানে। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এখানেও তাঁদের পরিবারকে নিদারুণ অসচ্ছলতার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। বরং আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগল। এরই মাঝে মাইকেল ফ্যারাডেকে তাঁর জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু তাই বলে তার অদম্য জ্ঞান-পিপাসা কখনো থেমে থাকে নি।
মাইকেল ফ্যারাডেকে ওঠে আসতে হয়েছে একটি দরিদ্র পরিবার থেকে। বাড়ির সন্নিকটে একটি প্রাথমিক স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু এবং সমাপ্তি ঘটে।ফ্যারাডের উচ্চারণে সমস্যা ছিলো। তিনি “র” উচ্চারণ করতে পারতেন না।
এটা নিয়ে সবখানে হাসাহাসি হতো, স্কুলেও। সামান্য যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ শেখা পর্যন্তই ছিলো তার গণিতবিদ্যার দৌড়! অর্থাৎ আর্থিক অনটনের কারণে তাঁকে মাঝ পথেই স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। সে সময় তাঁর প্রতিভার কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় নি। ভবঘুরের মত সময় কাটাত ফ্যারাডে। সেই সঙ্গে তাঁর কাজ ছিল ছোট তিন বোনকে দেখাশুনা করা।
মাত্র তের বছর বয়সে তাঁকে অভাবের তাগিদে কাজে ঢুকতে হলো। জর্জ নামক এক ভদ্রলোকের বইয়ের দোকানে কাজ নিল মাইকেল ফ্যারাডে। সেখানে তাঁর কাজ হচ্ছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বিভিন্ন স্থানে বাড়ি বাড়ি ফেরি করা। সকাল থেকে তাঁকে এই কাজে ব্যস্ত থাকতে হতো। আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে বই পড়ার কাজে মনোনিবেশ করতেন।
এরপর তাঁর কাজের ধরন পরিবর্তন হলো। বই বাঁধাইয়ের কাজ পেলেন। এতে আয় কমে গেল। এখানে আগের চেয়ে পরিশ্রম অনেক কম। ফলে কাজের ফাঁকে জ্ঞান অর্জনের কাজে আরো মনোনিবেশ করলেন নিজেকে। বিজ্ঞান বিষয়ের বইগুলো বেশি আগ্রহের সাথে পড়তে লাগলেন।
এর মধ্যে দুটি বই তাঁকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করলো। একটি হচ্ছে মার্শেটের লেখা কনভারসেশনস ইন কেমিষ্ট্রি। অন্যটি হচ্ছে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার বিদ্যুৎ সন্বন্ধীয় প্রবন্ধগুলো।
মজার কথা, মাইকেল ফ্যারাডে একদিন নিজেই উদ্যোগী হয়ে গবেষণার জন্য ল্যাবরেটরি তৈরি করে ফেললেন নিজ বাড়িতে। আর এটা সম্ভব হলো হাত খরচার পয়সা বাঁচিয়ে গবেষণার জন্য দু’একটা করে জিনিস কেনার মাধ্যমে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ফেলে দেওয়া আবর্জনা থেকে তৈরি করে নিতেন কিছু উপকরণ।
তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে কোন বক্তৃতা হলে তা শোনার জন্য কৌতূহলী হতেন। একদিন বক্তৃতা শোনতে যাবেন কিন্তু সমস্যা দেখা দিল। পরে দোকানের মালিক তাঁর ইচ্ছার কথা জানতে পেরে ছুটি মঞ্জুর করলেন। টিকেটের দাম পেলেন ভাইয়ের নিকট হতে। এই বক্তৃতা শুনে মাইকেল ফ্যারাডের মনে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হলো। তার মনোজগতে নতুন দিগন্তের সূচনা হলো।
কিছুদিনের জন্য বই বাঁধাইয়ের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। এবার দুর্ভাগ্য যেন তাঁদের পরিবারে বাসা বাঁধল। অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হলো। আর্থিক দৈন্যতা ও অসুস্থতার কারণে তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করলেন। মায়ের শারীরিক অবস্থাও ভাল ছিল না। ভাইয়ের চাকরিটা চলে গেল। আর মাইকেল ফ্যারাডে উপার্জনের জন্য মরিয়া হয়ে ছুটে বেড়াতেন। তবুও আশার কথা কিছুদিন পরে বই বাঁধাইয়ের পুরোনো চাকরিটা ফিরে পেলেন।
নামকরা বিজ্ঞানী স্যার হামফ্রি ডেভি তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। তখন ফ্যারাডের বয়স মাত্র ২১ বছর। একদিন স্যার হামফ্রির বক্তৃতা হবে। দোকানের এক খরিদ্দার এই বিখ্যাত বিজ্ঞানীর চারদিনের বক্তৃতার টিকিট দিয়ে গেল। দোকানের মালিক জর্জ বিজ্ঞান বিষয়ে ফ্যারাডের আগ্রহের কথা জানতেন।
সবক’টি টিকিট তাঁকে দিয়ে দিলেন। বক্তৃতা শুনে তাঁর মনের গভীরে বৈপ্লবিক আলোড়ন সৃষ্টি হলো। ফলে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আর বই বাঁধাইয়ের কাজ নয়, বিজ্ঞানই হবে তাঁর জীবনের কাঙ্ক্ষিত সোপান।
কিন্তু কিভাবে এই সিদ্ধান্ত সফল করা যায়। রয়াল সোসাইটির সভাপতি বিজ্ঞানী স্যার হামফ্রির নিকট চিঠি লিখলেন। তিনি লিখলেন তাঁর মনের গভীর আকুতি ও আগ্রহের কথা। উদ্দেশ্য হচ্ছে বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁকে গবেষণার কোনো সুযোগ করে দেওয়া।
অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে স্যার হামফ্রি ডেভির চিঠির প্রত্যুত্তর পেলেন। এই চিঠিতে স্যার ডেভির নিকট হতে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ তাকে খুবই আলোড়িত করল। এদিকে মাইকেল ফ্যারাডে-এর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে মুগ্ধ হলেন স্যার ডেভি। তিনি উপলদ্ধি করলেন বিজ্ঞানের প্রতি মাইকেল ফ্যারাডের তীব্র আগ্রহ।
তাঁকে সেখানে নিজের গবেষণাগারে চাকরি দিলেন। এখানে ছোট চাকরি পেলেও এই চাকরি তাঁর জীবনে সৌভাগ্যের দ্বার খুলে দেয়। এই সুযোগই মাইকেল ফ্যারাডের আমূল পরিবর্তন আনল। ফ্যারাডের মাঝে যে সুপ্ত প্রতিভা ছিল তা ক্রমেই বিকশিত হতে লাগল। দেশ ভ্রমণ ফ্যারাডের এক উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভ্রমণকালীন সময়ে তিনি স্যার ডেভির সহকারী হিসেবে বহু পণ্ডিত মনীষীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেলেন।
স্যার ডেভি ছাড়াও এসব বিজ্ঞানীদের সাহচর্যে তার জীবনে ব্যাপক সাফল্যের সূচনা ঘটল।
তিনি ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ফ্রান্স, ইতালিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ইতালি ভ্রমণের সময় সাক্ষাৎ ঘটল খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ভোল্টারের সঙ্গে। তিনি তখন বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এবার ফ্যারাডে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত গবেষণার প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন।
১৮৮৫ সালে বিদেশ ভ্রমণ শেষে ফিরে এলেন তিনি। এবার মাইকেল ফ্যারাডে রয়াল সোসাইটিতে একজন গবেষক হিসেবে যোগ দিলেন। এটি ছিল মাইকেল ফ্যারাডের জীবনে এক বিশাল প্রাপ্তি।
নিজের আবিষ্কারটাকে তিনি সবার কাছে প্রচার করলেন। কিন্তু সেটার পেছনে কোনো গাণিতিক ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। কারণ, সেই যে ছোটোবেলায় তিনি দারিদ্র্যে ভুগেছিলেন, ঐ যে তিনি স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন। গণিতের জটিলতা তিনি কখনোই বুঝে উঠতে পারেননি।
তাই প্রায় সবাই ফ্যারাডের কথাগুলোকে প্রমাণ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালো। কেউ কেউ খোঁচা মারতেও ছাড়লো না। এমন সময় তার সাহায্যে এগিয়ে এলেন মোটামুটি সুপরিচিত একজন তরুণ গণিতবিদ, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল।তিনি মনে করলেন, ফ্যারাডের এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে চোখ ধাঁধানো।
তিনি বসে গেলেন, এই চৌম্বকক্ষেত্রের বিস্তারটাকে একটা গাণিতিক রুপ দেয়ার জন্য। লিখে ফেললেন, On Physical Lines of Force.সেটার পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দিলেন মাইকেল ফ্যারাডের কাছে। তিনি আবিষ্কার করলেন ক্লোরিন গ্যাসের তরলীকরণ তড়িৎ বিশ্লেষণের সূত্র।
একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ল ক্রমশ। মূলত তাঁর গবেষণার মূল বিষয় ছিল রসায়ন বিজ্ঞান এবং তড়িৎ রসায়ন বিজ্ঞান। সেই সময়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার আমন্ত্রণ পেলেও তিনি গবেষণাকে প্রাধান্য দিলেন। গবেষণার কাজে আরো গভীরভাবে মনোনিবেশ করলেন।
তাঁর একটি বিখ্যাত আবিষ্কার হচ্ছে সেফটি ল্যাম্প যা খনি শ্রমিকরা আলোর কাজে ব্যবহার করত। তিনি একদিন কয়েক মুহূর্তের জন্য কাঁচা লোহা তারের সাহায্যে চুম্বক শক্তিতে বিদ্যুৎ প্রবাহের সৃষ্টি করলেন। তার কিছুদিন পরে প্রস্তুত করলেন প্রথম ডায়নামো যার নাম দিলেন ‘ম্যাসানো ইলেকট্রিক মেশিন’।
১৮৪১ সালে তিনি তাঁর যুগান্তকারী তত্ত্ব আলোকের উপর চৌম্বকত্বের প্রভাব আবিষ্কার করলেন। আর এর উপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল আবিষ্কার করেন বিদ্যুৎ চুম্বকীয় সমীকরণ। এর ফলশ্রুতিতে মানুষ লাভ করল কোনো তারের সংযোগ ছাড়াই বেতার টেলিগ্রাফ যোগাযোগ।
তিনি প্রতিষ্ঠা করেন যে, চুম্বকত্ব আলোক রশ্মিকে প্রভাবিত করে এবং এই দুই প্রত্যক্ষ ঘটনার মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত সম্পর্ক রয়েছে।
আলবার্ট আইনস্টাইন তার পড়ার ঘরের দেয়ালে কেবল তিনজনের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছিলেন – আইজ্যাক নিউটন, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, আর তৃতীয় জন – যাকে নিয়ে আজ আমাদের গল্প – মাইকেল ফ্যারাডে। মহান বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডকে চেনেন তো?
তিনি মাইকেল ফ্যারাডেকে নিয়ে বলেছিলেন, “আমরা যদি ফ্যারাডের আবিষ্কারের বিশালতা ও ব্যাপ্তি কল্পনা করি এবং সেইসাথে বিজ্ঞান ও শিল্পের উপর তার প্রভাব লক্ষ্য করি, তাহলে দেখা যাবে যে তাঁকে দেওয়ার মত বড় মাপের কোন সম্মাননা খুঁজে পাওয়াই ভার, সর্বকালের সেরা আবিষ্কর্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন এক সত্ত্বা।”
জীবিত থাকা অবস্থায় মাইকেল ফ্যারাডেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো যে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবি (Westminster Abbey)-তে তার কবর দেয়া হবে। সেখানে ব্রিটেনের রাজা-রাণীদের কবর দেয়া হয়। সেখানে আইজ্যাক নিউটনের মত বিজ্ঞানীর মৃতদেহ রাখা আছে। তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। ৭৫ বছর বয়সে, ১৮৬৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখে, মারা যাওয়ার পর তাকে লন্ডনের হাইগেইট সেমেটারিতে কবর দেয়া হয়। সেখানে স্ত্রী সারাহ এবং তার কবর পাশাপাশি।
সুত্রঃউইকিপিডিয়া, বিজ্ঞানযাত্রা
কৃতজ্ঞতায়ঃ জ্যোতির্বিদ্যা ও সৃষ্টিতত্ত্ব