কাজী আকাশ
ঐতিহাসিকভাবে, গণিত ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নারীরা সবসময় একটু পিছিয়ে ছিল। এর মূল কারন, এক শতক বা তার পূর্বে নারীরা গণিত ও বিজ্ঞানে খুব কম শিক্ষা অর্জন করেছিল।
অথবা হয়তো মোটেও শিক্ষা গ্রহন করেনি। তবে সর্বাধিক সংকল্পবদ্ধ নারীরা তাদের ঘরের কাজ করার পাশাপাশি গণিতের অত্যন্ত বাস্তবধর্মী শাখায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে সোফিয়া কোভালেভস্কি অন্যতম।
উত্তর ইউরোপের প্রথম মহিলা অধ্যাপক সোফিয়া। গণিতের প্রথম ডক্টরেট প্রাপ্ত নারী। তিনিই প্রথম নারী হিসেবে বিজ্ঞানভিত্তিক পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্বজুড়ে গণিতের মহিলাদের জন্য পথিকৃৎ ছিলেন তিনি।
সোফিয়া কোভালেভস্কি ১৮৫০ সালের ১৫ জানুয়ারি রাশিয়ায় মস্কো শহরে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পুরো নাম অবশ্য সোফিয়া ভাসিলিভিয়েনা কোভালেভস্কি। রাশিয়ায় সাধারণত প্রত্যেকের নামের তিনটি অংশ থাকে।
তিন ভাইবোনের মধ্যে সোফিয়া দ্বিতীয়। তাঁর বাবা ভাসিলি করভিন কোভালেভস্কি সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। সোফিয়ার বাবা পোল্যান্ডের বংশোদ্ভূত, মা ছিলেন জার্মানির শিক্ষিত পরিবারের সদস্য। সোফিয়া ১১ বছর বয়সে গণিতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর চাচা পয়েটার ভ্যাসিলিভিস কোভালেভস্কির কাছে।
সোফিয়া তখন নার্সারিতে পড়ছে। সোফিয়ার ঘরের দেয়ালে কাগজের অভাবে গণিতের কিছু নোট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এগুলো ছিল ডিফারেনশিয়াল এবং ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের অ্যানালাসিসের নোট। সোফিয়া দেখলো এখানে যা আছে তাঁর কিছু কিছু সে চাচার কাছে শুনেছিল।
সে নোটগুলো থেকেই সোফিয়া প্রথম ক্যালকুলাসের ধারণা পায়। এরপর সোফিয়ার জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করা হলো। ওয়াই আই ম্যালভিচের কাছে সোফিয়া গণিত অধ্যায়ন করতে শুরু করলো।
সোফিয়াও খুব দ্রুত ক্যালকুলাস শিখতে লাগলো। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সোফিয়া রাত জেগে গণিত অধ্যায়ন করতো। এই কান্ড দেখে তাঁর বাবা গণিতে অধ্যায়ন বন্ধ করে দিলেন।
সোফিয়াদের পারিবারিক বন্ধু ছিল প্রফেসর টারটভ। পরের বছর প্রফেসর তাঁর নিজের লেখা একখানা পদার্থবিজ্ঞানের বই সোফিয়ার পরিবারকে উপহার দেয়ছিলেন।
সেই বই পড়তে শুরু করে সোফিয়া। কিন্তু বইয়ে ত্রিকোণমিতির কিছু সূত্র তাঁর বোধগম্য ছিলনা। তাই সে নিজেই কিছুটা সমাধান করার চেষ্টা করেন। তাঁর সমাধান দেখে অবাক হয় প্রফেসর টারটভ।
প্রফেসর সোফিয়ার উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে তাঁর বাবাকে জানান। কয়েক বছর পরে সোফিয়ার বাবা মেয়ের উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সোফিয়াকে অবশ্যই বাড়িতে থেকে পড়তে হবে গৃহশিক্ষকের কাছে।
সোফিয়া উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানের হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন বলে মনস্থির করলো। কারণ সে সময় রাশিয়া বা বেশিরভাগ দেশেই মেয়েদের পড়াশুনা চালু হয়নি। বাধ সাজলো তাঁর বাবা।
কোনভাবেই দেশের বাইরে যেতে দিবেননা মেয়েকে। সমস্যার এখানে শেষ নয়। রাশিয়ার বাইরে পড়তে হলে পিতা বা স্বামীর লিখিত অনুমতিপত্র লাগবে। যেহেতু তাঁর বাবা চায় না সোফিয়া বিদেশ যাত্রা করুক তাই সোফিয়া বাধ্য হয়ে নকল বিয়ের আশ্রয় নিলেন।
১৮ বছর বয়সে সোফিয়া ভ্লাদিমির কোভালেবস্কি ( চার্লস ডারউনের বই তিনিই প্রথম রাশিয়ায় অনুবাদ করেছিলেন) নামের এক যুবককে নামমাত্র বিয়ে করেন। এই বিয়ে পরে কাল হয়েছিল সোফিয়ার জন্য। সোফিয়ার আসল স্বামী (তাঁর নামও ভ্লাদিমির) এই বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে বিবাহ বিচ্চেদ করে।
১৮৬৯ সালে সোফিয়া হাইডেলবার্গে গণিত ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান অধ্যায়নের জন্য ভ্রমন করেন। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, নিয়মানুযায়ী সোফিয়া সেখান থেকে ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন না। তবে ক্লাস ও সেমিনারে উপস্থিত থাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন।
তিন বছর পরে সোফিয়া ওয়েয়াস্ট্রেস নামক এক শিক্ষকের সাথে বার্লিনে চলে আসেন পড়াশুনা করার জন্য। ওয়েয়াস্ট্রেস ও তাঁর সহকর্মীরা চেষ্টা করেছিল সোফিয়াকে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সোফিয়ার ভর্তি নিতে অসম্মতি জানায়। ফলে ওয়েয়াস্ট্রেস ৪ বছর তাকে ব্যাক্তিগত ভাবে পড়াতে থাকে।
১৮৭৪ সালের মধ্যে সোফিয়া তিনটি গবেষণাপত্র শেষ করলো। পেপারগুলো আংশিক ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ, অ্যাবেলিয়ান ইন্টিগ্রালস এবং শনির রিং সম্পর্কিত ছিল।
ওয়েয়াস্ট্রেস মনে করেন, এর প্রত্যেকটি পেপার ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের উপযোগী। এর মধ্যে একটি পেপার পরের বছর ক্রেলেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।
এই বছরেই সোফিয়া গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্ট্ররেট ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর সোফিয়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার জন্য চেষ্টা করেও ব্যার্থ হন। এর মূল কারণ সোফিয়ার নারী ছিল।
১৮৭৮ সালে সোফিয়া এক কন্যা সন্তানের মা হন। ১৮৮২ সালে আলোর প্রতিসরণ নিয়ে কাজ করেন তিনি। একই বছর আলোর প্রতিসরণের ওপর তিনটি প্রবন্ধ লেখেন।
যদিও সে প্রবন্ধে ভুল ছিল। ফলে সোফিয়া গবেষণা বন্ধ করে দেন। পরের বছর তাঁর স্বামী (আসল স্বামী) ভালিদিমির আত্নহত্যা করলে সোফিয়ার মধ্যে অপরাধবোধ সৃষ্টি হয়।
ভ্লাদিমিরের আত্নহত্যা ভুলে থাকতে আবার গণিত নিয়ে পড়ে থাকেন। দুই বছর পর ১৮৮৪ সালে ভাগ্য সহায় হয় সোফিয়ার। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারের সুযোগ পান। সে বছর জুনে সোফিয়াকে ৫ বছরের জন্য সহকারী প্রোফেসর হিসেবে নিযুক্ত করেন স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
১৮৮৯ সালে সোফিয়া প্রফেসর (পুরোপুরি প্রফেসর) হিসেবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। একই বছর সোফিয়া ম্যাক্সিম কোভালেভস্কি (সোফিয়ার স্বামীর পরিচিত) নামের এক যুবকের প্রেমে পড়েন। কিন্তু তাঁরা বিয়ে করেননি।
সোফিয়া স্টকহোমে থাকাকালে আবার পুরনো গবেষণা শুরু করেন। এবার সাফল্য ধরা দিয়েছে। সোফিয়া ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
এছাড়া শনির চক্র সংক্রান্ত ল্যাপ্লাস ও ম্যাক্সওয়েলের প্রাপ্ত ফলাফলকে উন্নত করেছিলেন। তিনি গতির সমীকরণের গাণিতিক সমাধান করেছিলেন।
১৮৮৬ সালে ফরাসি একাডেমি অব সায়েন্স প্রি বর্ডিন পুরষ্কারের ঘোষণা দেয়। পুরস্কারের শর্ত, আবিষ্কার কোনো শক্ত বস্তুর ঘূর্ণন বিষয়ক হতে হবে। সোফিয়ার একটি স্থির বস্তুর চারপাশে শক্ত বস্তুর ঘূর্ণন বিষয়ক প্রবন্ধের জন্য পুরষ্কারে ভূষিত করে।
তখন পুরষ্কারের অর্থমূল্য ছিল ৩০০০ ফ্রাংক। মজার ব্যাপার হলো, সোফিয়ার এমন অসাধারণ আবিষ্কারের ফলে পুরষ্কারের অর্থমূল্য ৩০০০ থেকে ৫০০০ ফ্রাংক করে দেওয়া হয়। ১৮৮৯ সালে সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স থেকে সোফিয়া এই পুরষ্কার গ্রহণ করেন।
এরপর অক্টা ম্যাথেমেটিকা নামে একটি নতুন জার্নালের সম্পাদক হন সোফিয়া। সোফিয়া ছোটবেলায় নাটক ও স্মৃতিকথা লিখতে ভালোবাসতেন। সেই পুরনো অভ্যাস আবার শুরু করলেন।
সফলও হয়েছেন লেখালিখি করে। তাঁর লেখা প্রথম গ্রন্থটি সুইডেনে সর্বাধিক বিক্রীত গ্রন্থে পরিণত হয়েছিল।
সোফিয়া চেয়েছিলেন নিজ দেশ রাশিয়ায় অধ্যাপণা করতে। কিন্তু মহিলা বলে সে সুযোগ পেতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে। পরে অবশ্য রাশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম পরিবর্তন করে সোফিয়াকে দেশে ফেরানো হয়।
সোফিয়া যখন গণিতের দক্ষতা ও খ্যাতির শীর্ষে তখন নিউমোনিয়া হয়ে ১৮৯১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তাঁর মাত্র ৪১ বছরের জীবন বিশ্বজুড়ে গণিতের মহিলাদের জন্য পথ দেখিয়ে গেছেন।
সোফিয়ার নাম স্মরণ রাখার জন্য হাম্বোল্ড ফাউন্ডেশন ১৩টি দেশের ২৯ জন প্রতিভাবান তরুণকে কোভালেভস্কি ফেলোশিপ দিয়েছেন।
লেখক: কাজী আকাশ
তথ্যসূত্র: ম্যাথ হিস্ট্রি ডট এসট