পর্ব-১৬: খুশিতে-ঠ্যালায়-ঘোরতে বিবর্তন
আমরা, যারা বিবর্তন নিয়ে মোটামুটি জ্ঞান রাখি, যখনই বিবর্তন নিয়ে কথা বলি, তখন বিবর্তনের সাথে ন্যাচারাল সিলেকশন ফ্রি চলে আসে। মানে এদের নাম একসাথে নিতেই হয়।
নাহলে পেটে কেমন জানি গুড়-গুড় করে। অনেকেতো আবার মনে করেন যে বিবর্তন মিউটেশন দিয়ে শুরু, ন্যাচারাল সিলেকশন দিয়ে শেষ। মানে, তারা ন্যাচারাল সিলেকশনকেই বিবর্তনের ওয়ান এন্ড ওনলি মেকানিজম মনে করেন।
কিন্তু, না।
রিসেন্ট পর্বগুলোতে আমরা সেক্সুয়াল সিলেকশন নিয়ে জেনেছি। এটা কী তাহলে বিবর্তনের আরেকটা “স্বতন্ত্র” চালিকা শক্তি? অনেকে বলেন হ্যা, তবে প্রায় সবাই বলেন না।
সর্বাধিক সমাদৃত মত হচ্ছে, সেক্সুয়াল সিলেকশন হলো ন্যাচারাল সিলেকশনের বিশেষ মোড, বিশেষ প্রকার।আপনি ভালো করে সেক্সুয়াল সিলেকশন জিনিসটা বুঝলে এখানেও ন্যাচারাল সিলেকশনের হালকা গন্ধ পাবেন।
কারণ, সঙ্গী নির্বাচন আর প্রজনন অত্যন্ত প্রাকৃতিক একটা প্রক্রিয়া।সেক্সুয়াল সিলেকশনের ফলাফলগুলোর পেছনে প্রাকৃতিক কারণ কাজ করে। জীবরা প্রাকৃতিক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়েই সঙ্গী নির্বাচন করে।
তাহলে,সেক্সুয়াল সিলেকশন আসলে বিবর্তনের তেমন “স্বতন্ত্র” চালক না।এটা ক্লিয়ার করা প্রয়োজন ছিলো।
আর কোনো মেকানিজম আছে? সেটা বোঝার জন্য আমরা চলে যাচ্ছি “কুদ্দুস গরুর খামার” এ।
১০ টা গরু, ৮ টা খয়রি, ২ টা সাদা।
ধরলাম,রঙের ক্ষেত্রে G ডমিনেন্ট এলিল, খয়রি।আর g রিসেসিভ এলিল,সাদা।
৮ টা খয়রির মধ্যে ৫ টার আছে GG, ৩ টার আছে Gg। ২ টা সাদার থাকবে gg. এই ১০ টা।মানে, মোট G আছে ১৩ টা,মোট g আছে ৭ টা।
(হিসাবের সুবিধার্থে ঘি রঙের গরুগুলোকেও খয়রি ধরলাম,মানে শুধু এলিল ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে কাজ করবো, জিনোটাইপ অতটা লাগবেনা।না বুঝলে আগের পর্বগুলো পড়ে আসেন)
রাত ২ টা।
চারিদিকে অন্ধকার, লোকজন নাক ডাকায়ে ঘুমাচ্ছে।আস্তে আস্তে আসলো চোর, গরু-চোর।সে দেখলো, গরু আছে ১০ টা।
কিন্তু,ও যেই ট্রাকে গরু নিয়ে যাবে, সেখানে গরু ধরবে দুইটা।রাতের অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যায় না। একপ্রকার কানা হয়েই সে ঢুকে দুই হাতে দুইটা গরু টের পেলো, দড়ি খুলে আস্তে করে কেটে পড়লো।
চুরি শেষ।
সকালে কুদ্দুস উঠে দেখলো, সাদা গরু দুইটা নাই। কুদ্দুস কাঁদতে থাকুক, আমরা বিজ্ঞানটা বুঝে আসি।
এইখানে ব্যাপারটা কী হলো? আসলে তেমন কিছুই হয়নি। চোর এক্কেবারে র্যান্ডমলি, কোনো কারণ ছাড়াই, নিজের অজান্তেই, কারো বা কিছু দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই, বলা যায় “ভুল করে” সাদা রঙেরই দুইটা গরু নিয়ে গেছে।
ফলে? এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে ড্রামাটিক চেঞ্জ আসছে। একসাথে ৪ টা g চলে গেল, রয়ে গেল মাত্র ৩ টা, ওদিকে G আছে ১৩ টাই।
ফলে, নেক্সট জেনারশনে gg আসার সম্ভাবনা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এভাবে, বড় একটা সম্ভাবনা তৈরি হলো, কয়েক জেনারেশন পরে আর g পাওয়া যাবেনা।
জি বাংলা সিরিয়ালের কাহিনীর মতো একদম,মাত্র একটা চুরি কুদ্দুসের গরুর খামারের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি কাপিয়ে দিলো।আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, “জেনেটিক ড্রিফট”!
এখানে আমি যে বিষয়টার ওপর জোড় দিয়েছি, সেটা হলো “র্যান্ডমনেস”।
বাংলায় “যদৃচ্ছতা”। জেনেটিক ড্রিফট সম্পূর্ণভাবে র্যান্ডমনেস দ্বারা চালিত।(এজন্যই পর্বের নাম এমন দিয়েছি) এখানে কোনো রকমের কারণ, উদ্দেশ্য, বৈশিষ্ট্য কাজ করবেনা।
সাদা গরু দুইটাই চুরি হবে, এর সম্ভাবনা শুণ্য ছিলোনা,ফলে তা “হতেই পারতো”, আর একদম র্যান্ডমলি সেটাই হয়েছে।
না হলে অন্য কিছু হতো, একটা সাদা, একটা খয়রি বা দুইটা খয়রিই চুরি হতে পারতো, যা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো বেশি। কিন্তু, হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হলেই যে হবে, তা না।র্যান্ডমনেস জিনিসটাই এমন।
একটা ঘটনা বলি।
রিচার্ড ফাইনম্যান নাকি প্রায়ই তার কলিগদের কাছে যেতেন, আর মুখভরা উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন,
“জানো আজকে আমার সাথে কী হইছে? জানো?” তারা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করতো, “কী?” তিনি উত্তর দিতেন,
“কিছুই না!”
ঘটনাটা সত্য কিনা জানিনা, লরেন্স ক্রাউস তার অনেক বক্তৃতায় এই ঘটনাটা উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটা সত্য-মিথ্যা যাই হোক, এর সারমর্মটা চমকপ্রদক।
আমরা ভাবি যে আমাদের সাথে যা হয়, সেটাই স্পেশাল বা কোনো কারণে হয়, আমরা ভালো ঘটনাকে আমাদের ভালো কাজের ফল বা কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীর শুভকামনার ফল হিসেবে চিন্তা করতে ভালোবাসি।
কিন্তু, আসলে এইটাযে এক্কেবারে র্যান্ডমলি হচ্ছে, তা বুঝতে চাইনা। আমরা ঘটনাকে কারণযুক্ত বা উদ্দেশ্যযুক্ত করতে পছন্দ করি।
যেকোনো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, একটা না একটা ঘটনা হতেই হতো, আর র্যান্ডমলি একটা হয়ে গেছে। এতে স্পেশাল কী?
যা হয়েছে সেটা যদি স্পেশাল হয়, তবে যা হয়নি, সেটাও সমানভাবে স্পেশাল।আর কিছু না হওয়ারও একটা সম্ভাবনা ছিলো বলে সেটাও সমানভাবে স্পেশাল, ফাইনম্যান এটাই বোঝাতেন।
আর যদি স্পেশাল না হয়, তবে কোনোটাই স্পেশাল না।
এত কথা বলার কারণ কী? জেনেটিক ড্রিফটে একটা জনসংখ্যা থেকে র্যান্ডমলি নির্দিষ্ট ধরনের এলিল কোনো ঘটনার ফলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া অসম্ভব না।
“স্পেশাল” বা “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” না। র্যান্ডমনেসের ফলে দুইটাই সাদা গরু চুরি হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার।
এভাবে,একদম র্যান্ডমলি, কোনো জনসংখ্যায় যখন একটা নির্দিষ্ট এলিলের ফ্রিকোয়েন্সি হঠাৎ করে অত্যন্ত কমে যায়, বা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়;
অর্থাৎ, পপুলেশনের এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে ড্রামাটিক চেঞ্জ আসে, তখন তাকে বলি জেনেটিক ড্রিফট।
ন্যাচারাল সিলেকশন কাজ করে অনুকূল ট্রেইটের নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু জেনেটিক ড্রিফটে অনুকূল-প্রতিকূল বিষয় না।
র্যান্ডমলি চেঞ্জ আসবে, ফলে অনেক সময় প্রতিকূল বৈশিষ্ট্যও টিকে যায়।
যেই দুইটা গরু চুরি হলো, হতে পারে সেগুলোই সবচেয়ে বেশি দুধ দেয়।
তাতে কী? র্যান্ডমলি চুরি হয়ে গেছে!হতে পারে খয়রি গরুগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম,তাতে কী?র্যান্ডমলি টিকে গেছে!
আচ্ছা, এবার বলেন, গরু যদি ১০০০টা থাকতো, খয়রি থাকতো ৮০০ টা, সাদা থাকতো ২০০ টা। তখন যদি চোর শ’খানেক ট্রাকও নিয়ে আসতো, তাহলেও সব সাদা গরু নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আগের তুলনায় কমে যেত।
আমি বলছিনা যে সম্ভাবনা শূণ্য হয়ে যেত,বরং সম্ভাবনা “কম হতো”।
তাই, জেনেটিক ড্রিফটের প্রভাব বড় জনসংখ্যার চেয়ে ছোট জনসংখ্যায় বেশি দেখা যায়।
ব্যাপারটা এভাবে ভাবতে পারেন, একটা কয়েনকে ১০ বার টস করলে হেড-টেল এর সংখ্যায় পার্থক্য বেশি হবে।
কিন্তু কয়েক হাজার বার করলে পার্থক্যটা কমে যাবে, হেড-টেল উভয়ে ৫০% এর অনেকটা আশেপাশে চলে আসবে।
র্যান্ডমনেসের প্রভাব বড় সংখ্যায় তুলনামূলক কম বোঝা যায়, ছোট জনসংখ্যায় বেশি।
আর জেনেটিক ড্রিফট যেহেতু সম্পূর্ণ র্যান্ডম, তাই ছোট জনসংখ্যায় এটা নাটকীয় প্রভাব ফেলে।
অনেক কথা বললাম, আজ এই পর্যন্তই।
পর্ব-১৭:আদিপিতা কুদ্দুস
গতপর্বে আমরা “কুদ্দুস গরুর খামার”এ গরু চুরি হওয়ার মাধ্যমে জেনেটিক ড্রিফটের ধারণা নিয়েছিলাম।
ড্রিফট জিনিসটা খুশিতে-ঠেলায়-ঘোরতে হয়, কোনো কারণ, উদ্দেশ্য, প্রভাবের প্রভাব থাকেনা।আজকে আমরা চলে যাবো আমাদের কুদ্দুসের কাছেই।
আমাদের হাইপোথেটিকাল কুদ্দুস থাকে হাইপোথেটিকাল বছিরনগরে, সমুদ্রের পাড়ে একটা ছোট লোকালয়, যেখানে মোট জনসংখ্যা ১০০০।
এই ১০০০ জনের মধ্যে মাত্র ১০ জনের মধ্যে বিশেষ একটা ট্রেইট আছে, কুদ্দুস সেই ১০ জনের একজন।
তারা তাদের জিহ্বা দিয়ে নাকের আগা স্পর্শ করতে পারে।
কিন্তু, তাদের কেউই নিজেদের এই অসাম বৈশিষ্ট্যটা খেয়াল করেনি কখনো।খেয়াল না করাটাই স্বাভাবিক।
চমৎকার একখান ইউনিক বৈশিষ্ট্য বলে কথা!
একদিন, বছিরনগরের ৯জন বাসিন্দা মিলে ঠিক করলো যে তারা নৌকায় করে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবে, ৯ জনের প্রধান ছিলো কুদ্দুস।
কুদ্দুস নৌকা চালাবে।
তারা গেল, বিকালে সমুদ্রে ঝড় উঠলো, নৌকা ভেসে চলে গেল কতদূর!কোন জায়গায় কে জানে।রাত কাটলো, সকালে তারা নিজেদেরকে আবিষ্কার করলো সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায়।
কী আর করার, সেখানেই কোনোমতে খাবার-দাবার জোগাড় করে দিন কাটাতে লাগলো। ছেলে-মেয়ে ছিলো, প্রজনন করলো।
তারা ১০ থেকে ২০, ২০ থেকে ৪০,৪০ থেকে ৮০ হলো। জনসংখ্যা বাড়তে লাগলো।
কয়েকশ বছর পর সেই জায়গায়, সমুদ্রের মাঝে লোকালয় গড়ে উঠলো।
একদিন, এক লোক হঠাৎ নিজের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করলো।
“সে জিহ্বা দিয়ে নিজের নাকের আগা স্পর্শ করতে পারে!”
সারা গ্রামে এই কথা রটে গেল, সবাই কৌতুহলে নিজেও চেষ্টা করে দেখলো যে তারা পারে কিনা। দেখা গেল যে, সবাইই এই অদ্ভুত জিনিসটা করতে পারে।
অনেক বড় গল্প বললাম।
এবার, বিজ্ঞান!
এখানে ব্যাপারটা ঘটেছে কী?
ওইযে ১০ জন বিশেষ ট্রেইটধারী ছিলোনা বছিরনগরে?
তারাতো জানতো না যে তারা ওই বিশেষ ট্রেইটটা ধারণ করে। একদম র্যান্ডমলি,বলা যায় দুর্ভাগ্যবশত, তাদের মধ্যে ৯জনই সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলো।
আবার বলি, “র্যান্ডমলি”।
মানে মাছ ধরতে যাওয়া ৯ জনই সেই বিশেষ ট্রেইটধারী ১০ জনের ৯ জন। তারাই নতুন লোকালয়ের আদিপিতা,কুদ্দুস তাদের একজন।
ফলে কুদ্দুসদের বংশধরদের মধ্যে,এক্কেবারে সবার মধ্যেই এই বিশেষ ট্রেইটটা আছে,কারণ তাদের আদিপিতাদের সবার মধ্যেই একই ট্রেইট ছিলো। মানে, একটা নতুন জনসংখ্যার উৎপত্তি হয়েছে ও একটা ট্রেইট বিস্তার লাভ করেছে, নাটকীয় ভাবে।
আমরা প্রত্যক্ষ করলাম “ফাউন্ডার ইফেক্ট”, জেনেটিক ড্রিফটের বিশেষ প্রকার।
যখন একটা জনসংখ্যা থেকে একদল লোক,যাদের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি ওই টোটাল জনসংখ্যার এলিল ফ্রিকোয়েন্সিকে রিপ্রেজেন্ট করেনা, তারা যখন মাইগ্রেট করে অন্য স্থানে চলে যায় ও সম্পূর্ণ নতুন জনসংখ্যার উৎপত্তি ঘটায়, তখন নতুন জনসংখ্যার এলিল ফ্রিকোয়েন্সি আগেরটা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে,আর উভয় জনসংখ্যারই জেনেটিক ভ্যারিয়েশন বা জিন-বৈচিত্র কমে যায়, একেই বলে ফাউন্ডার ইফেক্ট।
আমাদের নতুন লোকালয়ের আদিপিতারাতো বছিরনগরেরই অধিবাসী। বছিরনগরের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি আর এই ৯ জন থেকে উৎপন্ন লোকালয়ের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি কী এক?
কখনোই না।কারণ এই ৯ জনই বিশেষ ট্রেইটটা ধারণ করে, আর বাকি থেকে যাওয়া ৯৯১ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন এই ট্রেইটধারী।
তাই, তাদের এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে আকাশ-পাতাল তফাৎ, ওই ৯ জনের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি দেখে সমগ্র বছিরনগরকে বিচার করা যাবেনা। আবার, যখন ৯ জন বছিরনগরে ছিলো, তখন বছিরনগরের জিনপুলে অদ্ভুত এই ট্রেইটটাও ছিলো,বৈচিত্র ছিলো।
কিন্তু যখনই ৯ জন চলে গিয়ে নতুন জনসংখ্যার উৎপত্তি ঘটালো, বড় একটা বৈচিত্র কমে গেল।আর নতুন লোকালয়ে বৈচিত্র নেই বললেই চলে, কারণ সবার মধ্যেই একই ট্রেইট।
সুতরাং, ওভারঅল, জিন ভ্যারিয়েশন কমেছে।(জিনপুল তেমন কিছু না,একটা জনসংখ্যার সব জিনের সেট)
ক্লিয়ার?
ফাউন্ডার ইফেক্টের ফলে জিনোটাইপ ও ফিনোটাইপে বিপুল পরিবর্তন আসতে পারে।আমরা বছিরনগরের উদাহরণের মাধ্যমে শুধু জিনোটাইপ নিয়েই কথা বলেছি।
ফিনোটাইপ বললে হোমোজাইগাস-হেটেরোজাইগাস অনেক কিছু চলে আসতো, ঝামেলা বাড়তো, কিন্তু ফলাফল একই হবে।

আচ্ছা,আমাদের গ্যালাপ্যাগোসের ফিঞ্চ আর কচ্ছপদের কথা মনে আছে? যারা দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্যালাপ্যাগোসে চলে গিয়েছিলো?

বিখ্যাত একটা হাইপোথিসিস হলো, ওখানেও এই জেনেটিক ড্রিফট ঘটেছিলো, ফাউন্ডার ইফেক্ট। আর এই ফাউন্ডার ইফেক্ট হয়ে যাওয়ার পর ন্যাচারাল সিলেকশন সবকিছু নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেয়, তারপর ভিন্ন প্রজাতির উৎপত্তি ঘটে।
আজ এই পর্যন্তই, পড়তে থাকুন……..
পর্ব-১৮:বিপর্যয়ে বিবর্তন
বছিরনগরে এবার মাত্র ১০০ জন লোক থাকে। সরকারের টাকা বেশি হয়ে গেছিলো, তাই কয়েক কোটি টাকার বাজেট ধরে সরকার সেখানে লোক পাঠালো বছিরনগরের লোকজনদের চুলের রঙ দেখার জন্য।তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখল আর জানতে পারলো, ২৫ জন কালচে খয়রি আর ৭৫ জন কালো।
এর কয়েকদিন পরেই, লোকসংখ্যা তখনো বাড়েনি,
একদিন ক্যাটাগরি পাঁচ এর ঘূর্ণিঝড় হলো,৩৫ জন মারা গেল।
১ মিনিটের নীরবতা।
শেষ।
ত্রাণ সহায়তা দিতে সরকারি লোকজন আসলো। বাকি ৬৫ জনকে ত্রাণ দেয়ার সময় দেখা গেল কোনো লোকের চুলই কালচে খয়রি না।
মানে, সেই ২৫ জনই মারা গেছে।
র্যান্ডমলি।
এবার, সেখানে যত শিশু জন্ম দেবে, সবার চুলই কালো হবে, কারণ কালচে খয়রি এলিলওয়ালা কেউ বেঁচে নেই।
সুতরাং, এলাকার জিন পুলে আর এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে বিপুল পরিবর্তন আসছে, জিন ভ্যারিয়েশন কমে গেছে। কীভাবে? কোনো একটা আকস্মিক বিপর্যয়ের কারণে, এক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়। একে বলে “Bottleneck effect”
একটা বোতলে লাল,নীল,হলুদ,কমলা, এই চার রঙের মারবেল ভরলাম, তারপর মুখ খুলে বোতলটাকে ঝারা দিলাম।
কতটুকু সম্ভাবনা আছে যে প্রত্যেক রঙের সমান সংখ্যক মারবেল বের হবে?
একেবারেই কম। সম্ভাবনা বেশি হলো, কোনো নির্দিষ্ট রঙের মারবেল বেশি বের হবে।
বোতলের ভেতরের মারবেলের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি আর বের হওয়া মারবেলের এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে আকাশ-পাতাল তফাৎ।
মানে, উৎপন্ন হওয়া ডটার পপুলেশন এর প্যারেন্ট পপুলেশনকে রিপ্রেজেন্ট করেনা। আর উৎপন্ন হবে কীভাবে? যেকোনো দুর্যোগ,বিপর্যয় বা আকস্মিক জনসংখ্যা হ্রাসকারী কোনো ঘটনার মাধ্যমে।
এইটাই বটলনেক ইফেক্ট, আরেকপ্রকার জেনেটিক ড্রিফট। বুঝছেন?
আসলে এখানে যত সহজে ব্যাখ্যা করলাম তত সহজ না।
কারণ, কালো চুল যদি হোমোজাইগাস না হয়ে হেটেরোজাইগাস হয়, তাহলে প্রজননের সময় ডমিনেন্ট-রিসেসিভ রিকম্বাইন হয়ে কালচে খয়রির জন্য প্রয়োজনীয় জিনোটাইপ আবার তৈরি হতে পারে।
আবার এখানে হেটেরোজাইগাস আর হোমোজাইগাসের দুইপ্রকার, এই তিনটা ফিনোটাইপ থাকার কথা, কিন্তু বোঝার সুবিধার্থে আমরা দুইটা, কালো আর কালচে খয়রি ধরে নিয়েছি।
এই গেল একটা ঝামেলা, আরেকটা হলো, শুধু বটলনেক বা শুধু ফাউন্ডার ইফেক্ট হয়ে আলাদা প্রজাতি তৈরির মতো জিনপুলে হঠাৎ আমূল পরিবর্তন আসা একটু কঠিন।
কারণ র্যান্ডমলি একটা নির্দিষ্ট ট্রেইটেধারী সবাই মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও কম, ২-১ জন থেকেই যাবে,তাই ওই ট্রেইটটাকে টোটালি নির্মূল করতে ফাউন্ডার আর বটলনেক পরপর হওয়া লাগবে। মানে দুইটা ছাকনির মতো।
আর তা না হলে ট্রেইটটা টোটালি ধ্বংস হওয়ার একমাত্র উপায় প্রজননের সময় র্যান্ডম রিকম্বিনেশন।মানে, প্রজননের সময় একেবারে র্যান্ডমলি সেই ফিনোটাইপের জন্য প্রয়োজনীয় জিনোটাইপটা তৈরি হবে না।
মনে করেন, যেই ট্রেইটটা ধ্বংস হবে, সেটার জিনোটাইপ dd আর টিকে যাবে Dd. রিকম্বিনেশনের সময় dd,DD,Dd, তিনটাই তৈরি হতে পারে। কিন্তু, র্যান্ডমলি যদি কারোর মধ্যেই dd তৈরি না হয়, তাহলেই বহু প্রজন্ম পর ট্রেইটটা নির্মূল হবে।
কিন্তু এটা একবারে হবেনা, হবে কয়েক মিলিয়ন বছরে, কয়েক হাজার প্রজন্মে।
এভাবে বহু প্রজন্মের পর সেই ফিনোটাইপ, সেই ট্রেইট টোটালি ধ্বংস হয়ে যাবে, আর জনসংখ্যাটা একটা নতুন প্রজাতি হওয়ার দিকে আরেকধাপ এগিয়ে যাবে।
আজ এতটুকুই।
জানি, ভাষাটা একটু কঠিন আর জটিল হয়ে গেছে, বুঝতে অসুবিধা হলে বলেন, পিডিএফ করার সময় আরো ব্যাখ্যা করবো তাহলে।
পর্ব-১৯:স্থির নাকি চলমান?
আমরা বিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তিগুলোর একটা, জেনেটিক ড্রিফট নিয়ে আলোচনা করে ফেলেছি।
এখন, জেনেটিক ড্রিফট বা ন্যাচারাল সিলেকশন হওয়ার পর একটা বিশেষ ঘটনা ঘটে, সেটা নিয়ে আলোচনা করবো।
আমরা আগের পর্বগুলোতে বিষয়বস্তুগুলো বোঝার সুবিধার্থে যত উদাহরণ দিয়েছি, সবক্ষেত্রে কী হয়েছে?
ডারউইনগর,কুদ্দুস গরুর খামার,বছিরনগর ইত্যাদি ইত্যাদি, কী হয়েছে সবশেষে?
সবক্ষেত্রেই শেষমেষ একটা ট্রেইট জনসংখ্যার সবার মধ্যে চলে এসেছে, মানে একটা এলিল প্রত্যেকের জিনে স্থান করে নিয়েছে।
মানে? একটা এলিলের ফ্রিকোয়েন্সি ১০০% হয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ প্রত্যেকের মধ্যেই ওই এলিলটা আছে।এলিলটা ওই জনসংখ্যার জিন পুলে fixed হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনাকে বলে Fixation. স্থায়ীকরণ বা স্থিরীকরণ।
একটা জনসংখ্যার জিন পুলে একই জিনের দুইটা এলিল থাকার অবস্থা থেকে একটা এলিল টিকে যাওয়া ও আরেকটি বিলুপ্ত হওয়ার ঘটনাকে ফিক্সেশন বলে।
এটা প্রধানত ন্যাচারাল সিলেকশন আর জেনেটিক ড্রিফটের মাধ্যমে হয়। নতুন কোনো মিউটেশন হওয়া আর “হেটেরোজাইগোট এডভান্টেজ”, এই দুইটার অনুপস্থিতিতে এই ফিক্সেশন অবস্থা বিরাজ করে।
মিউটেশন হলে নির্দিষ্ট এলিলের ফ্রিকোয়েন্সি ১০০% থাকলোনা, ফিক্সেশন ভঙ্গ হলো, বুঝলাম। কিন্তু এই হেটেরোজাইগোট এডভান্টেজ টা কী?
এটা হলো এমন একটা অবস্থা, যেখানে হেটেরোজাইগোট জিনোটাইপটা হোমোজাইগোট থেকে বেশি সুবিধাজনক।
তাই, হেটেরোজাইগোট এডভান্টেজ থাকলে সেটাই সিলেক্টেড হবে, ফলে প্রজননকালে ডমিনেন্ট-রিসেসিভ রিকম্বাইন হয়ে হোমোজাইগাস রিসেসিভ বা ডমিনেন্ট, দুইটাই তৈরি হতে পারে, এতে আবার ফিক্সেশন ভঙ্গ হবে। হেটেরোজাইগোট এডভান্টেজ নিয়ে পিডিএফে আরো লিখবো।
এই ফিক্সেশনে মূলত বায়োলজির থেকে গণিত বেশি, কতক্ষণ লাগবে ফিক্সড হতে, সম্ভাবনা কত, ব্লা ব্লা। আমরা আর ওদিকে গেলাম না।
মূল ব্যাপার হচ্ছে, অনেক স্বঘোষিত বিজ্ঞানী, ধরে নেন যে একটা মিউট্যান্ট জিন এর ফিক্সেশন হওয়ার সময় আর বাকি কোনো জিন এর কোনো কার্যকলাপ হবে না, সব ফ্রিজ হয়ে থাকবে।
তারপর তারা হিসাব করেন, “অস্ট্রেলোপ্যাথিকাস থেকে মানুষ আসতে গেলে মাত্র ৮ টা উপকারী মিউটেশন হতে গেলে ১৮ বিলিয়ন বছর লাগবে!”
তারা ধরে নেন যে, একটা মিউটেশন হয়, হওয়ার সময় অন্য কোনো জিন কাজ করেনা। চুপ করে থাকে। সেটা মিউটেশন হয়, ফিক্সেশন হয়, তারপর কয়দিক ছুটি কাটায়, তারপর গিয়ে আরেকটা শুরু হয়।
এইরকম জ্ঞান নিয়ে যারা বিবর্তনের ওপর বই লিখে ফেলেন দেখে আমার বিখ্যাত গায়ক মাহফুজুর রহমানের কথা মনে আসে।
আসলে, মানুষের মধ্যে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে মিউটেশনের সঠিক সংখ্যা কত, তা এখনো নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। কোনো গবেষণায় উঠে এসেছে ৩-১০ টা, আবার কেউ বলেছে ৪২-৬৪ টা। সে যাই হোক, কিন্তু সংখ্যাটা ২০ এর কম হবে বলে আমার মনে হয়না।
সাধারণ যুক্তি খাটান, মানুষের জিন আছে প্রায় ২৫-৩০ হাজার। এতগুলো জিন, চিন্তা করুন,একপ্রজন্মে কতগুলো মিউটেশন হওয়া সম্ভব?
আর মিউটেশনের ফলে প্রকাশিত বৈশিষ্ট্যের ওপর সিলেকশনতো সর্বদাই চলে। আবার আছে জেনেটিক ড্রিফট, যেখানে কখন কোন ট্রেইট সিলেক্ট হয়ে যাবে, কেউ জানেনা!
তাই,এখনো কোনো মূর্খই বলবে যে একটামাত্র মিউটেশন ফিক্স হয় এট এ টাইম, তারপর আবার আরেকটা শুরু হয়। আমরা বিবর্তনক সহজভাবে উপস্থাপন করার জন্য একটা-একটা করে উদাহরণ দেই। কিন্তু আসলে কী বিবর্তন এত সহজ?
জনসংখ্যা আছে কয়েকলক্ষ, ট্রেইট আছে হাজার হাজার,মিউটেশন হচ্ছে ডজন ডজন, সময় আছে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর, এর ওপর ক্রিয়া করে সিলেকশন, ড্রিফট, ফ্লো আরো কত কী!
একটা অতি সহজ উদাহরণ দেই শেষে, কুদ্দুস চাকরি পায়নি ওর অদ্ভুত স্বভাবের জন্য, মনে আছে?
সেখানে কী ওর একটা মাত্র ট্রেইটের বিপক্ষে সিলেকশন হয়েছিলো? না। কুদ্দুস যেহেতু চাকরি পায়নি, বিয়ে হয়নি, প্রজনন হয়নি, মানে ওর কাছে যত ট্রেইট ছিলো, একটাও পরবর্তী প্রজন্মে পাস হয়নি। শুধুমাত্র একটা খারাপ বৈশিষ্ট্য, অদ্ভুত স্বভাবের জন্য ওর একটা ট্রেইটও পাস হলোনা, মানে ওর দেহে যত মিউটেশন ছিলো, একটাও পাস হলোনা।
ওদিকে, হোসুইন, শুধুমাত্র ওর বাপ বড়লোক্স বলে ওর দেহের অর্ধেক মিউটেশন পাস হয়ে গেল!
এখানে কী একটামাত্র ট্রেইটের সিলেকশন হয়েছে? মাত্র একটা মিউটেশন ফিক্স হয়েছে? না অনেকগুলো একসাথে হয়েছে বা হচ্ছে।
সুতরাং, একইসাথে অনেকগুলো ফিক্সেশন হতে পারে।আবার একটা মিউট্যান্ট জিন যখন ফিক্স হয়ে গেছে, একই সময়ে আরেকটা হয়তো শুরু হয়েছে, আরেকটা হয়তো মাঝপথে আছে। ফিক্সেশন কোনো স্থায়ী জিনিস না, একটা মাত্র মিউটেশন হলেই তা ভেঙে যাবে, আর যেহেতু মিউটেশন হলো বিবর্তনের নাটকের পরিচালক, সেটা হবেই। বিবর্তন নদীর স্রোতের মতো চিরবহমান।
আজ এইটুকুই, পড়তে থাকুন।
পর্ব-২০:জিন প্রবহণ
ঘটনা-১:
একটা প্রজাতি আছে, A.
A এর বাসিন্দারা নিজেদের মধ্যে প্রজনন ঘটায়। মানে,তাদের নিজেদের মধ্যেই জিন আদান-প্রদান হচ্ছে, সন্তান উৎপাদনের সময় তাদের নিজেদের জিনই জগা-খিচুড়ি হয়ে মিলে-মিশে নতুন একপিস উৎপাদন হচ্ছে।
মানে, তাদের প্রজাতির স্বকীয়তা রক্ষাকারী জিনগুলো টিকে আছে, তারা একই প্রজাতির।
এইযে একই প্রজাতির প্রাণীরা সঙ্গম করছে, এখানে জিন প্রবাহিত হচ্ছে।
নিজেদের জিন নিজেদের মধ্যেই প্রবাহিত হচ্ছে। একই প্রজাতির এক প্রাণীর জিন আরেক প্রাণীর মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে?
তাদের জিন পুল বিশুদ্ধ থাকছে, বাইরের কারো দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেনা।
মিউটেশন হলেও তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
নিজেদের মধ্যে জিনের প্রবহণ প্রজাতির মৌলিকত্ব এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছে।
ঘটনা-২:
A প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে দ্বন্দ দেখা দিলো। ফলে তারা দুইভাগ হয়ে গেল, A1 & A2.
একদল আরেকদলের ছায়াও পা দেয়না।সঙ্গমতো বহু দূরের ব্যাপার। ফলে কী হলো?
A1 এর প্রাণীদের মধ্যে মিউটেশন হয়ে যেসব বৈশিষ্ট্যের সিলেকশন হলো, তা A2 থেকে আলাদা। কারণ, তারা নিজেদের মধ্যে সঙ্গম করছে না, জিন আদান-প্রদান করছে না। ফলে একদলের মিউটেশন আরেকদলে পাস হচ্ছেনা।
এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে দুইদলের মধ্যে আলাদা নতুন নতুন মিউটেশন হবে, দুইদলের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ট্রেইট টিকতে থাকবে। আর ভাগ্যক্রমে র্যান্ডমলি দুইদলে একই ধরনের মিউটেশন হয়ে তা সিলেক্ট হওয়ার সম্ভাবনা মোটেই নেই বললে দোষ হবেনা।
অনেকদিন পর দেখা যাবে, A1 আর A2 আলাদা দুইটা প্রজাতি হয়ে গেছে।মানে, তারা নিজেদের মধ্যে প্রজনন করে উর্বর সন্তান উৎপাদন করতে পারছেনা।
জিনের আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে দুইটা আলাদা প্রজাতির সৃষ্টি হলো। A এর জিন পুলে ফাটল দেখা দিয়ে ধীরে ধীরে তা A1 আর A2 তে ভাগ হতে থাকলো। A1 আর A2 তে ভিন্ন ভিন্ন মিউটেশনের ফলে দুই দলের মধ্যে জিন ভ্যারিয়েশন বাড়তে থাকলো।
ঘটনা-৩:
কয়েক হাজার বছর পরে, A1 আর A2 তখন ভিন্ন দুইটা প্রজাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।
উল্লেখ্য যে প্রজাতির শুরু শেষ নির্ণয় করা যায়না। কেন? পড়ে আসুন
এইটা বলা সম্ভব না যে ঠিক কোন প্রাণী থেকে বা ঠিক কোন মুহূর্তে নতুন প্রজাতির শুরু। তাই, আমরা এমন একটা সময় কল্পনা করতে পারি, A1 আর A2 যখন এমন একটা পর্যায়ে যে প্রায় অনেকটাই আলাদা প্রজাতি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের মিল আছে এখনো।
ফলে, তারা নিজেদের মধ্যে এখনো উর্বর সন্তান উৎপাদন করতে পারছে। আর কয়েকটা মিউটেশন হলেই আর পারবেনা।
এমন সময়ে, A1 এর এক ছেলে(x), A2 এর এক মেয়ের(y) প্রেমে পড়লো।
দীর্ঘদিনের প্রজাতিগত দ্বন্দ প্রেমের সামনে হেরে গেল।
x আর y বিয়ে করলো, y চলে গেল x এর বাড়িতে থাকতে। y, A1 এ মাইগ্রেট (migrate) করলো।ফলে কী হলো?
A2 এর মধ্যে যত মিউটেশন ছিলো, তার অর্ধেক(বাবা,x থেকে বাকি অর্ধেক আসবে) y এর মাধ্যমে A1 এ চলে আসলো x এর সাথে প্রজনন করার মাধ্যমে। সন্তানের মধ্যে এবার x আর y উভয়ের বৈশিষ্ট্য আছে।
সে যখন A1 এর কারো সাথে মিলে প্রজনন করবে, তার মধ্যে আবার A2 এর বৈশিষ্ট্যের অংশ চলে যাবে।
x আর y এর বৈপ্লবিক প্রেম কাহিনী মিডিয়া, সোশাল নেটওয়ার্ক কে কাপিয়ে দিলো। বহু তরুণ-তরুণী উদ্বুদ্ধ হলো।
ধীরে ধীরে A1 আর A2 এর মধ্যে সম্পর্ক বাড়তে থাকলো। migration বা স্থানান্তর বাড়তে থাকলো।জিন আদান-প্রদান হতে শুরু করলো।
ফলে, এতদিন যাবৎ তাদের মধ্যে ভিন্ন যেসব মিউটেশন হয়েছিলো, সেগুলো মিক্স হতে থাকলো।
এক পর্যায়ে, তাদের ভিন্ন দুইটি জিন পুল এর মধ্যে মিল্কিওয়ে-এন্ড্রোমিডার জিন ভ্যারিয়েশন কমে গিয়ে পৃথিবী-মঙ্গলের পর্যায়ে চলে আসলো।
আরো সময় এগোতে থাকলে তারা এতটাই মিক্স হয়ে গেল, জিনের প্রবাহ নিজেদের মধ্যে এতটাই বেড়ে গেল যে তারা আবার মিলে প্রজাতি A হয়ে গেল। তাদের জিনপুল এক হয়ে গেল, আলাদা হিসেবে জিন ভ্যারিয়েশন রইলো না।
এই নতুন A কিন্তু আবার ঘটনা-২ এর আগের A এর মতো হয়ে যাবেনা। হওয়ার সম্ভাবনা এক্কেবারেই ০ বলা যায়।কারণ আগেই বলেছি, একই মিউটেশন হুবহু আরেকবার হয়ে সিলেক্ট হবেনা বললেই চলে, সম্ভাবনা এত কম।তাছাড়া নতুন অনেক মিউটেশন হওয়ার পর দুইদল এক হয়েছে।
এইযে বারবার জিনের প্রবাহ, জিনের প্রবাহ বলে চিল্লাচ্ছি, একে বলে Gene flow. একজনের জিন অন্যজনে যাওয়া বা প্রবাহিত হওয়া, অথবা একটি দলের জিনপুলের মধ্যে অন্য দলের জিনপুল ধীরে ধীরে ঢুকে বা প্রবাহিত হয়ে মিলেমিশে একাকার হওয়া, এইটাই জিন ফ্লো।
ঘটনা-১ এ বোঝা যায়, একই প্রজাতির মধ্যে এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে জিন ফ্লো প্রজাতির স্বতন্ত্রতাকে টিকিয়ে রাখে।
ঘটনা-২ এ বোঝা যায়, একই প্রজাতির মধ্যে কোনো কারণে (কারণগুলো নিয়ে পরে আলোচনা করবো বিস্তারিত) জিন ফ্লো বন্ধ হয়ে গেলে আলাদা দুইটা প্রজাতির সূচনা হতে পারে।
উল্লেখ্য যে, অনেকসময় একেবারে আলাদা প্রজাতির উদ্ভব হয়না।
একই প্রজাতি থাকে, কিন্তু একটা বৈশিষ্ট্যের ওপর তাদেরকে দুইদলে ভাগ করা যায়। মানে প্রজাতি একই, কিন্তু নির্দিষ্ট কয়েকটা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে দল দুইটা। আলাদা প্রজাতি হবে, নাকি শুধু কয়েকটা বৈশিষ্ট্যের কারণে একই প্রজাতির আলাদা দল গঠন হবে, সেটা ওই জিন ফ্লো বন্ধের কারণের ওপর নির্ভর করে অনেকখানি।
ঘটনা-৩ এ বোঝা যায়, দুইটা “প্রায় আলাদা প্রজাতি”, একেবারে আলাদা হয়ে পারেনি এমন, তবে দেখে আলাদা করা যায়।
এমন দুই প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে কোনোভাবে জিন ফ্লো শুরু হলে দুইটা প্রজাতি মিলেমিশে একটা প্রজাতি হয়ে যাবে। তাদের জিনপুল এক হয়ে যাবে, তাদের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি এক হয়ে যাবে। মানে, তারা একটা নতুন প্রজাতি গঠন করবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রজাতির সংজ্ঞা নিয়ে মতভেদ আছে। তাই দুইটা আলাদা প্রজাতি মিলেও একটা প্রজাতি গঠন করতে পারে। তবে তাদের গণ একই হওয়া লাগবে। গাছের একটা প্রজাতি আর বানরের একটা প্রজাতির মধ্যে নিশ্চই জিন ফ্লো হবেনা।
দুইটি প্রজাতির মধ্যে জিন ফ্লো আসলে ওভারঅল জিন ভ্যারিয়েশন কমিয়ে দেয়। বিবর্তনের ফলে নতুন ও বেশি প্রজাতি সৃষ্টি হয়, জেনেটিক ডাইভার্সিটি আসে।
কিন্তু এই জিন ফ্লো এর ফলে দুইটা প্রজাতি একটা হয়ে যায়, প্রজাতি কমে যায়। জিন ভ্যারিয়েশন বা ডাইভার্সিটি কমে যায়। কিন্তু, নতুন প্রজাতি ঠিকই গঠিত হয়।
শুধু একটা প্রজাতি হতে গিয়ে দুইটা প্রজাতির আত্ম-বলিদান দিতে হয়।
আজ এইটুকুই।