পর্ব-৬:কুদ্দুসের চাকরি ও সিলেকশন
কুদ্দুসের বয়স এখন ২৫ বছর। ইনকামের বয়স, পরিবারের হাল ওকে ধরতে হবে। রাস্তায় রাস্তায় চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু, ওর উল্টা-পাল্টা স্বভাবের জন্য কেউ ওকে চাকরি দেয়না। সেদিন,
চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেল, রুমে ঢুকতেই বলে উঠলো,
” আম্মেগো টয়লেটের বাত্তি জ্বলে না ক্যা? আন্ধারে ক্যাম্নে কাম সাড়েন?”
–”গেট আউট”
এভাবেই, কুদ্দুস চাকরি পায়না।
চাকরি না পেয়ে ও শেষমেষ অনুপ্রেরণা নিলো স্বাস্থ্যের ডিজির গাড়ির ড্রাইভারের থেকে। এখন ও চেষ্টায় আছে কোনো হত্তা-কর্তার চাকর-বাকর হওয়ার।
ও নিজের ধান্ধায় থাক, আমরা বিজ্ঞানটা বুঝে আসি।
কুদ্দুস চাকরি পাবেনা।ফলে? গার্লফ্রেন্ডের বাবা রিজেক্ট করে দেবে।
ফলে? কুদ্দুসের বংশ শেষ। ফলে?কুদ্দুসের বৈশিষ্ট্যগুলো ওর কারো মাঝে ট্রান্সফার হবেনা।ফলে? বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে যাবে।
মানে,কুদ্দুসের যেসব বৈশিষ্ট্য সমাজে টিকে থাকার জন্য প্রতিকূল, যেই বৈশিষ্ট্যগুলো ওকে চাকরি পেতে বাধা দিয়েছে,সেগুলো হারিয়ে যাবে। এভাবে ঘটে সিলেকশন বা নির্বাচন।
কোন ট্রেইটগুলো থাকবে, আর কোনগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তার নির্বাচন। এখানে কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো ব্যাক্তি বা বস্তু এই নির্বাচন করেনি, সমগ্র ব্যবস্থাটা মিলে একটা এমার্জেন্ট কোয়ালিটি হিসেবে নির্বাচকের মতো আচরণ করেছে।
একই বৈশিষ্ট্য একরকম পরিবেশে অনুকূল, আরেকরকম পরিবেশে প্রতিকূল হতে পারে। পরিবেশ নিজের সাপেক্ষে কোন ট্রেইট গুলো টিকবে, তা নির্বাচন করে দেয়।
একই ঘটনা যদি প্রকৃতিতে ঘটে, আর একটা সাধারণ প্রজাতি থেকে আলাদা প্রজাতির উৎপত্তি ঘটায়,তাহলে তাকে আমরা বলবো ন্যাচারাল সিলেকশন,প্রাকৃতিক নির্বাচন।
মহামতি ডারউইন, ভ্রমণ করতে করতে পৌছালেন গ্যালাপ্যাগাস আইল্যান্ডে।১৮ টা দ্বীপের সমষ্টি গ্যালাপ্যাগাস যেন এক জীবন্ত বিবর্তনের সাক্ষী! ডারউইন দেখলেন বিভিন্ন রকমের প্রাণীদের।
১৮ টা দ্বীপে একটার পরিবেশ অন্যটা থেকে সামান্য আলাদা, আর, প্রত্যেক দ্বীপে বসবাসকারী একই প্রজাতির প্রাণী সেই সামান্যতম পার্থক্যের সাথে মানিয়ে নেয়ার মতো করে আলাদা আলাদাভাবে তৈরি। যেমন- কচ্ছপের কথা বলি

গ্যালাপ্যাগাসের বড় দ্বীপগুলোতে ঘাস বেশি হয়।সেখানে কচ্ছপরা বড়,ভারী,তাদের শেল গম্বুজাকৃতির।
ছোট দ্বীপগুলোতে ঘাস কম হয়। ফলে, সেখানে কচ্ছপরা বাধ্য হয়ে ক্যাক্টাস খায়। ভালো ক্যাক্টাসগুলো থাকে গাছের ওপরে।আর, সেখানে কচ্ছপদের সামনের পা লম্বা, গলা লম্বা, আর শেলের সাম্নের দিকটা একটু উঁচু ও খোলা!
মানে এক্কেবারে পরিবেশের সাথে খাপে খাপ মেলানো!

ডারউইন দেখলেন ফিঞ্চ পাখিদেরকে। যেসব পাখি পোকা খায়, তাদের চঞ্চু লম্বা, মাটির ভেতরে থেকে পোকা বের করার জন্য উপযুক্ত।
আবার, যারা শস্যদানা খায়, তাদের চঞ্চু মোটা, শস্যদানা ভাঙার জন্য। এভাবে,একই ফিঞ্চ পাখির ১৪ টা প্রজাতির ১৪ রকমের বৈশিষ্ট্য, ১৪ রকমের পরিবেশের জন্য উপযুক্ত।
ডারউইন “হা” করে রইলেন! “ক্যাম্নে সম্ভব?”
এক্কেবারে র্যান্ডমলিতো এত খাপে-খাপ মিলে যাওয়া প্রাণীর আবির্ভাব অসম্ভব।
এজন্যই প্রাচীন গ্রীসে অনেক দার্শনিকরা বিবর্তনকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আসলেই, এক্কেবারে র্যান্ডমলি মিউটেশন মাধ্যমে পরিবেশের সামান্যতম প্রতিকূলতার সাথে মানিয়ে নেয়ার মতো বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব কীভাবে ঘটে? ডারউইন ভাবতে থাকলেন।
ওনার মাথায় বাত্তি জ্বলে উঠলো, কৃষকদের সিলেক্টিভ ব্রিডিং!
পর্ব-৭:কুদ্দুসের দাদা ও ব্রিডিং
ডারউইনের মাথায় ব্রিডিং এর বাত্তি জ্বলতেই সবটা তার কাছে বুড়িগঙ্গার পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। তাই, আমাদের এখন ব্রিডিং জিনিসটা বোঝা দরকার।
কুদ্দুসের দাদা, কৃষক ছিলেন। নাম শক্কর আলি। একদিন তার ইচ্ছা হলো আমের বাগান করবেন। বেশ ভালো জিনিস, খাইতে খুব ট্যাশ।
তাই,১০ টা চারা কিনে এনে লাগালেন। গ্রীষ্মকালে আম হলো, দেখলেন যে ১ টা গাছের আম ইয়া বড় বড়। বাকি নয়টা গাছের আম নর্মাল।
শক্কর আলি চালাক মানুষ। ওই গাছের থেকে যত আম হলো, প্রত্যেকটার আটি বুনলেন, বাকিগুলো ফেলে দিলেন।
পরের বছর আবার আম হলো। এইবার, সব গাছের আম ইয়া বড় বড়। কিন্তু একটা গাছের আম মধুর মতো মিষ্টি। হাত ধোয়ার পরেও ঘ্রাণ যায়না, খাওয়ার ৩-৪ দিন পরেও জিহ্বায় মিষ্টি ভাব থাকে। শক্কর আলি এই গাছের সব আটি বুনলেন, বাকিগুলো ফেলে দিলেন।
পরের বছর আবার আম হলো,এইবার সব আম ইয়া বড় বড় আর সেই রকমের মিষ্টি। কিন্তু, একটা গাছের আমে রোগ-বালাই কম হয়।
এইটা রাখলেন,বাকিগুলো ফেললেন।পরের বছর, আমগুলো বড়,মিষ্টি,রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
কুদ্দুসের দাদা এই আমের নাম দিলেন “শক্করাম”। কুদ্দুসের দাদা আম বিক্রি করে এখন গ্রামের সবচেয়ে পয়সা-ওয়ালা লোক।
এইবার যদি আমরা ৩ বছর আগের আম আর ৩ বছর পরের আমের তুলনা করি, উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখতে পারবো। এইভাবে যদি আরো কয়েক প্রজন্ম পার হয়?
এইভাবে করতে করতে ১০,২০,৫০,১০০ বছর পর দেখা যাবে, দেখে বোঝাই যায় না যে বর্তমানের আমটা ওই ১০০ বছর আগের আমেরই বংশধর।
এমন সময় একদল মুরুব্বি এসে শক্কর আলিকে বলবে,
“মিছা কথা কন ক্যা মিয়া? ওই আম থিকা এই শক্করাম হইতেই পারেনা। বান্দরের বাচ্চা কী মানুষ হয় কোনোদিন? আচ্ছা,মানলাম ওই আম থিকাই শক্করাম আইছে।
তাইলে এহনো ওই আমগাছ রইছে কেম্নে? সব আম শক্করাম হইয়া যাইতোনা?”
এনাদের বংশধররাই এখন বলে,
“বানর থেকে মানুষ আসলে এখনো বানর আছে কীভাবে?”
(বানর থেকে মানুষ আসেনি)
যাই হোক, কুদ্দুসের দাদা নতুন আমের প্রজাতি সৃষ্টি করলেন। এভাবে হয় ব্রিডিং।
র্যান্ডম মিউটেশনের ফলে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব ঘটে।এরপর কৃষক নির্ধারণ করেন যে কোন বৈশিষ্ট্য লাভজনক, সেটাকে পালন-পোষণ করে পরবর্তী প্রজন্মে নিয়ে যান। আবার একই ঘটনা ঘটে।এভাবে করতে করতে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়,যাদের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা।
এখন একদল মহাজ্ঞানী চিল্লায় উঠবেন,
“প্রমাণ কই?”
দিচ্ছি।
বর্তমানে আমরা যে ব্রকলি,ফুলকপি,বাধাকপি খাই, এরা প্রকৃতিতে ছিলোনা। এরা সবাই Brassica oleracea প্রজাতিরর এক প্রকার জংলি গাছের ব্রিডিং এর ফল। বর্তমানেও এরা আছে, একে wild mustard বলা হয়।
তারপর এত ধরনের কুকুর, এরাও প্রকৃতিতে ছিলোনা। এরা সব নেকড়ের বংশধর। আদিম মানুষেরা ধীরে ধীরে নেকড়েদের পোষ মানিয়ে কুকুর প্রজাতির সৃষ্টি করেছে।
তাদের মধ্যে কেউ বড় কুকুর, কেউ মোটা কুকুর, কেউ ছোট কুকুর, কেউ লোমশ কুকুর পছন্দ করে, পছন্দ অনুযায়ী বাছাই করতে করতে এত ধরনের কুকুরের আবির্ভাব।
Gray wolf কে বলা হয় সব কুকুরের কমন এন্সেস্টর।
এমনকি বর্তমানেও প্রতিনিয়ত ব্রিডিং হচ্ছে।তবে কৃষকদের দ্বারা না, বিজ্ঞানী আর গবেষকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ব্রিডিং হয়।
নাইলোটিকা মাছ, হরি ধান, ব্রাহমা গরু, বয়লার মুরগি, এরা সবাই একপ্রকার ব্রিডিং এর ফল।
IRRI নামের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণার সংস্থা এখনো ধানের ব্রিডিং ঘটায়, বাংলাদেশেও ধানের ব্রিডিং হয়। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে ব্রিডিং এর।
প্রকৃতিতেও এই ব্রিডিংই হয়। কোন বৈশিষ্ট্য টিকে যাবে, আর কোনটা বাদ যাবে, প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়।
আচ্ছা,ব্রিডিং না হয় বুঝলাম।কিন্তু, এখানেতো নির্বাচক হিসেবে মানুষ আছে। মানুষের চেতনা আছে, সে বুঝতে পারে যে তার কোনটা দরকার।কিন্তু প্রকৃতিরতো জ্ঞান-বুদ্ধি কিছুই নাই, সে কীভাবে ব্রিডিং করে? তার দরকারই বা কী ব্রিডিং করার?
পর্ব-৮: প্রকৃতিতে ব্রিডিং
গতপর্বে ব্রিডিং কী জিনিস তা আমরা ভালো করে বুঝেছি। এবার সময় ন্যাচারাল সিলেকশন বোঝার। এই টপিকটা বিবর্তন তত্ত্বের অন্যতম একটা ভিত্তি, আর দুঃখের বিষয়, এটা নিয়েই অনেক সূক্ষ্ম ভুল ধারণা আছে সবার মাঝে। তাই আমরা চেষ্টা করবো খুটে খুটে বোঝার।

মহামতি ডারউইন গ্যালাপ্যাগোসে ফিঞ্চদের হরেক রকম প্রজাতির উৎপত্তির চিন্তা করতে করতে তার মাথায় উদয় হলো “ব্রিডিং”, সাথে সাথে সব তার কাছে একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। আমরা প্রবেশ করবো ডারউইনের চিন্তার জগতে!
অমাবশ্যার রাত, প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ঝড়ো বাতাসে বড় বড় গাছ গুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। এমন সময়, একদল ফিঞ্চ পাখি উড়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ, প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটা এল,বাতাসের টানে তারা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উড়ে গ্যালাপ্যাগোসে চলে আসলো। বাস!
সকালে উঠে তারা দেখলো এ যেন “ফিঞ্চদের স্বর্গ”। খাবারের অভাব নেই, কোনো শিকারী নেই, গাছ-পালা ভরা এক Finch-Heaven এই গ্যালাপ্যাগোস।
এখন ফিঞ্চ পাখিরা খালি খায়,ঘুমায় আর ইচ্ছামতো বংশবিস্তার করে।দিন যেতে লাগলো, গ্যালাপ্যাগোসের আকাশ ভরে গেল ফিঞ্চ পাখি দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই ভোক্তা বাড়তে থাকলে আর উৎপাদনের হার ধ্রুব থাকলে খাদ্যসংকট দেখা দেবে। ঠিক সেটাই হলো।
এখন, ওদের নিজেদের মাঝে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি মারামারি লেগে গেল। যারা সাইজে বড়, শক্তি বেশি,দামড়া টাইপের, তারা এক প্রকার জিতে গেল।আর দুর্বলরা খাবারে ভাগ না বসাতে পেরে মারা গেল। কিন্তু তাও সমস্যার সমাধান হলোনা, খাদ্যাভাব রয়েই গেল।
এখানে ঢুকে যাবে র্যান্ডম মিউটেশন। র্যান্ডম মিউটেশনের ফলে ওই ফিঞ্চদের দলের কয়েকটা পাখির চঞ্চু ছিল একটুখানি লম্বা, আর কয়েকটা পাখির চঞ্চু ছিল একটুখানি মোটা। এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক! ক্লাসে ৬০ জন ছেলে-মেয়ে থাকলে দেখা যাবে ২০ জন বেশি লম্বা, ১০ জন বেশি খাট, ৩০ জন মাঝারি।
আর এখানেতো ফিঞ্চ ছিলো হাজারে-হাজারে।তাই, এক্কেবারে র্যান্ডমলি যে কয়েকজনের চঞ্চু লম্বা আর কয়েকজনের মোটা হওয়া অসম্ভব, তা বলাটা পাগলের প্রলাপ।
আবার এমন মনে করেন না যে অর্ধেকের মোটা আর অর্ধেকের লম্বা ছিলো, “কিছু কিছু পাখির”। হরেক রকম ভ্যারাইটিও ছিলো, কারো চ্যাপ্টা, কারো ছোট, কারো বাঁকা ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু, সুবিধা পেয়ে গেল মোটা আর লম্বা চঞ্চুর পাখিরা।তারা আবিষ্কার করলো যে তাদের মারামারির দরকার নাই।
মোটা চঞ্চুর ফিঞ্চরা শস্যদানা ভেঙে খেতে পারে বেশ ভালো করে, আর লম্বা চঞ্চুর ফিঞ্চরা মাটি থেকে পোকা-মাকড় তুলে খেতে পারে বেশ ভালো করে। এবং এর বিপরীতটাও সত্য, মোটা চঞ্চুর ফিঞ্চদের পোকা খেতে অসুবিধা হবে,আর লম্বা চঞ্চুর ফিঞ্চদের শস্য খেতে অসুবিধা হবে।
এভাবে, তারা একপ্রকার অঘোষিত সমঝোতায় চলে আসল।
খাবারের সুষম বণ্টন হলো, আর এই দুই বিশেষ র্যান্ডম ট্রেইটের পাখিরা অন্যদের থেকে বেশি টিকে গেল।
এবার, কুদ্দুস মুন্সীগঞ্জ থাকে।শহরের বাইরে যায় না বেশি। স্বাভাবিকভাবেই মুন্সীগঞ্জের কোনো মেয়েই ওর গার্লফ্রেন্ড হবে। কিন্তু কুদ্দুস বেকার বলে চৌধুরী সাহেব নিজের মেয়েকে কুদ্দুসের কাছে দেননি। থাক, ওর দুঃখের কথা না বলি!
একইভাবে, লম্বা চঞ্চুর ফিঞ্চরা বেশিরভাগ সময় একসাথে থাকে।কারণ, খাবারের জন্য তারা একই জায়গায় যায়, একই সাথে খায়। ফলে,তাদের গ্রুপ অন্যদের থেকে একটু আলাদা হয়ে গেল।
ফলে,তাদের নিজেদের মধ্যে বংশবিস্তার করার প্রবণতা আর সম্ভাবনা বেড়ে গেল।একই ঘটনা ঘটলো মোটা চঞ্চুর ফিঞ্চদের ক্ষেত্রেও।
যখন তারা নিজেদের মধ্যেই বংশবিস্তার করলো, তখন মোটা চঞ্চুর ফিঞ্চদের সন্তানের মোটা চঞ্চু, আর লম্বাদের লম্বা চঞ্চু হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গেল।
কারণ ব্যাখ্যা করলাম না, পানেট স্কয়ার নিয়ে আগে কথা বলেছিলাম। পিতা-মাতা উভয়েরই একই ট্রেইট থাকলে সন্তানের মধ্যে সেই ফিনোটাইপ প্রকাশের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
মানে, সার্বিকভাবে লম্বা চঞ্চুদের সন্তান লম্বা চঞ্চু আর মোটা চঞ্চুদের সন্তান মোটা চঞ্চুই হতে থাকলো।
আর, এখানে শুধু চঞ্চুই যে গুরুত্বপূর্ণ তা না। যারা পোকা খাবে, তাদের পুষ্টিমান আর যারা শস্য খাবে তাদের পুষ্টিমান আলাদা হবে, তাদের থাকা-খাওয়া যাবতীয় সবই ধীরে ধীরে আলাদা হবে।
এভাবে কয়েক হাজার প্রজন্ম পাড় হওয়ার পর তাদের মাঝে বৈশিষ্ট্যের এতটাই পার্থক্য দেখা দেবে যে তারা সম্পূর্ণ আলাদা দুটি প্রজাতি হয়ে যাবে।মানে তাদের নিজেদের মধ্যে উৎপাদিত সন্তান প্রজননক্ষম হবে না।
ফিঞ্চ-কথন এখানেই শেষ। ফিঞ্চদের এই ঘটনায় প্রকৃতি তাদের মধ্যে আলাদা প্রজাতি সৃষ্টি করেছে।
কীভাবে? ব্রিডিং করে। কাদের? মোটা চঞ্চু আর লম্বা চঞ্চুর পাখিদের। কীভাবে?
খাদ্যাভাবের মাধ্যমে। কেন? এই “কেন” প্রশ্নটা এক্কেবারে ফালতু। আসলেই যদি আমরা ঘটনাটা অনুধাবন করে থাকি, তাহলে বুঝতে পেরেছি যে এখানে যা ঘটেছে তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই এখানে কারো কোনো উদ্দেশ্য নেই।
সমগ্র ব্যবস্থা আর ফলাফল দেখে মনে হয় যে এখানে সিলেকশন ঘটেছে, আর তাকেই আমরা বলি ন্যাচারাল সিলেকশন।
আর এখানে আমি শুধু একটা বৈশিষ্ট্য,চঞ্চু নিয়ে কথা বলেছি, তাও মাত্র ২ ধরনের চঞ্চু। তাই মনে হতে পারে যে মাত্র একটা বৈশিষ্ট্যের কারণে একদম আলাদা, আস্ত দুইখান প্রজাতি সৃষ্টি হবে?
না। ফিঞ্চদের ১৪ রকমের প্রজাতি আছে, তাদের মধ্যে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে কয়েকশ।এসকল বৈশিষ্ট্যই তাদেরকে আপন পরিবেশের সাপেক্ষে অন্যদের তুলনায় বেশি সুবিধা দিয়েছে।
ফলে, এই ট্রেইটধারীরা টিকে গিয়েছে, বাকিরা হারিয়ে গিয়েছে।সবগুলো নিয়ে বলা সম্ভব না।
আর, এত্ত কাণ্ডকারখানা কিন্তু কয়েকবছরে হয়নি।কয়েক হাজার প্রজন্মের পর প্রজাতি আলাদা হয়েছে।
ফিঞ্চদের এক প্রজন্মের আয়ু ৭-১১ বছর। মাত্র ১০০০ প্রজন্ম ধরলেও সর্বোচ্চ ৭-৮ হাজার বছর সময় আছে আমাদের হাতে।আর ফিঞ্চরা বছরে ৪-৫ টা সন্তান উৎপাদন করে। ৭ বছরে ধরলাম প্রায় ২০ টা।
ফিঞ্চ আছে কয়েক হাজার, সময় আছে ৭-৮ হাজার বছর।এবার ভাবুন এত বিশাল সময়ে,এত বিশাল জনসংখ্যায় র্যান্ডম মিউটেশনের লীলা কত আজব পর্যায়ে যেতে পারে! আর তাতে ন্যাচারাল সিলেকশন ক্রিয়া করলে কত কী ঘটতে পারে!
Nature is amazing!
পর্ব-৯:প্রকৃতিতে আরেকটু ব্রিডিং
গতপর্বে আমরা সাক্ষ্য হয়েছি গ্যালাপ্যাগোসের ফিঞ্চদের জীবন্ত বিবর্তনের। আজও আমরা গ্যালাপ্যাগোসেই যাবো, দেখবো কচ্ছপদের বিবর্তন।তাই আর কোনো নাম খুঁজে পেলাম না এই পর্বের।
গ্যালাপ্যাগোসের দুই ধরনের কচ্ছপের কথা আগেই বলেছি, ন্যাচারাল সিলেকশনের কনসেপ্টটায় আরো ক্লিয়ার হওয়ার জন্য কচ্ছপদেরকেই টেনে আনলাম।
আবারো ঝড়ের রাত,বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে,প্রচণ্ড বাতাস,মুষলধারে বৃষ্টি, ওইসব। এমন সময়ে কয়েকটা কচ্ছপ সমুদ্রে ছিলো।
হঠাৎ প্রচণ্ড ঢেউ এল, তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল গ্যালাপ্যাগোসে, হয়তো কোনো ভাঙা গাছের কাণ্ড বা তেমন কিছুতে।
এরাও সকালে ঘুম থেকে উঠলো, নিজেদেরকে আবিষ্কার করলো সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায়।সেখানেই এরা থাকা শুরু করলো।
এই কচ্ছপদের মধ্যে ছিলো স্ত্রী-পুরুষ। তারা বংশবিস্তার করলো, অনেক সন্তান উৎপাদন করলো।
ধীরে ধীরে এরা গ্যালাপ্যাগোসের প্রায় প্রত্যেকটা দ্বীপেই ছড়িয়ে গেল। প্রকৃতির খেলা শুরু হবে এখন।
বড় দ্বীপগুলোতে ঘাস বেশি হয়, ফলে কচ্ছপদের খাওয়ার কোনো অসুবিধা নেই।
হাঁটে আর খায়, বসে আর খায়, ঘোরে আর খায়, এর চেয়ে সুখের জীবন আছে? কিন্তু, ছোট দ্বীপগুলোতে, যেখানে ঘাস কম হয়, সেখানে কচ্ছপরা সমস্যায় পড়ে গেল।
সেখানে দেখা দিল খাদ্যের অভাব। এখন, এক্কেবারে র্যান্ডমলি, র্যান্ডমলি মানে একদম র্যান্ডমলি, মিউটেশনের ফলে সেই ছোট দ্বীপের কয়েকটা কচ্ছপের গলা সামান্য লম্বা ছিলো। ফলে? এরা মুখ উঁচুতে নিয়ে গাছের ভালো ক্যাক্টাসগুলো খেতে পারতো।
তাই, এরা জীবনযাপনের জন্য বা টিকে থাকার জন্য সামান্য সুবিধা পেয়ে গেল।তবে, এই সামান্য সুবিধাই অনেক কিছু পরিবর্তন করতে পারে।
ছোট দ্বীপে যাদের গলা নর্মাল আকারের, তারা একটু কম খেতে পেল, ধীরে ধীরে তাদের খাদ্য কমতে থাকলো, তাদের পুষ্টির জোগান কমতে থাকলো, ফলে তাদের সমগ্র জীবনব্যাবস্থাটাই এক প্রকার খারাপভাবে প্রভাবিত হয়ে গেল।
যে খাবারই জোগাড় করতে পারে না, সে সন্তান উৎপাদন করতে কীভাবে?
আমি একটা বিষয় পরিষ্কার করতে চাই, এমন না যে সবকয়টা ছোটগলার কচ্ছপ খাবারের অভাব দেখা দেয়ার সাথে সাথে মারা যাবে,তা সম্ভব না।
এটা হবে খুব ধীরে ধীরে।বিবর্তন একটা ধীর-স্থির প্রক্রিয়া, তাই বড় প্রাণীদের ক্ষেত্রে বিবর্তনের প্রত্যক্ষ চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব।
যা বলছিলাম, লম্বা গলাদের সন্তান উৎপাদনের হার ছোট গলাদের থেকে বেশি হবে। এই হারের পার্থক্য বাড়তে থাকবে, কয়েকশ প্রজন্ম পর দেখা যাবে ছোট গলার কচ্ছপ সহজে পাওয়া যাচ্ছেনা।আর কয়েক হাজার প্রজন্ম পরে?
সবাই লম্বা গলার কচ্ছপ। এখনো কিন্তু প্রজাতি আলাদা হয়নি।
সবার গলা যখন লম্বা, তখন লম্বাগলা একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সবাইই ভালো ক্যাক্টাস খেতে পারে। কিন্তু, এদের মধ্যে আবার কারো কারো পা একটু লম্বা। কেন?
কারণ, বিবর্তনের নাট্যমঞ্চের পর্দার পিছনে প্রতিমুহূর্তে কাজ করে যাচ্ছে মিউটেশন। এটা হবেই,হতে থাকবেই,আর হবে একদম র্যান্ডমলি, কারো হস্তক্ষেপ ছাড়া।
আচ্ছা, যাদের পা লম্বা, তারা আরেকটু ওপরে উঠে খেতে পারলো। অন্যান্যদের থেকে লম্বা দেখে মেয়ে কচ্ছপরা এদের প্রতি বেশি আকর্ষিত হলো। ফলে,খাদ্যের পাশাপাশি প্রজননের দিক দিয়েও এরা সামান্য বেশি সুবিধা পেয়ে গেল।
আগের মতোই ঘটনা ঘটবে, প্রজনের হার বেশি, টিকে থাকার সুবিধা বেশি ইত্যাদি।তাই বারবার লিখলাম না।
বহু বছর পর, সবার গলা লম্বা, সবার পা লম্বা।এবার? মিউটেশন চলমান, কয়েকজনের shell এর সামনের দিকটা একটু খোলা, ফলে এরা গলা আরো একটু লম্বা করতে পারলো।
আবারো একই ঘটনা, কালের আবর্তনে, সাধারণ shell এর কচ্ছপদের সংখ্যা কমতে কমতে শুণ্য হয়ে যাবে। এবার, সবার গলা লম্বা, পা লম্বা, shell এর সামনের দিকটা একটু খোলা।
এখন যদি কেউ ওই ঢেউয়ের ঠেলায় ভেসে আসা কচ্ছপদের সাথে এদের তুলনা করে, চোখে পড়ার মতো পার্থক্য দেখতে পাবে।
এভাবে, কয়েক হাজার প্রজন্ম পার হবে, আমি শুধু “লম্বা” হওয়া নিয়ে আলোচনা করলেও পাশাপাশি আরো অনেক বিষয়, শিকারি, রোগ-ব্যাধি,আবহাওয়া ইত্যাদি কাজ করবে।
বিভিন্ন ট্রেইটের নির্বাচন হবে, একসময় প্রজাতিই আলাদা হয়ে যাবে!
আবার, পাশের বড় দ্বীপগুলোর কচ্ছপদের ক্ষেত্রেও একইরকমের সিলেকশন ঘটবে, ফলে তারাও তাদের ভেসে আসা আদিপিতাদের থেকে একদম আলাদা হয়ে যাবে, আর দুইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের প্রজাতির উদ্ভব ঘটবে, ঘটালো কে? ন্যাচারাল সিলেকশন।
গ্যালাপ্যাগোসে ১৫ প্রজাতির কচ্ছপ ছিলো, এখন টিকে আছে ১১ টা।
এখানে আরো কয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন, আমরা কখনো বিবর্তন হতে দেখিনা কেন?উত্তরের জন্য রিচার্ড ডকিন্স এর একটা ব্যাখ্যাকে আমার মতো করে তুলে ধরলাম।
আচ্ছা, আপনি কী কোনো একটা মুহূর্তে ঘড়ির ঘণ্টার কাটাকে নড়তে দেখেন?না। হঠাৎ করে আবিষ্কার করেন কাটাটা ১ থেকে ২ এ বা ৩ থেকে ৪ এ চলে এসেছে।
একই ঘটনা ঘটে আমাদের সাথেও। বিবর্তনের ক্ষেত্রে সময়ের স্কেলটা হাজার-হাজার বছরের থেকে শুরু করে মিলিয়ন-মিলিয়ন বছরের পর্যন্ত হতে পারে।
আর আপনি ৬০ বছর বাঁঁচবেন কিনা তা ই সন্দেহ, মাত্র ৬০ বছরে কোনো প্রাণীর সন্তান উৎপাদনে মিউটেশনের বৈচিত্র কতটুকু হতে পারে?যতটুকুও হয়, তা একেবারে ধরার বাইরে। কিন্তু, যখন আপনি কয়েক মিলিয়ন বছর সময় দিচ্ছেন, অনেক ছোট ছোট মিউটেশনের টিকে যাওয়া ও বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে।
যেভাবে, ১X১০০০=১ ই, কিন্তু ১.০১X১০০০=১০১০।প্রতি প্রজন্মের মাত্র ১ % পরিবর্তন হলেও ১০০০ প্রজন্ম পর সংখ্যাটা ১.০১ থেকে বিবর্তিত হয়ে ১০১০ হয়ে যায়।
অঙ্কের মাধ্যমে আসলে এখানে বিষয়টাকে অনেক অবাস্তব আর ড্রামাটিকভাবে দেখানো হয়েছে।১০১০ লাগবে না, ১ থেকে ৫ হওয়াই যথেষ্ট।
আর ১০০০ প্রজন্ম অনেক কম সময়, বিবর্তনের স্তরে সময় থাকে আরো অন্নেএএএক বেশি।
সারাংশে, মিউটেশনের ফলে নতুন ট্রেইটের আবির্ভাব হয়,পরিবেশের জন্য উপযুক্ত ট্রেইটগুলো টিকতে থাকে, একসময় এই র্যান্ডম মিউটেশন হতে পাওয়া টিকে যাওয়া ভিন্ন ট্রেইটের সংখ্যা এত বেশি হয়ে যায় যে, আলাদা প্রজাতি তৈরি হয়।
পর্ব-১০:সিলেকশনের খুঁটি-নাটি(১)
গত কয়েক পর্বে ন্যাচারাল সিলেকশন আমরা বেশ ভালো একটা ধারণা পেয়েছি। এখন,জানা প্রয়োজন এর প্রকারভেদ নিয়ে।
ন্যাচারাল সিলেকশনকে সাধারণত তিনটা প্রকারে ভাগ করা হয়।
নাহ্, স্কুলের স্যারদের মতো একটা একটা পয়েন্ট পড়ায়ে মুখস্ত করাবো না, আগে বুঝাবো, পরে জানাবো।
১৯ শতক, ইংরেজরা তখন এক তুঙ্গে উঠে বসে আছে। এই সময়টাতে নাকি ইংরেজ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য ডুবতো না। ১৭৬০ সালে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়ে ১৮৪০ পর্যন্ত এক বিশাল সময়ে সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিলো ইংরেজরা।
কিন্তু, এর ফলে শুধু সভ্যতারই মোড়ই ঘোরেনি, বিবর্তনের ছোট একটা গলিও ঘুরে গিয়েছিলো।
পেপার্ড মথ (peppered moth) নামে এক প্রকার পোকা আছে। বাংলায় কী বলে জানিনা। নিচে ছবি দেখে নিয়েন।

বারবার এর নাম নেয়া লাগবে বলে একে “মইত্থা” ডাকনাম দিলাম।(কারণ-গ্রামের মানুষরা অ+ব্যাঞ্জন ধ্বনি থাকলে সেখানে অই+ব্যাঞ্জন ধ্বনির দিত্ব+আ লাগায় ডাকে)
তো, ১৮১১ সালের আগে সব সাদা রঙের মইত্থা দেখা যেতো,ধলা মইত্থা। কালা মইত্থা ছিলোই না, মানে ধরা পড়েনি, কেউ জীবনে দেখেওনি। হঠাৎ, ১৮৪৮ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে প্রথমবারের মতো কালা মইত্থা ধরা পড়ে।

ব্যাপার না,এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো। কারণ আমরা জানি যে জিন-এলিলরা মাঝে মাঝে ভুল-ভাল পথে চলে গিয়ে মিউটেশন ঘটায় ফেলে, তাই দুই-একটা কালা মইত্থা পাওয়া তেমন আহামরি কিছু না।
কিন্তু, ঘটনা ঘটলো ১৯ শতকের শেষের দিকে। ১৮৯৫ সালে এসে কালো মইত্থার সংখ্যা আচমকা ৯৮% বেড়ে গেল। মানে, ধলা মইত্থা দেখা তখন সৌভাগ্যের ব্যাপার, এমন একটা অবস্থা। এইবার বিজ্ঞানীদের টনক নড়লো।
বাংলাদেশে হলে সবার আগে তদন্ত কমিটি গঠন হতো, যার প্রধান থাকতো কোনো এক্সট্রা-ডাইমেনশনাল মাল্টিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী নেয়া সাধক তান্ত্রিক বাবা। যাই হোক!
হঠাৎ করে কালা মইত্থা কেন বাড়লো? নানা মুনী নানা মত দিলেন। তবে, সঠিক ধারণার উত্থান করেছিলেন J.W. Tutt নামের এক ভদ্রলোক।১৮৯৬ সালে,ডারউইনের মৃত্যুর ১৪ বছর পর, তিনি বললেন,
” ইহা ন্যাচারাল সিলেকশনের কেরামতি!”
তখন থেকে এই “মিরাকল অফ মইত্থা” নিয়ে ছোট-খাট গবেষণা শুরু হয়, সম্ভবত ২০১২ সালে এ নিয়ে সবচেয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রকাশ হয়। আমরা সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করবো।
ম্যানচেস্টার ছিলো ইংল্যান্ডের সবচেয়ে শিল্পোন্নত শহরগুলোর একটা। শিল্পবিপ্লবের ফলে সারা বিশ্বে কয়লার ব্যাবহার বেড়ে যায়, কয়লা মানেই কার্বন, আর কার্বন মানেই কালা।
মুক্ত পরিবেশে যখন কার্বনের পরিমাণ বেড়ে গেল, গাছ-পালা আর বিভিন্ন স্থাপনার গায়ে কার্বন লেগে তাদের রঙ অনুজ্জ্বল হয়ে গেল। ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হলেও সত্য, আপনার চারপাশে তাকালেই বুঝতে পারবেন।
তো, সবকিছু যখন কালা হয়ে গেল, কী হলো? ধলা জিনিসগুলো ফুটে উঠলো, চোখে পড়লো, বেশি দৃষ্টিগোচর হলো। এর আগে সবকিছু যখন পরিষ্কার ছিলো, সাদা-কালো তেমন ম্যাটার করতো না। কিন্তু, এখন করে।
শিল্পবিপ্লবের আগে সব ছিলো ধলা মইত্থা।দুই-একখান কালা মইত্থা যদিও বায়-চান্স জন্ম নিতো, নিজের মিউটেশনকে পরবর্তী প্রজন্মে তেমন আকারে পাস করতে পারতোনা।
ফলে কালা মইত্থাদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম, প্রজননের হার ছিলো ধ্রুব। কিন্তু, যখনই শিলবিপ্লব হলো, পরিবেশে কার্বন বাড়লো, সবকিছু কালো কালো হয়ে গেল।
তখন, সাদা মইত্থারা একদম ফুটে রইলো, সহজেই চোখে পড়ার মতো। ফলে, শিকারীদের সুবিধা হয়ে গেল। আগে ধলা মইত্থা চোখে পড়বে, আগে তাকেই ধরবে।
অন্যদিকে, কালা মইত্থা নিজের কালা
ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে মিশে গেলে, সহজে চোখে পড়লো না, সহজে শিকার হলোনা।ফলে, ধীরে ধীরে সাদা মইত্থার সংখ্যা কমতে লাগলো। মানে? কালা মইত্থার সংখ্যা বাড়তে লাগলো।
এভাবে, একসময় এতটাই বেড়ে গেল যে, মইত্থা মানেই কালা মইত্থা। এই ঘটনাকে বলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেলানিজম। মানে, শিল্পোন্নয়নের কারণে কোনো প্রজাতিতে গাঢ় পিগমেন্টের আধিক্য হওয়া।
এটা হয় ন্যাচারাল সিলেকশনের কারণে।
১৯৭৮ সালে সিওয়াল রাইট বলেন,” এটা (মিরাকল অফ মইত্থা) প্রথম ঘটনা, যেখানে বিবর্তন সুস্পষ্টভাবে অবজার্ভ করা হয়েছে।”
আচ্ছা, এই মিরাকল অফ মইত্থায় কোন ধরনের ফিনোটাইপটা সিলেক্টেড হয়েছে? শুধু গাঢ় ধরনের। মানে, একটা নির্দিষ্ট ফিনোটাইপ এর সংখ্যা ভীষণভাবে বেড়ে গিয়েছে।
এই ধরনের ন্যাচারাল সিলেকশনকে বলে “ডায়রেকশনাল”।
মানে, কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের চরম বা ভীষণ ধরনের ফিনোটাইপের সিলেকশন। এক্ষেত্রে, মইত্থাদের রঙের ক্ষেত্রে গাঢ় রঙের সিলেকশন হয়েছে।
এই জিনিসটার গ্রাফ আকালে কেমন হবে? x অক্ষে ট্রেইট, বাম দিক থেকে হালকা শুরু করে ডানদিকে গাঢ় বা চরম বা ভীষণ ধরনের ফিনোটাইপ। আর y অক্ষে জনসংখ্যা। নিচে ছবি দেয়া আছে, ঢেউটা গাঢ় ট্রেইটের দিকে সড়ে যাবে।
এই ধরনের সিলেকশনে এলিল ফ্রিকোয়েন্সি নির্দিষ্ট ফিনোটাইপের দিকে শিফট হয়।
তো, আমরা ন্যাচারাল সিলেকশনের প্রমাণ পাওয়ার পাশাপাশি এর একটা প্রকারভেদও জেনে নিলাম।
আরেকটা খুশির খবর, পরবর্তীতে দূষণ কমালে ধলা মইত্থার সংখ্যা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো।