বিবর্তন!!!!!
শব্দটা শুনেই সর্বপ্রথম মাথায় আসে মহামতি চার্লস ডারইউনের ছবি, আর তারপর আসে একটা বানর থেকে ধাপে ধাপে মানুষ হওয়ার ছবি।
দাড়ান,বিবর্তন তত্ত্ব কিন্তু কখনোই বলেনা যে বানর থেকে মানুষ এসেছে,এটা একটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা আর বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত একটা ভুল ধারণাও বটে ।
এমন অগণিত ভুল ধারণার আচ্ছাদনে বিবর্তনের মতো চমকপ্রদক একটা তত্ত্ব, যা আধুনিক জীববিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি, তা অনেক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
যদিও মানুষ কি ভাবলো,না ভাবলো, তাতে বিজ্ঞানের কিছু যায়-আসেনা, বিজ্ঞান সর্বদা প্রমাণ আর পরীক্ষণের ওপরই চলেছে,চলছে আর চলবে। বর্তমানে যারা বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধিতা করে, তারা এমন সব উদ্ধৃতি দেয়, যা বিবর্তন তত্ত্বে কোনোদিন বলা হয়নি।
এসব ভুল ভাঙিয়ে বিবর্তন আসলে কী, কীভাবে হয় আর এর প্রমাণই বা কি, তা বোঝানোর চেষ্টা করবো এই সিরিজে,
An Evolving Life
পর্ব-১:ভূমিকা
বিবর্তন বিষয়টা যেমন সুন্দর, কাওকে বোঝানো ততটা কঠিন। যখন ভাবলাম যে বিবর্তন নিয়ে কিছু লিখবো, মাথায় ডিপজলের ডায়লগটা বেজে উঠলো,
“তুই কিন্তু বহুত বড় জায়গায় হাত দিছস।”
তাও,সাহস করে লেখা শুরু করলাম, ভুল হলে অনুগ্রহ করে ধরিয়ে দেবেন আর ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
পৃথিবীতে ৮.৭ মিলিয়ন প্রজাতির জীব আছে। আরেকবার শুনুন, ৮.৭ মিলিয়ন!!!প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য আলাদা!
কারো ২ টা হাত, কারো ৪ টা,কারো ৮ টা।কারো ৮ টা চোখ, কারো চোখই নাই। কেউ মাটিতে,কেউ পানিতে,কেউ বাতাসে।কেউ দৌড়ায়, কেউ হাটে,কেউ ঘোরে,কেউ ওড়ে,কেউ কিছুই পারেনা! এত্তকিছু আসলো কোথা থেকে?
এত প্রাণী কী আকাশ থেকে পড়লো, নাকি মাটি চিড়ে উঠলো? এই প্রশ্নটাই একসময় ভাবিয়েছে মানুষকে।নানান মানুষ নানান কল্পনা করেছে, বহুযুগ ধরে চলেছে রূপকথার রাজত্ব।
কিন্তু, Science always wins.
আজ আমরা পেয়েছি “বিবর্তন তত্ত্ব”, যা সফল ভাবে ব্যাখ্যা করে রঙ-বেরঙের প্রাণীদের উৎপত্তি,পরীক্ষণ আর পর্যবেক্ষণ দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত একটি তত্ত্ব।
যদিও বিবর্তন খুব নতুন কোনো তত্ত্ব না,বহু আগে এক আরবীয় বিজ্ঞানী, আল জাহিয
এই বিবর্তনের ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি তার বই, “কিতাব-আল-হায়াওয়ান” বা “প্রাণীদের বই” এ লিখেছেন,
“একজন কালো রঙের চুলওয়ালা যুবকের মাথার উঁকুনগুলো কালো, আর একজন ধূসর রঙের চুলওয়ালা বৃদ্ধের মাথার উঁকুনগুলোও ধূসর।”
এইটা মাইক্রো-ইভোলুশনের সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ, যা আমরা দৈনন্দিন জীবনেই দেখতে পাই, কিন্তু অতটা খেয়াল করিনা।
আল জাহিয এরপর ন্যাচারাল সিলেকশন ও টিকে থাকার লড়াই বা সার্ভাইভাল ফর এক্সিস্টেন্স নিয়ে সামান্য বর্ণনাও দিয়েছেন।কিন্তু, অতটা সাড়া ফেলতে পারেননি।
প্রাকৃতিক নির্বাচন
চার্লস ডারউইনের প্রায় এক হাজার বছর আগে ইরাকে একজন মুসলিম দার্শনিক ছিলেন যিনি প্রাকৃতিক নিয়মে প্রাণীকুলের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে তার উপর একটি বই লিখেছিলেন।
এই দার্শনিকের নাম ছিল আল-জাহিজ। যে পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন ঘটে তিনি তার নাম দিয়েছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচন।
তার আসল নাম ছিল আবু উসমান আমর বাহার আলকানানি আল-বাসরি, তবে ইতিহাসে তিনি আল জাহিজ নামেই বেশি পরিচিত।
তার এই নামের অর্থ এমন একজন ব্যক্তি যার চোখের মণি বেরিয়ে আসছে।
এই আল-জাহিজ নামটিই বিখ্যাত হয়ে আছে তারই লেখা প্রজনন সংক্রান্ত একটি বই-এর কারণে। গ্রন্থটির নাম কিতাব আল-হায়ওয়ান অর্থাৎ প্রাণীদের বিষয়ে বই।
তার জন্ম হয়েছিল ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে, দক্ষিণ ইরাকের বাসরা শহরে, মুতাজিলাহ আন্দোলনের সময়। এসময় ধর্মতাত্ত্বিক কিছু মতবাদ জনপ্রিয় হচ্ছিল যেখানে মানুষের যুক্তির চর্চার উপর জোর দেওয়া হচ্ছিল।
তখন ছিল আব্বাসীয় খেলাফত বা শাসনের চরম সময়। সেসময় জ্ঞান বিজ্ঞানের অনেক বই গ্রিক ভাষা থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হতো। জোরালো বিতর্ক হতো ধর্ম, বিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়ে। এসবের কেন্দ্র ছিল বাসরা শহর। এসব আলোচনা থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল আল-জাহিজের চিন্তাধারা।
চীনা বনিকেরা ততদিনে ইরাকে কাগজের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন তত্ত্ব লিখিত আকারে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।
তরুণ আল-জাহিজ তখন নানা বিষয়ে লেখালেখি করতে শুরু করেন। যেসব বিষয়ে তার খুব বেশি আগ্রহী ছিল সেগুলোর মধ্যে ছিল বিজ্ঞান, ভূগোল, দর্শন, আরবি ব্যাকরণ এবং সাহিত্য।
ধারণা করা হয় তার জীবদ্দশাতেই তিনি দুশোর মতো বই প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার মাত্র এক তৃতীয়াংশ এই আধুনিক কাল পর্যন্তও টিকে রয়েছে।
দ্য বুক অফ অ্যানিমেলস
তার বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে দ্যা বুক অফ অ্যানিমেলস বা প্রাণী বিষয়ক বইটি।
এটি একটি এনসাইক্লোপিডিয়ার মতো যাতে সাড়ে তিনশো প্রাণীর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এই বইটিতে তিনি এমন কিছু ধারণা তুলে ধরেছেন যার সাথে আধুনিক কালের বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদে তত্ত্বের চমকপ্রদ অনেক মিল পাওয়া যায়।
আল-জাহিজ তার বইতে লিখেছেন, “টিকে থাকার জন্যে প্রাণীদেরকে লড়াই করতে হয়। লড়াই করতে হয় তাদের খাদ্যের জন্যেও, এবং তারা নিজেরাই যাতে অপরের খাদ্য না হয়ে যায় সেটা নিশ্চিত করার জন্যে। এমনকি, প্রজননের জন্যেও তাদেরকে সংগ্রাম করতে হয়।”
“নিজেদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে পরিবেশের নানা কারণে প্রাণীরা নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এভাবেই তারা নতুন নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়।”
তিনি আরো লিখেছেন, “যেসব প্রাণী প্রজনন ঘটাতে টিকে থাকতে পারে তারা তাদের সফল বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারে।”
আল-জাহিজের কাছে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল যে এসব প্রাণীকুলকে টিকে থাকার জন্যে অনবরত সংগ্রাম করতে হয়। এবং একটি প্রজাতি সবসময়ই আরেকটি প্রজাতির চেয়ে শক্তিশালী।
টিকে থাকার জন্যে খাবার সংগ্রহের লড়াই-এ প্রাণীদের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়। অন্যের খাবার হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং সন্তান জন্মদান করতেও তাদের সংগ্রাম করতে হয়।
এসব কারণে তারা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে রূপান্তর ঘটাতে বাধ্য হয়।
আল-জাহিজের এসব ধারণা তার পরবর্তী অন্যান্য মুসলিম চিন্তাবিদদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন আল-ফারাবি, আল-আরাবি, আল বিরুনী এবং ইবনে খালদুন।
পাকিস্তানের ‘আধ্যাত্মিক পিতা’ মোহাম্মদ ইকবাল, যিনি আল্লামা ইকবাল নামেই অনেক বেশি পরিচিত তিনিও আল জাহিজের এসব তত্ত্বের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত তার বক্তব্যের একটি সঙ্কলনে তিনি বলেছিলেন, “আল-জাহিজ দেখিয়ে দিয়েছেন অভিবাসন এবং পরিবেশে পরিবর্তনের কারণে প্রাণীদের জীবনে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে।”
‘মোহাম্মদীয় তত্ত্ব’
বিবর্তনবাদের ধারণায় মুসলিম বিশ্বের অবদান বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কাছে গোপনীয় কোন বিষয় নয়।
এমনকি, চার্লস ডারউইনের একজন সমসাময়িক বিজ্ঞানী উইলিয়াম ড্রেপার ১৮৭৮ সালে “বিবর্তনবাদের মোহাম্মদীয় তত্ত্ব” নিয়ে কথা বলেছিলেন।
তবে যাই হোক, চার্লস ডারউইন মুসলিম বিজ্ঞানী আল-জাহিজের চিন্তাধারা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন কিনা কিম্বা তিনি আরবি বুঝতেন কিনা তার পক্ষে কোন তথ্য প্রমাণ নেই।
ব্রিটিশ এই বিজ্ঞানী প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন যেখানে প্রাণীর টিকে থাকার সংগ্রামের কথা বিশদ ও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ক্রিয়েশনিজম
দশম শতাব্দীর ইরাকে, যখন বাসরা ও বাগদাদ ইসলামিক সভ্যতা ও শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তখনও ক্রিয়েশনিজমের ধারণা খুব একটা জোরালো ছিল না।
ক্রিয়েশনিজম হচ্ছে এমন এক ধর্মীয় বিশ্বাস যাতে মনে করা হয় “ঐশ্বরিক কোন ঘটনা থেকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও প্রাণের সৃষ্টি” হয়েছিল যা প্রকৃতির বিবর্তনবাদের ধারণার বিরোধী।
সাংবাদিক এহসান মাসুদ ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লিখেছেন, “বিজ্ঞানীরা তখন নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করার লক্ষ্যে বাইরে বের হয়ে পড়তেন।”
এই জ্ঞানের অন্বেষণ করতে গিয়েই মুসলিম দার্শনিক আল-জাহিজের মৃত্যু হয়েছিল।
বলা হয়ে থাকে যে ৯২ বছর বয়সী আল-জাহিজ যখন একটি আলমারি থেকে বই নামাতে গিয়েছিলেন তখন আলমারিটি তার গায়ের ওপরে পড়ে গেলে তিনি মারা গিয়েছিলেন।
তথ্যঃ বিবিসি বাংলা
বহুযুগ পরে,সভ্যতার হাল যখন ইংরেজদের হাতে, জর্জ ক্যাভিয়ার, চার্লস ল্যায়ল,জন ব্যাপ্টিস্ট লামার্ক ও থমাস ম্যালথাস সহ অনেকে বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেন।
তারা এইটুকু সঠিক ধরতে সক্ষম হন যে, সকল প্রজাতির প্রাণীই একটা প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু সেই প্রাণীটা কে, কীভাবে বিবর্তন হলো, কোথায়, কখন, কেন, ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি।
যেমন লামার্ক, তিনি বললেন,” জিরাফের আদিপিতারা ছোট ছিলো, কিন্তু ওরা যেখানে থাকতো, সেখানে গাছের পাতা ছিলো উঁচুতে, ফলে ওরা গলা লম্বা করে খাওয়ার চেষ্টা করতো।
এভাবে লম্বা করতে করতে ধীরে ধীরে আজকের জিরাফের গলা এত লম্বা!” মানে, বৈজ্ঞানিক ভাষায়, উনি জিনের ওপর পরিবেশ প্রভাবকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
বসবাসের পরিবেশ জিনকে অতি সামান্য প্রভাবিত করলেও, গলা লম্বা করে নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করতে পারেনা।
তাই, লামার্ক,তুমি ভুল বলেছিলে।
১৯ শতক
একজন সাদা দাড়িওয়ালা ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী, চার্লস ডারউইন, আর তার বন্ধু ওয়ালেস। একই প্রশ্ন তাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, “এত্তকিছু কইত্থে আইলো?”
আগের বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু বলে গেছেন, কিন্তু তা মনে ধরেনি এই দুইজনের। শুরু করলেন গবেষণা,শুরু করলেন বিশ্বভ্রমণ।
ডারউইন চলে গেলেন দক্ষিণ আমেরিকার গ্যালাপ্যাগাস আইল্যান্ডে,১৮ টা দ্বীপের সমষ্টি। আর ওয়ালেস দক্ষিণ আমেরিকার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায়ও যান।
শোনা যায় যে এমাজন জঙ্গলেও গিয়েছিলেন। বহুদিন চিন্তা-ভাবনা,পরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ করার পর, দুই বন্ধু তাদের নোট মিলাতে লাগলেন। তারপর আগের বিজ্ঞানীদের গবেষণার দিকে তাকালেন। তাদের মাথায় বাতি জ্বলে উঠলো,
“বিবর্তন”!!!
১৮৫৮ সালে লন্ডনে বিজ্ঞানীদের সভায় উপস্থাপন করলেন তাদের গবেষণা।অনেকে মেনে নিলো,অনেকে বিরোধিতা করলো।
প্রতিষ্ঠিত হলো জীববিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি,বিবর্তন তত্ত্ব। পরবর্তীতে গ্রেগর জোহান মেন্ডেল, হার্ডি, ওয়েইনবার্গ, মরগান সহ অনেকে জড়িয়ে যাবেন বিবর্তন তত্ত্বের সাথে।
পর্ব-২:খুঁটি-নাটি থেকে “ইউনিক কুদ্দুস”
বিবর্তন তত্ত্বের এক্কেবারে বেসিকে আছে ডিএনএ, জিন, এলিল, ক্রোমোজোম এর মতো জিনিস। এগুলো নিয়ে প্রায় সবারই একটা ধারণা আছে, তাও, একবার ঝালাই করতে সমস্যা কী!
A,G,C,T, এই চারটা অক্ষর ঠিক করবে যে আমার চুল কেমন হবে, চোখ কেমন হবে, আমি জিরাফের মতো লম্বা হবো, নাকি খচ্চরের মতো খাটো হবো, ইত্যাদি সব বৈশিষ্ট্য।
এদেরকে বলে নিউক্লিওটাইড। এরা পরপর বসে তৈরি করে ডিএনএ এর পলিনিউক্লিওটাইড বা একটা সুঁতা, দুইটা সুঁতা কুণ্ডলীর মতো প্যাচায় যাবে, তৈরি করবে ডাবল হেলিক্স।এইপাশে A থাকলে তারসাথে যুক্ত হবে ওইপাশের T।
একইভাবে, C এর সাথে G। এভাবে এরা পরপর বসে তৈরি করে তথ্য এনকোড করবে। সেই তথ্য অনুযায়ী প্রোটিন উৎপাদন হবে।
আমার চুলের আগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সব হচ্ছে প্রোটিন। (এই “সব” মানে ওই “সব” না)
তো, ডিএনএ বহুত লম্বা হয়। আমার সারা বডির ডিএনএ খুলে ফেললে তা দিয়ে নাকি প্লুটো পর্যন্ত যাওয়া-আসা করা যায়। অন্নেএএক লম্বা!!!
এই ডিএনএ এর একেক অংশ একেক কাজ করে।
অনেকগুলো নিউক্লিওটাইড মিলে যদি একটা নির্দিষ্ট প্রোটিনের জন্য কাজ করে, ডিএনএ এর সেই অংশটুকুকে একটা জিন বলে। ধরলাম, আমার মাথার সবচেয়ে ওপরের ডানদিকের কোষটায় ২ মিটার ডিএনএ আছে।
এর গোড়া থেকে শুরু করে ২০ সেন্টিমিটার(এমনি ধরলাম) পর্যন্ত নিউক্লিওটাইডগুলোতে আমার একটা চুলের রঙ কী হবে, তা লেখা।
লেখা বলতে এনকোড করা, এই অনুযায়ী পিগমেন্টের প্রোটিন তৈরি হবে, আর তা গিয়ে আমার চুলে ঢুকবে। এই ২০ সেন্টিমিটার হলো একটা জিন।
আচ্ছা, আমার চুল কাকের মতো কালো বলে কী সবার চুল কালো নাকি? ব্রিটিশ প্রিন্স হ্যারি, ওনার চুলের রঙ, কী সুন্দর লালাভ।এমন হলো কেন? ওনার গায়ে কী জিন নাই?
আছে। তাহলে? যেই জিন আমার চুলের রঙ ঠিক করছে, সেই একই জিনই ওনারও চুলের রঙ ঠিক করছে।
কিন্তু, ওনার জিন উৎপাদন করবে লাল রঙের পিগমেন্টের প্রোটিন। এইরকমভাবে, একই ধরনের জিনের ভিন্ন ভিন্ন রূপকে বা ভিন্ন ধরনের প্রোটিন উৎপাদনকারী একই ধরনের জিনকে বলে এলিল। আমার হলো কালো এলিল, আর প্রিন্স হ্যারির লাল এলিল।
কিন্তু জিন একটাই, চুলের রঙের জিন। বুঝছেন?
এবার, ফিরে যাই ডিএনএ তে।হিস্টোন নামের একটা প্রোটিন আছে। এক একটা হিস্টোন চাকতির চারপাশে ডিএনএ এর ১৪৬ টা বেস-পেয়ার প্রায় ১.৭ টা প্যাচ দেয়।
বেস পেয়ার মানে দুইটা নিউক্লিওটাইডের একটা জোড়া, ওই A-T, C-G। তাহলে, এইভাবে প্যাচাতে প্যাচাতে অনেকগুলো হিস্টোনের চারপাশে বিশাল পরিমাণে ডিএনএ প্যাচায়, আর একটা দড়ির মতো তৈরি করে। একে বলে ক্রোমাটিন।
এই ক্রোমাটিন আবার ওলট-পালট হয়ে নিজের মধ্যে নিজে ঘোর-প্যাচ দিয়ে আরো মোটা একটা দড়ির মতো হয়, একে বলে ক্রোমাটিড। মানে ক্রোমাটিন যদি মশারি টাঙানোর দড়ি হয়,ক্রোমাটিড হবে গরু বাঁধার দড়ি।
আচ্ছা, এবার দুইটা ক্রোমাটিড যুক্ত হবে একটা সেন্ট্রোমিয়ার দিয়ে। তৈরি হলো ক্রোমোজোম।
এতক্ষণের লেখায় বিবর্তনের গন্ধ-বাস আসেনি, এইবার আসবে। মানুষের ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম আছে। ২৩ টা পিতা হতে, আর ২৩ টা মাতা হতে আসবে। এবার পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্যতো এক না।
কুদ্দুসের আব্বা আদর করার সময়ও ঝাড়ি দেয়,মা কথা বলতে গেলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। আব্বা ৬ ফুট, মা সাড়ে ৫ ফুট ।
আব্বা কালোজামের মতো, মা সন্দেশের মতো।আব্বার নাক একদম তীরের আগার মতো, মায়ের নাক বোঁচা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবার “কুদ্দুস উৎপাদন প্রক্রিয়ায়” পিতা-মাতার ক্রোমোজোম লাগবে। কিন্তু এই ক্রোমোজোম রিকম্বিনেশন হবে ২ বার। গ্যামেট তৈরি হওয়ার সময় একজনের ৪৬ টা ক্রোমোজোমের যেকোনো ২৩ টা চলে আসবে,একদম র্যান্ডমলি। আবার গ্যামেট মিলে জাইগোট তৈরি হওয়ার সময় আরেকবার রিকম্বাইন হবে।
কুদ্দুস রাগী,ফর্সা,নাক বোঁচা আর ৬ ফুট লম্বা। এখানে কিন্তু কেউ বা কিছু ওই ক্রোমোজোমকে বলে দেয়নি যে কোন কোন ক্রোমোজোম গ্যামেটে আসবে, বা জাইগোটে কীভাবে কে-কার সাথে গিয়ে লাগবে। এক্কেবারে র্যান্ডমলি আমরা পেয়ে গেলাম ইউনিক পিস, কুদ্দুসকে। এই প্রক্রিয়াকে বলে “হেরেডিটি” বা “বংশগতি”।
আর সারা দুনিয়ায় একপিস কুদ্দুস, এই অনন্য বৈশিষ্ট্য তৈরি হওয়া, পিতা-মাতার থেকে সন্তানের আলাদা গুণাবলি হওয়া, একে বলে “ডিসেন্ট উইথ মোডিফিকেশন” বা ” বিশেষায়িত বংশধর”।কিন্তু, দেখা গেল, কুদ্দুসের মুখ লম্বা।
বড়ই চিন্তার বিষয়!
কুদ্দুসের আব্বার গোল আলুর মতো মুখ, মা’র ও গোল আলুর মতো। কুদ্দুসের মুখ কেন লম্বা হবে?
পর্ব-৩:কুদ্দুসের ইউনিকত্বের চুল-চেড়া বিশ্লেষণ
গত পর্বে একটা বড় ধরনের পাপ হয়ে গেছে! বংশগতির কথা বললাম, জিনের কথা বললাম, কিন্তু গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের নাম নেয়া হয়নি।
এ বড় অন্যায়!
তিনি যাতে রাগ না করেন, তাকে নিয়ে কয়েকটা কথা বলে নেই,তারপর কুদ্দুসের লম্বা মুখের রহস্যে যাবো।
চেক মংক, গ্রেগর মেন্ডেল। আধুনিক জেনেটিক্সের প্রতিষ্ঠাতা। ইনি গবেষণা করেছিলেন মটরশুটি গাছ নিয়ে। বাংলাদেশে থাকলে মটরশুটির ব্যাবসা করে উদ্যোক্তা হতেন, ৩ বছর পর ঢাকায় ১০ টা ফ্লাট থাকতো।
যাই হোক, গ্রেগরের ওইসব লোভ নাই। তিনি গবেষণা করেই খুশি। তো, তিনি গাছের ৭ টা বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরীক্ষণ করলেন। উচ্চতা,রঙ ইত্যাদি। তিনি লক্ষ্য করলেন, পিতা-মাতার একই ধরনের জিনের ভিন্ন দুইটা এলিলের যেকোনো একটা সন্তানের ওপর আধিপত্য করবে।
যে আধিপত্য করবে, তাকে বলা হবে ডমিনেন্ট এলিল, আর যে চুপচাপ থাকবে, তাকে বলা হবে রিসেসিভ এলিল। এইসব নিয়ে আরো গবেষণা করে ১৮৬৬ সালে গ্রেগর তার গবেষণা প্রকাশ করলেন, ও প্রতিষ্ঠিত হলো,”মেন্ডেলিয়ান ইনহেরিটেন্স” তত্ত্ব।
গ্রেগর-কথন এখানেই শেষ করলাম।এই ডমিনেন্ট-রিসেসিভ নিয়ে আরো কাহিনী আছে,সেগুলো এখন না জানলেও চলবে, পরে লিখবো। এখন গতপর্বে যান আর ভাবুন, কুদ্দুসের দেহে ডমিনেন্ট এলিল কোনগুলো আর রিসেসিভ এলিল কোনগুলো?
এবার, কুদ্দুসের মুখ লম্বা হবে কেন?এখানে আলোচনায় হাজির হবে “মিউটেশন”। গতকাল যে ডিএনএ,জিন, ক্রোমোজোমের কথা বলেছিলাম, তা মনে আছে নিশ্চই। তাহলে এই মিউটেশন বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা না।
মিউটেশনের খাটি বাংলা হলো পরিব্যক্তি বা পরিবর্তন। কীসের পরিবর্তন? জিনের অথবা ক্রোমোজোমের। কীসের পরিবর্তন হবে, তার ওপর ভিত্তি করে মিউটেশন ২ প্রকার।
◑ক্রোমোজোমাল মিউটেশন- সংজ্ঞা আর কী দেবো?ক্রোমোজোম যেমন হওয়ার কথা ছিলো, তেমন না হয়ে অন্যরকম হলে বলে ক্রোমোজোমাল মিউটেশন। ক্রোমোজোমের একটা অংশ পরিবর্তন হয়ে যায়।
এটা আবার কয়েকভাবে হয়। ডুপ্লিকেশনে ক্রোমাটিডের একটা অংশের দুইটা কপি চলে আসে, ফলে ক্রোমাটিড লম্বা হয়,ডিলেশনে একটা অংশ ডিলেট বা বাদ হয়ে যায়, ইনভার্শনে একটা অংশ উলটো হয়ে যায়, ট্রান্সলোকেশনে দুইটা ক্রোমাটিডের মধ্যে নির্দিষ্ট অংশের অদল-বদল হয়- এরটা ওর ঘাড়ে,ওরটা এর ঘাড়ে।
◑জিন মিউটেশন-এখানে জিনের রূপ পরিবর্তন হয়। ফলে, জিনটা ভিন্ন প্রোটিন উৎপাদন করে।এটাও কয়েকভাবে হয়,সাবস্টিটিউশনে দুইটা ভুল বেস জোড়া লেগে যায়, ইনসার্শনের একটা অতিরিক্ত বেস চলে আসে আর ডিলেশনে একটা বেস বাদ হয়ে যায়।
এতকিছু মনে রাখা লাগবেনা,শুধু এইটুকু বুঝলেই হবে যে মিউটেশন মানেই নতুন বৈশিষ্ট্য।
এভাবে মেইনলি মিউটেশন হয়। নানা কারণে হতে পারে। ডিএনএ রেপ্লিকেশনের সময় আর মিয়োসিসের সময় এক্কেবারে র্যান্ডমলি, মানে খুশিতে-ঠেলায়-ঘোরতে, রেডিয়েশনের কারণে, বিভিন্ন মেডিসিনের কারণে ইত্যাদি।
মিউটেশনের ফলে ভিন্ন প্রোটিন উৎপাদন হবে, ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে।
ফলে, পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্যের বাইরেও অনেক নতুন নতুন ট্রেইট বা বৈশিষ্ট্য আমদানি হবে।
মানে, এতটুকু বোঝা গেল যে কুদ্দুসের মুখ লম্বা হওয়ার কারণ হলো মিউটেশন। কিন্তু প্যাচ এখানেই শেষ না।
কুদ্দুস চিন্তায় পড়ে গেল, ওর লম্বা মুখ পছন্দ না।
তাই, ও চায় না যে ওর বাচ্চা-কাচ্চা হলে তাদের মুখও লম্বা হোক। একটু বৈজ্ঞানিক ভাষায় বললে, কুদ্দুস নিজের মিউটেশনকে তার হেরেডিটিতে পাস করতে চায়না।
কুদ্দুস চাইলেই কি, না চাইলেই কি। ২৫ বছর পর দেখা গেল কুদ্দুসের বাচ্চারও মুখ লম্বা! কুদ্দুস চিন্তায় পড়ে গেল। ও চিন্তা করতে থাকুক, আমরা বিজ্ঞানটা বুঝে আসি।
মিউটেশন দুইটা জায়গায় হতে পারে।গ্যামেটে , অথবা দেহকোষে।
পিতা-মাতার গ্যামেট তৈরি হওয়ার সময় মিউটেশন হতে পারে। গ্যামেট মিলিত হওয়ার পর জাইগোটে ক্রোমোজোম জোড়া লাগবে, সেখানে মিউটেটেড ক্রোমোজোম বা জিন আছে, ফলে পরবর্তী যতগুলো কোষবিভাজন হবে,প্রত্যেক কোষে ওই মিউটেটেড ক্রোমোজোমের কপিই থাকবে।
ফলে, সন্তান যখন আবার বংশবৃদ্ধি করবে, তার দেহ থেকে যে ক্রোমোজোমগুলো যাবে, সেখানে ও—ই মিউটেটেড ক্রোমোজোম চলে যাবে। আর মিউটেশনর ফলে যে ভিন্ন এলিল তৈরি হয়েছিলো, সেটা ডমিনেন্ট হলে সেই বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাবে।
একে বলে জার্মলাইন মিউটেশন, যেটা জাইগোট তৈরির আগে হয়।
কুদ্দুসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। ওর আব্বা বা আম্মার গ্যামেট তৈরি হওয়ার সময় মিউটেশন হয়ে গেছে,কুদ্দুসের জাইগোট তৈরি হইছে,দেহের প্রতি কোষে লম্বা-মুখ এলিলের কপি চলে আসছে।
ফলে, কুদ্দুস যখন আবার সন্তান উৎপাদন করছে, তখন ওর দেহ থেকে এই এলিল জাইগোটে চলে গেছে, ডমিনেন্ট হয়ে গেছে, ফলাফল হলো কুদ্দুসের বাচ্চার মুখ লম্বা!
সুতরাং, জার্মলাইন মিউটেশন হলো হেরিটেবল বা সন্তানের মধ্যে পাস করা যায়।
আরেকটা হলো দেহকোষে মিউটেশন।একে বলে সোমাটিক মিউটেশন।এটা জাইগোট তৈরির পরে, দেহকোষে হয়।
নির্দিষ্ট এলাকায় হয় বলে হেরিটেবল না।যেমন ক্যান্সার হলে প্রথমে একটা একটা কোষে হবে, তারপর সেই ডিএনএ নিজের কপি তৈরি করবে ও ক্যান্সার ছড়ায় দেবে।
কিন্তু সারা দেহের সব কোষেতো আর এই মিউটেশন হয়নি বা এই মিউটেটেড জিন চলে যাবেনা।মূল দেহকোষে আগে থেকেই ক্রোমোজোমে সব তথ্য রয়ে গেছে,সেখানে চেঞ্জ হয়নি।
ফলে সন্তান উৎপাদনের সময় ক্যান্সারের তথ্যওয়ালা জিন গ্যামেটে যাবেনা।
ধরি, এক্সিডেন্টে কুদ্দুসের হাত-পা ভেঙে গেলে কেটে বাদ দেয়া লাগলো, কিন্তু তার সন্তানের ঠিকই হাত-পা হবে।কারণ অন্যান্য জিনে হাত-পা’র তথ্য রয়ে গেছে।এভাবে, সোমাটিক মিউটেশন কখনো হেরিটেবল না।
কুদ্দুসের ইউনিকত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেক বকবক করা লাগলো।পরের পর্বে কুদ্দুসের ইউনিকত্ব থেকে আমরা ঢুকে যাবো বিবর্তনে।
পর্ব-৪:আরেকটু খুটি-নাটি ও কুদ্দুসের জিন-চেড়া বিশ্লেষণ।
ভাবলাম যে ন্যাচারাল সিলেকশনে ঢুকে যাবো, কিন্তু নাহ্, এখনো বাকি, অনেএএএক বাকি।
এইসব বেসিক বোঝা দরকার, এগুলো না বোঝার কারণেই বিবর্তনকে “জাস্ট এ থিওরি” বলা মহাজ্ঞানীরা ম্যা ম্যা করে। আমরা তেমন মহাজ্ঞানী হতে চাইনা।
তাহলে শুরু করা যাক।
গতপর্বে ডমিনেন্ট এলিল আর রিসেসিভ এলিলের কথা বলেছিলাম, নিশ্চই মনে আছে।আজকে এই বিষয়টা নিয়েই নাড়াচাড়া করবো।
আমরা জানি, মানুষের দেহে একই বৈশিষ্ট্য নির্ধারণকারী জিনের জন্য দুইটা এলিল থাকে। কারণ আমরা ডিপ্লয়েড জীব, মা থেকে একটা আসে,বাবা থেকে একটা আসে।
জোড়া তৈরি হয়, জোড়ায় একটা প্রকাশ পায়, একটা চুপচাপ থাকে।আবার জোড়ায় দুইটাই ডমিনেন্ট বা দুইটাই রিসেসিভ হতে পারে। কুদ্দুস ফর্সা, কারণ ওর গায়ের রঙের জিনের ক্ষেত্রে ডমিনেন্ট ফর্সা এলিল উপস্থিত ছিলো,রিসেসিভ কালা এলিল থাকলেও প্রকাশ পায়নি, অথবা ছিলোই না।
(এইসব কথা পড়ে নিশ্চই মাথা ঘুরাচ্ছে, সমস্যা নাই, নিচে সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছি)
এইবার, ডমিনেন্ট এলিলকে প্রকাশ করা হবে ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে, যেকোনো এলফাবেট। আর রিসেসিভকে প্রকাশ করা হবে একই এলফাবেটের স্মল লেটারে।
আমরা কুদ্দুসের গায়ের রঙের এলিলকে “ডি” ধরলাম।আর, কোনোভাবে জানতে পারলাম যে ফর্সা এলিল ডমিনেন্ট হবে।
কুদ্দুসের জন্মের আগে ওর আব্বা জানতে চাইলো যে ছেলের গায়ের রঙ কী হবে। কুদ্দুসের চাচার কথা শুনে তারা চলে গেল তান্ত্রিকবাবা আদুচাঁনের কাছে।
কিন্তু আমরা বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ, ওইসব ভণ্ডামিতে আমরা মানিনা, আমরা বিজ্ঞান দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করবো।
ডমিনেন্ট ফর্সা এলিল D
রিসেসিভ কালা এলিল d
একই জিনের জন্য দুইটা এলিল জোড়া লাগবে
এই দুইটা দিয়ে কয়ভাবে জোড়া বানানো যায়?
DD, Dd,dd (dD আর Dd একই জিনিস, কিন্তু মানুষ বড়টার দিকেই আগে নজর দেয়)
মানে, আমরা এলিলের গঠনে তিনটা সম্ভাব্য ঘটনা দেখতে পারি। এই তিনটাকে বলে “জিনোটাইপ”।
জিনোটাইপ দুই প্রকার। হোমোজাইগাস আর হেটেরোজাইগাস।
হোমো মানে একই,হেটেরো মানে আলাদা। তাহলে DD,dd হলো হোমোজাইগাস। কিন্তু দুইটা জিনিস আলাদা, তাই এদেরকে যথাক্রমে হোমোজাইগাস ডমিনেন্ট ও হোমোজাইগাস রিসেসিভ বলে। আর Dd হলো হেটেরোজাইগাস।
যাদের এলিল জোড়া হোমোজাইগাস,তাদের বলে হোমোজাইগোট। মানে,আমি যদি বলি কুদ্দুস হোমোজাইগোট, তার মানে ওর দেহে একই
এলিলের জোড়া আছে,DD অথবা dd।
আবার আমি যদি বলি কুদ্দুস হেটেরোজাইগোট,মানে ওর দেহে এলিলের জোড়ায় দুইটা আলাদা এলিল, Dd আছে।
জোড়ায় যদি ডমিনেন্ট এলিল থাকে, সে রিসেসিভকে ডর-ভয় দেখায় চুপ করায় রাখবে। কিন্তু, যদি জোড়ায় ডমিনেন্ট এলিলই না থাকে? ঠেকায় পড়ে রিসেসিভই প্রকাশ পাবে, কারণ ও ছাড়া আর কেউ ইন-চার্জ নেই।
মানে,উপরের তিনটা জিনোটাইপের জন্য আমরা ফলাফল পাবো কয়টা? দুইটা।
DD=Dd=ফর্সা
dd=কালো
এই দুইটা হলো “ফিনোটাইপ”।ওকে?
এই গেলো এলিলালাপ। এইবার, কুদ্দুসের গায়ের রঙ কী হবে?
তা জানার জন্য আমাদেরকে ওর আব্বা-আম্মার জিনের দিকে তাকাতে হবে। জানা গেল, কুদ্দুসের আব্বার জিনোটাইপ হলো dd,মানে ওর আব্বা হোমোজাইগোট, হোমোজাইগাস রিসেসিভ ধারণ করে।ফলে, আব্বার প্রকাশিত ফিনোটাইপ হলো কালা।আর ওর আম্মার জিনোটাইপ হলো Dd, মানে ওর আম্মার হেটেরোজাইগোট, সে হেটেরোজাইগাস ধারণ করে।
এইবার,আব্বা-আম্মার কুদ্দুস উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এই এলিল মিক্স হবে। মিক্স হয়ে কী কী সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে?
Dd X dd = Dd,Dd,dd,dd. কার্তেসীয় গুণজের মতো।মানে, কুদ্দুসের হেটেরোজাইগোট হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% আর হোমোজাইগোট রিসেসিভ হওয়ার সম্ভাবনা ৫০%।
হেটেরোজাইগোট মানেই ডমিনেন্ট এলিল প্রকাশ পাবে।
আর আমাদের কুদ্দুসের ক্ষেত্রে ওই হেটেরোজাইগাস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাটাই ফলে গেছে! ফলে, কুদ্দুস হেটেরোজাইগোট, তার জিনোটাইপ Dd,তার ফিনোটাইপ ফর্সা।
কেস খতম। আর ওইযে কার্তেসীয় গুণজ করলাম না? ওইটাকে একটা বর্গাকৃতির বক্সের মাধ্যমে প্রকাশ করাকে বলে “পানেট স্কয়ার”। নিচে ছবি দেখলেই বুঝে যাবেন,কিন্তু ওখানে এলিলকে “আর ” দিয়ে প্রকাশ করেছে।
তো, আমাদের খুটিনাটি এখানেই শেষ। আগামীকাল হার্ডি-ওয়েইনবার্গ ইকুইলিব্রিয়াম দিয়ে ন্যাচারাল সিলেকশনে ঢুকে যাবো।পড়তে থাকুন……..
পর্ব-৫:বিবর্তনের ফালতু অঙ্ক
আমরা বিবর্তন তত্ত্বের এক্কেবারে বেসিকের জিনিসগুলো মোটামুটি জেনে নিয়েছি। এইবার, একটু অঙ্ক করা সময়। দুই ভদ্দরলোক, ম্যাথমেটিশিয়ান হার্ডি ও গাইনোকলজিস্ট ওয়েইনবার্গ মিলে এই গণিতটা গড়ে তোলেন,দুইটা সমীকরণ, নাম হার্ডি-ওয়েইনবার্গ ইকুইলিব্রিয়াম।
তাহলে, শুরু করা যাক।
আমরা কল্পনা করি একটা লোকালয়,যার নাম ডারউইনগর, যেখানে মাত্র ১০০০ জন থাকেন। কল্পনা করতে টাকা লাগে না, যা ইচ্ছা ধরে নেয়া যায়।
আমরা নিজেদের সুবিধার্থে ধরে নিলাম। মানুষের হাজারো বৈশিষ্ট্য বা ট্রেইট আছে, আমরা চুলের রঙ ধরলাম।
ডারউইনগরে শুধু দুইরকমের চুলের রঙের মানুষ থাকে। কালো,লালাভ। আমরা চুলের রঙের এলিলকে “এইচ” দিয়ে প্রকাশ করবো, আর কালো
এলিল হবে ডমিনেন্ট।
তাহলে, কালো চুল=H
লালাভ চুল=h
সরকার কয়েক কোটি টাকা বাজেট ধরে বিশেষজ্ঞের দল পাঠালো তাদের চুলের রঙ দেখার জন্য।
জানা গেল, ৭৫০জনের চুল কালো, ২৫০ জনের লালাভ।
যে কয়জনের চুল কালো, তাদের মধ্যে HH ও আছে, Hh ও আছে। কিন্তু লালাভ চুলওয়ালাদের শুধু hh আছে,তাই আমরা এটা নিয়ে কাজ করবো।
hh=২৫০/১০০০=২৫%। আর বাকি দুইটা মিলে ৭৫%।
আচ্ছা, দুইটা h একসাথে আসার সম্ভাবনা ২৫ % বা ০.২৫। তাহলে একটা h আসার সম্ভাবনা কত? Root over ০.২৫ বা ০.৫ বা ৫০%
এলিল আছে দুইটা, h আর H, তাহলে H আসার সম্ভাবনা কত?
১-০.৫=০.৫ বা ৫০%।
একে বলে এলিল ফ্রিকোয়েন্সি।মানে, ডারউইনগরের ১০০০ জনের ২০০০টা এলিলের মধ্যে ১০০০টা লাল,১০০০টা কালো।
এখানে কিন্তু হেটেরোজাইগাসদের Hh সহ এই ফ্রিকোয়েন্সি বের করা হয়েছে।
f(H)=50%,f(h)=50%
এখানে f মানে ফাংশন না, ফ্রিকোয়েন্সি।দুটার ফ্রিকোয়েন্সি যোগ করলে হয় ১০০ % বা ১।
আমরা কী সমীকরণ পাবো?
H+h=1
সাধারণত p, q দিয়ে প্রকাশ করা হয়, আমি সরাসরি এলিলের নাম দিয়েই করলাম।এখানে বোঝাচ্ছে যে H এর হার আর h এর হারের যোগফল সর্বদা ১ হবে।হতেই হবে। এক্কেবারে কমন সেন্স,ব্যাখ্যা করলাম না।
এই সমীকরণটা ছিলো এলিল ফ্রিকোয়েন্সির সমীকরণ। মানে, এই সমীকরণটা দিয়ে জানা যায় যে দুইটা এলিল শতকরা কতভাগ আছে।এবার, আমরা আরো তদন্ত করতে চাই।
মানে সূক্ষ্মভাবে জানতে চাই যে, হোমোজাইগাস রিসেসিভ কয়জন, ডমিনেন্ট কয়জন, আর হেটেরোজাইগাস কয়জন।মানে, আমরা জিনোটাইপ ফ্রিকোয়েন্সি জানতে চাই তাহলে আমরা কী করবো?
(H+h)(H+h)=1•1
HH+Hh+hH+hh=1
H^2+2Hh+h^2=1
কী করলাম? উভয় পাশে বর্গ করে দিলাম। কিন্তু বীজগণিতটা না হয় বুঝলাম, এর বাস্তবতা কী?
H^2 মানে দুটো H একসাথে,h^2 মানে দুটো h একসাথে।
মানে, হোমোজাইগাস ডমিনেন্ট আর হোমোজাইগাস রিসেসিভ। স্বাভাবিকভাবেই Hh মানে হেটেরোজাইগাস।কিন্তু তার আগে ২ গুণ মানে কী?
পিতা থেকে একটা আর মাতা থেকে একটা এলিল আসবে। Hh হওয়ার জন্য কী কী ঘটনা ঘটতে পারে? পিতা থেকে H আর মাতা থেকে h, অথবা পিতা থেকে h আর মাতা থেকে H আসতে পারে।
দুইটা সম্ভাবনা যোগ করলে 2Hh. বাকি দুটো, পিতা থেকে H আর মাতা থেকে H, অথবা পিতা থেকে h আর মাতা থেকে h.উল্টায় লিখলে যেই লাউ সেই কদু, H^2 আর h^2 ই থাকবে।
এবার অঙ্ক করি।একটা H আসার সম্ভাবনা কত ছিলো? ৫০% বা ০.৫।দুটো H একসাথে আসলে? H^2 বা ০.২৫বা ২৫%।
একটা h আসার সম্ভাবনা ৫০% বা ০.৫। দুটো একসাথে আসলে ০.২৫ বা ২৫%। একইভাবে 2Hh= ০.৫ বা ৫০%।যোগ করলে? ১ বা ১০০%
মানে, ডারউইনগরের শতকরা ২৫ জন হোমোজাইগাস ডমিনেন্ট, শতকরা ৫০ জন হেটেরোজাইগাস আর শতকরা ২৫ জন হোমোজাইগাস রিসেসিভ।
মানে, কালো চুল হবে শতকরা ৭৫ জনের,লাল চুল হবে শতকরা ২৫ জনের। যা আমাদের দেয়া তথ্যের সাথে মিলে যায়।
মানে, অঙ্ক ঠিক আছে।
কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করছেন?এখানে আমরা এলিল ফ্রিকোয়েন্সিকে ধ্রুবক ধরেছি, মানে তা চেঞ্জ হবেনা,যত প্রজন্মই যাক। আবার জিনোটাইপ এর হারকেও ধ্রুবক ধরেছি,যত প্রজন্মই যাক। যদি সামান্যতম চেঞ্জ হয়, তাহলে অঙ্ক মিলবে না।
কিন্তু, জিনোটাইপ আর এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতো চেঞ্জ হওয়াটাই স্বাভাবিক, আর হবেই,এগুলো আজীবন ধ্রুব থাকা সম্ভব না। তাহলে এই অঙ্কের ভিত্তি কী?
আসলে, হার্ডি-ওয়েইনবার্গ ইকুইলিব্রিয়ামের কতগুলো শর্ত আছে। সে সকল শর্ত পূরণ না হলে বামপক্ষ আর ডানপক্ষ সমান হয়না।
অনেকগুলো শর্ত, সবগুলোর মূলকথা একই, কোনোকিচ্ছু চেঞ্জ হতে পারবেনা, কোনোভাবেই না,সব ধ্রুব থাকবে,আর চেঞ্জ না হওয়া মানে বিবর্তন হবেনা।
তাই, এই সমীকরণগুলোর বাস্তব উদাহরণ দেখা অসম্ভব।
তাইলে এই জিনিসখান কোন কামে লাগে?এইডা এক্কেবারে ফালতু হইয়া গেল না?
না,আসলে এই গণিতটাই প্রমাণ করে যে বিবর্তন হচ্ছে। দেখুন, আমরা ওপরে যেসব যুক্তি দিয়ে অঙ্ক করেছি, সবগুলো শতভাগ সত্য আর প্রমাণিত।মানে গাণিতিকভাবে আমরা সঠিক,শর্তগুলো পূরণ করলে উভয়পক্ষ সমান হবে, মানে বিবর্তন হবেনা।
কিন্তু বাস্তবে এগুলো সত্য হওয়ার জন্য শর্তগুলো কোনোদিন পূরণ হয়না, জিনোটাইপে আর এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে চেঞ্জ সর্বদাই হয়।মানে, উভয়পক্ষ সমান না।
মানে বিবর্তন হচ্ছে, Congrats!
আমরা ঢুকে গিয়েছি বিবর্তনে। আগামী পর্বে আশা করি ন্যাচারাল সিলেকশন নিয়ে লিখবো।