আসলে ডিএনএ ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিস খুবই দুর্বল, এর পেছনে যতটা না প্রমাণ আছে তার চেয়ে বেশি আছে সমালোচনা। বেশিরভাগ লোক নিতান্তই ডিএনএ এর প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসার বশে এই হাইপোথিসিস সাপোর্ট করেন। তাও, সামান্য কয়েকটা গবেষণা হয়েছে এই নিয়ে, তা ই উপস্থাপন করব।
২০০৯ সালে গবেষকরা প্রাচীন পৃথিবীতে উপস্থিত বিভিন্ন মৌল-যৌগের মিশ্রণ তৈরির মাধ্যমে বিশেষ পরিবেশে কিছু সুগার উৎপাদন করেন, ডিএনএ তে উপস্থিতগুলোর মতো।আর সেই সুগার যুক্ত ছিলো AICA এর সাথে।
AICA হলো নাইট্রোজেন বেস এর মতোই কিছুএকটা।এখন দরকার AICA কে বেসএ পরিণত করা, আর তারপর ফসফেট যুক্ত করা। তাছাড়া এই AICA তে একটা অপ্রয়োজনীয় সালফার অণুও ছিলো।সালফারটা বিক্রিয়াগুলোকে সাহায্য করেছে, কিন্তু এখন ওটাকে বাদ দেয়া প্রয়োজন।ডিএনএ এর ধারে-কাছেও যেতে পারেননি গবেষকরা।তাই এটা একপ্রকার ব্যর্থ গবেষণা।
এবায়োজেনেসিস এ ডিএনএ কে সবসময়ই উপেক্ষা করা হয়। কিন্তু অনেকের ধারণা এই যে, যদি ডিএনএ নিউক্লিওটাইড গুলো প্রথমেই পরিবেশে উপস্থিত থাকে,যেটা থাকা অসম্ভব কিছু না, তাহলে হয়তো জীবনের প্রথম আধা-মরা রূপ সেগুলো নিয়ে কোনোভাবে ব্যাবহার করেছিলো, পরবর্তীতে সে ওই নিউক্লিওটাইডগুলোকে জোড়া লাগানোর পদ্ধতি দেহস্থ করে ফেলেছিল।এই কথাটাও একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। কিন্তু ওইযে, প্রমাণ নেই!
এর কয়েজবছর পরেই আরেকদল বিজ্ঞানী আরেকটু উন্নত গবেষণা করেন।তারা আরো প্রত্যক্ষ একটা পথ বাতলে দেন যে কীভাবে সেই প্রাচীন পৃথিবীর চরম পরিবেশে ডিএনএ এর উপাদানগুলো গঠিত হতে পারে।
প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো হলো পানি, হালকা এলক্যালিন pH আর ৪০ ডিগ্রী থেকে ৭০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা। এমন একটা পরিবেশে প্রক্রিয়াটার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিক্রিয়া আর উৎপাদ পাওয়া যায়।এতদিন ধারণা করা হতো যে ডিঅক্সিনিউক্লিওসাইড এর উৎপাদন শুধুমাত্র জীবদেহে কিছু বিশেষ এনজাইমের অধীনে সুগার আর বেসকে জোড়া দিয়েই সম্ভব।কিন্তু,নতুন পদ্ধতিতে সুগার নির্দিষ্ট একটা পর্যায়ে হঠাৎ করে বেসের সাথে যুক্ত হয় না।
বরং, একটা স্বল্পদীর্ঘ পর্যায়ক্রমিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে যুক্ত হয়, যার মধ্যে অন্যান্য জৈব উপাদান, যেমন এসিট্যালডিহাইড ও গ্লিসার্যালডিহাইড অংশ নেয়।
আবার, গবেষকদের ধারণা, তারা হয়তো ডিএনএ এর সম্পূর্ণ নতুন একদল পূর্বপুরুষ খুঁজে পেয়েছেন যেগুলোর ডিঅক্সিরাইবোজ এর অর্ধেক সুগার দ্বারা পরিবর্তন করা। কিন্তু, আরএনএ এর গবেষণায় যেমন আরএনএ উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছিলো, এখানে তা হয়নি। মানে সেই একই, যথাযথ প্রমাণ নেই!
ডিএনএ ওয়ার্ল্ড নিয়ে এইটুকুই। ডিএনএ ওয়ার্ল্ড হাইপথিসিস নিয়ে গুগলে সার্চ দিলেও এর চেয়ে বেশি কিছু পাবেন না! আসলে ডিএনএ এর জটিলতার কারণে গবেষকরা এটাকে সেই প্রাচীন পৃথিবীতে গঠিত হওয়ার অনুপযুক্তই মনে করেছেন। তাই গবেষণাও হয়নি তেমন।
শুরু করি একটা গরম গরম গবেষণা দিয়ে, এই জুন মাসের প্রথমদিকের যেটা প্রকাশ হয়েছে।এর টাইটেল, “Selective prebiotic formation of RNA pyrimidine and DNA purine nucleosides”.
এখানে বিশেষ একটা পরিবেশ তৈরি করা হয় ঠিক প্রাচীন পৃথিবীর মতোই, তারপর পানিতে আরএনএ এর গাঠনিক উপাদান মিশ্রিত করে দেয়া হয়। এরপর সেটা শুকিয়ে আবার উত্তাপ দেয়া হয়।এরপর সেগুলোকে ইউভি লাইট এর সংস্পর্শে আনা হয়।মানে পরিবেশটা প্রাচীন পৃথিবীর কোনো পাথুরে জলাশয়ের মতোই।
এই প্রক্রিয়ায় আরএনএ এর দুইটা বিল্ডং ব্লক এর সংশ্লেষণের বিক্রিয়ায় উৎপাদিত ইন্টারমিডিয়েটরা বা মধ্যবর্তীরা অতিদ্রুত ডিএনএ এরও দুইটা বিল্ডিং ব্লক এ রূপান্তরিত হয়ে যায়।ইন্টারমিডিয়েট দ্বারা বোঝায় বিক্রিয়কগুলোর বিক্রিয়া দ্বারা উৎপন্ন এমন একটা যৌগ যেটা মূল উৎপাদ না, বরং যৌগটাও বিক্রিয়ায় অংশ নিয়ে উৎপাফ তৈরি করে।মূলত, ডিঅক্সিএডিনোসিন ও ডিঅক্সিইনোসিন, এই দুইটি ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিওসাইডের সিলেক্টিভ সংশ্লেষণ সংঘটিত হয়।
এই গবেষণায় পাইরিমিডিন রাইবোনিউক্লিওসাইড বা সাইটিডিন ও ইউরিডিন এর সংশ্লেষণ মূলত ঘটিত হয় কিছু বিশেষ ইন্টারমিডিয়েট এর কারণে ,ইন্টারমিডিয়েটগুলো উৎপাদিত হওয়ার পর পিউরিন ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিওসাইড সংশ্লেষণের সমগ্র বিক্রিয়াজুড়েই স্থায়ী হয়।ফলে পাওয়া যায় ডিঅক্সিএডিনোসিন, ডিঅক্সিনোসিন, সাইটিডিন ও ইউরিডিন।
আরএনএ এর দুইটা আর ডিএনএ এর দুইটা করে বেঠিক বিল্ডিং ব্লক দ্বারা গঠিত কোনো জেনেটিক এলফাবেট প্রথম প্রাণের রূপকে এনকোড করার জন্য যথেষ্ট। এই গবেষণায় প্রমাণ হয় যে একই ধরনের পরিবেশ থেকেই ডিএনএ আর আরএনএ এর বেসগুলো উৎপাদিত হতে পারে।
তারা উৎপাদন করেছিলো সাইটিডিন আর ইউরিডিন, আরএনএ এর দুইটা বেস। আর ডিঅক্সিএডিনোসিন, যেটা ডিএনএ এর। এই
ডিঅক্সিএডিনোসিন আংশিকভাবে ডিঅক্সিনোসিনএ রূপান্তরিত হয়ে যায়,যেটা আরেকটা ডিএনএ বেস।
এই গবেষণাটা বেশ বড় একটা প্রমাণ যে কোনো এক কালে আরএনএ ও ডিএনএ সহাবস্থান করেছিল। তারপর হয়তো ন্যাচারাল সিলেকশনের কারণে ডিএনএ এর অধিক কার্যকারিতা তাকে জীবজগতে প্রাধান্য দিয়েছে, আর আরএনএ রয়ে গিয়েছে অন্যান্য কাজে ডিএনএ কে সাহায্য করার জন্য।
আরএনএ পলিমারেজ রাইবোজাইমের আরএনএ থেকে ডিএনএ কপি করার যে ক্ষমতা, সেটা ডিএনএ জিনোমের বিবর্তন বোঝার একটা পথ খুলে দিয়েছে। আরএনএ পলিমারেজ হলো একটা এনজাইম যেটা ডিএনএ এর কপিতে সাহায্য করে, আর রাইবোজাইম হলো বিক্রিয়ার প্রভাবক আরএনএ।
তো এই ডিএনএ আরএনএ সমস্যার সমাধানে ১৯৫৮ সালে একটা সমাধানের মডেল প্রস্তাবিত হলো, যার মধ্যে সম্ভাব্য সমাধান ছিলো আসলে দুইটা।এই মডেলে বলা হয়, ডিএনএ তে সংরক্ষিত জেনেটিক ইনফরমেশন এর প্রতিলিপণ হয়ে আরএনএ তৈরি হয়।যেটা ট্রান্সলেট করে রাইবোজোম, এমিনো এসিডের চেইন তৈরি করার জন্য।এই চেইনগুলো ভাজ হয়ে,দলামোচর হয়ে প্রোটিন তৈরি করে।আর এই প্রোটিন কোষের প্রায় যাবতীয় সব কর্মের কর্তা।
এবার নিচের ছবিখানা দেখুন। “এ” আর “বি” দিয়ে দুটো গতিপথ চিহ্নিত করা আছে।
“এ”: ডিএনএ থেকে তথ্য আরএনএ তে যায়, আরএনএ থেকে প্রোটিনে যায়। ডিএনএ তৈরি ডিএনটিপি( ডিঅক্সিনিউক্লিওসাইড ট্রাইফসফেট) দিয়ে।
আর ডিএনএ রেপ্লিকেট বা প্রতিলিপিত হতে পারে। আরএনএ তৈরি এনটিপি (নিউক্লিওসাইড ট্রাইফসফেট) দিয়ে।আরটি বা রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেস নামের এনজাইম এর সাহায্যে আরএনএ এর বিল্ডিং ব্লক দিয়ে পরিপূরক ডিএনএ তৈরি হয়। [ট্রান্সক্রিপ্টেস হলো একপ্রকার এনজাইম যা প্রতিলিপিকরণের সময় ডিএনএ এর উপাদান দিয়ে আরএনএ তৈরির বিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। তাই, রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেস হলো এর উলটা]
এমন কিছু আরএনএ প্রভাবক দ্বারা প্রতিলিপণ নিয়ন্ত্রিত হয় যাদের মধ্যে এমন প্রোটিন আছে যারা প্রভাবকের কার্যাদি সুনিয়ন্ত্রিত রাখে।এবার চিত্রের সাথে এই বর্ণনাটা মিলিয়ে পড়ুন।
“বি”:রাইবোজাইম(RdRp:RNA dependent RNA polymerase) দ্বারা আরএনএ জিনোম রেপ্লিকেট হয়।আরএনএ ওয়ার্ল্ড এ ডিএনটিপি উপস্থিত থাকলে আরটি এনজাইম সহজেই আরএনএ জিনোমকে টেম্পলেট হিসেবে ব্যাবহার করে ডিএনএ তৈরি করতে পারে।রাইবোজাইমও সম্ভবত ডিএনএ জিনোম এর প্রতিলিপি তৈরি জন্য দায়ী। এবার চিত্রের সাথে মিলিয়ে পড়ুন।
ধারণা করা হয়,ডিএনএ থেকে আরএনএ থেকে প্রোটিনে তথ্যের প্রবাহ একটা সরল বিবর্তনের সময়ে বিবর্তিতি হয়েছে যখন জেনেটিক তথ্য সংরক্ষণ আর প্রতিলিপণ করতো শুধু আরএনএ।
আর “বি” এ চিত্রিত প্রক্রিয়ায় রাইবোজোমের সাহায্যে প্রোটিন সংশ্লেষণ(আরএনএ এনজাইম) বিবর্তিত হয়।কিন্তু, এই হাইপোথিসিস ডিএনএ জিনোমের বিবর্তন নিয়ে তেমন কিছু বলেনা।
আধুনিক মেটাবলিজম বা বিপাক প্রক্রিয়ায় প্রোটিন ভিত্তিক আরটি এনজাইম আরএনএ কপি করে পরিপূরক ডিএনএ উৎপাদন করতে পারে।আবার অন্য অনেক এনজাইম কিছু জটিল ও ক্ষীণ-সম্ভাবনার বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আরএনএ নিউক্লিওটাইড থেকে ডিএনএ নিউক্লিওটকিডের উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে সক্ষম।
তাহলে প্রথম ডিএনিএ জিনোম কীভাবে আসল? দুইটা পথ, প্রথমত : ডিএনএ জিনোমের আগেই প্রোটিন এনজাইম ছিলো আর দ্বিতীয়ত: আরএনএ পলিমারেজ রাইবোজাইম ছিলো, যারা এক-সূত্রক পরিপূরক ডিএনএ উৎপাদন করতে পারত ও একে দ্বি-সূত্রক ও সুস্থায়ী ডিএনএ তে রূপান্তরিত করতে পারত।
বিশ্বে বিভিন্ন গবেষণাগারে চেষ্টা চলছে এমন রাইবোজাইম তৈরি করার যেটা আরএনএ এর প্রতিলিপণ বজায় রাখতে পারে।তারপর ২০১৬ সালের দিকে কৃত্রিমভাবে একটা রাইবোজাইম তৈরিও করা হলো যেটা জটিল আরএনএ কপি করতে পারতো ও খাটো আরএনএ টেম্পলেটকে বিবর্ধিত করতে পারতো।
তার কিছুদিন পরে এটা জানা গেলো যে ওই রাইবোজাইমটা আসলে আরটি এর মতোও কাজ করে।একে ডিএনএ নিউক্লিওটাইড খেতে দেয়া হলে এটা আরএনএ টেম্পলেট এর ক্ষুদ্র অংশ ব্যাবহার করে পরিপূরক ডিএনএ তৈরি করে।সুতরাং,যদি প্রাচীন পৃথিবীতে ডিএনএ নিউক্লিওটাইড থেকে থাকে, তাহলে রাইবোজাইমের সাহায্যে সেগুলো ডিএনএ জিনোম আকারে সুসজ্জিত ও সম্ভবত প্রতিলিপণও হতে পারে।
প্রাচীন পৃথিবীতে ডিএনএ ছিলো কিনা তা নির্ভর করে আরএনএ শাসিত পৃথিবীতে ডিএনএ নিউক্লিওটাইড থাকার ওপর।কৃত্রিমভাবে নির্মিত রাইবোজাইম দ্বারা বেশ সাধারণ উপাদান থেকে আরএনএ এর দুইধরনের বেস সংশ্লেষণ করা গিয়েছে।
ফলে ধারণা করা হচ্ছে যে কোনো আদি আরএনএ ব্যাবস্থার সাহায্যেই এই নিউক্লিওটাইডগুলো তৈরি হয়েছিলো। যদি ডিএনএ এর পূর্বপুরুষরা তখন উপস্থিত থেকে থাকে, তাহলে আরএনএ সিস্টেমের এর সাহায্যে ডিএনএ নিউক্লিওটাইড সংশ্লেষণ অসম্ভব না। যদিও এইসব এখনো তাত্ত্বিক কথাবার্তা হিসেবেই রয়ে গেছে, পরীক্ষা করা যায়নি।কিন্তু এমন কোনো মৌলিক কারণ নেই যার ফলে প্রাচীন পৃথিবীতে ডিএনএ নিউক্লিওটাইড থাকতে পারেনা।
কৃত্রিম আরএনএ পলিমারেজ রাইবোজাইম যদিও বেশ আশার আলো দেখাচ্ছে,কিন্তু এদের বিভিন্ন নিউক্লিওটাইড যুক্ত করার ক্ষমতা সীমিত।বর্তমান রাইবোজাইম গুলো তাদের দ্বারা প্রতিলিপিত ক্রমগুলোর তুলনায় যথেষ্ট বড় আর জটিল।
কিন্তু স্ববিবর্তনক্ষম কোনো ব্যাবস্থা উৎপাদনের জন্য এই রাইবোজাইমকে নিজেদের থেকে বড় আর জটিল ক্রমের প্রতিলিপণে সক্ষম হতে হবে।ভবিষ্যতে আরো উন্নত গবেষণার মাধ্যমে হয়তো আমরা আরএনএ থেকে ডিএনএ বিবর্তিত হওয়ার সম্পূর্ণ গতিপথ জানতে পারবো, ফলে প্রাণ সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরো স্পষ্ট হবে।
লিখাঃতাহসিন আহমেদ অমি