প্রথম দিকে একটু বোরিং কথা-বার্তা আছে,পরে মূল টপিক।তাও একটু কষ্ট করে পড়েন। পৃথিবী তৈরি হওয়ার ইতিহাস আমরা কমবেশি সবাই জানি। যে একটা নেবুলা থেকে সূর্য গঠিত হয়, সূর্যের চারপাশে ঘুরতে থাকা গ্যাস-ধূলিকণা নিয়ে গ্রহগুলো গঠিত হয়।প্রায় প্রত্যেকটা নক্ষত্রেরই হ্যাবিটেবল জোন আছে।
আর সূর্যের হ্যাবিটেবল জোন যেখানে,সেখানে যে গ্রহ গঠিত হয়, তার নাম পৃথিবী। আজ থেকে প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী গঠিত হয়।পৃথিবী তখন ছিল একটা জ্বলন্ত, ফুটন্ত, গলন্ত, উত্তপ্ত ম্যাগমা দিয়ে ঢাকা অগ্নিপিণ্ড। ধীরে ধীরে তা ঠাণ্ডা হয়ে আসল। মহাবিশ্বের শূণ্যতার মাঝে পৃথিবীর উপরিভাগ তাপ বিকিরণ করে ঠাণ্ডা হলো, ম্যাগমা জমে তৈরি হলো কালো রঙ এর স্তর, যাকে আমরা বলি ব্যাসাল্ট পাথর।
আর কেন্দ্রে থেকে গেল গলিত ভারী ধাতুগুলো।উপরিভাগের কঠিন হয়ে যাওয়ার কারণে সেটা আর তাপ বিকিরণ করতে না পেরে উত্তপ্ত আর গলিতই থেকে গেল।এভাবে বহুদিন গেল। হঠাৎ করে প্রায় ৪.৪০ থেকে ৪.৪৫ বিলিয়ন বছর আগে থিয়া নামের এক গ্রহের সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষ হয়। ধ্বংসাবশেষ ঘুরতে থাকে পৃথিবীকে ঘিরে,একদিন গঠিত হয় আমাদের চাঁদ। আর আবার পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
একবার ভাবুন সেই সময়টাত কথা! কোথাও কিছু নেই, চারিদিকে শুধু লাল আভা, উত্তপ্ত ভারী গ্যাস পরিবেশটাকে ঠেলে উপরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে,অভিকর্ষ তাকে নিচে নামিয়ে আনছে। এবার আপনার চারিদিকে তাকান! আপনার চারিদিকে সবুজ প্রকৃতি, নীল আকাশ, প্রাণে ভরপুর এক পৃথিবী। ওহ,সরি, আপনি নিশ্চই শহরে থাকেন,চারদেয়ালে বন্দি,যেখানে ঘাস দেখাই ভাগ্যের ব্যাপার!তাহলে,,,,এমাজন জঙ্গলের কথা ভাবুন।কীভাবে সেই উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ডের মাঝে স্পন্দিত হলো প্রথম প্রাণ? কীভাবে অজীব জড় বস্তু থেকে, মাত্র কতগুলো জীবনহীন অণূ-পরমাণু থেকে তৈরি হতে পারে প্রথম জীবন? তাই নিয়ে আমার সিরিজ।
অজীব থেকে কীভাবে জীব এলো, তার গবেষণাকে বলে এবায়োজেনেসিস। অনেকে হয়তো মনে করতেন যে ইভোলুশন বা ডারউইনের বিবর্তনবাদ মনে হয় প্রাণের আবির্ভাব ব্যাখ্যা করে, কিন্তু আসলে তা না, বিবর্তন প্রাণ থেকে প্রাণের উন্নয়ন ব্যাখ্যা করে।আর এবায়োজেনেসিস প্রাণহীন থেকে প্রাণের উদ্ভব ব্যাখ্যা করে।
যদিও মহামতি ডারউইন প্রাণের আবির্ভাব নিয়ে কাজ করেছেন কিছু, সেটা এবায়োজেনেসিস এ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটা বিবর্তনবাদ না।
মূল আলোচনায় ফিরে যাই। বর্তমানে চারপাশে আমরা যা যা দেখি, প্রকৃতিতে প্রাণ এর নানান রূপ দেখি, এগুলো থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে প্রাণের গঠনের জন্য ৩ টা জিনিস লাগবেই, বা হওয়া লাগবেই।এগুলো আছে ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে বিশালাকায় নীলতিমির মধ্যেও।তাই,এগুলো ছাড়া প্রাণ গঠন অসম্ভব। একে বলা যায় প্রাণের ত্রিত্ববাদ! সেগুলো হলো –
➡নিউক্লিক এসিড(ডিএনএ ও আরএনএ)
➡এমিনো এসিড (প্রোটিন)
➡লিপিড(স্নেহ)
অনেকে আবার এখানে আরেকটা জিনিস যোগ করেন, কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা। কিন্তু সেটার গুরুত্ব এই তিনটির সমান না। আর এই তিনটি থেকে উপরে,এক অনন্য উচ্চতায় আছে পানি।
কারণ আমাদের দেখা সকল জীবই পানির উপরে কোনো না কোনো ভাবে নির্ভর করে।পানি হলো আদর্শ দ্রাবক,মানে এতে সকল ধরনের জিনিস দ্রবীভুত হতে পারে,তাই অনেকগুলো কেমিকেল একত্রে থাকার জন্য,জৈব যৌগ গঠনের জন্য,কেমিক্যাল রিয়েকশন ঘটানোর জন্য আর প্রাণের প্রথম স্পন্দন হওয়ার জন্য পানিই হলো আদর্শ জায়গা।
তাই আমরা এতটুকু নিশ্চিত হলাম, যে প্রথম প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল পানির মধ্যে। এবার কোন পানিতে? সাগর,নদী,পুকুর, নাকি ডোবা? সেটা ধীরে ধীরে বলব।উল্লেখ করা তিনটি উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো লিপিড বা স্নেহ জাত। কারণ এটাই হলো কোষপ্রাচীরের মূল উপাদান!আসলে ঠিক লিপিড না, ফসফোলিপিড।
কোষপ্রাচীর না থাকলে তার ভেতরে অন্যন্য অঙ্গগুলো ক্রিয়াকলাপ করতে পারত না। সবকিছু চারিদিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকতো,কোষপ্রাচীর সেগুলোকে একটা রুমে আবদ্ধ করে। ফলে কোষের স্বতন্ত্রতা, স্বকীয়তা তৈরি হয়। ফসফোলিপিড গুলোর আকৃতি কিছুটা এমন, ওপরে একটা গোল মাথা, আর নিচে ২ টা পা। গোল মাথাটায় থাকে ফসফেট আর গ্লাইসেরল, তাই এটা হাইড্রোফিলিক,মানে এরা পানি পছন্দ করে।
আর পা দুটোতে থাকে স্যাচুরেটেড আর আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড।তাই এরা হাইড্রোফোবিক,মানে এরা পানি অপছন্দ করে।যেহেতু প্রথমেই আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে পানির মধ্যেই প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল, তাই এই ফসফোলিপিডও নিশ্চই পানির মধ্যেই ছিল!তাই স্বাভাবিক ভাবেই যখন অনেকগুলো লিপিড একত্রে আসে, ২ টা ফসফোলিপিড তাদের পা দুটো পরস্পরের দিকে দেয়,যাতে একে অপরকে পানি থেকে বাচাতে পারে,আর মাথাদুটো থাকে বিপরীত দিকে বা পানির দিকে। এভাবে দুটো ফসফোলিপিড পরস্পরের সাথে বিপরীতভাবে যুক্ত হয়, একে বলে ফসফোলিপিড বাইলেয়ার। বাইলেয়ার মানে ২ টি আবরণ।এভাবে পাশাপাশি অনেকগুলো লিপিড যুক্ত হয়ে একটা গোল আকৃতি আবরণ তৈরি করে।
এতে সেই গোলকের ভেতরে আর বাইরে থাকে পানি, আর মাথাগুলো পানি পছন্দ করে। আর পা গুলো থাকে পানির বিপরীত দিকে,আবরণটার অভ্যন্তরে,সেখানে পানি নেই। নিচে ছবি সংযুক্ত করে দেব, দেখলে ভালোভাবে বুঝতে পারবেন।কিন্তু লিপিডগুলো এমন কেন করে? মানে তাদেরতো জীবন নেই,তারাতো নির্জীব,তারা কিছু বোঝেনা,জানে না!
আসলে এটা লিপিডের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, তারা এমনই করে, তাই “কেন? ” প্রশ্নটা সেইভাবে উপযুক্ত নয়।তাহলে,আরেকটা জিনিস নিশ্চিত, প্রথম যে প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল, সেখানে অবশ্যই লিপিড ছিল। লিপিড না থাকলে সেখানে নিউক্লিক এসিড আর প্রোটিন আবদ্ধ হতে পারত না।
মানে, একটা খেলনা গাড়ি, এর ভেতরে সব যন্ত্রপাতিকে একত্রে রাখে বাইরের প্লাস্টিকের আবরণটা। আমাদের কোষপ্রাচীরেও, শুধু আমাদের না,প্রত্যেক কোষের কোষপ্রাচীরে এই ফসফোলিপিড বাইলেয়ার আছে।এবার প্রশ্ন, এই লিপিড কি সেই প্রাচীন প্রাণহীন পৃথিবীতে ছিল? থাকলেও কীভাবে গঠিত হলো?
লিখাঃতাহসিন আহামেদ অমি