আজ আলোচনা করব প্রাণের আবির্ভাব কোথায় হয়েছে তার একটা সবচেয়ে গ্রহণ যোগ্য তত্ত্ব নিয়ে।
প্রিমর্ডিয়াল স্যুপ যখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু,তখন আবিষ্কার হলো, সমুদ্রের অতল তলে,প্রচণ্ড তাপ-চাপ সমৃদ্ধ এক পরিবেশেও জীবের বাস আছে,তারা শুধু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র না, ছোট-বড় সব আকৃতির।
শুরু হলো গবেষণা। যেই পরিবেশে জীবের বেচে থাকা সম্ভব না, সেখানেও কীভাবে জীব বেচে আছে! পাওয়া গেল হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট।হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট হলো সমুদ্র তলে একটা ফাটল,যেখানে পানি উত্তপ্ত ম্যাগমার সংস্পর্শে আসে আর প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে ওপরে উঠে আসে।এগুলো সাধারণত সক্রিয় আগ্নেয়-ক্ষেত্রের কাছাকাছি তৈরি হয় যেখানে টেকটনিক প্লেট নড়া-চড়া করে।মধ্য আটলান্টিকের “লস্ট সিটি” নামের ভেন্টগুলোকে ভাবা হয় সেই জায়গা।
১৯৭৭ সালে প্যাসিফিক সমুদ্রে যখন প্রথম হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট আবিষ্কার হয়, সেগুলো ছিল ব্লাক স্মোকার, বা কালো ধোয়া উদগীরণকারী।এগুলো থেকে ভূ-উত্তাপে উত্তপ্ত পানি বের হতো, যার তাপমাত্রা ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌছাত।
কিন্তু পানির স্ফুটনাঙ্কতো ১০০ ডিগ্রি। আসলে সমুদ্রের সেই অতল গভীরে পানির চাপও প্রচণ্ড বেশি,স্ফুটনাঙ্ক আর চাপের সম্পর্ক সমানুপাতিক,একটা বাড়লে আরেকটা বাড়ে,তাই সেখানে ৪০০ ডিগ্রিতেও পানি তরল থাকে। সেই পানিতে ছিল উচ্চমাত্রায় সালফাইড। এই সালফাইড যখন সমুদ্রের ঠাণ্ডা পানির সাথে সংস্পর্শে আসে, তখন তার অধঃক্ষেপ পড়ে আর সেই চিম্নির মতো দেয়ালগুলো তৈরি হয়।
২০০০ সালের দিকে নতুন আরেক ধরনের ভেন্ট আবিষ্কার হয়,ওই লস্ট সিটি ভেন্ট।এগুলো ছিল হোয়াইট স্মোকার বা সাদা ধোয়া উদগীরণকারী।এই ভেন্টগুলো একটা বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়, যার নাম সার্পেন্টিনাইজেশন।সমুদ্রতলের পাথর, ম্যাগনেসিয়াম আয়রন সিলিকেট পানির সাথে বিক্রিয়া করে,আর প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন ক্যাটায়ন উৎপাদন করে।আবার,লস্ট সিটি ভেন্টের তাপমাত্রা ৪৫-৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত হয়, আর পিএইচ ৯-১১।
আর তখন সমুদ্রে বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড ছিল। প্রাণের আদিপিতারা সেই উপযুক্ত পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড আর হাইড্রোজেন গ্রহণ করত এমিনো এসিড আর নিউক্লিওটাইড তৈরি করতে।কিন্তু এই কেমিকাল রিয়েকশন গুলোর জন্য দরকার বিপুল পরিমান শক্তি। সমুদ্রের গভীরের সেই ভেন্টগুলোর খণিজের তৈরি দেয়াল গুলো হয়তো সেই শক্তির উৎস্য হিসেবে কাজ করেছিল।
আদিম কালের সমুদ্র ছিল এসিডিক আর প্রোটন (হাইড্রোজেন ক্যাটায়ন) দিয়ে পূর্ণ । আর অন্যদিকে ভেন্টগুলো থেকে নির্গত হতো এলক্যালিন ফ্লুইড, যা হাইড্রক্সাইড এনায়ন দিয়ে পূর্ণ ছিল। এই একল্যালিন তরল যখন সমুদ্রের এসিডিক পানির সাথে মিশত,তখন সাদা ক্যালসিয়াম কার্বনেটের চিম্নির মতো দেয়াল তৈরি করত,যেগুলো ৩০-৬০ মিটার উঁচু।ভেন্টগুলো পাথুরে এবং আয়রন হাইড্রক্সাইড ও আয়রন সালফাইড পূর্ণ যে সকল দেয়াল তৈরি করত যেগুলোতে ছিল অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র বা প্রকোষ্ঠ।
এই দেয়ালগুলো সেই উত্তপ্ত এলক্যালিন তরলকে এসিডিক সমুদ্রের পানি থেকে আলাদা করে রাখত।এই দুইটি যখন মিলিত হতো,তখন একটা প্রাকৃতিক চার্জ গার্ডিয়েন্ট বা আধানের মাত্রার তারতম্য তৈরি হয়,যেটা কিছুটা ব্যাটারির সাথে তুলনা করা যায়।এটা হাইড্রোজেন আর কার্বন ডাই অক্সাইডকে বিক্রিয়া করে কার্বন ভিত্তিক বিভিন্ন জৈব যৌগ তৈরিতে সহায়তা করত,যেমন এমিনো এসিড আর প্রোটিন।
এমনকি এই চার্জ গার্ডিয়েন্ট কোষ ঝিল্লী(ফসফোলিপিড বাইলেয়ার) আর নিউক্লিওটাইড তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছিল।পরীক্ষাগারে এক্সপেরিমেন্ট করে তারা সেই প্রাচীন সামুদ্রিক পরিবেশে কার্বন-হাইড্রোজেন বিক্রিয়া ঘটিয়ে ফর্মাল্ডিহাইড উৎপাদন করেছে,আর পাশাপাশি ০.০৬% রাইবোজ সুগারও তৈরি হয়েছে,যা প্রাণের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
আদিকোষ গুলো সেই নতুন কার্বন ভিত্তিক যৌগগুলোকে একত্রিত করার জন্য ভেন্টের সরু-সর্পিল দেয়ালগুলোকে ব্যবহার করত,যার ফলে বর্তমানে দৃশ্যমান কোষের আদিপিতারা তৈরি হয়েছিল।পৃথিবীর সকল প্রাণীর ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে আমাদের আদিপিতা কোষ হাইড্রোজেন ক্যাটায়ন ব্যাবহার করত শক্তি উৎপাদনে,আর তারা বসবাস করত একটা আয়রন সমৃদ্ধ জায়গায়,ঠিক ভেন্টের মতো।তার নাম দেয়া হয়েছে LUCA (Last Universal Common Ancestor).
আর তারা সেই পরিবেশের আধানের তারতম্য ব্যবহার করে আরো জটিল জটিল বিক্রিয়া ঘটাতে পারত,যার ফলে আরো জৈব যৌগ তৈরি হতো।সমুদ্রের তলদেশে বসবাসকারী আর্কিয়া ব্যাক্টেরিয়া একটা সরল কোষীয় পাম্প ব্যবহার করে, যেটা সোডিয়ামকে কোষ থেকে বের করে দেয়,আর তখনই একটা প্রোটন ভেতরে টেনে নেয়। এই কোষীয় পাম্পের আদিপিতারা তৈরি হয়েছিল প্রাচীন আদিকোষগুলোর কোষঝিল্লীতে।
হাইড্রোজেন ক্যাটায়নকে ঝিল্লীর গা ঘেষে ঘুরিয়ে পাম্প হতো।কোষের একপাশে আধান বেশি থাকত,অন্যপাশে কম থাকত।ফলে প্রোটন ঝিল্লীর গা ঘেষে ঘুরতে থাকত।এতে কোষের ভেতরে আর বাইরে আধানের তারতম্য তৈরি হতো, একে বলে H+ Motive Force.এতে প্রায় ৩ পিএইচ এর সমান আধানের পার্থক্য তৈরি হতো।এটা বিভব শক্তি সংরক্ষণের জন্য কার্যকরী মেকানিজম।এই শক্তি তখন সংগ্রহ করা যায় যখন প্রোটন ঝিল্লী জুড়ে পাস করা হয় এডিপিকে ফসসোরাইলেট করে এটিপি তৈরির জন্য।
ভেন্টের চিম্নির সেই সরু,পাতলা দেয়ালগুলোর সাথে সমুদ্রের পানির পিএইচ পার্থক্য ছিল ৩, এই দেয়ালের মাঝের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠগুলোই কোষের জন্য ভালো আবরণের কাজ করত। বায়োলজি ল্যাবেও পরীক্ষার মাধ্যমে এমন ইলেক্ট্রিক পাওয়ার উৎপাদন করা হয়েছে যা একটা এলইডি লাইট বাল্ব জ্বালাতে সক্ষম।তাই,প্রাণের আবির্ভাব নিশ্চিত ভাবে প্রোটন সমৃদ্ধ ভেন্টেই হয়েছে।কিন্তু,সমুদ্র থেকে বের হয়ে ভূমিতে বাসের জন্য কোষের দরকার নিজের ভেতরে শক্তি উৎপাদনকারী একটা মেকানিজম।
ঝিল্লী গুলো প্রথম দিকে ছিল বড় বড় ছিদ্রযুক্ত।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই ছিদ্রগুলো ছোট হতে থাকল,যার ফলে সোডিয়াম বের হতে পারত না, আর পাশাপাশি প্রোটনও ভেতরে ঢুকত।এভাবে, আদিকোষগুলো পরিবেশে বিদ্যমান আধান ব্যবহার করতে শুরু করল।যখন ঝিল্লীর ছিদ্র সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল, তখন কোষের কাছে একটা সোডিয়াম পাম্প থেকে গেল,যেটা কোষের ভেতর বিক্রিয়াকে শক্তি জোগাতো।
এর ফলে প্রাণের রূপ আরো জটিল হতে লাগল,যা ছিল সমুদ্র ছেড়ে ওপরে ভূমিতে বাস করার জন্য উপযুক্ত।হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট বাদে সমুদ্রেতলের ৭৬০ মিটার নিচে সার্ফেসের কিছু পাথরেও আদি-প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।তারা সেই খণিজ পাথরে কিছু যৌগের অদ্ভুত গঠন দেখেছেন যেগুলো শুধু লস্ট সিটি ভেন্টেই দেখা যায়।খণিজের এমন গঠন তখনই সম্ভব যখন হোয়াইট স্মোকারের এলক্যালিন ফ্লুইড সামুদ্রিক পানির সংস্পর্শে আসে।তাই ধারণা করা হচ্ছে যে প্রাণ গঠনের একই রসায়ন সমুদ্রতলের নিচেও ঘটেছে।
যদিও, হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে হওয়ার পক্ষে প্রমাণ বেশি। কারণ, যৌগগুলো মনোমার আকারের তৈরি হয় পানির মধ্যে,সেগুলো ঘনীভূত হয়ে পলিমার গঠনের জন্য দরকার একটু শুষ্কতা বা পানি শোষণ। আর ভেন্টের চিম্নির সেই অতিক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে এমন কিছু খণিজ আছে যারা পানি শোষণ করে।তাই,সেখানে সবকিছু পানিতে নিমজ্জিত থাকা সত্ত্বেও পানি শোষণকারী বিক্রিয়া হওয়া সম্ভব,যেটা সমুদ্রতলে সম্ভব না।
কিন্তু,আমাদের বর্তমান কোষগুলোতে আধিক্য রয়েছে পটাশিয়ামের, সোডিয়ামের না,যেখানে, প্রাচীন কোষগুলো তৈরি হয়েছিল সোডিয়াম পূর্ণ পরিবেশে। গবেষকরা বলেছেন যে, কোষগুলো সোডিয়াম পূর্ণ পরিবেশে তৈরি হলেও, ধীরে ধীরে তারা পটাশিয়ামের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়, তাই ভেন্টের মধ্যে প্রাণের আবির্ভাবের পক্ষে প্রমাণই বেশি।
আবার,নিউক্লিক এসিডের আদিপিতাদের সংশ্লেষণ শুরু হয়েছিল হাইড্রোজেন সালফাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড আর আল্ট্রাভায়োলেট লাইটের মাধ্যমে, কিন্তু ভেন্টের অত গভীরে ইউভি লাইটের পৌছানো সম্ভব নয়।তাই,ধারণা করা হয়, প্রাচীন কোষগুলো অধঃক্ষেপিত জিংক সালফাইড ব্যবহার করত ইউভি লাইটের জায়গায় অনুঘটক হিসেবে কার্বন ডাই অক্সাইড রিডাকশনের জন্য।আবার,বর্তমানে এমন কোনো কোষ নেই,যেটা ইউভি লাইট ব্যবহার করে শক্তির উৎস্য হিসেবে, বরং এটা কোষের মৃত্যু ঘটায়।
তাই ইউভি লাইট ব্যবহারের ধারণাও বাতিল।আবার, আমাদের কোষ ঝিল্লী,যেটা মূলত ফ্যাট,সেটাও এক্সপেরিমেন্টে ভেন্টের পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে সেখানে তৈরি করা গিয়েছে।দেখা গেছে,লবণাক্ত আর উত্তপ্ত পরিবেশে ফ্যাট আরো ভালো বন্ধন তৈরি করে।আগের করা কিছু পরীক্ষায় ভেন্টের পরিবেশ তৈরির পরেও ফ্যাটি এসিড পলিমার গঠন করেনি।কারণ,সেই পরীক্ষাগুলোতে সীমিত সংখ্যক ফ্যাটি এসিড ব্যবহার করা হয়েছিল।কিন্তু,সমুদ্রে তো নানান ধরনের এসিড থাকার কথা,কয়েকটা না।
পরে যখন অনেক ধরনের ফ্যাটি এসিড দিয়ে পরীক্ষা করা হয়,তখন ঠিকই পলিমার গঠিত হয়।এবার শুরুর দিকে বলেছিলাম প্রাণের একেবারে প্রাচীন আদিপিতা হাইড্রোজেন ক্যাটায়ন পাম্প করে জৈব যৌগ উৎপাদনের বিক্রিয়ায় শক্তি জোগাত। কিন্তু প্রাণ যখন উন্নত হলো,তখন শক্তি পেল কোথায়? মানে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা তৈরির জন্য সেই সমুদ্রের নিচে তারা কী ব্যবহার করত? এখানে আসে কেমোসিন্থেসিস।
কেমোসিন্থেসিস হলো একটা প্রক্রিয়া, যেখানে কার্বন অণু আর অন্যান্য মৌল বিক্রিয়া করে শর্করা জাতীয় জৈব যৌগ তৈরি করে।প্রধানত হাইড্রোজেন সালফাইড আর মিথেন বিক্রিয়া করে,আর সালফার নির্গত হয় বায়প্রোডাক্ট হিসেবে।
তাছাড়াও নাইট্রোজেন,এমোনিয়া,কার্বন ডাই অক্সাইড,কার্বন মনো অক্সাইড,ফসফরাস,হাইড্রোজেন সায়ানাইডের মতো অসংখ্য যৌগ ছিল বিক্রিয়ার জন্য।যারা পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করে জটিল জটিল জৈব যৌগ তৈরি করত।আর এসকল উপাদানই আছে হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের মধ্যে।এসকল বিক্রিয়ায় যে বায়প্রোডাক্ট নির্গত হয়,তারাও আরো বিক্রিয়া করে জটিলতর জৈব যৌগ উৎপন্ন করে।
সুতরাং,হাইড্রোথার্মাল ভেন্টই হলো প্রাণের আবির্ভাবের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা।৩.৭ বিলিয়ন বছর আগের সেই ভেন্টের চরম তাপ,চাপ আর রাসায়নিক অবস্থা, প্রাণের গঠনের জন্য আদর্শ।তাই বিজ্ঞানীরা ভেন্টকেই ধরে নিয়েছেন প্রাণের উৎপত্তিস্থল।
লিখাঃতাহসিন আহামেদ অমি