গত দুইটি পর্বে প্রাণের আবির্ভাব কোথায়, তা নিয়ে ২ টা সবচেয়ে আলোচিত হাইপোথিসিস নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। গত পর্বে এই কনক্লুশনে এসেছিলাম যে সকল বিশেষজ্ঞরা সকল যুক্তি,প্রমাণ,পরীক্ষার ভিত্তিতে হাইড্রোথার্মাল ভেন্টকেই প্রাণের আবির্ভাবের জায়গা হিসেবে ধরে নিয়েছেন।
তাই,আমাদের পরবর্তী সকল আলোচনা হবে এই হাইড্রোথার্নাল ভেন্টকে ম্যাট্রিক্স হিসেবে ধরে।এবার, একেবারে ১ম পর্বে ফসফোলিপিড বাইলেয়ারের গঠন নিয়ে অল্পকিছু কথা বলেছিলাম,এখন আবার একটু মনে করিয়ে দেই,এই অণুগুলো হলো এমফিলিক, মানে এদের একই অণুতে একটা পোলার আরেকটা ননপোলার গ্রুপ থাকে। পোলার মানে আহিত, আর নন পোলার মানে অনাহিত।
এমন এমফিলিক যৌগরা অবিরতভাবে নিজেদেরকে বিভিন্ন জটিল গঠন প্রদান করে, যেমন-বায়মলিকুলার লেয়ার, যেটা প্রথম আবদ্ধ কোষ ঝিল্লি সৃষ্টি করেছিল।এরা আয়রন-সালফার ফেনাকে আবদ্ধ করত আর কোষ আকৃতির বাবল তৈরি করত।এবার এদের গঠন আরেকটু বিস্তারিত বলব।
কোষ ঝিল্লি গুলো মূলত গ্লাইসেরোফসফোলিপিড দিয়ে তৈরি। আসলে ফসফোলিপিডের একটা গ্রুপের সাথে গ্লাইসেরল আর দুইটা ফ্যাটি এসিড চেইন থাকে, তাই এর আরেক গালভরা নাম গ্লাইসেরোফসফোলিপিড। গ্লাইসেরল হলো তিন কার্বন বিশিষ্ট যৌগ যেটা এই মেমব্রেন লিপিডগুলোর মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে।ফ্যাটি এসিড দুইটি প্রথম ও দ্বিতীয় কার্বনের সাথে এবং ফসফেট গ্রুপ তৃতীয় কার্বনের সাথে যুক্ত থাকে।
এই ফসফেটের সাথে বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ যুক্ত হতে পারে, সাধারণত নাইট্রোজেন গ্রুপ। এই অণুটার আকৃতি সিলিন্ড্রিকাল।ফলে এরা পাশাপাশি যুক্ত হয়ে লম্বা শীট গঠন করতে পারে।তাদের এই বিশেষ জ্যামিতিক আকৃতির কারণে তারা নিজেরাই বাইলেয়ার গঠন করে কোনো শক্তি ব্যবহার ছাড়াই।কেন করে,কীভাবে করে তা প্রথম পর্বে বলেছি।
এই বাইলেয়ার এর লেয়ারদ্বয় একত্রে আবদ্ধ থাকে দুইটি ফসফোলিপিডের লেজগুলোর মাঝে উইক হাইড্রোফোবিক ইন্টারএকশন দ্বারা।প্রাণিদের মেমব্রেনে কোলেস্টেরল পাওয়া যায়, কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়ার ঝিল্লিতে এটা অনুপস্থিত। তাই ধারণা করা হয় যে প্রথম গঠিত ঝিল্লিতেও এটা ছিল না।মেমব্রেনগুলোতে প্রোটিন থাকে, সেইটা নিচে আলোচনা করব।
নিম্নতাপমাত্রায় মেমব্রেনটা জেল এর মতো অর্ধতরল আচরণ করে,আর উচ্চতাপমাত্রায় এরা সম্পূর্ণ তরলের মতো আচরণ করে।ফসফোলিপিডের দুইটা ফ্যাটিএসিডের লেজের মধ্যে একটা স্যাচুরেটেড বা সমপৃক্ত আরেকটা আনস্যাচুরেটেড বা অসম্পৃক্ত।এই বৈশিষ্ট্য লেজ দুইটির ফ্লুইডিটি বা প্রবাহধর্মে সাহায্য করে,যারা সবসময় গতিতে থাকে।
পরীক্ষাগারে বিভিন্ন পরীক্ষা প্রমাণ করে যে এই আবদ্ধ ঝিল্লিগুলো বিভিন্ন ম্যাক্রো-মলিকুলকে নিজের ভেতরে আবদ্ধ করতে সক্ষম, যেমন -নিউক্লিক এসিড আর এমিনো এসিড। যারা যথাক্রমে আরএনএ-ডিএনএ ও প্রোটিন তৈরির উপাদান।এরা ছিল বেশ টলমলে জাতের, ভেন্টের চারপাশে ঘুরতে থাকত, কখনো দ্রবীভূত হয়ে যেত, আবার তৈরি হতো,এরকম।
কিন্তু,একটা ঝামেলা হলো, পরীক্ষাগারে দেখা গেল, লবণ আর আয়ন লিপিডকে বাইলেয়ার গঠন করতে দেয় না। কিন্তু আমরাতো জানি যে এসকল লিপিড সমুদ্রের গভীরে ভেন্টের কাছাকাছি বাইলেয়ার গঠন করেছিল যেখানে আয়ন, লবণ প্রচুর পরিমাণে থাকে।তাহলে কীভাবে সেখানে কোষঝিল্লি তৈরি হলো?
বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, প্রোটিন কোষঝিল্লিকে স্থিতিশীল করতে পারে।মানে সেই এমিনো এসিডগুলো একটা লবণাক্ত পরিবেশের মধ্যেও ফসফোলিপিড বাইলেয়ারকে গঠিত হয়ে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করে। প্রথমে ঝিল্লিগুলো একটা ঝামেলায় পড়ল, তাদের বিভিন্ন জৈব কার্যাদি চালিয়ে যাওয়ার জন্য আয়ন,লবণ দরকার ছিল।কিন্তু এগুলো সেই বাইলেয়ারকে নষ্ট করে দেয়।পরীক্ষাগারে দেখা গিয়েছে যে যখন এমিনো এসিড যুক্ত হয়,তখন সেটা ম্যাগনেসিয়াম আয়নের বিরুদ্ধে বাইলেয়ারকে সুরক্ষা দিতে পারে।
এই ম্যাগনেসিয়াম আবার আরএনএ পুনরুৎপাদন আর জেনেটিও ইনফরমেশন কোড করার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আরো দেখা গিয়েছে যে আরএনএ এর বিল্ডিং ব্লক, নিউক্লিওটাইডরা ফ্যাটিএসিডের তৈরি মেমব্রেনে যুক্ত হয়ে থাকতে পারে আর লবণ ও আয়নের ক্ষতি হতে মেমব্রেনকে রক্ষা করতে পারে।
১০ টা ভিন্ন ধরনের এমিনো এসিড নিয়ে করা এক্সপেরিমেন্ট হতে জানা যায় যে কিছু এসিড মেমব্রেনের সাথে যুক্ত হয়ে তাকে স্থিতিশীল করে আর কিছু এসিড মেমব্রেন বা ঝিল্লির গাঠনিক পরিবর্তনও সাধন করে, যেমন এক ধরনের এসিড মেমব্রেনকে কনসেন্ট্রিক কতগুলো লেয়ারের আকৃতিতে ভাগ করে দিয়েছিল,অনেকটা পেয়াজের মতো।
এখন এগুলো কীভাবে মেমব্রেনের সাথে যুক্ত হয়?ছোট-খাট ধনাত্মক চার্জিত কণা দ্বারা উৎপাদিত স্থিরতড়িৎ আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে আর হাইড্রোফোবিক পেপটাইডের মাধ্যমে এরা মেমব্রেনের সাথে যুক্ত হতে পারে।পেপ্টাইড হলো এমিনো এসিডের চেইন যেখানে ২ টা থেকে ৫০ টা এমিনো এসিড থাকতে পারে।
দেখা গিয়েছে, মাত্র ৭ এমিনো এসিড লম্বা বা তার চেয়েও ছোট আকারের পেপ্টাইড নিউক্লিক এসিডকে ঝিল্লি বা মেমব্রেনের সাথে যুক্ত করতে পারে। এমন ছোট পেপ্টাইড, যাদের একইসাথে একটা হাইড্রোফোবিক গ্রুপ আরেকটা ক্যাটায়নিক গ্রুপ আছে, যেটা আরএনএ এর নেগেটিভ চার্জিত ফসফেট গ্রুপের সাথে স্থির-তাড়িত আন্তঃক্রিয়া করতে পারে,এরা কিছুটা আঠার মতো কাজ করে ফসফোলিপিডগুলোকে ধরে রাখার জন্য, আর তারপর আরএনএ কে আকর্ষণ করে আর একই মেমব্রেনের সার্ফেসে ধরে রাখে।
তাই ধারণা করা হয় যে প্রথম প্রাণের রূপের একটা ফসফোলিপিডের তৈরি সরল আবরণ,তার সাথে যুক্ত পেপ্টাইড আর কয়েকটা নিউক্লিক এসিড ছিল।
তাছাড়া, বর্তমানে একটা ঝিল্লির প্রায় অর্ধেক ভর আসে তাদের মধ্যে থাকা প্রোটিন থেকে।প্রোটিনগুলো ঝিল্লির মধ্যে প্রোথিত থাকে এবং উভয় দিকে এদের মাথা বের করা থাকে। এই ধরনের প্রোটিনকে বলা হয় ট্রান্সমেমব্রেন প্রোটিন।
এই প্রোটিনদের যেই অংশটুকু গ্লাইসেরোফসফোলিপিডের হাইড্রোকার্বনের অর্থাৎ ফ্যাটি এসিডের তৈরি লেজে থাকে তারা ওই লেজের মতোই হাইড্রোফোবিক, এবং যেই অংশটুকু বের হয়ে থাকে,মানে গ্লাইসেরল এর মাথার দিকে থাকে,সেইটাও মাথার মতোই হাইড্রোফিলিক। এই ঝিল্লিগুলো অর্ধভেদ্য পর্দা।
ছোট ছোট হাইড্রোফোবিক অণু আর অক্সিজেন,কার্বন অক্সাইড খুব দ্রুত এটা ভেদ করে যেতে পারে।আর ক্ষুদ্র,তবে আহিত অণু,যেমন- পানি,ইথানল এদের মধ্য দিয়ে ধীরগতিতে যায়।তবে এই ঝিল্লি উচ্চ মেরু-প্রবণতাযুক্ত কণা, যেমন- আয়ন, আর বড় অণু,যেমন- এমিনো এসিডের আসা-যাওয়াকে চরমভাবে বাধা দেয়।
তবে, কোষের ভেতর এদেরও আসা-যাওয়া প্রয়োজন। সেজন্য এরা নির্ভর করে নির্দিষ্ট কিছু ট্রান্সপোর্ট প্রোটিনের মাধ্যমে যারা মেমব্রেনের মধ্যে প্রোথিত থাকে। আবার কিছু সীমান্তবর্তী বা পেরিফেরাল প্রোটিন থাকে, যারা মেমব্রেনের সাথে যুক্ত,তবে তার মধ্যে প্রোথিত না।এরা মেমব্রেনের অন্যান্য প্রোটিনের মধ্যে বন্ড বা বন্ধনের কাজ করে।কিছু প্রোটিন আবার মেমব্রেনের একদম নিচে ফিলামেন্টাস বা তন্তুময় নেটওয়ার্ক তৈরি করে।
এটা ট্রান্সমেমব্রেন প্রোটিনকে যুক্ত করে থাকে।এখন, আমরা না হয় ধরে নিয়েছি যে এই গ্লাইসেরোফসফোলিপিড বাইলেয়ার ভেন্টেই তৈরি হয়েছে, সেই ভিত্তিতেই আজকের পর্বটা লেখা। কিন্তু এর কোনো প্রমাণ আছে? আছে।বিশেষজ্ঞরা ভেন্টের পরিবেশে এই বাইলেয়ার উৎপাদনের প্রচেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু প্রথমবার ব্যর্থ হন। কারণ, তখন তারা ভেন্টে উপস্থিত মাত্র ৩-৪ ধরণের সর্বাধিক প্রাপ্ত মৌলের দ্রবণ নিয়েছিলেন,কিন্তু পরে যখন এলকেলিন দ্রবণে প্রায় ১৪ ধরনের মৌল আর যৌগ নেয়া হয়, তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি করা হয়, আর পিএইচ মান ১২ নেয়া হয়, তখন দেখাগেলো স্থিতিশীল বাইলেয়ার গঠিত হচ্ছে। নিশ্চই মনে আছে যে এমন পরিবেশ শুধু ভেন্টেই থাকে। তাই,এটাও সুনিশ্চিত যে মেমব্রেন গঠনের জন্য হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট শুধু উপযুক্ত না, আদর্শ আর একমাত্র উপযুক্ত।
তাই,দেখা যাচ্ছে যে ভেন্টের কাছে প্রথম ফসফোলিপিড বাইলেয়ার গঠিত হওয়া স্বাভাবিক,সহজ একটা প্রক্রিয়া। ভেন্টে কার্বন, হাইড্রোজেন,ফসফরাস,নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম সহ নানান ধরনের মৌল ছিল ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন।
তাহলে এটাই স্বাভাবিক যে তারা বিক্রিয়া করে নতুজ নতুন যৌগ উৎপন্ন হবে, এই যৌগরা আবার বিক্রিয়া করবে, ফলে নতুন উৎপাদ আসবে,তারাও আবার যুক্ত হবে। মনে হতে পারে বেশ জটিল আর দীর্ঘ বিক্রিয়া,কিন্তু আসলে এটা হয়তো কয়েক মিনিটের মধ্যে হওয়া সম্ভব।আবার এই প্রক্রিয়ায় এমিনো এসিড আর নিউক্লিওটাইডও যুক্ত হয়ে যায়,যা প্রাণ গঠনে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান। তাই, এই তিনটা উপাদান, লিপিড,প্রোটিন আর নিউক্লিক এসিড একসাথেই ছিল, একটা ছাড়া আরেকটা থাকা অসম্ভব। এই প্রশ্নই ওঠে না যে এরা কীভাবে একসাথে আসল।
লিখাঃতাহসিন আহমেদ৷ অমি