বিবর্তনকে ভুল প্রমাণ করার জন্য চিরকালই একদল হোমো স্যাপিয়েন্স উঠে-পড়ে লেগে আছে। তাদের অকাট্য দাবি গুলোর একটা হলো এই waiting time problem.
এর সারাংশটা এরকম, “একটা উপকারী/উপযুক্ত/ভালো মিউটেশন টোটালি র্যান্ডমনেসের মাধ্যমে হতে গেলে (কোনো কিছু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে) প্রচুর সময় লাগার কথা। আর তারপর সেই মিউটেশনটা সমগ্র জনসংখ্যায় পৌছে গিয়ে তার ফ্রিকোয়েন্সি স্থির হতে গেলে আরো বেশি সময় লাগার কথা।”
এভাবে তারা হিসাব-নিকাশ করে দেখেছেন যে হোমিনিড এন্সেস্টর থেকে মানুষ আসতে গেলে যতগুলো মিউটেশন হওয়া দরকার, সেগুলো একেবারে র্যান্ডমলি হতে গেলে, আবার প্রত্যেকটা মিউটেশন একেরপর এক হয়ে সমগ্র জনসংখ্যায় ছড়িয়ে তার ফ্রিকোয়েন্সি স্থির হতে গেলে নাকি যা সময় লাগবে, তা মহাবিশ্বের বয়সের চেয়ে বেশি।
(সংখ্যার ঝামেলায় যাইনি, ও জেনে লাভও নেই, মূল জিনিসটা বুঝলেই হবে)
সমস্যাটা আসলেই ভাবার মতো, তাদের হিসাবেও ভুল নেই। তাহলে ভুলটা কোথায়?
তাদের বিবর্তনের কন্সেপ্টে।
মনে করেন, আপনি ফকির। ঘর-বাড়ি,জামা-কাপড়, খাবার-দাবার, টাকা-পয়সা কিচ্ছু নেই। জীবনটা তামাতামা।
এবার, বর্তমান সমাজের দিকে তাকান। একজন মানুষের “ভালোভাবে” থাকার জন্য কী কী লাগে?
একটা বাসা(ভাড়া হলেও হবে), সেখানে বেডরুম,ড্রয়িং-ডাইনিং, বাথরুম, কিচেন, বারান্দা থাকবে। ইলেক্ট্রিসিটি, আসবাবপত্র, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, মোবাইল, এসি এইসবও দরকার বর্তমান যুগে “ভালোভাবে” বেঁচে থাকার জন্য।
এইসবকিছুর জন্য, খুবই কম ধরলেও, একবারে ২-৩ লক্ষ টাকা লাগবে, টোটাল ফকির থেকে একজন “ভালোভাবে” জীবনযাপনকারী হতে গেলে, “কিছু নাই” থেকে “পর্যাপ্ত আছে” হতে গেলে।
এবার, আপনি কোনোমতে একখান খবরের কাগজ জোগাড় করলেন। দেখলেন, সেখানে ৪ টা চাকরির জন্য নিয়োগের খবর আছে। প্রত্যেকটার জন্যই আপনি কোয়ালিফাইড।
একটার বেতন মাসে ৫ হাজার, আরেকটার ৭ হাজার, আরেকটার সাড়ে ৭ হাজার, আরেকটার ৯ হাজার। ৩ লাখ টাকার চাকরিও আছে, কিন্তু তার জন্য যোগ্যতা লাগবে অনেক বেশি।যা আপনার মোটেও নাই।
আপনি “ভালোভাবে” থাকতে চান, তারজন্য লাগবে ৩ লাখ টাকা, বেতন সর্বোচ্চ আছে ৯ হাজার।আপনি ওই চাকরিটাই নিলেন।
মাসে ৯ হাজার টাকা পেলেন, অনেক ছোট একটা ঘর ভাড়া নিলেন, দিনে ২ বেলা ভাত-ডাল খেলেন, অন্তত বেঁচে থাকতে পারলেন।
এতকিছু বলার কারণ কী?
এভাবেই বিবর্তন হয়।
পরিবেশে একেবারে ভালোভাবে বাঁচার জন্য নাজানে কত ট্রেইট লাগবে! সেগুলো টোটাল র্যান্ডমনেসের মাধ্যমে মিউটেটেড হয়ে একবারে আসতে গেলে কল্পনাতীত সময় লাগবেই। কিন্তু র্যান্ডমলি যতগুলো ট্রেইট তৈরি হবে, তারমধ্যে সবচেয়ে ভালোটাই টিকে যাবে।
দেখেন, ওপরে ৩ লাখ টাকার সামনে ৯ হাজার কিচ্ছুই না।সেই ৯ হাজার একেবারে র্যান্ডমলি এসেছিলো, যারা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, তারা কী আপনার কথা ভেবে দিয়েছে? না।
যতগুলো অপশন এভেইলেবল ছিলো, কোনোটাই একেবারে ভালোভাবে থাকার জন্য উপযুক্ত না। কিন্তু অপশনগুলোর মধ্যে একটা বাকিদের থেকে তুলনামূলক ভালো, সেটাই সিলেক্ট করলেন আপনি।আপনি যদি বসে থাকেন,” কবে ৩ লাখ টাকার চাকরির নিয়োগ আসবে, যেটা আমার যোগ্যতার সাথে মিল থাকবে, সেদিন চাকরি নেবো।” এই করলে আপনার মরা ছাড়া উপায় নেই।
একইভাবে, পরিবেশে টেকার জন্য সবচেয়ে ভালো ট্রেইটটার দরকারই নেই, র্যান্ডম মিউটেশনের দয়ায় যেই কয়টা অপশন আছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালোটা সিলেক্ট হলেই হবে, আর বিবর্তন সেটাই করে।
এবার, আপনি ৯ হাজার টাকার চাকরি করছেন। প্রতিদিনই খবরের কাগজ পড়েন। একেকদিন ২ হাজার, ৩ হাজার টাকার চাকরির নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি আসে। কোনোদিম ৬ হাজার,৭ হাজার। হঠাৎ একদিন দেখলেন সাড়ে ৯ হাজার এর চাকরির বিজ্ঞপ্তি। ৫০০ টাকা বাড়লেও লাভ আছে। আপনি ৯ হাজার টাকার চাকরি ছেড়ে সাড়ে ৯ হাজার টাকার চাকরি নিলেন।এতদিনে আপনার যোগ্যতাও বেড়েছে কিছুটা।
এইটাও কিন্তু ৩ লাখের ধারে কাছে না।
বিবর্তনও এভাবেই হয়, প্রতিবার তুলনামূলক ভালো মিউটেশনটা সিলেক্ট হচ্ছে।খারাপ মিউটেশনও হচ্ছে, কিন্তু সেটা বাদ হয়ে যাচ্ছে। সব হচ্ছে র্যান্ডমলি।
আপনি এভাবে করতে করতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করলে ৩ লাখ টাকার চাকরিও পাবেন।যোগ্যতাও মিলে যাবে।কিন্তু ততদিন কী ঘরবাড়ি ছাড়া থেকেছেন? না।একটু ছোট ঘরে, একটু কম খেয়ে, একটু কমদামি জামা পড়ে থেকেছেন, সমস্যা কী? ধীরে ধীরে বেতন বাড়ার সাথে সাথে বড় থেকে বড় বাসা ভাড়া নিছেন, খাওয়া বাড়ছে, জামা-কাপড়ের দামও বাড়ছে। একদিন, “ভালোভাবে” থাকার মতো সবকিছু পেয়ে গেছেন।
এখানে কিন্তু সময় বেশি লাগেনি, হয়তো ৪-৫ বছর। কিন্তু আপনি যদি একেবারে র্যান্ডমলি কম যোগ্যতায় ৩ লাখ টাকার চাকরি আসার অপেক্ষা করতেন, কত বছর লাগতো কে জানে! এমন চাকরি আছে কিনা তাও সন্দেহ!
সুতরাং, “উপকারী” মিউটেশন বলে কিছু নেই। আপাতত পরিবেশের সাপেক্ষে যেইটা ইট্টুসখানি ভালো, সেইটাই সবচেয়ে উপকারী। নাই মামার চেয়ে কানা মামা আর কানা মামার চেয়ে একচোখ ওয়ালা মামাও ভালো। যদিও দুইচোখ ওয়ালা মামা সর্বোত্তম, কিন্তু সে অপশনে না থাকলে একচোখওয়ালা দিয়েই কাজ চলবে।
বুঝলেন?
উল্লেখ্য যে, যেই উদাহরণটা দিলাম চাকরির, সেটার সাথে বিবর্তনকে হুবহু মিলাতে যেয়েন না। বিবর্তন জিনিসটা এতটাই জটিল একটা প্রসেস যার সাথে হুবহু মিলে যায় এমন কোনো উদাহরণ নেই। এই উদাহরণটা শুধু র্যান্ডম মিউটেশন আর উপকারী ট্রেইট বোঝাতে দিয়েছি।
এখানে আরেকটা সমস্যা আছে। আপনি ২০২০ সালে জানতেন ৩ লাখ টাকা হলে ভালোভাবে থাকা যায়। ৩ লাখ টাকার চাকরি পেতে আপনার ৫ বছর লেগেছে। ৫ বছরে কি দুনিয়া স্থির হয়ে ছিলো?
না, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সব উন্নত হয়েছে।
২০২৫ সালে আপনি ৩ লাখ টাকার চাকরি পেলেন, কিন্তু ২০২৫ সালে মানুষের জীবনযাত্রার মানও বেড়ে গেছে, তখন দরকার ৪ লাখ টাকা। মানে আবারো আপনার সিলেকশন করতে হবে।
যতদিনে ৪ লাখ টাকার মতো যোগ্যতা আর চাকরি পাবেন, ততদিনে দেখা যাবে দরকার হবে ৫ লাখ। এভাবে চলতে থাকবে।
বিবর্তন জিনিসটাও এমন। এটা প্রাণীদের মধ্যে উন্নয়নের প্রতিযোগিতা না, বিবর্তন হলো একটা প্রতিযোগিতার উন্নয়নের ধারা, এখানে প্রাণীদের কোনো নির্দিষ্ট ফিনিশিং পয়েন্ট নেই।
বেস্ট ট্রেইটওয়ালা প্রাণীটা আপাতত টিকে যাবে প্রতিযোগিতায়, কিন্তু কালকে প্রতিযোগিতাটা নিজেই আরো উন্নত হবে, জটিল হবে। গতকালে বেস্ট ট্রেইট তখন আর কাজে দেবেনা, আবার সিলেকশন হবে, আবার “আপাত বেস্ট ট্রেইট” সিলেক্ট হবে।
সেটা হতে হতে পরিবেশ আরো জটিল হবে, অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতা বাড়বে। এভাবে, বিবর্তন সর্বদা চলমান, বহমান,গতিময়, ত্বরণশীল।
এবার, সর্বশেষ পয়েন্টটা নিয়ে কথা বলতেও আমার কেমনজানি লাগছে।
ওয়েটিং টাইম প্রব্লেম এ ধরে নেয়া হয়, “একটা মিউটেশন হয়, সেইটা সবার মাঝে ছড়িয়ে গিয়ে স্থির হয়। তারপর আরেকটা মিউটেশন হয়।তার আগে না”
মানে? ক্যাম্নে কী? কয় কী এরা?
মানুষের এক প্রজন্ম পাস হলে গড়ে কতগুলো মিউটেশন হয় তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত না। কিন্তু কোনো পাগলও বুঝবে যে সংখ্যাটা ১ না। ৪০-৫০-১০০ টা হওয়াতো স্বাভাবিক ব্যাপার।
আচ্ছা, যতগুলোই হোক, সব মিউটেশন কি একটা ট্রেইটের জন্য হয়?না। ৪০ টা মিউটেশন ৪০ রকম ট্রেইটের জন্য হতে পারে।
এমননা যে শুধু চুলের রঙের জন্য মিউটেশন হবে, কালো, সাদা,লাল, বাদামী ব্লা ব্লা।
চুলের রঙ, চোখের রঙ, উচ্চতা, পায়ের সাইজ, হাতের সাইজ আরো যত যা মনে আসে, সব ধরে নেন।যতগুলো মিউটেশন হবে, প্রায় সবগুলোই ভিন্ন ভিন্ন ট্রেইটের জন্য হবে।
ভিন্ন ভিন্ন ট্রেইটের জন্য মিউটেশন মানে সবকয়টার জন্যই সিলেকশন সর্বদা চলতে থাকবে।
মানুষ কোন যুক্তিতে চিন্তা করে যে একটা মিউটেশন হবে, সেইটা সিলেক্ট হবে, সমগ্র জনসংখ্যায় ছড়াবে, তারপর গিয়ে আরেকটা মিউটেশন হবে!
এমন কোনো মেকানিজম জীবদেহে নেই যা এরকম কিছু ঘটায়। একইসাথে অনেকগুলো মিউটেশন হবেই, আর সবগুলোও ওপরেই সিলেকশন কাজ করবে।
একটা পাখির ডানা বড় আর ঠোট লম্বা হওয়ার মিউটেশন হলো। দুইটার ওপরেই সিলেকশন কাজ করবে। ওড়ার ক্ষেত্রে আর খাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হবে,একই সময়ে হবে। সমস্যা কোথায়?
আপনি চাকরি খুজছেন বলে কী বিয়ের জন্য গার্লফ্রেন্ড খুজতে পারবেন না? এইটা কোনো কথা?
একটা ট্রেইটের জন্য মিউটেশন ফিক্স হতে হতে আরেকটা ভালো মিউটেশন আসলে সেটা সিলেক্ট হতে থাকবে, পূর্বের ফিক্সেশন ভঙ্গ হবে। একই সময়ে আরেকটা ট্রেইটের মিউটেশন ফিক্স হওয়া হয়তো শুরু হবে,বা শেষ হবে বা মাঝপথে থাকবে।
সমস্যাটা কোথায়?
মানে, একটার পর একটা মিউটেশন হয়ে ফিক্স হতে গেলে আসলেই অনেক সময় লাগতো, কিন্তু তেমন হয়না। কারণ একইসাথে অনেকগুলো মিউটেশনের ফিক্সেশন চলে।
সুতরাং, ওয়েটিং টাইম প্রব্লেম যেই ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, সেইটাই ভুল। বিবর্তনকে তারা যেমন বলে, এটা তেমন না।
(ওয়েটিং টাইম প্রব্লেমের সমাধান পুরোটাই প্রায় গাণিতিক আর সেটা অনেক জটিল,আমার জন্যও সেটা বোঝা কষ্টকর।তাই, আমি সহজ ভাষায় যুক্তির সাহায্যে বিষয়টা বোঝাতে চেষ্টা করেছি।
গাণিতিক ও অধিক গ্রহণযোগ্য প্রমাণ এখানে পাবেন