সময়ের সাথে সাথে মানব জাতির সামষ্টিক জ্ঞান কতটুকু বেড়েছে এটা পরিমাপ করা কঠিন। তবে এর একটা সরল ইন্ডিকেটর আছে। সেটা হল পাই মান হিসাব করতে পারার ক্ষমতা।
বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতকে গ্রিক হরফ পাই (π) এর সাহায্যে প্রকাশ করা হয়। যেকোনো গোলাকার বস্তুর আকার ও আয়তন হিসাব করার জন্য π এর মান জানতে হয়। তাই প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নির্ভুলভাবে π এর মান নির্ণয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
যেমন, আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগেই মেসোপোটেমিয়াতে মানুষ π এর মান দশমিকের পরে দুই ঘর পর্যন্ত নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে পেরেছিল। তারা ধরে নিয়েছিল π=22/7.
পাই এর মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হল এর পাই এর মান কখনই নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কারণ পাই একটি অমূলদ সং্খ্যা। অর্থাৎ একে ভগ্নাংশ আকারস প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তার উপর পাই হল একটা ট্রান্সিডেন্টাল সং্খ্যা।
পাই এর মানকে কোনো এলজেব্রায়িক সমীকরণের মূল হিসাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই পাই এর মান নির্ণয়ের একমাত্র সমাধান হল অসীম ধারা। পাই এর মানকে বিভিন্ন অসীম ধারার যোগফল হিসাবে প্রকাশ করা যায়।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাই এর মান দশমিকের পরে ২০২ ট্রিলিয়ন ঘর পর্যন্ত নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা গেছে, যদিও দশমিকের পরে মাত্র চল্লিশ ঘরের মান সঠিকভাবে জানা থাকলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এর যেকোনো হিসাব নির্ভুলভাবে করা সম্ভব।
তাই হিসাবের নির্ভুলতার জন্য নয় মানুষ এখন পাই এর মান নির্ণয়ে শ্রম দিচ্ছে কৌতূহল থেকে এবং কিছু বিশেষ প্রয়োজনে। আমরা জানি, সাইবার সিকিউরিটি ফিল্ডে র্যান্ডম নাম্বার খুব দরকারি একটা জিনিস।
র্যান্ডম নাম্বার জেনারেশনে পাই এর মানের ডিজিটগুলো ব্যবহার করা হয়। তবে পাই এর মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মানুষকে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
গাণিতিকভাবে পাই এর মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন গ্রীক গণিতবিদ আর্কিমিডিস। আর্কিমিডিস বৃত্তের ভেতর বহুভূজ অঙ্কন করে পাই এর মান নির্ণয়ের পথ বাতলে দেন। পাই এর মান নির্ণয়ের এই পদ্ধতি ক্যালকুলাস আবিষ্কারের আগপর্যন্ত মানে পরবর্তী দুই হাজার বছর চলমান থাকে।
প্রায় সব গণিতবিদরাই আর্কিমিডিসের দেখানো পথে হেঁটেছেন। যেমন, চীনারা গণিতবিদরা দশমিকের পরে ৮ ঘর পর্যন্ত পাই এর মান নির্ণয় করতে পেরেছিলেন খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যেই। চীনা গণিতবিদদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলেন লিউ হুই এবং জু চংজি।
লিউ হুই ছিলেন তৃতীয় শতকের এবং তিনি দশমিকের পরে ৪ ঘর পর্যন্ত এবং জু চংজি ছিলেন পঞ্চম শতকের তিনি দশমিকের পরে ৮ ঘর পর্যন্ত পাই এর মান নিঁখুতভাবে হিসাব করেছিলেন। পরবর্তী এক হাজার বছর এটাই ছিল পাই এর সবচেয়ে নির্ভুল আসন্নায়ন।
তবে পঞ্চদশ শতকে পারস্যের গণিত ও জ্যোতির্বিদ জামশেদ আল কাশি ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে দশমিকের পরে ১৪ ঘর পর্যন্ত নির্ভুলভাবে পাই এর মান নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। মোটামুটি পরবর্তী দুই শতাব্দী পর্যন্ত এটাই ছিল পাই এর সবচেয়ে নির্ভুল মান।
সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয় গণিতবিদরা পাই এর মান নির্ণয়ে আরো আগ্রসর হন। এর মধ্যে আবিষ্কৃত হয় ক্যালকুলাস। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে পাই এর মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এফিশিয়েন্ট এপ্রোচগুলোর একটা আবিষ্কার করেছিলেন তামিল গণিতবিদ রামানুজন এবং সেটা গত শতাব্দীতে, মাত্র একশ বছর আগে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট আবিষ্কার এবং একবিংশ শতকে আরো উন্নত মানের প্রসেসর আবিষ্কারের ফলে পাই এর মান নির্ণয়ে মানুষ অকল্পনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। তাই দেখা যাচ্ছে, ইতিহাসের কোন একটা সময়ে মানব সভ্যতা সামষ্টিকভাবে কতটা অগ্রসর ছিল এটা বোঝার একটা সুপ্ত ইন্ডিকেটর হল পাই।
কোনো সভ্যতা পাইকে যত নির্ভুলভাবে চিনেছে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে তত বেশি অগ্রসর ছিল এই সরলীকরণ করতে বোধ হয় ভুল হবে না।
How did they first calculate pi?