২০১২ সালে এনপিআরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে চীনা সাংবাদিক ইয়ং জিসেং একটা লোমহর্ষক ঘটনা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন- “সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, দ্য গ্রেট চাইনিজ ফেমিনের সময় খাদ্য সংকটে মানুষ মানুষকে খেয়েছে এমন অসংখ্য কেস রয়েছে। ক্ষুধার জ্বালায় বাবা-মা তাদের সন্তানকে খেয়েছে, সন্তান খেয়েছে তার বাবা-মাকে এমন ঘটনাও ছিল অহরহ।”
কিন্তু কী ছিল এই গ্রেট চাইনিজ ফেমিনের পিছনের ঘটনা? সেসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গেলেই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসে মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
১৯৫৮ সালে মাও সে তুং চারটা প্রাণীকে চীনের উন্নয়নের জন্য বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই তালিকায় ছিল ইঁদুর, মশা, মাছি এবং চড়ুই। বিশেষ করে ইউরেশিয়ান গেছো চড়ুইকে মারার জন্য টার্গেট করা হয়।
বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হচ্ছিল যে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফসল খেয়ে ফেলে চারপাশে বসবাসরত চড়ুই পাখির দল। আর তাই এ সমস্যার সমাধানে দেশ থেকে সব চড়ুই পাখি মেরে ফেলার নির্দেশ দিলেন মাও সে তুং।
গণহারে শুরু হলো চড়ুই মারা। কিন্তু এত বিশাল আয়তনের দেশটি থেকে রাতারাতি চড়ুই পাখি বিলুপ্ত করে দেয়া তো আর চারটি খানি কথা নয়। তাই কিভাবে চড়ুই পাখি মারা যায়, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলল।
লোকে ড্রাম আর থালা হাতে রাস্তায় নেমে পড়ত, চড়ুই দেখলেই বাজানো শুরু করত। প্রবল বাদ্যযন্ত্রের শব্দে সহজেই ভীত হয়ে পালাত চড়ুই। কিন্তু চারপাশের ক্রমাগত আওয়াজে একসময় দুর্বল হয়ে হৃদপিণ্ড থেমে যেত ছোট্ট পাখিগুলোর।
দেশপ্রেমের টানে দলে দলে চড়ুই নিধন কর্মসূচীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সকলে। সাংহাইয়ের একটি পত্রিকা সেই দিনটির বর্ণনা করেছিল এভাবে-
“১৩ই ডিসেম্বর (১৯৫৮) সকালে, সবখানে বেজে উঠল চড়ুই পাখির বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা। চারিদিকে উঠে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য কাকতাড়ুয়া, কুশ পুত্তলিকা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, সরকারী অফিসের কর্মী, কারখানার শ্রমিক, কৃষক, পিপল’স লিবারেশন আর্মি সকলেই ছুটে চলেছে যুদ্ধের জয়গান গেয়ে।”
মূলত কম বয়সী মানুষের ঘাড়ে পড়েছিল চড়ুই পাখি ধরা, তাড়া করা, বিষ দিয়ে মারার মতো কাজগুলো। আর বৃদ্ধ ও শিশুদের দেয়া হয়েছিল প্রহরীর দায়িত্ব। গৃহিণীরাও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন থালা, বাটি, হাড়ি, পাতিল নিয়ে।
চড়ুই পাখির বাসা নষ্ট করা, ডিম ভেঙে ফেলা, গুলি করা, বন্দী করে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা ছিল সেদিনকার বীভৎস কর্মসূচীর মুখ্য অংশ।
চড়ুই নিধন সংক্রান্ত এক করুণ ঘটনার সাক্ষী ছিল বেজিংয়ে অবস্থিত পোল্যান্ড দূতাবাস। শোনা যায় আশেপাশে লোকের আক্রমণে টিকতে না পেরে প্রচুর চড়ুই পাখি দূতাবাসের ভেতরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পোলিশ কর্তৃপক্ষ চিন সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও চড়ুই নিধনকারীদের দূতাবাসের ভেতর ঢুকতে দেয়নি।
এতে ক্ষেপে গিয়ে দূতাবাস ঘিরে হাজার হাজার লোক রাতদিন ড্রাম বাজাতে থাকে। ড্রামের বিকট শব্দে হার্টফেল করে মারা যায় অনেক চড়ুই। এভাবে টানা দুইদিন বাজানোর পর লোকজন সরে গেলে দেখা যায় দূতাবাসের উঠানে এত পরিমাণ মরা চড়ুই পড়ে ছিল যে সেগুলো সরানোর জন্য পোলিশদের বেলচা পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়েছিল।
তবে চিনাদের এমন নির্বোধ কর্মকাণ্ডের খেসারত দিতেও বেশি সময় লাগল না। ধেয়ে এলো প্রকৃতির নির্মম আঘাত।
শস্যদানার পাশাপাশি চড়ুই নানান ধরনের পোকামাকড়ও খেয়ে থাকে। তাই চড়ুই পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেল সেসব পোকামাকড়ের সংখ্যা। পঙ্গপাল সহ ফসলের ক্ষেত ভরে গেল ক্ষতিকর সেসব পোকামাকড়ে। ফলস্বরূপ যে শস্য বাঁচানোর জন্য এত কিছু করা হল, সেই শস্য গেল পোকামাকড়ের পেটে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শস্যভাণ্ডার খালি হয়ে গেল। খাদ্য সংকটের মুখে পড়ল কোটি কোটি মানুষ। “দ্য গ্রেট চাইনিজ ফেমিন” নামে পরিচিত এই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারালো প্রায় দেড় কোটি মানুষ।
শেষমেশ চিন সরকার বাধ্য হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েক লাখ চড়ুই আমদানি করে। এই চড়ুই সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে চীন আস্তে আস্তে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামাল দিতে সক্ষম হয়।
আমরা মানুষেরা জেনে বা না জেনে প্রকৃতির উপর নানা আঘাত করি। কিন্তু প্রকৃতি সবসময় তার উপর কৃত অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়ে থাকে। কখনো কখনো হয়তো এমন নির্মমভাবে নেয় যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না…..