আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে, কোন বস্তুর গতি ও তার সময়ের “গতির” সাথে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যদি সময়ের সাথে কোন বস্তুর গতি বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাহলে তার গতিবেগ বৃদ্ধির সাথে সাথে তার সময়েরও প্রসারণ ঘটতে থাকবে।
এখানে বলা আবশ্যক যে, সময়ের এই যে প্রসারণ কিন্তু পুরোপুরি বাস্তব এবং তা সময়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। শুধু সময় মাপন যন্ত্র বা ঘড়িই ক্ষেত্রেই এমন ঘটে তাই না, গতি যে কোন প্রাণীর জৈবিক ঘড়িকেও একই ভাবে প্রভাবিত করে।
যেমনঃ আপেক্ষিক ভাবে স্থির কোন বস্তুর তুলনায়, কোন গতিশীল যানে বা মহাকাশযানে একজন মানুষের হার্টবিট, বয়স বৃদ্ধির হার ইত্যাদি অপেক্ষাকৃত ধীর হবে।
ধরা যাক, একজন ব্যক্তি পৃথিবীতে অবস্থান করছে, একই সময়ে একজন মানুষ একটি মহাকাশযানে চড়ে পৃথিবী থেকে মহাশূন্যের পথে রওনা হলো, তাহলে একই ঘটনার জন্য মহাকাশযানে ভ্রমণ করা মানুষটির কাছে সময় ধীরে চলবে (প্রসারিত হবে)।
মহাকাশযানের গতি আলোর যত কাছাকাছি হবে, সময়ের প্রসারণ তত দ্রুত হারে বাড়তে থাকবে।
যেমন, মহাকাশযানের গতি যদি আলোর গতির শতকরা ৯৫ ভাগ হয়, পৃথিবীর ১০ বছর সাপেক্ষে মহাকাশযানে অবস্থানকারী ব্যক্তির অতিক্রান্ত সময় হবে ৩.১ বছর, আর মহাকাশযানের গতি যদি আলোর গতির শতকরা ৯৯ ভাগ হয়, তাহলে এই সময় হবে মাত্র ০.১৯ বছর বা ৭৩ দিন (প্রায়)।
জমজ বোনের ধাঁধা (Twin Paradox)
আইনস্টাইনের নতুন তত্ত্বের এত সাফল্যের মাঝেও অনেকেরই মনে কিন্তু একটি প্রশ্ন খচখচ করছিল। তা হলো, যদি বস্তুর গতিবেগ যেহেতু আপেক্ষিক এবং গতির সাথে সাথে সময়ের প্রসারণ সরাসরি সম্পর্কিত হত, তাহলে তো সময়ের প্রসারণও আপেক্ষিক!
কিন্তু, তা কিভাবে সম্ভব! কারণ, সেক্ষেত্রে একটি নতুন ধাঁধার সৃষ্টি হবে।
কিভাবে? একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
মনে করি, মিতা আর রিতা দুই জমজ বোন।
রিতা কোন একটি মহাকাশযানে চড়ে আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে দূরে কোন একটি নক্ষত্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। এদিকে মিতা পৃথিবীতেই রয়ে গেল।
এখন পৃথিবী থেকে যখন মিতা মহাকাশযানের দিকে তাকাবে তার কাছে মনে হবে রকেটিতে চড়ে রিতা আলোর গতির প্রায় কাছাকাছি গতিতে তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ, আপেক্ষিকতার সূত্র অনুসারে, মিতার তুলনায় রিতার সময় অনেক ধীরে চলবে।
সেই হিসেবে কয়েক বছর পরে যখন রিতা পৃথিবীতে ফিরে আসবে রিতার বয়স মিতার চেয়ে কম হারে বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ, মিতা বয়সে রিতার চেয়ে বড় হবে!
এবার, ব্যাপারটা আমরা একটু রিতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেষ্টা করি। রিতা মহাকাশযানে করে যাত্রা শুরুর করার পর যখন পৃথিবীর দিকে তাকাবে, তখন সেও কিন্তু দেখতে পাবে যে আলোর গতির প্রায় কাছাকাছি গতিতে পৃথিবী ও মিতা তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
সেক্ষেত্রে, মিতার সময়ের প্রসারণ ঘটার কথা, ও মিতার বয়স রিতার চেয়ে ধীর গতিতে বৃদ্ধি পাবে। তাহলে কয়েক বছর পরে যখন রিতা পৃথিবীতে ফিরে ফেরত আসার পর মিতার বয়স রিতার চেয়ে কম গতিতে বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ, মিতা বয়সে রিতার চেয়ে ছোট হবে!
কিন্তু, সেটা কি করে সম্ভব! মিতা একই সাথে কিভাবে রিতার চেয়ে বড় ও ছোট হতে পারে! আপেক্ষিকতা তত্ত্বে সময়ের প্রসারণের (Time Dialation) বিষয়টি তাত্ত্বিক ভাবে প্রমাণিত হওয়ার সাথে সাথেই অবধারিত ভাবেই এই বিতর্কটিও শুরু হয়।
সেই থেকেই এটি “জমজ বোনের ধাঁধা বা Twin Paradox হিসেবে পরিচিত।
ধাঁধার মত মনে হলেও সমস্যাটি আসলে কোন ধাঁধা নয়। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তার তত্ত্ব প্রকাশের সাথে সাথেই নিজে থেকেই এই সমস্যাটি অনুধাবণ করেন, এবং দ্রুত এর সমাধানও বের করে ফেলেন।
সমাধানটি বুঝতে হলে এর একটি বাস্তব অবস্থা ভালভাবে অনুধাবণ করতে হবে। তা হলো, পৃথিবী থেকে রিতার মহাকাশযানের আপেক্ষিক গতি ও মহাকাশযান থেকে পৃথিবী দূরে সরে যাওয়ার আপেক্ষিক গতি দেখতে এক মনে হলেও, দু’টি অবস্থার মাঝে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে।
তা হলো, রিতার মহাকাশ ভ্রমণ ঘটনাটি শেষ করতে রিতাকে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। যেমন, পৃথিবী থেকে মহাকাশযান একটি বিশেষ ত্বরণে যাত্রা শুরু করবে, তারপর মহাকাশে একটি নির্দিষ্ট গতিতে ভ্রমণ করবে, একসময় ব্রেক করে, ঘুরে আবার একটা নির্দিষ্ট ত্বরণে কিছুক্ষণ চলবে, তারপর একটি নির্দিষ্ট গতিতে চলে পৃথিবীর কাছে এসে ব্রেক করে গতি কমিয়ে একসময় পৃথিবীতে অবতরণ করবে।
কিন্তু, এই সম্পূর্ণ সময়ে মিতা পৃথিবীতে মোটামুটি একই রকম অবস্থার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করবে (গতির হিসেবে)।
তাই রিতার মহাকাশযানের ত্বরণ, গতি, ব্রেক, ঘুরে আবার ত্বরণ, গতি ও পুনরায় ব্রেক ইত্যাদি রিতা ও মিতার দু’টি অবস্থার পর্যবেক্ষণে বিস্তর পার্থক্য সৃষ্টি করবে এবং কার্যত তাদের অবস্থার সিমেট্রি ভেঙ্গে যাবে।
আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সূত্রে আমরা দেখেছি, সূত্রটি অপরিবর্তনশীল গতির (uniform) গতির উপর ভিত্তি করে তৈরি, ত্বরণের উপর ভিত্তি করে নয়। কারণ, ত্বরণ আপেক্ষিক না, এটি একটি পরমমান (absolute)।
সুতরাং, রিতার মহাকাশযানে অপরিবর্তনশীল নির্দিষ্ট গতি তার সময়ের প্রসারণ ঘটাবে, বা তার সময় ধীরে চলবে।
ফলে, পৃথিবীতে ফিরে আসার পর অবশ্যম্ভাবী ভাবেই রিতার বয়স মিতার চেয়ে কম বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ, মিতা বয়সে রিতার চেয়ে বড় হবে। এখানে দু’টি বিষয় অনুধাবন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ –
প্রথমতঃ সময়ের এই প্রসারণ বা ধীরে চলার বিষয়টি কিন্তু শুধু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয় বরং এটি বাস্তবেই এমন ঘটবে,
দ্বিতীয়তঃ গতির সাথে বয়স বৃদ্ধির কোন সম্পর্ক নেই, শুধুমাত্র সময় প্রসারণের কারণেই মহাকাশযানে রিতার সময় ধীরে চলবে।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, ২০২০ সালে রিতা সেকেন্ডে ২৪০,০০০ কিলোমিটার বেগে একটি মহাকাশযানে করে যাত্রা শুরু করলো।
যাত্রার সময়ে রিতা ও মিতার বয়স ৩০ বছর। মনে করি, ২০৪০ সালে মহাকাশযানটি পৃথিবীতে ফিরে আসল। তাহলে, এই সময়ে পৃথিবীতে থেকে যাওয়া মিতার বয়স হবে ৫০ বছর।
কিন্তু, আইনস্টাইনের সূত্র অনুসারে, মহাকাশযানের এই গতিতে মহাকাশযানে সময় অতিক্রান্ত হবে মাত্র ১২ বছর। অর্থাৎ, রিতা যখন পৃথিবীতে ফিরে আসবে তখন সে অবাক হয়ে দেখবে যে পৃথিবীতে ২০ বছর সময় পার হয়ে গিয়েছে, মিতার বয়স হয়েছে ৫০ বছর, হয়তো মিতার চুলেও পাক ধরেছে কিছুটা, কিন্তু তার নিজের বয়স তখন মাত্র ৪২!
এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এখানে ২০২০ সাল থেকে ২০৪০ সালের মধ্যবর্তী সময়টা নির্দিষ্ট নয়, এটা আপেক্ষিক – রিতার কাছে তা ১২ বছর (রিতার সময়) কিন্তু মিতার কাছে ২০ বছর (মিতার সময়)। রিতা ও মিতা দুজনেই যার যার অবস্থানে সঠিক!
অর্থাৎ, “বর্তমান বা এখন” বলে আর কিছুর অস্তিত্ব রইলো না! একজনের ১২ বছর আরেকজনের ২০ বছরের সমান হতে পারে বা একজনের “এখন” অন্য কারো “তখন” হতে পারে!
তাহলে কি উচ্চ গতিই হতে পারে চির যৌবনের চাবিকাঠি?
না, ব্যাপারটি এমন না। অনেকেই এই ভুলটি করে থাকে। মহাকাশযানে আলোর কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণ করে ফিরে আসার পরে পৃথিবীতে দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও, তাতে নভোচারীর বয়স বাড়ার গতি কিন্তু কমবে না।
রিতা ও মিতার উদাহরণটি যদি চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাই যে, রিতার ফ্রেমে ১২ বছরের তুলনায় মিতার ফ্রেমে সময় ২০ বছর পার হলেও, রিতার নিজের ফ্রেমে তার নিজের বয়সও কিন্তু ঠিকই বাড়ছে। ধরা যাক, রিতা হয়তো ৭৫ বছর বাঁচবে।
তাহলে সে যত গতিতেই ভ্রমণ করুক না কেন, মহাকাশযানে তার বয়স ঠিকই স্বাভাবিক গতিতে বাড়তে থাকবে, এবং ৭৫ বছর বয়সেই মারা যাবে। ততদিনে হয়তো পৃথিবীতে ১২০ বছরেরও বেশি সময় কেটে যাবে, কিন্তু তাতে রিতার নিজস্ব সময়ের অভিজ্ঞতায় কোন লাভ নেই।
অর্থাৎ, রিতার ৭৫ বছর, সে যেখানেই থাকুক না কেন তার নিজের সময়ের হিসেবে ৭৫ বছরের সমানই হবে।
লেখাঃ হাসান তারেক চৌধুরী