এইবারের নোবেল পুরস্কার খুবই মজার এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দারুন একটি বিষয় কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙলমেন্টের উপর।
বিষয়টির উৎপত্তি ১৯৩৫ সালে আইনস্টাইন-পোডোলস্কি-রোজেন এই ৩ জনের লেখা একটি আর্টিকেলের মাধ্যমে যা পরবর্তীতে EPR প্যারাডক্স নামে অধিক পরিচিতি লাভ করে।
এই প্যারাডক্সটি একটি থট এক্সপেরিমেন্টকে কেন্দ্র করে গঠিত কারণ তখন এইটা নিয়ে সত্যিকারের এক্সপেরিমেন্ট করার কোন সুযোগ ছিল না।
তাহলে থট এক্সপেরিমেন্টটা কি? তারা একটি এন্ট্যাঙলড জোড়া পার্টিকেলের কথা ধরে নিয়েছিল। যেহেতু তারা এন্ট্যাঙলড তাহলে এদের একটি পার্টিকেলের পজিশন কিংবা মোমেন্টাম মাপতে পারলে অন্যটির পজিশন বা মোমেন্টাম জানা হয়ে যায়।
এর অর্থ ইনফরমেশন ট্রান্সফারড আলোর চেয়ে বেশি গতিতে যা আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির তত্বকে violate করে। আবার অন্যদিকে কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন বলে দুটো পার্টিকেলই মিক্সড স্টেটে আছে।
যতক্ষণ না দুটোর আলাদাভাবে মেজারমেন্ট না করা হবে তাদের পজিশন বা মোমেন্টাম সম্মন্ধে কিছু বলা সম্ভব না কারণ তারা সমান সম্ভাবনায় দুটো পার্টিকেলই মিক্সড স্টেটে আছে। এইজন্যই এটি প্যারাডক্স হিসাবেই খ্যাত।
কিন্তু অতি সম্প্রতি এক দল জার্মান গবেষক এক্সপেরিমেন্টাললি দেখান যে দুটো কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙলড পার্টিকেলকে ফাইবার অপটিক্সের মাধ্যমে ৩৩ কিলোমিটার দূরত্বে আলাদা করে একটির স্টেট মেজার করলে একই সাথে ৩৩ কিলোমিটার দূরের অন্যটির মেজার করা হয়ে যায় বা একটির সম্মন্ধে জানলে সাথে সাথে অন্যটির স্টেট সম্মন্ধে জানা হয়ে যায়।
এটি কিভাবে সম্ভব? এটির ব্যাখ্যার জন্য একটি singlet স্টেটের কথা ভাবতে পারি
1/sqrt(2)[|up>|down>-|down>|up>]
যেখানে ।up>, ।down> হলো সিঙ্গেল স্টেটের অর্থনর্মাল বেসিস। Singlet মানে হলো দুটো হাফ স্পিন পার্টিকেলের এমন মিক্সড স্টেট যাদের টোটাল স্পিন হলো জিরো।
এখন যদি এমনভাবে তৈরী করা দুটো পার্টিকলকে স্থানিকভাবে আলাদা করে একটির উপরে মেজারমেন্ট চালানো হয় তাহলে বারবার এক্সপেরিমেন্ট করলে এটির স্পিন কখনো up বা কখনো down পাওয়া যাবে।
যেটাই পাওয়া যাক না কেন টোটাল স্পিন জিরো করতে হলে অন্যটির হবে ঠিক তার অপোজিট। সুতরাং এখানে রেলটিভিটি violate করার কোন বিষয় নাই কারণ এখানে ইনফরমেশন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার বিষয় নেই।
যেটি আছে সেটি হলো conservation of total স্পিন।
কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট হল এমন এক অদ্ভুত ঘটনা যেখানে দুটি কণা এতটাই অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত হতে পারে যে একটি পরীক্ষা করলে অন্যটির অবস্থা সম্পর্কে জানা হয়ে যাবে।
অদ্ভুত শোনালেও, একটি কণা সম্পর্কে কিছু পরিবর্তন করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে তার পার্টনারকে পরিবর্তন করে ফেলে, তারা যত দূরেই থাকুক না কেন।
এটি আমাদের চিন্তাকে এমন এক অস্বস্তিকর দিকে নিয়ে যায় যে মনে হতে পারে তথ্য আলোর গতির চেয়ে দ্রুত “টেলিপোর্ট” করা হচ্ছে।
এমন একটি ধারণাই EPR প্যারাডক্সের জন্ম দিয়েছিল এবং স্বয়ং আইনস্টাইন এটিকে “দূরত্বে ভুতুড়ে ক্রিয়া” হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। এই EPR প্যারাডক্সই কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সাইন্সের জন্ম দিয়েছে যা খুবই এক্সসাইটিং।
এর সাথে two-slit এক্সপেরিমেন্টের দারুন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ধরি স্লিট দুটোর দূরত্ব যেই আলো ব্যবহার করছি তার ওয়েভ লেংথের কাছাকাছি।
দুটোর একটি স্লিট বন্ধ করে অন্যটি দিয়ে যদি আলো পাঠাই যেই ইনটেনসিটির ডিস্ট্রিবিউশন পাব এইরকম দুটো ডিস্ট্রিবিউশন থেকে দুটো খোলা রাখলে যেই ডিস্ট্রিবিউশন পাব তা কনস্ট্রাক্ট করা যাবে না।
এইবার দুটো স্লিটই খোলা রেখে একটি একটি করে অনেক আলোর পার্টিকেল বা ফোটন পাঠালে যেই ডিস্ট্রিবিউশন পাই তাদেরকে এক সাথে পাঠালেও একই ডিস্ট্রিবিউশন পাই। তার মানে একটি ফোটন যখন যায় সে জানে যে দুটো স্লিটই খোলা?
আমরা যুক্তি দিয়েছি যে পদার্থ বা শক্তির কণা সর্বদা শুধুমাত্র একটি স্লিট দিয়ে যায়, যদিও পদার্থবিজ্ঞানের জনপ্রিয় কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা দাবি করে যে আমরা কণার পথ জানতে পারি না, আমরা এটি পরিমাপ না করা পর্যন্ত একটি পথের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও জানতে পারি না।
একই সময়ে একাধিক জায়গায় থাকতে পারা আইনস্টাইনকে গভীরভাবে বিরক্ত করেছিল। পরবর্তীতে ডেভিড বোহমের “পাইলট-ওয়েভ থিওরি” নিশ্চিত করে যে একটি বস্তুনিষ্ঠ বাস্তব কণা তার পাইলট তরঙ্গ দ্বারা পরিচালিত একটি স্লিটের মধ্য দিয়েই ভ্রমণ করে কিন্তু কখন কোনটি দিয়ে যাবে এটি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না।
অনেকগুলো আলোর পার্টিকেল গেলে পরেই একটি প্যাটার্ন পাওয়া যাবে যা মনে হবে যেন Youngs ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট। একটি একটি করেগেলেও আলোর পার্টিকেল জানে কিভাবে কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কখনো যাওয়া যাবে না?
কোথায় সবচেয়ে বেশিবার যেতে হবে যেন টোটাল প্যাটার্ন ঠিক থাকে?
লেখক: কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক,
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ,
ঢাবি।
(২)
২০২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তিনজন গবেষককে। এই তিনজন নোবেলজয়ী হলেন:
ফ্রান্সের ইকোল পলিটেকনিকের অধ্যাপক আলান এসপেক্ট (Alain Aspect), ক্যালিফোর্নিয়া জে এফ ক্লাউসার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এর প্রধান বিজ্ঞানী জন এফ ক্লাউসার (John F Clauser), এবং অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্তন সাইলিঙ্গার (Anton Zeilinger)।
প্রফেসর আলান এ্সপেক্টের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ জুন ফ্রান্সে। ১৯৮৩ সালে প্যারিস-সুদ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জন করেন তিনি।
জন ক্লাউসারের জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনায় ১৯৪২ সালের ১ ডিসেম্বর। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি অর্জন করেন ১৯৬৯ সালে।
আন্তন সাইলিঙ্গারের জন্ম অস্ট্রিয়ায় ১৯৪৫ সালের ২০ মে। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি অর্জন করেছেন ১৯৭১ সালে।
এবছরের তিনজন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানীই কাজ করেছেন এবং করছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যবহারিক দিক নিয়ে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমাদের প্রকৃতির মতোই রহস্যময়। গত একশ বছরে কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর তত্ত্ব থেকে আমরা দেখেছি – জটিল প্রাকৃতিক ঘটনাবলির সঠিক ব্যাখ্যা কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে যেভাবে করা যায়, ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স দিয়ে সেভাবে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না।
কিন্তু সমস্যা হলো – কোয়ান্টাম মেকানিক্স খুবই জটিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা কীভাবে কাজ করে তা সহজে বোঝা যায় না। যেমন – কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটা ধর্ম হলো – কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট।
দুটো কোয়ান্টাম কণা এমন যুগলভাবে কাজ করে যেন কোন অদৃশ্য সূতার টানে একটি অপরটির সাথে লেগে থাকে – তাদের মাঝখানের বাস্তব দূরত্ব যাই হোক না কেন।
সেই অবস্থায় একটি কণাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অন্য কণাকেও আপনাআপনি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এবছরের তিন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্বতন্ত্রভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধর্মকে কাজে লাগিয়ে যেসব পরীক্ষামূলক গবেষণা করেছেন – তাতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং তথ্যপ্রবাহে কোয়ান্টাম নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।
আমাদের ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটার কাজ করবে হাজার গুণ দ্রুত, আর নিরাপত্তা এতই কঠিন হয়ে উঠবে যে হ্যাকারদের কাজ হয়ে উঠবে অনেক বেশি কঠিন।
এটাকে ঠিক কাকতালীয় বলা যাবে কি না জানি না, ঠিক একশ বছর আগে ১৯২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী নীলস বোর।
লেখা- প্রদীপ দেব
ছবিঃ ফারদিন