১১ জুলাই, ২০০৭ সাল। জামালপুরের জগন্নাথগঞ্জ স্টেশন থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত নিয়মিত চলাচল করে জিএম এক্সপ্রেস ২৫৪ ডাউন নামক লোকাল ট্রেনটি। আজ ট্রেন চালাচ্ছেন ড্রাইভার (লোকো মাস্টার) আব্দুল মতিন এবং মোঃ এনায়েত খান। ময়মনসিংহ পৌরসভার কাশর এলাকার ইটখলায় যখন ট্রেনটি আসে, তখন ঘড়িতে সময় বেলা ৩টা ১০ মিনিট। হঠাৎ ড্রাইভাররা দেখেন, রেলপথের বাঁ পাশ থেকে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ একে অন্যকে ধরাধরি করে রেল লাইনের দিকে আসছে। মোট ৯ জন। পুরুষ, নারী, শিশু—সবাই একই পরিবারের সদস্য। রেললাইন ধরে চুপচাপ বসে পড়ে তারা।
প্রথমে ড্রাইভাররা কিছুই বুঝতে পারেননি। পরে খেয়াল করলেন, তারা রেললাইন পার হচ্ছে না, লাইনের ওপরেই বসে আছে। ড্রাইভার হুইসেল দিলেন। তারা লাইন থেকে সরল না। ড্রাইভাররা বুঝতে পারলেন এরা সবাই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। ট্রেন ইমার্জেন্সি ব্রেক করালেন। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। চোখের সামনে ৯ জন মানুষকে চাপা দিয়ে ট্রেন বেশ খানিকটা সামনে গিয়ে থামে।
গাড়ি থেকে নেমে সবাই দেখতে পায়, ২ জন তখনও বেঁচে আছে। একটা বাচ্চা ছেলে এবং একজন তরুণী ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন শরীর নিয়ে ‘পানি পানি’ চিৎকার করছে। স্থানীয় লোকজন তাদেরকে পানি খাইয়ে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তারা পথেই মারা যায়। রেললাইনের কয়েক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ৯ জন মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশের কাটা টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। রক্ত, মাংস আর হাড়ে পুরো রেললাইন রক্তাক্ত। গাড়ি থেকে নেমে এই দৃশ্য দেখে একজন ড্রাইভার জ্ঞান হারান।
ঘটনাস্থলে দ্রুত পুলিশ পৌঁছায়। আশেপাশের মানুষদের সাথে কথা বলে নিহতদের নাম ঠিকানা জানতে পারে। মা, ২ ছেলে, ৪ মেয়ে এবং ২ নাতি নাতনী আত্মহত্যা করেছিল একসাথে।
এরা হলো—মা হেনা আনোয়ার (৬০), পুত্র আরিফ আনোয়ার (৩০) ও রাহাত আনোয়ার (২২), কন্যা আক্তারী আনোয়ার (৩৫), মুর্শেদা আনোয়ার (২৭), মুন আনোয়ার ওরফে মবি (৩০) ও শবনম আনোয়ার (১৮), নাতি মৌলা আনোয়ার (৮) এবং নাতনী মৌ আনোয়ার (১০)। রেললাইনের পাশেই তাদের বাড়ি।
ওই বাড়ির ভেতর গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কেউ নেই। একটি পাকা ঘর। পাঁচ-ছয়টি কক্ষ। উঠানে কবরের মতো বড় একটি গর্ত খোঁড়া। বারান্দায় লাশ নেওয়ার খাট। রান্নাঘরে কাটা ছোট মাছ পড়ে আছে। তরিতরকারিও কেটেকুটে রাখা হয়েছে।
(একজন সাংবাদিকের বর্ণনায়—মা, ২ নাতি, ৫ মেয়ে এবং এক ছেলের কথা বলা হয়েছে। আসলে ডেডবডিগুলো এমনভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে, কে ছেলে আর কে মেয়ে সেটা বের করা বেশ কঠিন।
২০১৭ সালের ৩০শে মার্চ সিলেটে একটা জঙ্গি আস্তানায় একই ফ্যামিলির ৮ জন মেম্বর আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের উডিয়ে দেয় । ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ডেডবডির পার্টস দেখে পুলিশ এখনো নিশ্চিত নয় যে এখানে কয়জন মানুষের ডেডবডি রয়েছে।)
এলাকাবাসী জানায় , দুই দিন আগে বাঁশের বেড়া দিয়ে বাড়িটি ঘেরাও করে ফেলা হয়। বাসার ভিতরে কবর এবং গোসলের এরেঞ্জমেন্ট দেখে ধারনা করা হচ্ছে , তারা অনেক আগে থেকেই সুইসাইডের প্লান করে রেখেছিল ।
বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ বেশ কিছু ডায়েরি ও হাতে লেখা কাগজপত্র উদ্ধার করে। এগুলোর কিছু বাংলায় আবার কিছু ইংরেজিতে লেখা। এগুলোয় বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য ছিল। ইংরেজিতে একটি ডায়েরিতে লেখা ছিল—“আমরা পৃথিবীর একমাত্র পরিবার যারা স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল। মোহাম্মদের আইনের বাইরে এবং সব ধর্মের সব কার্যকলাপের বাইরে। তাহলে আমরা কে? আমরা হলাম আদম।”
এ ছাড়া “সবার উপরে আদম সত্য, জুলুমের বিচারের ব্যবস্থা করিব”—ইত্যাদি ধরনের বেশ কিছু মন্তব্য ছিল।
ময়মনসিংহ পৌরসভার স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার মোজাম্মেল হক ইউসুফ বলেন, এ পরিবারটির সঙ্গে এলাকার কারো সম্পর্ক ছিল না। কেউ তাদের বাসায় যেত না। তারাও এলাকায় অন্য কারো বাসায় যেত না। আশপাশের কোনো পরিবারের সঙ্গে তাদের খারাপ সম্পর্ক বা রেষারেষিও ছিল না।

ঘটনার নেপথ্যে আনোয়ার দরবেশ-প্রতিষ্ঠিত ‘আদম ধর্ম’
আনোয়ার দরবেশের ছোট ভাই, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আব্দুল হান্নান থাকেন ময়মনসিংহের গোহাইলখালিতে। সাংবাদিকদের তিনি জানান, “আমার ভাই (আনোয়ার দরবেশ) হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল। মৃত্যুর পরে ওর পরিবারের বাকি সবাই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। তারপর থেকে তারা আমাদের এবং অন্যান্য আত্মীয়দের সাথে দূরত্ব তৈরি করে। কেউ ওদের খোঁজখবর নিতে গেলে দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিত।”
তবে ওই বাসায় যেসব ডায়েরি এবং অন্যান্য বই পুস্তক পাওয়া গেছে সেখানে খ্রিস্টধর্মের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ময়মনসিংহ এলাকার চার্চে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই পরিবারটি কখনো কোনো খ্রিস্টধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি।
এরই মাঝে ঘটনায় যোগ হয় নতুন টুইস্ট। ১৪ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মেদ্দা এলাকায় এক নারী নিজেকে আনোয়ার দরবেশের মেয়ে মবি বলে দাবি করেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমার নাম মবি। পেপারে দেখছি আমি মৃত বলে খবর ছাপা হয়েছে। আমি বেঁচে আছি। ওই বাড়িতে আমি ছিলাম না, কিন্তু আমার ছেলে মওলা আর মুন ওই বাসায় ছিল। ওরা খুন হয়েছে।”
মবি এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে মানতে নারাজ। তিনি দাবি করেন, এটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, “আমার ভাই, আনোয়ার মাহিন, অক্সফোর্ড ইনিভার্সিটিতে পড়ত। ২০০৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অজ্ঞাত কিছু লোক ওকে খুন করে। সেই একই লোকজন আমাদের বাড়ি দখল করতে চায়। তারাই আমার পরিবারের ৯ জনকে ট্রেনের তলায় ফেলে দিয়েছে। তবে মবি তার ছেলে এবং মেয়ের ডেডবডি আনার জন্য ময়মনসিংহে যাননি।
পুলিশ তখন নতুন করে ডেডবডির স্তূপ ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে। এতদিন ধরে যাকে মবির ডেডবডি বলে ধারণা করা হচ্ছিল, এটা তাহলে মবি নয়, মবি বেঁচে আছে। তাহলে এই অজানা মেয়েটি কে?
উদ্ধারকৃত ডায়েরিগুলোর মধ্যে লিনা নামে একজনের ডায়েরিও পাওয়া যায়। ডায়েরি থেকে যানা যায়, লিনা এই পরিবারের সদস্য নয়। লিনার মা আর বাবা আনোয়ার দরবেশের মুরিদ ছিলেন। তারা মাঝে মাঝে এই বাড়িতে এসে থাকতেন। লিনাও আসতেন নিয়মিত। একসময় লিনা আনোয়ার দরবেশের প্রতিষ্ঠা করা ‘আদম ধর্ম’ গ্রহণ করেন এবং নিজের পরিবার ছেড়ে এই পরিবারে এসে থাকতে শুরু করেন। এর আগে বাড়ির ‘কাজের মেয়ে’ হিসেবে তাকে কোনো কোনো সাংবাদিক উল্লেখ করেছিলেন। তবে পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের ডায়েরিতে লিনার কথা উল্লেখ নেই।
আনোয়ার দরবেশ সম্পর্কেও বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেল। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পরে তিনি বেশ ধর্মকর্ম শুরু করেন। এলাকার মানুষ তাকে দরবেশ/ ফকির ও পীর বলে ডাকত। তবে ধীরে ধীরে তার চিন্তাভাবনা প্রচলিত ইসলামিক চিন্তা চেতনার চেয়ে একটু ভিন্ন হয়ে গেল। অন্যান্য ধর্মীয় অনুসারীদের সাথে তিনি আলোচনা করতে বসলে প্রায়ই তর্ক শুরু হয়ে যেত। ১৯৯৫ সালে গ্রামের একটি চায়ের দোকানে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে তর্কের একপর্যায়ে হাতাহাতি হয়। চায়ের দোকানের লোকজন তখন তাকে মারধোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
এ ঘটনার পর থেকে তিনি বাড়ির বাইরে যাওয়া একেবারে কমিয়ে দেন। পরিবারের অন্যরাও তাই করে। সম্ভবত এরপর থেকে তিনি তার ভক্ত কিংবা মুরিদদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র পরিবারের সদস্যদেরই নিজধর্মে দীক্ষিত করতে শুরু করেন। তার সবচেয়ে বড় শিষ্য হয়ে ওঠে তার বড় ছেলে আরিফ আদম। ২ জন মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করতেন ।
আনোয়ার দরবেশ মারা যান ২০০০ সালের ১১ জুলাই ঢাকার একটি হাসপাতালে। মৃত্যুর পরে তার ডেডবডি কিভাবে সৎকার করা হবে সে বিষয়ে তিনি একটি লিখিত নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে বলেছিলেন—
“মৃত্যুর পরে আমার কোনো জানাজা দিবা না, গোসল করাবা না, কাফনের কাপড় পরাবা না। যে কাপড় পরে মারা যাব, সেই কাপড়ে সেই অবস্থাতেই আমাকে কবর দিবা। কোনো কবরখানায় আমাকে নিবে না, বাড়ির ভিতরে গর্ত খুঁড়ে আমাকে কবর দিবে। আমার মাথা থাকবে পূর্বে, পা থাকবে পশ্চিমে আর মুখ দক্ষিণ দিকে ঘুরানো থাকবে। যদি অন্য রকমভাবে কবর দাও, তাহলে আমি কঠিন প্রতিশোধ নিব।”
আদম পরিবার ঠিক এইভাবেই বাবার ডেডবডি কবর দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু স্থানীয় জনগণ তা হতে দেয়নি। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট এবং স্থানীয় হুজুরদের উপস্থিতিতে তার গোসল, জানাজা এবং কবর দেওয়া হয় ইসলামী পদ্ধতিতে। আদম পরিবারের কেউ সেই জানাজায় উপস্থিত হয়নি।
এই ঘটনার পর আদম পরিবার ঢাকায় চলে যায়। সেখানে বড় ছেলে আরিফ কোনো এক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং পরিবারের খরচ চালাতেন (একজনের ডায়েরি থেকে দেখা যায়, আরিফ ঢাকার ৫২টা ইউনিভার্সিটির ডিন ছিল!)।
২০০৫ সালে ঢাকায় আরিফ মারা যায় কিংবা খুন হয়। পুরো পরিবার তখন আবার গ্রামে ফিরে আসে। পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য তখন রাহাত। তার ওপর দায়িত্ব পরিবারের ভরণপোষণের। তিনি কী ধরনের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন কিংবা তার পরিবারের সদস্যরা অর্থাভাবে না খেয়ে থাকত কিনা, তা জানা যায়নি। তবে তার ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন:
We are the only family in the world that is independent and selfdepanded. We are the only one family in the world that is totally independed and selfdepended and out of mohamod’s rules.,law and relisious activities and relisions.
(ডায়েরির মূল বানান অবিকৃত রাখা হয়েছে)
বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পরে বড় বোন আক্তারী আনোয়ার সংসারের হাল ধরেন। তিনি অন্যান্য ভাইবোনের মধ্যে আদম ধর্মের উপাচারগুলো চালু রাখেন। বাবা এবং বড় ভাইয়ের আত্মার সাথে কথা বলার জন্য পরিবারটি তখন নিয়মিত ধ্যান শুরু করে। একসময় তারা সফল হয়। বাবার আত্মা প্রথমে আক্তারীর দেহে ভর করে। আক্তারীর মুখ দিয়ে আনোয়ার দরবেশ তখন আদেশ-নিষেধ দেওয়া শুরু করলেন। (আক্তারী আনোয়ারের ডায়েরির কিছু অংশ তিনি লিখেছেন তার নিজের জবানীতে। কিছু অংশ লেখা আছে তার বাবা আনোয়ার আদমের জবানীতে) ধীরে ধীরে সবার শরীরেই তার বাবা এবং ভাইয়ের আত্মা ভর করে। ডায়েরিতে লিনার ভাষ্যানুযায়ী, এই পরিবার সারাদিন ঘুমাত আর সারারাত জেগে জেগে ধ্যান করত।
প্রত্যেক সদস্যই মৃত্যুর আগে তাদের নিজেদের কথা গুছিয়ে ডায়েরিতে লিখেছিল। অধিকাংশ লেখাই ইংরেজিতে, কিছু আছে বাংলায়। মা হেনা আনোয়ার সম্ভবত লেখাপড়া জানতেন না, তার পক্ষ থেকে এক মেয়ে তার কথাগুলো লিখে দিয়েছেন। এমনকি ২টা বাচ্চাও তাদের কথা ডায়েরিতে লিখেছে। তারা স্বেচ্ছায় লিখেছে নাকি অন্য কেউ তাদেরকে ডিক্টেশন দিয়ে লিখিয়েছে তা পরিষ্কার নয়।
ডায়েরি থেকে জানা যায়, তারা অনেক আগে থেকেই এই আত্মহত্যার প্ল্যান করছিল। এটা তাদের কাছে আত্মহত্যা নয়, এটা তাদের কাছে ছিল বাবা এবং বড় ভাইয়ের সাথে মিলিত হওয়ার উপলক্ষ। জুলাই মাসের ৭ তারিখে তারা একবার আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেও পরে বাতিল করে। বাবা আনোয়ার আদমের মৃত্যু দিবস ১১ জুলাই পর্যন্ত তারিখ পেছানো হয় এবং ওইদিনই তারা একসাথে আত্মহত্যা করে। তাদের ভাষায়—‘বাবা এবং বড় ভাইয়ের সাথে মিলিত হতে যায়।’
ডায়েরি থেকে উদ্ধারকৃত লেখাপত্র অনুযায়ী—আদম হচ্ছেন বিশ্বের প্রথম মানুষ। তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। অন্যান্য সব মানুষ আদমেরই অংশ (বনি আদম)। আদম বিভিন্ন সময়ে মারা যান, আবার পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জন্মগ্রহণ করেন। বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে আদম হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আনোয়ার আদম।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দিকী ওই সময় বাড়িটিতে ঢুকতে পেরেছিলেন এবং কিছু ছবি তুলতে পেরেছিলেন। প্রথম ছবি বাদে এই লেখায় ব্যবহৃত সব ছবিই তার তোলা। উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে—বাড়ির জানালায় সাইনবোর্ডের মতো করে একটি হোয়াইট বোর্ড টানানো। সেখানে মার্কার পেন দিয়ে ভুল গ্রামারের ইংলিশে কিছু কথা লেখা আছে। ভাবানুবাদ করলে সম্ভবত এইরকম দাঁড়ায়, “এটা আদমের বাড়ি। বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছে আদম। সবার উপরে আদম সত্য। এই বাড়িতে কেউ ঢুকবে না এবং কেউ কিছু টাচ করবে না। যদি কেউ আমাদের আদেশ অমান্য করে বাসায় ঢোকো, তাহলে আমরা প্রতিশোধ নিব। আদেশক্রমে-আদমেরা।”

বোর্ডের উপরে হেডলাইন লেখা ‘এডামস হোম’ এবং নিচে তারিখ লেখা—১১ জুলাই ২০০৭। আবু বকর সিদ্দিকীর ভাষ্যে জানা যায়, বাসার ভেতরে একটি রুমের ছাদে বেশ কয়েকটা দড়ি ঝোলানো ছিল। সম্ভবত ওরা প্রথমে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করার প্ল্যান করেছিল। আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, খাটের ওপরে চেয়ার রাখা। সম্ভবত গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল।
অন্য ছবিতে দেখা যায় একটি রুমের ভিতরে মোমবাতি, কাগজ এবং কিছু থালাবাসন রাখা। দৃশ্যটা দেখে মনে হতে পারে কেউ রান্নাবান্না করছিল। আবার রান্নাবান্না বাদে অন্য কোনো স্পিরিচিয়াল কাজেও কেউ এগুলো ব্যবহার করে থাকতে পারে। মৃত ব্যক্তির আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্লানচেট এবং কাগজ ব্যবহৃত হয়।
বেশ কিছুদিন পুলিশের হেফাজতে লাশগুলো (ডেডবডির ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অংশগুলো) থাকলেও সেগুলো কেউ নিতে আসেনি। অবশেষে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের কাছে সেগুলো হস্তান্তর করা হয়। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম মুসলিম রীতি মেনে দাফন সম্পন্ন করে।
এই ঘটনার আগে বা পরে আর কেউ কখনো আদম ধর্ম সম্পর্কে কথা বলেনি কিংবা আদম ধর্মের অনুসারী হওয়ার দাবি করেনি।
রহস্যের সমাধান
কোলকাতার সাইকোলজিস্ট প্রফেসর নাসিমা সেলিম এই ঘটনা নিয়ে একটি থিসিস পেপার লিখেন । পেপারটি ডাউনলোড করতে পারেন এই লিংক থেকে–
তিনি সকল তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করে দাবি করেন , আদম ফ্যামিলি Shared Delusion অথবা Shared Psychotic Disorder (SPD) নামক মানসিক রোগে ভুগছিল । ফ্যামিলির খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা , এলাকাবাসীর অপমান ইত্যাদি কারনে আনোয়ার আদম সম্ভবত সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং নিজেকে তিনি আদম বলে দাবি করা শুরু করেন।
ফ্যমিলির অন্যান্য মেম্বররা যেহেতু বাবার প্রতি খুব নির্ভরশীল ছিল ,তাই তারা বাবার সব কথা বিশ্বাস করল । তারাও আদম ধর্মের অনুসারী হয়ে উঠল । এক মেয়ে যখন দাবি করল, আমার শরীরে আদমের আত্মা ভর করেছে , তখন সবাই তাকে বিশ্বাস করল, সবার শরীরেও আদমের আত্মা আসা শুরু করল । কেবলমাত্র মেজো মেয়ে ,মবি, স্ট্রং মেন্টালিটির অধিকারী ছিল বলে সে শেয়ারড ডিলুশনের শিকার হয়নি । অন্য সবাই দুর্বল মেন্টালিটির অধিকারী বলে সবার শেয়ার্ড ডিলুশন হয়েছে ।
( বড় মেয়ে আক্তারীর বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু ডিভোর্স হয়ে যায় । মুর্শেদা এবং শবনমের অনেক বয়স হয়ে গেলেও বিয়ে হচ্ছেনা । এদের সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে । এজন্য তারা মানসিকভাবে দুর্বল ছিল । অন্যদিকে মবির বিয়ে হয়েছে,২টা বাচ্চাও আছে ,সুখী সংসার তার। এই কারনে সে মানসিকভাবে অনেক সবল ছিল । সূস্থ শরীরে যেমন কোনো রোগ জীবানু বাসা বাধতে পারেনা , ঠিক তেমনি সূস্থ মনেও কোনো মানসিক রোগ বাসা বাধতে পারেনা ।
বড় ছেলে আরিফ মানসিকভাবে খুব একটা সুখী ছিল এমন কোনো প্রমান পাওয়া যায়না । অন্যান্যদের ডায়েরি থেকে জানা যায় ,তার এক গার্লফ্রেন্ড ছিল, নাম ফাতেমা । সেই ফাতেমাকে আদম ধর্ম সম্পর্কে জানানোও হয়েছিল ,কিন্তু ফাতেমা সেই ধর্ম গ্রহন করতে অস্বীকার করে । নিজের রিলেশন এবং ফ্যামিলির ভিতরে সম্ভাব্য টানাপোড়েনের কারনে আরিফ হয়তো মানসিকভাবে অশান্তিতে ছিল । শেয়ার্ড ডিলুশন , সিজোফ্রেনিয়া কিংবা অন্য যে কোনো মানসিক রোগের জন্য যেটা আইডিয়াল অবস্থা )
বাংলাদেশে শেয়ারড ডিলুশন এর ঘটনা এটাই প্রথম নয় । এর আগে ২০০৫ সালে মীরপুরে রিতা-মিতা নামক দুই বোনের ঘটনা মিডিয়ায় এসেছিল । শেয়ারড ডেলুশনের কারনে সিজোফ্রেনিক রোগী মিতা তার সূস্থ বড় বোনকেও অসূস্থ করে ফেলেছিল । এই ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেল পড়ুন https://www.facebook.com/groups/DSmystery/permalink/1236204213131659/
তবে রিতা মিতার ঘটনায় মাত্র একজন মানুষ আরেকজনকে অসূস্থ করেছিল । এখানে একজন মানুষ পুরো ফ্যামিলিকে আক্রান্ত করেছে । এই ঘটনায় একেবারে বিরল নয় । বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলে দেখা যায় , ক্লাসের একজন মেয়ে ভূত দেখে অজ্ঞান হয়ে গেলে ক্লাসের সবাই অজ্ঞান হয়ে পড়ে । সাধারনভাবে এই ঘটনাকে মাস হিস্ট্রিয়া বলে
(বিস্তারিত — https://www.facebook.com/groups/DSmystery/permalink/1255642191187861/ )
এছাড়া প্রফেসর নাসিমা সেলিম এই রোগকে সম্ভাব্য Folie a` famille বলে চিহ্নিত করেছেন । ফলি এ ফ্যামিলি রোগে সাধারনত ফ্যামিলি মেম্বররা অদ্ভূত আচরন শুরু করে । একজন কোনো অস্বাভাবিক কাজ শুরু করলে অন্যরাও সেই কাজ করা শুরু করে ।
২০০৮ সয়ালে সুইডেনের উরুসুলা এরিকসন রাস্তায় বের হয়ে একটা ট্রাকের নিচে চাপা পড়ার চেষ্টা করেন । ভাগ্যক্রমে বেচে যান । একটুপরে তার যমজ বোন সাবিনা এরিকসন একইভাবে হাইওয়েতে বের হয়ে গড়ির সাথে ধাক্কা খাওয়ার চেষ্টা করেন। ভাগ্যক্রমে তিনিও বেচে যান। পুলিশ এদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সাইকোলজিস্টরা এদেরকে ফলি এ ফ্যামিলি রগের ভিক্টিম বলে চিহিন্ত করে ।
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ৫ জনের একটি ফ্যামিলি বাড়ি ঠেকে বের হয়ে ১৬০০ কিলোমিটার দূরে চলে যান উদ্দেশ্যহীনভাবে । তাদের কাছে মনে হচ্ছিল, বাড়ি ঠেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল । ডাক্তাররা এদেরকেও ফলি এ ফ্যামিলির রোগী বলে চিহ্নিত করেছেন । এই ধরনের আরো কেস জানতে উইকিপিডি আর্টিকেল দেখতে পারেন https://en.wikipedia.org/wiki/Folie_%C3%A0_deux
উপসংহার
ময়মনসিংহের ঘটনায় একই ফ্যামিলির ৯ জন আত্মহত্যা করেছিল । এরা সবাই মানসিক রোগী ছিলও ।তারা একটা ভুল ধারনাকে মনে প্রানে বিশ্বাস করতো এবং সেই বিশ্বাস অনুযায়ী তারা হাসতে হাস্তে আত্মহত্যা করেছে , কারন তারা মৃত্যুর পরে নিকটজনদের সাথে মিলিত হতে পারবে
বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে । ২০১৭ সালের ২৯শে মার্চ আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী মৌলভিবাজারের নাসিরপুর গ্রামে একটি জংগি আস্তানা ঘেরাও করে । এসময় বাড়িতে থাকা জঙ্গি ফ্যামিলিটি আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরন ঘটিয়ে নিজেদের শরীর উড়িয়ে দেয় । ২টা রুম জুড়ে এদের মৃতদেহের টুকরো পড়ে ছিল । পুলিশের ধারনা , এখানে ৭ জন কিংবা ৮ জনের মৃতদেহ রয়েছে।
ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী, এখানে ৩৫ বছর বয়সী এক পুরুষ, ২৫ আর ৩৫ বছর বয়সী ২ জন নারী এবং ২ মাস, ২ বছর,৭ বছর এবং ১০ বছর বয়সী ৪ টি শিশু রয়েছে । (আদম ফ্যামিলির মত এখানে একজন পুরুষের ঘাড়ে পুরা ফ্যামিলির ভরন পোষনের দায়িত্ব ।বাকি সবাই নারি এবং শিশু )
রেফারেন্স
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায় , এই ফ্যামিলিও বাইরে বের হতোনা কখনো। এদের সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারেনা (আদম ফ্যামিলির মত)। ছোটো মেয়ে বাচ্চা দুটোও বোরখা পরে থাকতো সবসময় ।
আত্মঘাতী বোমা হামলা অথবা আত্মহত্যা জঙ্গিদের কাছে কখনোই কষ্টের কিছু নয়, কারন তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যুর পরেই তারা বিনা হিসাবে জান্নাত পাবে । এই কারনেই তারা পুরো ফ্যামিলি সহ আত্মহত্যায় উদ্বদ্ধ হয়েছিল । (আদম ফ্যামিলিও খুশি মনেই আত্মহত্যা করেছিল)
আদম ফ্যমিলির অদ্ভূত এক ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল । বাইরের মানুষেরা যতই সমালোচনা করুক, তারা নিজেদের ধর্মে দৃড় বিশ্বাস রেখেছিল । জংগিদের ক্ষেত্রেও তাই। বাংলাদেশের সাধারন জনগনের যে ইসলামি বিশ্বাস কিংবা আমাদের আইন আদালতের পরিপন্থী কিছু বিশ্বাস তারা ধারন করছে এবং সেই বিশ্বাস অনুযায়ী জিহাদ করছে ।
এই জঙ্গিরাও কি কোনো এক ধরনের মানসিক রোগী ? সিজোফ্রেনিয়া কিংবা শেয়ারড ডিলুশনের পেশেন্ট সবাই ?