একটি দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়তে কয়জন লোক লাগে ?
বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, মাত্র একজন রোগী ই যথেষ্ট। একজন করোনা রোগীই একের পর এক ভাল মানুষকে করোনা আক্রান্ত করে ফেলতে পারে। একসময় জোম্বি সিনেমার মত দেখা যাবে, দেশের সবাই করোনা পজিটিভ হয়ে গেছে।
এ বিষয়টার সাথে তুলনা করা যায় মানব শরীরের ভিতরের ক্যান্সার সেলের সাথে । প্রথমে একটা কোষ এ ক্যান্সার হয়। তারপর সে আশেপাশের কোষগুলাকেও ক্যান্সারে সংক্রমিত করে। যত দিন যায়, তত ক্যান্সার বাড়তে থাকে।
ক্যান্সারের মতই, কোনো একটা নির্দিষ্ট কমিউনিটির মধ্যে ভয়ংকর ছোয়াচে রোগ ছড়ানোর জন্য মাত্র একজনই যথেষ্ট।
দক্ষিণ কোরিয়ার ‘পেশেন্ট ৩১’ এর গল্প শুনেছেন ?
করোনা সংক্রমনের শুরুতে কোরিয়ায় রোগী পাওয়া গিয়েছিল ৩০ জন। এই ৩০ জন রোগী খুব সাবধানে আইসোলেটেড থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিল । ১৭ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ও দেশে মোট রোগী ছিল ৩০ জন।
১৮ই ফেব্রুয়ারি দেশে ৩১ তম রোগী সনাক্ত করা হয়।
এর কিছুদিন পরেই, ৭ই মার্চ দেশে মোট করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজারে। এখন, ২৬শে আগস্ট সেই সংখ্যা ১৮ হাজারে দাড়িয়েছে।
এই বিশাল স্পাইকের মূল কারন হল ৩১ নাম্বার রোগী। এর নাম পরিচয় কিছুই সাংবাদিকদের কাছে জানানো হয়নি। কেবলমাত্র Patient 31 দিয়েই পরিচয় দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, দক্ষিন কোরিয়ার দেগু ( Daegu) শহরের এই পেশেন্ট ৩১ গত ৯ই ফেব্রুয়ারি থেকেই সর্দিজ্বরে ভুগছিলেন। কিন্তু করোনা টেস্ট না করিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। মার্কেট, গীর্জা সহ বিভিন্ন জনবহুল জায়গায় ঘুরেছেন তিনি ।
১৭ই ফেব্রুয়ারি ডাক্তাররা তার লক্ষন দেখে তাকে করোনা টেস্ট করতে বলেন। তিনি টেস্ট না করিয়ে ডাক্তারদের সাথে এক ঘন্টা ধরে ঝগড়া করেন।
পরে ,১৮ই ফেব্রুয়ারি তিনি টেস্ট করতে রাজি হন, এবং করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে।
তবে , ততদিনে যা যা ক্ষতি হওয়ার ,তা হয়ে গেছে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি তিনি কোরিয়ার একটা গীর্জায় গিয়েছিলেন প্রার্থনার জন্য। সেদিন গীর্জায় প্রার্থনায় যোগ দিয়েছিলেন কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ খৃষ্টান। তাদের মধ্যে ১২০০ লোক পরে করোনা পজিটিভ হন। এদের কাছ থেকে পজিটিভ হয়েছেন আরো অনেকে।
গীর্জা ছাড়াও বাজার,শপিং মল,রাস্তায় রাস্তায় আরো অনেকের শরীরে করোনা জীবাণু ছড়িয়ে দিয়েছেন এই পেশেন্ট ৩১
সব মিলিয়ে এক ধাক্কায় দেশে করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা ৩০ থেকে বেড়ে যায় ৭ হাজারে।
অথচ, একজন মাত্র লোক, এই পেশেন্ট ৩১ যদি সচেতন হতেন, তাহলে কিছুই ঘটত না। তার ফ্লু উপসর্গ দেখা দিলেই যদি তিনি ডাক্তারের কাছে গিয়ে কভিড টেস্ট করাতেন বা নিজেকে আইসোলেট করে ফেলতেন, তাহলে পুরা দেশে রোগীর সংখ্যা ৩০ এই স্থির থাকত ।
[NEWS]২.
অস্ট্রেলিয়ার অবস্থাও একই রকম ।
১৮ মার্চ পযযন্ত অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা ছিল আন্ডার কন্ট্রোল। মাত্র ৫৯৬ জন করোনা পজিটিভ ছিল সেখানে।
কিন্তু, ১৯শে মার্চ রুবি প্রিন্সেস নামের একটি জাহাজ আসল অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বন্দরে।
এই রুবি প্রিন্সেস জাহাজের মধ্যে ছিল ২ জন কভিড পজিটিভ রোগী।
নিউজিল্যান্ড থেকে এই দুই যাত্রী করোনা ভাইরাস নিয়ে উঠেছিলেন জাহাজে।
কিন্তু, জাহাজে তারা নিজেরা নিজেদের কেবিনে চুপচাপ কোয়ারেন্টাইনে বসে থাকেননি। তারা ঘুরে ফিরে বেরিয়েছেন পুরা জাহাজ জুড়ে। নিজেদের সংক্রমনের কথাও তারা তেমন কাউকে জানান নি।
ফলাফল ? ওই জাহাজের আরো ৬৭০ জন যাত্রীকেও করোনা ভাইরাসে ধরল।
১৯শে মার্চ যখন সিডনি বন্দরে জাহাজটা থামল, তখনো জাহাজের যাত্রীদের পরীক্ষা করা হয়নি।
সিডনির জাহাজের গল্পে একটু পরে ফেরত আসছি। তার আগে চলুন , ১৪ই মার্চ ঢাকা শাহজালাল এয়ারপোর্ট থেকে ঘুরে আসি।
এই দিন, ইটালি থেকে ১৪২ যাত্রী নিয়ে একটি প্লেন ল্যান্ড করল শাহজালাল এয়ারপোর্টে। ইটালি প্রবাসী যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হল এয়ারপোর্টের পাশের আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পে। সেখানে তাদের পরবর্তী ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হল।
কিন্তু যাত্রীরা সেটা মানতে চাইলেন না। তারা বিক্ষোভ, ভাংচুর শুরু করলেন। “আই ফাক মাই কান্ট্রি সিস্টেম” বলে চিতকার করা এক যুবকের ভিডিও অনেকেই হয়তো দেখেছেন তখন।
প্রবাসী শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে IEDCR সন্ধ্যায় জানাল, ১৪২ শ্রমিকের সবাইকেই টেস্ট করা শেষ। সবাই করোনা নেগেটিভ। সবাই বাসায় চলে যেতে পারে।
বর্তমান সিচুয়েশনে কিন্ত আমরা দেখছি, RT-PCR পদ্ধতিতে করোনা টেস্টের রিপোর্ট পেতে ২৪ ঘন্টার চেয়েও বেশি সময় লাগছে। ওই দিন তাহলে কিভাবে টেস্ট করে করোনা নেগেটিভ নিশ্চিত করা হল?
নাকি প্রবাসীদের আন্দোলনে পড়ে, এবং মিডিয়া এবং পাবলিক সেন্টিমেন্টের প্রেশারের কারনে টেস্ট এর রেজাল্ট না নিয়েই ‘করোনা নেগেটিভ’ বলা হয়েছিল তখন? আমরা এখনো জানিনা সঠিক তথ্য।
ফিরে যাই সিডনির রুবি প্রিন্সেস জাহাজে। এই জাহাজটা ছিল একটি প্রমোদ তরী। হাজার হাজার ডলার খরচ করে যাত্রীরা এই জাহাজে উঠতেন কয়েকদিন আরাম আয়েশ করার জন্য। জাহাজের মধ্যে বার, সুইমিং পুল,ক্যাসিনো,নাইট ক্লাব,,স্পোর্টস পার্ক সহ বিনোদনের সব ব্যবস্থাই আছে। বড় সড় একটা ভাসমান ফাইভ স্টার হোটেল বলা যায় এটাকে।
তো, এই রুবি প্রিন্সেস এর ভি আই পি প্যাসেঞ্জাররা যখন নামলেন সিডনিতে ১৯শে মার্চে , তখন এদেরকে টেস্ট বা কোয়ারেন্টিন, কিছুই করা হয়নি।
( হতে পারে, এদের সাথেও ইটালিয়ান “আই ফাক মাই কান্ট্রি সিস্টেম” এর মত ঘটনা ঘটেছিল। সঠিকটা জানা যায়না) তবে আল্টিমেট রেজাল্ট হল,কোনো বাধা ছাড়াই এরা অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকে যায়। করোনা ভাইরাস নিয়েই ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে শহরে।
তারপরে কি হল? পহেলা এপ্রিল অস্ট্রেলিয়ায় কভিড পজিটিভ রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাড়াল ৫,০৪৮ জনে। মাত্র দুই সপ্তাহে ৯ গুন রোগী বৃদ্ধি।
এরপর অস্ট্রেলিয়া সরকারের টনক নড়ল। রুবি প্রিন্সেস এর যাত্রীদের ট্রেস করা শুরু হল। সরকার দোষ স্বীকার করে নিয়ে দেশের জনগনের কাছে মাফ চাইল।
[News]তাতে লাভ কিছু হয়নি। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় করোনা পজিটিভ এর সংখ্যা ২৫ হাজার। রুবি প্রিন্সেস এর ওই দুই জন যাত্রীকে আটকানো গেলে সংখ্যাটা হত অনেক কম।
দক্ষিণ কোরিয়া আর অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও এমন অনেক দেশের অনেক উদাহরন পাবেন, যেখানে সিংগেল সোর্স থেকেই অনেকে করোনা সংক্রমিত হয়েছে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না, এক বালতি দুধ নষ্ট করতে এক ফোটা গো-মূত্র যথেষ্ট? ঠিক সেইরকম ভাবে দেখা যাচ্ছে, সূস্থ স্বাভাবিক একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেংগে দিতে এক-দুই জন কোভিডিয়ট ই যথেষ্ট
———
COVID+ IDIOT = COVIDIOT, শব্দটা ইদানিং বেশ পপুলার হচ্ছে।যে লোকটা নিজে স্বাস্থ্যবিধি মানে না, এবং অন্যকেও করোনার ঝুকির মধ্যে ফেলে দেয়, সে ই হল কোভিডিয়ট।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কোভিডিয়ট এর গল্প ধারাবাহিকভাবে লেখার চেষ্টা করছি
কোভিডিয়টের অন্যান্য পর্ব —
- পর্ব ১ – জার্মানিতে লক ডাউন বিরোধী ১৭,০০০ কোভিডিয়টের মিছিল
- পর্ব ২- মায়ানমারের পাদ্রী রেভারেন্ড ডেভিড লাহ
- পর্ব ৩- ভারতের মন্ত্রী
- পর্ব ৪- ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট
- পর্ব ৬- ভারতে নরবলি