ল্যানসেটের (Lancet) impact factor 60.39, না ভুল দেখছেন না। এর অর্থ হল, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের নিরিখে ল্যানসেট পৃথিবীর সবচেয়ে ইনফ্ল্যুয়েনশিয়াল জার্নালগুলোর অন্যতম।
তবে কোন কোন আর্টিক্যাল, বিশেষ করে পাবলিক হেলথ ইস্যুতে, আমার কাছে glorified speculation/commonsense-এর চেয়ে খুব বেশি মনে হয় নি। কাউকে দোষ দিচ্ছি না।
নিজে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, ভৌত বিজ্ঞানে যে ধরণের এক্সপেরিমেন্টাল এবং থিওরেটিকাল রিগার (rigor) আমরা আশা করি, সেটা পাবলিক হেলথ ইস্যুতে অর্জন করা এক রকম অসম্ভব। Too many uncontrollable parameters।
ল্যানসেটে প্রকাশিত প্রবন্ধের অনেক গুরুত্ব এই কারনে যে পাবলিক হেলথ ইস্যুতে নীতিনির্ধারকেরা জানতে চান সবচেয়ে সম্ভাব্য সিনারিও এবং তা মোকাবেলার জন্য গড়পড়তা কার্যকরী কর্মপন্থা। এটা ‘এক্স্যাক্ট’ সায়েন্স না। পাবলিক হেলথ ইস্যু সামনে আসলে এই পয়েন্টগুলো মাথায় রাখা ভালো।
সম্প্রতি ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ নিয়ে হুলস্থুল শুরু হয়েছে। পত্রপত্রিকায় রিপোর্টটির উপর ভিত্তি করে বিশাল খবর ছাপা হচ্ছে। ফেইসবুক বেশ সরগরম।
ল্যানসেটে প্রকাশিত প্রবন্ধটি আসলে একটি ‘কমেন্ট’। গত মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একটি গবেষণা স্পন্সর করে। ঐ গবেষণায় বলা হয়েছে – কিছু পরীক্ষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে কোভিড-১৯-এর বায়ুবাহিত সংক্রমণের ব্যাপারে সুনিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল (Heneghan and colleagues’ systematic review, funded by WHO, published in March, 2021, as a preprint, states: “The lack of recoverable viral culture samples of SARS-CoV-2 prevents firm conclusions to be drawn about airborne transmission”.)।
খেয়াল করে দেখার বিষয়, এখানে বলা হয়েছে – “সুনিশ্চিত করে বলা’র কথা, আসলেই তাই।
“সুনিশ্চিত করে বলা কঠিন” – এর অর্থ এই নয় যে বায়ুবাহিত সংক্রমন হয় না।
এই প্রবন্ধটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ল্যানসেটে প্রকাশিত লেখাটিতে দশটি কারণ দেখানো হয়েছে যা থেকে ধারণা করা যায় কোভিড-১৯-এর বায়ুবাহিত সংক্রমণের প্রচুর সম্ভাবনা আছে। এবং অন্যান্য উপায়ে সংক্রমণের চেয়ে বায়ুবাহিত সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি।
এই লেখাটির শিরোনাম –
“Ten scientific reasons in support of airborne transmission of SARS-CoV-2”।
এই লেখাটির কোথাও ক্যাটেগরিক্যালি বলা হয় নি, অন্যান্য উপায়ে কোভিড-১৯ ছড়ানোর কোন সম্ভাবনা নেই। বরং মন্তব্যের শেষে উপসংহার টানা হয়েছে এই বলে –
“In conclusion, we propose that it is a scientific error to use lack of direct evidence of SARS-CoV-2 in some air samples to cast doubt on airborne transmission while overlooking the quality and strength of the overall evidence base. There is consistent, strong evidence that SARS-CoV-2 spreads by airborne transmission. Although other routes can contribute, we believe that the airborne route is likely to be dominant. The public health community should act accordingly and without further delay.” ।
এখানে পরিষ্কার করেই বলা হয়েছে বায়ুবাহিত সংক্রমণ ছাড়াও অন্যান্য mode of transmission সম্ভব। অথচ আমাদের সংবাদপত্রগুলো কী লিখছে (ইত্তেফাকের রিপোর্ট)?!
ল্যানসেটের এই প্রবন্ধকে সামনে রেখে সংবাদমাধ্যম ও ফেইসবুকবোদ্ধারা বায়ুবাহিত সংক্রমণ ছাড়া অন্যান্য সম্ভাব্য সংক্রমণের দিকগুলো নাকচ করে দিচ্ছে! কী অদ্ভুত আচরণ!!
সাধারণ ইংরেজি পড়ে পাঠোদ্ধার কী এতটাই কঠিন!!!? না কি না পড়েই নিজের মনের মাধুরী ল্যানসেটের কাঁধে চাপিয়ে বাহবা নেওয়া? লেখাপড়ার হলটা কী?!
লেখার, বলার এবং সাংবাদিকতার পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। কিন্তু ইস্যুটি যেহেতু মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে, সেখানে এই ধরণের বিভ্রান্তির কোন জায়গা থাকা উচিত নয়। ইত্তেফাকসহ অন্যান্য যেসব সংবাদ মাধ্যমে ল্যানসেটে প্রকাশিত মন্তব্যটিকে সামনে রেখে মনগড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে তা ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রত্যাহার করা উচিত।।
লেখকঃ অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রুবায়েত হাসান তানভী’র লেখা থেকে-
শ্বাসতন্ত্রীয় ভাইরাস সাধারণত এয়ারবর্ন ট্রান্সমিশন (যাকে বাংলায় বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানো বলা হয় ), ড্রপলেট ট্রান্সমিশন বা কন্টাক্ট (সংস্পর্শ) ট্রান্সমিশন এর মাধ্যমে ছড়ায়। এয়ারবর্ন ও ড্রপলেট ট্রান্সমিশন এর পার্থক্য কি ? সোজা কথায় পার্থক্য হলো আমাদের হাঁচি, কাশি, কথা বলা, নিশ্বাস প্রশ্বাস বা চিৎকার এর সাথে আমাদের শ্বাসতন্ত্র থেকে বের হয়ে আসা জলীয় কণার আকারে পার্থক্য।
এসব জলীয় কণার আকার যত ছোট তত বেশি সময় এরা বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। আর কণার আকার যত বড় তত দ্রুত তারা বাতাস থেকে মাটিতে পরে যাবে। যেসব ভাইরাস এর এয়ারবর্ন ট্রান্সমিশন হয় বা এরোসল বা অতিক্ষুদ্র জলীয় কণার মাধ্যমে ছড়াতে পারে সেসব ভাইরাস তার উৎস থেকে বেশি দূরে পর্যন্ত ছড়াতে পারে। কিন্তু এর মানে এই না যে কোনো ভাইরাসের এয়ারবর্ন ট্রান্সমিশন হলে তা ড্রপলেট ট্রান্সমিশন হবে না বা কন্টাক্ট ট্রান্সমিশন হবে না।
করোনাভাইরাস এর ক্ষেত্রেও তাই , এয়ারবর্ন , ড্রপলেট বা কন্টাক্ট যেকোনো ভাবেই ছড়াতে পারে । আসল ব্যাপার হলো যে কোনো ভাবে ভাইরাসের সংস্পর্শে আসা ও নিঃশ্বাসের সাথে যথেষ্ট পরিমান ভাইরাস আমাদের শ্বাসতন্ত্রে নিয়ে নেওয়া যার থেকে রোগের উৎপত্তি।
সবচেয়ে বেশি কিভাবে ছড়ায় তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু একভাবে ছড়ালে আরেকভাবে ছড়াবেনা তা কখনোই বলা যায় না।
একটা উদাহরণ দেই, যক্ষা রোগের কথা ধরুন। যক্ষা রোগের জীবাণু মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারক্যুলোসিস এয়ারবর্ন ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে বা বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় বলে জানা আছে। একারণে হাসপাতালে যক্ষা রোগীদের সেবা দেবার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা নিতে হয়।
পিপিই পরে, এন-৯৫ মাস্ক পরে, গ্লাভস পরে রোগীর কাছে যেতে হয়। এসব ক্ষেত্রে শুধু রোগী থেকে এক দু মিটার দূরে থাকলেই নয় রোগীর রুমে ঢুকলেও এসব সাবধানতা নিতে হয়। রোগীর সংস্পর্শে আসলে হাত সাবান দিয়ে ধুতে হয়। তার মানে হলো এসব রোগীর চিকিৎসা দেবার সময় কন্টাক্ট + ড্রপলেট + এয়ারবর্ন সবগুলো প্রিকশান নিতে হয় , রোগীকে আলাদা বিশেষ ঘরে রাখতে হয়।
কিন্তু আবার বাতাসে ছড়ায় বলে এর মানে এই না যে জীবাণু এই রোগী থেকে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে, হাসপাতালের সব রোগী বা সে এলাকার সব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ব। রোগীকে ঠিকভাবে আইসোলেট করে ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি আরোপ করার মাধ্যমেই রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হয়।
মহামারীর শুরু থেকেই অন্যান্য করোনাভাইরাস ও শ্বাসতন্ত্রীয় অন্যান্য ভাইরাসের সাথে তুলনা করে এবং এপিডেমিওলজিকাল ডাটা র উপর ভিত্তি করে বলা হয়েছে যে সার্স-কোভি-২ ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না।
কিন্তু এ নিয়ে আরো অনেক গবেষণা চলছে, এবং নতুন নতুন প্রমান আসছে যে এই ভাইরাস বাতাসের মধ্যেও ছড়াতে পারে। ল্যানসেট এ প্রকাশিত মতামতভিত্তিক পেপারটিতেও তাই বলা হয়েছে।
কিন্তু এই পেপার টা কে সূত্র ধরে ও তার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যেসব বলা হয়েছে যেমন: “কোভিড রোগ কোনমতেই হাঁচি, কাশি, কফ, থুতু দিয়ে ছড়ায় না” বা ” বারবার হাত ধুয়ে, স্যানিটাইজার ব্যবহার করে, বাইরে থেকে ফিরেই জামাকাপড় স্যানিটাইজ করলে কোনো লাভ নেই” – এসব সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও কল্পনা প্রসূত। এভাবে না জেনে, না বুঝে শুধু মাত্র বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের বা ল্যানসেট জার্নালের বরাত দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করাটা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয়।
যে ব্যাপারটা বোঝা প্রয়োজন যে , করোনারোগের উৎস হলো আরেকজন আক্রান্ত মানুষ। আপনি অরক্ষিত অবস্থায় (মাস্ক না পরে বা হাত স্যানিটাইজ না করে ) সে রোগীর যত কাছে থাকবেন, এয়ারবর্ন হোক বা ড্রপলেট হোক বা কন্টাক্ট হোক সব মাধ্যমেই ভাইরাস আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকবে।
ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় এর প্রমান মিলার মানে এই না যে অন্যান্য মাধ্যমে ছড়ানোর ঝুঁকিটা মিথ্যে হয়ে গেছে বা এপর্যন্ত যেসব স্বাস্থ্যবিধির উপর জোর দেওয়া হয়েছে সেসব বাতিল হয়ে গেছে।
Conclusion from Lancet commentary: “In conclusion, we propose that it is a scientific error to use lack of direct evidence of SARS-CoV-2 in some air samples to cast doubt on airborne transmission while overlooking the quality and strength of the overall evidence base.
There is consistent, strong evidence that SARS-CoV-2 spreads by airborne transmission. Although other routes can contribute, we believe that the airborne route is likely to be dominant. The public health community should act accordingly and without further delay.” [Greenhalgh et al., April 15, 2021, Lancet]