আজ ২০২০ সালের ১৩ই অক্টোবর । ঠিক ১০৩ বছর আগে ঘটেছিল ‘মিরাকল অফ ফাতিমা’। সূর্য সেদিন অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছিল বলে দাবি করা হয়।
১৯১৭ সালের কথা । ঘটনাস্থল -পর্তুগালের Beira Litoral প্রদেশের Ourém অঞ্চলের Fátima নামক ছোট শহর। এলাকাবাসীর তখন মড়ার উপর খাড়ার ঘা অবস্থা । বিশ্বব্যাপী প্রথম মহাযুদ্ধ চলছে । পর্তুগাল সেখানে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এর ভিতরে চলছে স্প্যানিশ ফ্লু। বর্তমান করোনার মতই ভয়াবহ একটি ছোয়াচে রোগ ছিল সেটা।
এত শত আপদ বিপদের মধ্যেও, ১৯১৭ সালের ১৩ই অক্টোবর ফাতিমা শহরের Cova da Iria নামের মাঠে জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ।
কিছু কিছু রিপোর্টে এই সংখ্যাটা লক্ষাধিক বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এত মানুষ জড়ো হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তারা সবাই শুনেছিল, ১৩ই অক্টোবর কোভা দা ইরিয়া মাঠে অলৌকিক কিছু ঘটবে। ঠিক কি ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটতে পারে, তা কেউ জানত না, কিন্তু ‘কিছু একটা’ ঘটবে শুনেই সবাই এসেছিল এখানে।
এই বিশাল গনজমায়েতের ডাক দিয়েছিল ৩ টা পিচ্চি। এদের মধ্যে দুই জন মেয়ে -লুসিয়া (১০ বছর), জেসিন্টা (৭ বছর) আর এক জন ছেলে- ফ্রান্সিসকো (৯ বছর বয়স)।
এই তিন পিচ্চি ছিল পরস্পর কাজিন। এদের কাজ ছিল, ফ্যামিলির গরু ,ছাগল, ভেড়া মাঠে নিয়ে ঘাস খাওয়ানো।
ভেড়া চরাইতে গিয়ে তারা বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনার মুখোমুখি হয়। ১৯১৭ সালের ১৩ই মে তারা এক এ্যাঞ্জেল এর দেখা পায়। সে এ্যাঞ্জেলটা নিজেকে ‘পর্তুগালের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে তাদের কাছে পরিচয় দেয়।
এরপর প্রতিমাসের ১৩ তারিখে তাদের সাথে অস্বাভাবিক কারো দেখা হত।
জুনের ১৩ তারিখে ভার্জিন মেরি এসে তাদেরকে দেখা দেন।ভার্জিন মেরি হচ্ছেন যীশু খৃষ্টের মা। তার অনেকগুলা নাম রয়েছে। লেডি অফ রোজারি নামেও তাকে ডাকা হয়। যেহেতু তিনি পর্তুগালের ফাতিমা গ্রামে দেখা দিলেন, তাই তাকে লেডি অফ ফাতিমাও বলা হয় ১৯১৭ এর পর থেকে।
যাই হোক, ভার্জিন মেরি বাচ্চাদেরকে অভয় দেন, তোমাদের কোনো ভয় নেই। আমি শীঘ্রই যুদ্ধ থামিয়ে দিব। সবাই সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে।
তিন পিচ্চির মধ্যে নেতা ছিল লুসিয়া। সে তার বাবা মা কে ভার্জিন মেরির এই বাণী শুনাল। পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে এই মেসেজ প্রচার করার কথা বলল। অনেকে তার এই কথা বিশ্বাস করল, অনেকে করল না।
প্রতিমাসের ১৩ তারিখেই ভার্জিন মেরির সাথে দেখা হত তাদের। ১৩ই জুলাই, ১৩ই আগস্ট,১৩ই সেপ্টেম্বরেও দেখা হয়েছিল।
এক পর্যায়ে ভার্জিন মেরি এসে লুসিয়াকে জানালেন, অক্টোবরের ১৩ তারিখে সবাইকে কোভা দা ইরিয়া মাঠে হাজির হতে বলো । আমি সবাইকে সেদিন আমার মিরাকল (অলৌকিক ঘটনা/তেলেসমাতি) দেখাব।
নির্ধারিত দিনে ,মাঠে তিল ঠাই আর নাহিরে। জ্যামপ্যাকড স্টেডিয়াম কিংবা কনসার্ট এরিয়ার মত অবস্থা।
অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো মিরাকল দেখা গেল না। এরই মধ্যে শুরু হল বৃষ্টি। লোকজন ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়ল। ৩ পিচ্চির উদ্দেশ্যে গালাগালিও শুরু করল কেউ কেউ।
লুসিয়া আর তার কাজিনরা তখন প্রার্থনা শুরু করলেন। প্রার্থনার ফলে লুসিয়ারা আবার ভার্জিন মেরিকে দেখতে পেলেন। শুধু ভার্জিন মেরি একা নন , সাথে ছিল Jesus, Our Lady of Sorrows, Our Lady of Mount Carmel এবং Saint Joseph ।
তারা দেখতে পেলেন যে, খৃষ্টান ধর্মের এই মহাপুরুষরা সেই মাঠের আকাশে উড়ে উড়ে জনগনকে আশীর্বাদ করছেন। ( তবে ওই ৩ পিচ্চি বাদে আর কেউ তাদের দেখতে পায়নি)
যাই হোক, লুসিয়ার বর্ননা অনুযায়ী, এরপর ভার্জিন মেরি উড়ে চলে গেলেন আকাশের অনেক উপরে। সূর্যের মধ্যে মিশে গেলেন তিনি। সূর্য এতক্ষন মেঘের আড়ালে ঢাকা ছিল, কিন্তু হঠাত করেই সব মেঘ সরে গিয়ে উজ্জ্বল সূর্য বেরিয়ে পড়ল। এবং সূর্য বেশ কিছু অস্বাভাবিক পারফরম্যান্স দেখায়।
একেকজনের বর্ননায় সূর্যের একেক রকম ঘটনার কথা পাওয়া যায়। যেমন-
- ক) তখন সূর্য হলুদ রঙের ছিলনা। রংধনুর মত বিভিন্ন রঙ দেখা গিয়েছিল সেখানে।
- খ) সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে যায় সব সময়, কিন্তু তখন সূর্য পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাচ্ছিল।
- গ) সূর্য টা আকাশে ঘুরছিল । মনে হচ্ছিল একটা ডিস্ককে কেউ ঘুরিয়ে দিচ্ছে আকাশে , খেলনার মত।
- ঘ) সূর্য সামনে পিছনে ডাইনে বায়ে নাচানাচি করছিল
- ঙ) সূর্য পৃথিবীর দিকে নেমে আসা শুরু করেছিল। আর কিছুক্ষন এই পতন অব্যাহত থাকলে একসময় সূর্য পৃথিবীর মাটিতে পতিত হত। তবে পুরোপুরি পতন ঘটেনি। কিছুক্ষন পর সূর্য আবার যথাস্থানে ফিরে গিয়েছিল।
- চ) যতক্ষন আসমানে এই মিরাকল ঘটছিল, তখন জমিনেও অনেক মিরাকল ঘটছিল। ওই মাঠে উপস্থিত অনেক অসূস্থ রোগী সূস্থ হয়ে গিয়েছিল। অনেক খোড়া, পংগু রোগীর পা ভাল হয়ে গিয়েছিল। তারা সূস্থ হয়ে পায়ে হেটে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল।
- ছ) বৃষ্টির পানি রাতারাতি শুকিয়ে গিয়েছিল।
আর এই সবই ঘটেছিল মাত্র কয়েক মিনিটে(সোর্স)
ঘটনাটা নিয়ে ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ আলোড়ন পরে যায়। ভ্যাটিকান সিটি এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে। লুসিয়া, ফ্রান্সি স্কো, জাসিন্টাকে অলৌকিক ক্ষমতাধর মর্যাদাবান উপাধি প্রদান করা হয়। ফাতিমা নামক স্থানে বিশেষ চার্চ বানানো হয়। প্রতিবছর লাখ লাখ টুরিস্ট এর আগমন ঘটে সেখানে।
Our Lady of Fatima নামে সিনেমাও নির্মিত হয়েছে, ১৯৫২ সালে । ২০২০ সালে ,করোনার মধ্যেই Fatima নামে আরেকটা সিনেমা বেরিয়েছে এই ঘটনা নিয়ে। IMDB রেটিং পেয়েছে ৬.৫।
এই ঘটনাকে উপজীব্য করে বিশ্বের বহু স্থানে Our lady of Fatima Church প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক জায়গায় ভাষাগত বৈসাদৃশ্যের কারনে মনে হয় , ফাতিমা কোনো মানুষের নাম। ব্যাপারটা তা নয়। ফাতিমা নামের কারো উদ্দেশ্যে এই চার্চ স্থাপন করা হয়নি, ফাতিমা নামক স্থানের মহিয়ষী নারীর স্মরণে এই চার্চগুলো বানানো হয়েছে।
কোলকাতার এন্টনি অঞ্চলেও এমন একটি চার্চ আছে। চার্চের সাইনবোর্ড হিসেবে লেখা রয়েছে Fatima Church.(সোর্স)
বাংলাদেশের কুমিল্লাতে কান্দিরপাড় এলাকায় Our Lady of Fatima Catholic Church রয়েছে।
নারায়নগঞ্জের টানবাজার যৌণপল্লীতে স্থানীয় যৌণকর্মীদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করার জন্য একটি ‘মা ফাতিমার মন্দির’ ছিল বলে জানা যায় প্রথম আলোর এই রিপোর্টে। অনুমান করি , এখানে ‘আওয়ার লেডি অফ ফাতিমা চার্চ’ নামটা বিকৃত হয়ে ‘মা ফাতিমার মন্দির’ হয়ে গিয়েছিল হয়তো । কেউ ভেরিফাই করতে পারবেন?(সোর্স)
বিজ্ঞানী মহল ফাতিমার এই ঘটনাকে কোনো অলৌকিক ঘটনা বলে মানতে নারাজ ।
তাদের যুক্তিগুলো এক এক করে উপস্থাপন করি।
- ক) ওখানে উপস্থিত একেক জন মানুষ একেক ধরনের মিরাকল দেখার কথা বলছে। সূর্য আসলে কেমন আচরন করছিল, তার পরিষ্কার একই রকম বর্ননা সবার কাছ থেকে পাওয়া যায়না।
- খ) দীর্ঘক্ষন সূর্যের উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর দৃশ্য দেখতে পারে মানুষ ।
- গ) এক পশলা বৃষ্টির পরে আকাশে রোদ উঠলে , বৃষ্টির কণার উপর সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর দৃশ্য তৈরি করে। সূর্যের ঠিক বিপরীত দিকে রঙধনু তৈরি হতে পারে। সূর্য মাঝ আকাশে থাকলে Halo , Sun dog কিংবা parhelion তৈরি হতে পারে। ফাতিমার মানুষ এমন কিছুই দেখতে পারে।
- ঘ) ভার্জিন মেরি বা অন্য দেবতাদেরকে শুধুমাত্র বাচ্চারাই দেখতে পেল ,অন্য কেউ দেখতে পেল না, এটা সন্দেহজনক। হ্যালুসিনেশন বা অন্য কোনো মানসিক অসূস্থতার কারনে বাচ্চাদের এই ধরনের দৃষ্টি বিভ্রম হতে পারে।
- ঙ) আকাশের সূর্যের যদি কিছু হতই, তাহলে শুধু ফাতিমার লোকেরা এটা দেখত না, বিশ্বের সব দেশের সব জায়গা থেকেই এটা দেখা যেত। চন্দ্র গ্রহন, সূর্যগ্রহন, উল্কা, ধূমকেতুর সব খবর যেমন আমরা পাই, তেমনি ১৯১৭ এর ১৩ই অক্টোবর আসলেই কিছু ঘটে থাকলে বিশ্বের সবাই খবর পেয়ে যেত । কিন্তু তেমন কিছুই হল না, শুধুমাত্র পর্তুগালের ফাতিমার মানুষই এটা দেখল !!
- চ) ১৯১৭ তে ক্যামেরা আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। ফাতিমার আকাশের মাত্র একটি ছবিই পাওয়া যায় । সেই ছবিতে অস্বাভাবিক কিছু নাই।ফাতিমায় ভীড় করা জনগনের অনেক ছবি তোলা হয়েছিল। সেগুলার মধ্যেও অস্বাভাবিক কিছু নাই ।আর আকানো ছবি অনেক পাওয়া যায়। সেগুলা তো কোনো প্রমাণ নয়।(সোর্স)
- ছ) অনেক মানুষ একসাথে হ্যালুসিনেশন এর শিকার হতে পারে। সাইকোলজির পরিভাষায় একে মাস হ্যালুসিনেশন বা মাস সাইকোজেনিক ডিজ অর্ডার বলে।একজন হ্যালুসিনেশনের শিকার হলে, তার কথা শুনেশুনে অন্য আরেকজনের হ্যালুসিনেশন হতে পারে। একে শ্যেয়ার্ড ডেলুশন বা ইনডিউসড হ্যালুসিনেশন বলে।
- জ) আকাশে আজব ধরনের কোনো মেঘ থাকতে পারে, যে মেঘে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে রংধনুর মত বিভিন্ন রঙ তৈরি করতে পারে। বাতাসের কারনে মেঘটা উড়ে উড়ে সামনে-পিছনে-ডানে -বামে যেতে পারে। আপেক্ষিকভাবে মনে হতে পারে, মেঘ স্থির রয়েছে, সূর্যই সামনে পিছনে দাইনে বামে ছুটাছুটি করছে।
অথবা , সিম্পলি এটা গুজব হতে পারে। একজনবা কয়েকজন এই গুজব ছড়িয়েছে, সবাই সেটা বিশ্বাস করেছে।
লুসিয়া এবং তার কাজিনরা কি পুরা ব্যাপারটা বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারে? তাদের মাথায় এত বুদ্ধি আছে? কয়েক হাজার মানুষকে বোকা বানাতে পারবে?
আসুন, আপনাদের আর্থার কোনান ডয়েল এবং দুই পিচ্চির গল্প শোনাই।
ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের কোটিংলি গ্রাম থেকে দুই পিচ্চি -এলসি (১৬ বছর) আর গ্রিফিত (৯ বছর) স্যার আর্থার কোনান ডয়েলকে একটা চিঠি লিখেছিল ১৯২০ সালে। চিঠিতে লেখা ছিল , “জানেন ? আমাদের বাসায় অনেকগুলা পরী আছে। তারা আমাদের সাথে সারাদিন খেলাধূলা করে। শুধু আমরা দুইজনেই তাদেরকে দেখতে পাই, আর কেউ তাদেরকে দেখতে পায়না”।
শার্লক হোমস এর স্রষ্টা এই কথা শুনে তার সেক্রেটারিকে পাঠালেন ওই গ্রামে। তিনিও পরী দেখতে পেলেন না। তবে দুই পিচ্চিকে খুব ভাল একটা ক্যামেরা দিয়ে আসলেন, যেন তারা পরীর ছবি তুলতে পারে।
পরবর্তী কয়েক মাসে, ওই পিচ্চিরা অনেকগুলা পরীর ছবি তুলে পাঠাল আর্থার কোনান ডয়েলের কাছে।
ছবিগুলা নিয়ে হইচই পড়ে গেল। দেখা গেল , এগুলা এডিট করা না। আসলেই পরীদের দেখা যাচ্ছে সেসব ছবিতে। পরীরা নাচতেছে, খেলা করতেছে, বিশ্রাম নিচ্ছে, কাপড় চোপড় খুলে গোছল করতেছে—সব কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে ছবিতে।
শার্লক হোমস এই রহস্য ভেদ করতে পারেন নি। ১৯২৩ সালে মারা যান। বিশ্ববাসী মোটামুটি মেনে নিল, যে কোটিংলি গ্রামে পরী আছে।
অনেক পরে ,১৯৮৩ সালে, এলিস আর গ্রিফিত যখন বুড়ি, তখন সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন, আমরা ১৯২০ সালে মিথ্যা কথা বলেছিলাম। পরী নামে কিছু নাই। আমরা পুতুল বানিয়ে সেগুলাকে কাপড় চোপড় পরিয়ে ছবি তুলেছিলাম সুন্দর করে। সেগুলাকেই পরী বলে চালিয়ে দিয়েছিলাম।(সোর্স)
মিরাকল অফ ফাতিমার ৩ বাচ্চা এমন কিছু করেছিল কিনা, তারা সেটা বলে যায় নাই। এদের মধ্যে দুই বাচ্চা -জেসিন্টা আর ফ্রান্সিস্কো মারা গিয়েছিল বাল্যকালেই, ১৯২০ সালে। স্প্যানিশ ফ্লু হয়েছিল ওদের। খৃস্টান চার্চ ওদেরকে অনেক সম্মানসূচকভাবে সেইন্ট উপাধি দিয়েছিল পরে।
৩ নাম্বার বোন, লুসিয়া বেচে গিয়েছিল। ১৯২১ সাল থেকে সে গীর্জায় কাজ শুরু করে। সিস্টার লুসিয়া হিসেবে পরিচিত পায়। সারাজীবন গীর্জাতেই কাটিয়েছে। তবে নতুন করে আর কোনো অলৌকিক অভিজ্ঞতা হয়নি। শেষ জীবনে বিভিন্ন রোগে ভুগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২০০৫ সালে মৃত্য হয় তার।
সিস্টার লুসিয়া বেশ কয়েকটা বই লিখে গেছে। সব গুলাতেই ১৯১৭ এর ঘটনাকে মিরাকল হিসেবে বর্ননা করেছেন।(সোর্স)
ফাতিমার ঘটনার সাথে রাজনীতি ও জড়িত ছিল।
১৯১০ এর আগে পর্তুগাল শাসিত হত রাজা দ্বারা।
৫ই অক্টোবর ১৯১০ তারিখে একটা বিদ্রোহ ঘটে এবং First Portuguese Republic গঠিত হয়। এই বিদ্রোহীরা অনেকটা ফরাসী বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রানিত ছিল। বিশ্বে সেই সময়ে আবার সমাজতন্ত্রের একটা ঢেউ লেগেছিল। ফলে, পর্তুগালের এই বিপ্লবীরা মনে করত, শোসক শ্রেণী ধর্মকে ব্যবহার করে গরীবদেরকে নিপীড়ন করছে। কাজেই ক্যাথলিক ধর্ম হল বিল্পবের প্রধান শত্রু।
নেপোলয়ান বোনাপার্টের একটা গল্প বলতে চাই। তখন নিয়ম ছিল, দেশের রাজাকে পোপ/ধর্মগুরু নিজ হাতে মুকুট পরিয়ে দিবে। রাজার তুলনায় চার্চের অবস্থানটা বেশি সম্মানের–এমন একটা কনসেপ্ট ছিল তখন।
নেপোলিয়ন তার অভিষেকের অনুষ্ঠানে ৩ ঘন্টা দেরিকরে এলেন। পোপকে ৩ ঘন্টা ওয়েট করালেন। তারপর সিংহাসনে বসে পোপের হাত থেকে নিজেই মুকুট টা নিয়ে নিজেই পরে ফেললেন। পোপের আশীর্বাদের আর দরকার নেই। চার্চের চেয়ে রাষ্ট্র বেশি শক্তিশালী–এই ছিল তার মনোভাব।
একচুয়ালি, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়েই , বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্র বনাম চার্চ এর সংঘাত আমরা দেখতে পাই। কে বেশি পাওয়ারফুল, কার কথা কে শুনবে, দেশের সংবিধান বা আইন কানুনে কার হস্তক্ষেপ বেশি থাকবে –এটা নিয়েই দ্বন্ধ ।
গেম অফ থর্ন্স টিভি সিরিয়ালে হাই সেপ্টন বনাম সার্সেই ল্যানিস্টার এর দ্বন্ধ দেখা যায়। লালসালু উপন্যাসে গ্রামের চেয়ারম্যান বনাম স্থানীয় পীর মজিদ এর দ্বন্ধ দেখা যায়। ১৯১০ এ পর্তুগালেও সেই ঘটনা ঘটেছিল।
সরকার গঠনের পরে , পর্তুগালের বিদ্রোহীরা চার্চের বিরুদ্ধে বেশ কঠোর হল। প্রেসিডেন্ট আফোনসো কস্তার নেতৃত্বে তারা চার্চের ক্ষমতা কমিয়ে দিল। রাজকার্যে ধর্ম কিংবা চার্চের হস্তক্ষেপ বন্ধ করে দিল । চার্চের ফাদারদের বেতন বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা কমিয়ে দিল। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে সরকারী ফান্ড দেওয়া ,বা সরকারি ছুটি দেওয়া বন্ধ করে দিল।
ফলে, চার্চের ফাদাররা নতুন শাসকদের উপর বেশ বিরক্ত হয়ে উঠেছিল।
দেশের জনগন যেন ধর্মের পথে থাকে , ( অর্থাৎ পুরনো রাজার দলে থাকে) , সেকুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষতা) এর দিকে না যায়, নতুন শাসকদের দলে না যায়, সে জন্য ধর্মের অলৌকিকতার অনেক কাহিনী তারা বর্ননা করত জনগনের মাঝে।
এরই পটভূমিকায় মিরাকল অফ ফাতিমা ঘটে। প্রথম থেকেই চার্চের ফাদাররা এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে বেশ উতসাহী ছিলেন। ঘটনা ঘটার পরে চার্চ সেটা অনেক বেশি করে প্রচার করে। এমনকি পোপ Pius xii জানিয়েছিলেন, আমি ভ্যাটিকান সিটিতে বসেই ৩০ বছর পরে একই রকম সূর্যের মিরাকল দেখতে পেয়েছি।
এ সকল কারনে অনেকে মনে করেন, মিরাকল অফ ফাতিমা পুরাটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা একটা গুজব ছাড়া আর কিছু নয়। অথবা, গুজব তৈরিতে চার্চের হাত না থাকলেও, ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পরে সেটা বিপুলভাবে প্রচার করে নিজদের পক্ষে প্রচুর সুবিধা আদায় করেছিল তখন চার্চ। ( ১৯২৬ সালে পর্তুগালের বিপ্লবী সরকারের পতন ঘটেছিল )
বাংলাদেশে ২০১৩ সালেও একই রকম একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদী কে চাঁদে দেখা গেছে–এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং সেই গুজবে বিশ্বাস করেছিলেন তখন অনেকে।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে তখন দেলোয়ার সাইদী জেলখানায় বন্দী ছিলেন। ওই দলের নেতাকর্মীরা তখন এই গুজব ছড়িয়ে সাধারন মানুষকে বলতে চাইছিলেন, চাঁদে যেহেতু সাইদী সাহেবকে দেখা গেছে, তার মানে সাইদি একজন অনেক বড় মাপের অলৌকিক ক্ষমতাধর বা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন নেতা । তাকে সরকার জেলখানায় বন্দী করে অনেক খারাপ কাজ করছে। চলো, আমরা আন্দোলন করে সাইদীকে জেল থেকে বের করে আনি।
গুজবে বিশ্বাস করে অনেক মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। দু;খজনকভাবে , পুলিশের সাথে গোলাগুলিতে অনেকে আহত-নিহত হয়েছিল তখন।
মিরাকল বা অলৌকিক বলে যা কিছু প্রচার হয় , ভালভাবে অনুসন্ধান করে দেখলে তার পেছনে কোনো না কোনো যৌক্তিক কার্য-কারন খুজে পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা অনেকেই সেই কারন না খুজে ‘চিলে কান নিয়ে গেছে’ শুনেই চিলের পেছনে দৌড়াই। নিজের কানে হাত দিয়ে দেখি না যে ,কান জায়গা মত আছে কিনা।
বিশ্বে অনেকগুলা সংগঠন আছে, যারা অলৌকিক ঘটনাবলীকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আপনি অলৌকিক কোনো ঘটনা দেখাতে পারলে এরা বিপুল পরিমান টাকা দিবে। যেমন-আমেরিকার জেমস রান্ডি ফাউন্ডেশনকে কোন মিরাকল বা কোনো প্যারানরমাল ঘটনা দেখাতে পারলে পুরষ্কার দিবে ১ মিলিয়ন ডলার ( বাংলাদেশী ৮ কোটি টাকা ) । ভারতের প্রবীর ঘোষের ‘বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদি সমিতি’ কে কোনো অলৌকিক ঘটনা দেখাতে পারলে নগদ ৫০ লাখ রুপি দিবে।
বিশ্বব্যাপী এমন আরো অনেক সংগঠন আছে। উইকিপিডিয়ার এই লিস্টে কমপক্ষে ৩০ টা সঙগঠনের নাম পাওয়া যায়। বলাবাহুল্য, কেউই এসব চ্যালেঞ্জ জিতে টাকা পয়সা পুরষ্কার নিতে পারেনি।(সোর্স)
আছে নাকি আপনার কাছে চ্যালেঞ্জ করার মত কোনো মিরাকল, বা কোনো অলৌকিক ঘটনা বা কোনো প্যারানরমাল এক্টিভিটিজ এর প্রমাণ?
লিখাঃজহিরুল ইসলাম