২৫ বছর, কয়েক হাজার মানুষের পরিশ্রম ও ৮৫৮,৩৮১,৮০০,০০০.০০ টাকা!!
সেই দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রেঞ্চ গায়ানাতে আজ আরিয়ান ৫ রকেট এর উৎক্ষেপন হবে। রকেট এর পে লোড এ থাকবে নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। আমি প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূর লেপের তলে শুয়ে ভাবছি আর শিহরিত হচ্ছি। কি একটা মুহুর্ত!
২৫ বছর এর সাধনা। ১৫ টা দেশের কয়েক হাজার সায়েন্টিস্ট, টেকনিশিয়ান এর অক্লান্ত পরিশ্রম, বার বার ডিজাইন-রিডিজাইন ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৮৫৮,৩৮১,৮০০,০০০.০০ টাকা) ব্যায় করে অনেকবার উৎক্ষেপণ প্লান বাতিল করে অবশেষে আজ আকাশে উড়তে যাচ্ছে ওয়েব টেলিস্কোপ। হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশ সম্বন্ধে আমাদের ধারনাই পাল্টে দিয়েছিল। ওয়েব টেলিস্কোপ না জানি কি দেখে। ওই দূর দূর আকাশে না জানি আরো কত রহস্য লুকিয়ে আছে।
এই টেলিস্কোপে যে ৪ টি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্র রয়েছে
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ বোধ করি পৃথিবীর ইতিহাসে লার্জ হাড্রন কোলাইডার এর পর সবচেয়ে জটিল সায়েন্টিফিক মেশিন। যদিও আমি ওয়েব টেলিস্কোপ কেই এগিয়ে রাখবো বিভিন্ন কারনে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ তৈরী করা হয়েছে গ্যালাক্সি কিভাবে তৈরী হয়েছে, নক্ষত্র কিভাবে তৈরী হয়েছে এসব জানার জন্য এক কথায় সৃষ্টির আদি রহস্য জানা এই টেলিস্কোপ এর প্রথম কাজ। এ ছাড়াও এক্সোপ্লানেট এর সন্ধান তাতে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না এসব ও করবে ওয়েব।
সৃষ্টির আদি রহস্য ব্যাপার টা অনেক জটিল।
সত্যি বলতে কি তাতে আমার খুব মাথা ব্যাথাও নেই।
আমি শিহরিত হচ্ছি বিজ্ঞানের উন্নতি দেখে। এই যে আমরা বিজ্ঞানের কল্যানে কত কিছু জানতে পারছি। হাবল টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ হওয়ার আগে আমরা কত কিছু জানতাম না মহাকাশ সম্বন্ধে ৷ ছোট একটু জায়গায় হাজার হাজার গ্যালাক্সি লুকিয়ে আছে। এটা কেও ধারনা করতে পারেনি৷ আমার মত এক অলস ক্ষুদ্র প্রাণের এই জানাতেই আনন্দ।
বিস্ময়কর ইঞ্জিনিয়ারিং এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এর। এর প্রাইমারি মিরর ২১ ফিট। হাবলের তুলনায় তিনগুণ বড়৷ ওয়েবের বড় ভাই হাবলের তুলনায় এটি ন্যাকেড টেলিস্কোপ।এর মিরর ১৮ টি মিররের সমন্বয়ে তৈরী৷ মিরর গুলো দেখতে সোনালী হলেও সোনার তৈরী নয়৷ আসলে এগুলো বেরিলিয়াম এর তৈরী।
এই টেলিস্কোপটি পূর্বের টেলিস্কোপ অপেক্ষা কত বড় সক্ষমতার দিক দিয়ে
উপরে সোনার প্রলেপ দেয়া আছে৷ এবং বেরিলিয়াম এর উপর এই প্রলেপ এত পাতলা!! মাত্র ৬০০ এটম পাতলা। ভাবা যায়! প্রাইমারি মিররে এই সোনার প্রলেপ দেয়ার কারন হচ্ছে এতে ইনফ্রারেড লাইট খুব ভালো প্রতিফলন হয়৷ এই লাইট প্রতিফলিত হয়ে সেকেন্ডারি মিররে প্রক্ষেপন হবে৷
১০ বিলিয়ন ডলারের এই টেলিস্কোপ ডিজাইন করা হয়েছে বিশেষ ভাবে ইনফ্রারেড লাইট ডিটেক্ট করার জন্য। যা বিলিওন বিলিওন লাইট ইয়ার দূর থেকে আসা আলো পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। বলা যায় টাইম মেশিন।
হাবলের মত এটি পৃথিবীর কাছাকাছি থাকবে না। ওয়েব এর যাত্রা অনেক লম্বা পৃথিবী থেকে১.৬ মিলিয়ন কিলো মিটার দূরে। এলটু নামক ল্যাগ্রান্স পয়েন্ট এ। যেখান গ্রাভিটেশনাল ব্যাপার স্যাপার গুলো অনেক স্ট্যাবল৷ এই টেলিস্কোপ কে এত দূরে পাঠানোর কারন কি? কারন টেলিস্কোপকে ঠান্ডা রাখা। টেলিস্কোপ এর অন বোর্ড ইন্সট্রুমেন্ট গুলোর সক্ষম ভাবে কাজ করার জন্য দরকার ফ্রিজিং টেম্পারেচার।
টেলিস্কোপটি যেভাবে আলোক তরঙ্গ সংগ্রহ করবে
টেলিস্কোপ কে সোলার রেডিয়েশন থেকে বাচাতে একপাশে রয়েছে পাঁচ স্তরের সান শিল্ড। মেটাল কোটেট এবং কেপটন নামের পদার্থ দিয়ে তৈরী। দেখতে প্লাস্টিকের মত। এই শিল্ড গুলো টেলিস্কোপ কে সুর্য থেকে ঢেকে রাখবে। টেলিস্কোপ এর এক দিকে তাপমাত্রা হবে পানি ফুটানোর মত গরম। আরেকদিকে হবে নাইট্রোজেন জমিয়ে ফেলার মত ঠান্ডা। -২২৩° সেলসিয়াস।
এই টেলিস্কোপ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড়। এতই বড় যে কোন রকেটেই একে আটানো যাবে না। এজন্য এটিকে ফোল্ডেড ডিজাইন করা হয়েছে। অরিগামির মত। যাতে আরিয়ান ৫ রকেটের মাথায় ভালো ভাবে বসে যায়।
টেলিস্কোপ স্পেস এ ডিপ্লয় এর পরে ধীরে ধীরে আনফোল্ড হবে। এবং এটা সবচেয়ে কমপ্লিকেটেড ব্যাপার। ৪৫ টা ডিপ্লয়মেন্ট স্টেজ আছে। প্রাইমারি মিররটাই তিন ভাগে ভাগ করা। সানশিল্ড গুলোও থাকবে ভাজ করা এর মধ্যে একটাও যদি ঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে মুশকিল।
টেলিস্কোপটি স্থাপন করা হবে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ১০ লক্ষ মাইল বা ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে ল্যাগরান্জ ২ নামক একটি স্থানে
পৃথিবী থেকে এত দূরে থাকার সুবিধার পাশা পাশি সবচেয়ে বড় অসুবিধাও লুকিয়ে।
সেটা হলো এই টেলিস্কোপ এ কোন সমস্যা হলে সেটা আর সারানো যাবে না। সেখানে এস্ট্রোন্যাটদের গিয়ে ত্রুটি দূর করার কোন সুযোগ নেই। যেটা হাবলের ছিলো। জেমস ওয়েবের যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে সব শেষ!! ২৫ বছর, ১০ বিলিয়ন ডলার, হাজার হাজার মানুষের পরিশ্রম সব মহাশুন্যে ভেসে যাবে।
যখন হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর কক্ষপথে অপারেশনাল হলো। তখন গ্রাউন্ড অপারেটররা দেখলেন ভুল হয়ে গেছে! সবার মাথায় হাত! হাবলের প্রাইমারি মিররে ত্রুটি। ফোকাস হচ্ছে না। অপটিকাল এব্রেশান। ফলাফল ছবি ঘোলা!! এই ত্রুটি ছিল ০.০০০১ ইঞ্চি তাতেই ছবি ঘোলা হয়ে যাচ্ছিলো।
১৯৯৩ সালে সেটা এস্ট্রোন্যাটরা গিয়ে সেটা ফিক্স করেছেন৷ তারপর থেকেই হাবল দুর্দান্ত সব মহাকাশের ছবি পাঠিয়েছে। মহাকাশের ধারনাই পালটে দিয়েছে। মোট ৫ বার হাবল ফিক্স করা হয়েছে ও আপগ্রেড করা হয়েছে৷ কিন্তু জেমস ওয়েব এর ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই।
রকেটের সাহায্য মহাকাশে উৎক্ষেপণের পরে যে প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করবে আগামী ২ সপ্তাহে
এ এই অসুবিধার কথা চিন্তা করে জেমস ওয়েব কে সেভাবেই বানানো হয়েছে। এই প্রত্যেকটা মিরর মোটরাইজড। যাতে মিরর গুলো ইন্ডিভিজ্যুয়াল ভাবে এডজাস্ট করা যায়৷ এবং এই এডজাস্টমেন্ট গুলো কল্পনাতীত ভাবে প্রিসাইস অর্থাৎ নিখুঁত । মানব চুলের প্রস্থের ৫০ ভাগের এক ভাগ এদিক ওদিক হলেই সর্বনাশ। এতটাই নিখুঁত করে বানানো হয়েছে JWST!!
আজ উৎক্ষেপণ সফল হলে জেমস ওয়েব লক্ষ্যে পৌছাতে সময় নেবে ১ মাস আর ফাংশনাল হতে হতে ৬ মাস লেগে যাবে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা আমরা মহাকাশের নতুন কি জানতে পারবো!! সব মিলিয়ে বলাই যায় বিজ্ঞান একটি নতুন ইতিহাস তৈরী হতে করতে যাচ্ছে আজ। সে ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারাটা আনন্দের। সেই ২০০৮ সাল থেকে শুনে আসছি কবে জেমস ওয়েব যাবে মহাকাশে।
টেলিস্কোপের বিভিন্ন যন্ত্র যেভাবে সংগৃহীত আলোক তরঙ্গ বিশ্লেষন করে মহাকশের বিভিন্ন বস্তু সম্বন্ধে তথ্য উদ্ধার করবে
আজ সেই দিন… আমি একটু হলেও অনুভব করতে পারছি এর পিছনে যারা ছিলেন তারা কেমন বোধ করছেন এই মুহুর্তে… অপেক্ষায় আছি….. and Liftoff শোনার জন্য। #NASA #UnfoldTheUniverse #JamesWebbSpaceTelescope
Photo : NASA / Northrop Grumman
লেখকঃ ফিরোজ আল সাবাহ