রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে ডোমের কাজ করতেন মুন্না। বিশ বছর বয়সী মুন্না মর্গে কাজ করতে গিয়ে অল্পবয়সী মৃত নারীদের নিয়মিত ধর্ষণ করতেন।
অবাক করা কাণ্ড, ডোমের কাজ করার পাশাপাশি মৃত নারীদের ধর্ষণ করাই যেন ছিল তার এক ধরনের নেশা।
একে একে সাতজন মৃত নারীকে ধর্ষণ করেন তিনি। হাসপাতালে ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসকরাও তার এই জঘন্যতম ও বিব্রতকর কাজে অবাক হয়েছেন।
কোনো একটি জিনিস, মলমূত্র, গাছ, পশুপাখি ও মৃত মানুষকে দেখে যৌন উত্তেজনা ওঠাকে যৌন বিকৃতি বলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।
সাধারণত এই ধরনের যৌন উত্তেজনা বা যৌনতাকে ‘সেক্সুয়াল ফেটিশিজম’ বলে। যৌন বিকৃতি কত প্রকার এটা সঠিকভাবে বলা মুশকিল, আবার অন্যদিকে ভারতের এক গবেষণায় ৫৪৯ রকমের যৌন বিকৃতির তালিকা পাওয়া গেছে।
মার্কিন মর্গে দায়িত্বে থাকা কেনেথ ডগলাস নামের এক ডোম শতাধিক মৃত নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন। জীবিত নারীর তুলনায় মৃত নারীর সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক করতে বেশি ভাল লাগে।
একদিন ১৯ বছর বয়সি একটি নারীকে যৌন সম্পর্ক করার পরে তার ডিএনএ পরীক্ষা করলে ডোম ডগলাসের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এই অপরাধে তার তিন বছর সাজা হয়। জেল থেকে বের হয়ে ফের ২০১২ সালে একই অপরাধ করেন ডগলাস।
মার্কিন মর্গে নয় এবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে ডোমের দায়িত্বে থাকা মুন্না মৃত তরুণীদের ধর্ষণ করেছেন।
এক মানসিক ব্যাধির নাম নেকরোফিলিয়া। থানাটোফিলিয়া বা নেকরোল্যাগ্নিয়া নামেও পরিচিত।
এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি মৃতদেহের প্রতি প্রচন্ডভাবে যৌন আকর্ষণ অনুভব করে। নেকরোফিলিয়া রোগের ইতিহাস বেশ পুরোনো যদিও শব্দটি তত পুরোনো নয়।
ইতিহাসের জনক হিরোডোটাসের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে মৃতদেহের সাথে যৌন সঙ্গমের উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন মিশরে সুন্দরী কিংবা প্রখ্যাত মহিলা মারা গেলে তাদের মমি করার পূর্বে তিন/চার দিন রেখে দেওয়া হতো যাতে উক্ত মৃতদেহ যৌন সঙ্গমের উদ্দেশ্যে কেউ ব্যবহার করতে না পারে।
তাছাড়া পেরুতে মনে করা হতো এর মাধ্যমে মৃতদেহের সাথে জীবিতের যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
নেকরোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগী যে শুধু মৃতের সাথে যৌন সহবাস করে তা নয় অনেক সময় সে সহবাসের উদ্দেশ্যে ভিকটিমকে হত্যা করে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায় নেকরোফিলিয়ায় আক্রান্ত সবরোগীই পুরুষ যাদের বয়স ২০ বছর হতে ৫০ বছর পর্যন্ত।
ডা. জোনাথন রসম্যান ও ডা. ফিলিপ রেসনিক তিন প্রকারের নেকরোফিলিয়া রোগীর উল্লেখ করেছেন :
- ক. নেকরোফিলিয়া হোমিসাইড : যারা ভিকটিমের মৃতদেহের সাথে সহবাসের উদ্দেশ্যে ভিকটিমকে হত্যা করে।
- খ. রেগুলার নেকরোফিলিয়া : যারা যৌন আনন্দের জন্য মৃতদেহকে ব্যবহার করে।
- গ. নেকরোফিলিক ফ্যান্টাসি : যারা মৃতদেহের সাথে কল্পনায় সহবাস করে যৌন আনন্দ লাভ করে কিন্তু বাস্তবে করে না।
নারীদের মরাদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পুরুষ ডোম রয়েছে। এতে নারীদের দেহের প্রতি পুরুষ ডোম আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এজন্য নারী ডোমের জন্য দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল দাবি জানাচ্ছে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সেলিম রেজা বলেন, মর্গে একটি ছেলে কাজ করতো। সে নাকি নারীদের মরাদেহের সঙ্গে অনৈতিক কাজ করতো।
তাকে গোয়েন্দা পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। ছেলেটি স্বাভাবিক না, বিকৃত রুচির মানুষ। যদি সে শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত ডোম হতো তাহলে এই কাজ কখনই করতে পারত না।
যেভাবে ধরা পড়লো অভিযুক্ত
সিআইডি’র বিবৃতিতে জানানো হয়, বাংলাদেশে ধর্ষণ, হত্যাসহ যেসব ঘটনায় মরদেহ ময়নাতদন্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়, সেসব আলামতের ডিএনএ পরীক্ষা এবং প্রোফাইল তৈরি করে থাকে সিআইডি।
২০১৯’এর মার্চ থেকে ২০২০’এর অগাস্ট পর্যন্ত শহীদ শোহরাওয়ার্দি মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে পাওয়া মৃত নারীদের দেহে পুরুষ শুক্রানুর উপস্থিতি পায় সিআইডি।
কিন্তু একাধিক নারীর মরদেহে একজন পুরুষের শুক্রানুর উপস্থিতি তাদের চমকে দেয়। তারা সেই পুরুষকে চিহ্নিত করার জন্য মাঠে নামে।
বিবৃতিতে সিআইডি বলেছে, মরদেহে পাওয়া শুক্রানুর ওপর ভিত্তি করে সেই পুরুষের ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হয়।
পরে ঢাকার মোহাম্মদপুর ও কাফরুল থানার কয়েকটি ঘটনা থেকে পাওয়া ডিএনএ প্রোফাইলের সাথে সন্দেহভাজন ব্যক্তির ডিএনএ প্রোফাইল মিলে যায় ।
প্রাথমিকভাবে সিআইডি’র ধারণা ছিল, প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি ভুক্তভোগীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে অথবা হত্যার পর ধর্ষণ করেছে।
তবে পরে আরও বিস্তারিত অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের পর সিআইডি সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে কোনো একজন ব্যক্তি মরদেহের ওপর ‘বিকৃত যৌন লালসা চরিতার্থ’ করছে।
পরে সিআইডি’র গোপন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে প্রত্যেক ভুক্তভোগীর মরদেহের ময়নাতদন্ত একটি নির্দিষ্ট হাসপাতালের মর্গে করা হয়েছে।
হাসপাতালটির মর্গের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে অনুসন্ধান করে সিআইডি জানতে পারে যে, ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নেয়া মরদেহ ব্যবচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে পরের দিন মর্গে রেখে দেয়া হতো।
মর্গের কার্যপদ্ধতি বিশ্লেষণ করার পর তদন্তকারীদের সন্দেহ হয় যে মর্গের ডোমদের কেউ অপরাধ সংঘটন করে থাকতে পারে।
সন্দেহের ভিত্তিতে ঐ নির্দিষ্ট হাসপাতালের ডোমদের গতিবিধি পর্যালোচনা করে তদন্তকারীরা। ঐ তদন্তের সময় জানা যায় যে হাসপতালটির একজন ডোম পাঁচটি ঘটনার সময় ভুক্তভোগীর মরদেহ পাহারা দেয়ার জন্য রাতে মর্গে ছিল।
এরপর বিস্তারিত তদন্তের পর তথ্য-প্রমাণের সাপেক্ষে সিআইডি নিশ্চিত হয় যে অভিযুক্ত ডোম এই অপরাধের সাথে জড়িত।
অভিযুক্ত যুবক তদন্তের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে গা ঢাকা দেয়। পরে বৃহস্পতিবার রাতে সিআইডি তাকে গ্রেফতার করে।
সিআইডি জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ স্বীকার করেছে।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তার মুন্না রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে ডোম জতন কুমার লালের সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
দুই থেকে তিন বছর ধরে সে মর্গে থাকা মৃত তরুণীদের ধর্ষণ করে আসছিল। মৃত নারীদের মধ্যে যাদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে তাদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিল ডোম মুন্না।
এই ধরনের ঘৃণিত কাজ নিয়মিত চালিয়ে গেলেও চিকিৎসকরা প্রথম অবস্থায় তা বিশ্বাস করতে পারেননি। ধাপে ধাপে একই ধরনের ঘটনা যখন ঘটতে থাকে তখন চিকিৎসকদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়।
মুন্নাকে ধরতে তদন্ত কর্মকর্তাদের নাটক
ডোম রজত কুমার লালের ভাগিনা মুন্না ভগতকে সন্দেহে মাঠে নামে সিআইডির তদন্ত টিম। গুমের শিকার হওয়া এক যুবকের স্বজন সেজে মুন্নার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন সিআইডির দুই কর্মকর্তা। শুরু হয় নাটকীয়তা।
বেশ কয়েকদিন লাগাতার তারা মুন্নাকে ফলো করতে থাকেন। রাতে মুন্নাই থাকে এটি নিশ্চিত হতে তারা রাত ১টা বা ২টায়ও মর্গে গিয়েছেন। ছবি দেখিয়ে জানতে চেয়েছেন এই চেহারার কোনো লাশ মর্গে এসেছে কিনা।
সম্পর্ক গাঢ় হলে, কৌশলে মুন্নার পান করা সিগারেটের ফিল্টার সংগ্রহ করেন তারা। ফিল্টার থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ’র সাথে মিলে যায় ওই পাঁচ কিশোরীর দেহে পাওয়া ডিএনএ।
রাতে প্রেমিকার সঙ্গে ফোনালাপের পর ধর্ষণ
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, মুন্নার সঙ্গে দু’বছর ধরে এক আত্মীয় তরুণীর প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে।রাতে প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমালাপের পর সে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। তাই সে বিকৃত যৌন কাজে লিপ্ত হতো।
মৃতদেহের সঙ্গে সেলফিও তুলতো মুন্না
আসামি মুন্নার মোবাইল ঘেটে মানসিক বিকৃতির আর প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। এক কর্মকর্তা জানান, মুন্না মৃতদেহের সঙ্গে সেলফি তুলত।
এক্ষেত্রে তার পছন্দের তালিকার শুরুতে ছিল তরুণীদের লাশ। এ ছাড়াও নানা বয়সের নারী মৃতদেহের কাটা ফাঁড়ার ভিডিও করত।
তরুণীদের মৃতদেহ মুন্নার কাছে ‘ভালো’ লাশ
বিকৃত মানসিকতার মুন্না সব মৃতদেহ সমান নজরে দেখতেন না বলে কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, মুন্নার কাছে কম বয়সী তরুণীদের মৃতদেহ হলো ‘ভালো’ লাশ। আর বয়স্ক নারী ও পুরুষদের লাশ হলো ‘খারাপ’ লাশ।
হাইকোর্টের ঐতিহাসিক নির্দেশনা
২০১৫ সালে হাইকোর্ট এক আদিবাসী নারীর অপমৃত্যু মামলার রায়ে এক ঐতিহাসিক নির্দেশ দেন। তাতে বলা হয়, কোনও নারীর অপমৃত্যু হলে, তাদের যৌনাঙ্গ থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করে সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করতে হবে।
দেখতে হবে অপমৃত্যুর আগে কোনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কিনা। তারপর থেকে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব আদালতের নির্দেশ মেনে আসছে।
আরো কিছুঃ
ঢাকা মেডিক্যালের এক ডোমের আত্নীয় ডেডবডি থেকে কলিজা খুলে খেয়ে ফেলত। পরে আজিমপুর গোরস্থানে বসে এই কাজ করার সময় তাকে হাতেনাতে ধরে গ্রেফতার করা হয়।
সিরিয়াল কিলার রসু খাঁ তো রীতিমত আলোড়ন তৈরি করে। মোবাইল ফোনে প্রেম করে করে ডেকে এনে মার্ডার করতো প্রেমিকাদের। দেশের সকল জেলায় তার একটা করে মার্ডার আছে।
অসুস্থ বিকৃত দুনিয়ার সবখানেই আছে। ইওরোপের নিউজপেপার এই ঘটনা তুলে ধরে, শিল্প সাহিত্যে এই ঘটনা স্বীকার করে, সমাজ নোটিস করে, রাষ্ট্র চিকিৎসা করে। আমাদের দেশেও এরকম চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
Join us বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা সংঘ