বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান আজ একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ”বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের পর রাশিয়ার তৈরি স্পুটনিক ৫ ভ্যাকসিন ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে।”
মে মাসের মধ্যেই এই টিকাটি বাংলাদেশে আসবে বলে তিনি জানান। প্রথমে ৪০ লাখ টিকা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তা আসতে ন্যুনতম ২ সপ্তাহ সময় লাগবে।
বিশ্বের ৬০টির বেশি দেশে ব্যবহার হচ্ছে রাশিয়ার করোনা টিকা স্পুটনিক ফাইভ। এটির কার্যকারিতা ৯৭ ভাগ। এখন পর্যন্ত এই টিকা নিয়ে নেতিবাচক কোনো খবরও আসেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেছিলেন, ল্যানসেট-এর গবেষণা প্রবন্ধে দেখা গেছে, রাশিয়ার টিকার কার্যকারিতা ৯১ শতাংশের কিছু বেশি। মাঠ গবেষণায় দেখা গেছে, কার্যকারিতা ৯৬ শতাংশের বেশি।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার পাশাপাশি এই টিকাটি বাংলাদেশে দেয়া হবে।
তবে যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পেয়েছেন, তারা দ্বিতীয় ডোজ হিসাবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাই পাবে বলে তিনি জানান।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় বিভিন্ন দেশে শুরু হয় যোগাযোগ। এতে ইতিবাচক সাড়া দেয় রাশিয়া। দুই দেশের মধ্যে একটি গোপন চুক্তিও হয়েছে।
সব ঠিক থাকলে এটির উৎপাদনও হবে বাংলাদেশেই। এ জন্য তিনটি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির টিকা প্লান্টের যে কোনো একটি ব্যবহার করা হবে। তালিকায় পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ইন্সেপ্টা ফার্মাসিউটিকলস এর প্লান্ট।
এদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন দিলে এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড—এই সাত দেশে ব্যবহারের অনুমোদন থাকলে সেসব ওষুধ, টিকা বা চিকিৎসাসামগ্রী বাংলাদেশে অনুমোদন দেওয়া হয়।
ধরে নেওয়া হয় ওই সব টিকা বৈজ্ঞানিভাবে কার্যকর ও নিরাপদ বলেই এসব ওষুধ ও টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ওই দেশগুলো অনুমোদন দেয়। কিন্তু রাশিয়ার টিকাটি ওই সব দেশ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন এখনো পায়নি। সে কারণে টিকাটির বিশেষ অনুমোদন দরকার।
এছাড়াও আমদানির জন্য আরো তিনটি টিকার সুপারিশ করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। টিকাগুলো হচ্ছে স্পুটনিক ফাইভ, মডার্না ও সিনোফার্ম। কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নয়, জি-টু-জি পদ্ধতিতে টিকা আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
কমিটি বলছে, তারা নিরাপত্তা, কার্যকারিতা, সংরক্ষণের সুবিধা, দাম ও টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যবহারের সক্ষমতা বিবেচনায় চীনের সিনোফার্ম ও রাশিয়ার স্পুতনিক-৫ টিকা দুটি সংগ্রহের প্রাথমিক সুপারিশ করে।
সিনোফার্মের টিকার কার্যকারিতা ৭৯ শতাংশ। এটি চীনের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত এবং বিশ্বের ৩৪টি দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর দাম প্রতি ডোজ প্রায় ১৯ থেকে ৪৪ ডলার।
অন্যদিকে স্পুতনিক-৫ টিকার কার্যকারিতা ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ উল্লেখ করে কার্যবিবরণীতে বলা হয়, এটি রাশিয়ার ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত। বিশ্বের ৬১টি দেশে এ টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে। দাম প্রতি ডোজ ১০ থেকে ২০ ডলার। এটিও আমদানি করবে সরকার।
সরকারিভাবে কমিটিকে জানানো হয়েছে, চলতি বছর মে থেকে ডিসেম্বর সময়ে এ টিকার ২ কোটি ৪০ লাখ ডোজ এবং আগামী জানুয়ারি থেকে এপ্রিল সময়ে ৩ কোটি ৬০ লাখ ডোজ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সব মিলিয়ে স্পুটনিক ৫ টিকা নিশ্চিত হলো ৬ কোটি ডোজ। যা দুই ডোজ হিসেবে ৩ কোটি মানুষ নিতে পারবে।
এছাড়া মঙ্গলবার দুপুরে করোনার টিকা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ছয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের পর করোনা মোকাবেলায় সাউথ এশিয়া মেডিকেল ইমারজেন্সি ফ্যাসিলিটিজ স্টোরেজ গঠনের উদ্যোগের কথা জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রাথমিক আলোচনায় সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় এই জরুরী মেডিকেল সেবা কেন্দ্র স্থাপনের কথা উঠে আসে।
সিনোফার্মা: মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) বঙ্গভবনে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেঙ্গহির সাথে সাক্ষাতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ করোনার ভ্যাকসিন সম্পর্কে গবেষণা ও উৎপাদনে চীনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। করোনার ভ্যাকসিন সম্পর্কে গবেষণা ও উৎপাদনে যৌথ উদ্যোগ নিতেও আগ্রহী বাংলাদেশ।
২৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানান চীনের সিনোফার্মা পাঁচ লাখ ডোজ উপহার দিয়েছে। আর কিছু টিকা তারা তাদের কর্মীদের ওপর প্রয়োগের অনুমতি চেয়েছে।
এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন তাদের অনুমোদন দিয়েছে। আমরা এ টিকা গ্রহণ করব বলে তাদের জানিয়েছি। তারা এ উপহার যেদিন আমাদের দেবে, আমরা সে সময় এটি গ্রহণ করব। এ টিকা আমাদের দেশের লোকের ওপর প্রয়োগ করা হবে কিনা তা জাতীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।
ফাইজার: মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বাধীন কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে বাংলাদেশ ফাইজারের টিকা পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। ২৫ এপ্রিল বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস উপলক্ষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত এক আলোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের এমনটি জানান তিনি।
খুরশীদ আলম বলেন, কোভ্যাক্সের টিকা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের দেবে বলেছে, ফাইজারের এক লাখ ডোজ টিকা দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, এর আগে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশকে ফাইজার-বায়োএনটেকের আট লাখ ডোজ টিকা দিতে চেয়েছিল কোভ্যাক্স। সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর প্রয়োগের শর্তে মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশের জন্য এ টিকা দেয়ার প্রস্তাব করেছিল বৈশ্বিক জোটটি। পরে দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ শুরু করা হলে মত বদলায় জোটটি। তখন অক্সফোর্ডের টিকা দেয়ার কথা জানানো হয়।
মে মাসে দুটি সূত্র থেকে সব মিলিয়ে একুশ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।
রবিবার তিনি জানান, ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে পাওয়া যাবে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ ডোজ টিকা। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে পাওয়া যাবে ফাইজার-বায়োএনটেকের এক লাখ ডোজ। তবে ফাইজারের কঠিন তাপনিয়ন্ত্রিত পরিবহণ ব্যবস্থা বাংলাদেশ কতটকু বজায় রাখতে পারবে, তাও আলোচনার বিষয় হবে।
কোভিশিল্ড: খুরশীদ আলম বলেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ২০ লাখ ডোজও আমরা পাব। বেক্সিমকোর উচ্চতর মহল আমাদের জানিয়েছে, ২০ লাখ ডোজ যথাসময়ে আসবে। যাদের আমরা এরই মধ্যে প্রথম ডোজ দিয়েছি, তাদের সম্পূর্ণভাবে দ্বিতীয় ডোজ দিতে পারব।
এর একদিন আগে শনিবার বেক্সিমকোর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান জানান, “সিরাম জানিয়েছে যে তারা বাংলাদেশের জন্য ৫০ লাখ ডোজ রেডি করে রেখেছে কিন্তু মিনিস্ট্রি অফ এক্সটারনাল এফেয়ার্স ছাড়পত্র দিচ্ছে না। তাই ভ্যাকসিন আনার বিষয়ে এখন বাংলাদেশ সরকারের চুপ করে থাকার কারণ নেই। ”
জানা যায়, গত নভেম্বরে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ‘কোভিশিল্ড’ টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে সরকার। টিকার দাম আগাম পরিশোধ করে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তির শর্ত অনুসারে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে আসার কথা। গত জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ টিকা এলেও ফেব্রুয়ারিতে এসেছে মাত্র ২০ লাখ ডোজ। মার্চ ও এপ্রিলে কোনো টিকা আসেনি।
এছাড়া নরেন্দ্র মোদি উপহার হিসেবে ২০ লাখ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান ১৩ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে আনেন। ফলে বাংলাদেশে মোট কোভিশিল্ডের টিকা আছে ১০৩ লাখ ডোজ।
এর মধ্যে গেল মাসে টিকা রফতানিতে স্থগিতাদেশ জারি করেছে ভারত সরকার। এতে আগামী কয়েক মাস টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
দেশে গতকাল পর্যন্ত ৫৮ লাখ ১৮ হাজার ৪০০ নারী ও পুরুষকে প্রথম ডোজের টিকা দেয়া হয়েছে। আর দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছেন ২৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৬ ব্যক্তি।
সব হিসেব ঠিক থাকলে বাংলাদেশ মে মাসে টিকা পাচ্ছে কোভিশিল্ড ২০ লাখ+ ফাইজার ১ লাখ + স্পুটনিক ৫ ৪০ লাখ + সিনোফার্মা ৫ লাখ = ৬৬ লাখ ডোজ।