গতকাল শনিবার বিকেল ৪টা ৩৯ মিনিটে কক্সবাজারে জেলার টেকনাফ উপজেলার নাফ নাদীর মায়ানমার অংশে ৪ দশমিক ১ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়েছে সেই ফল্টে গত ৭০ বছরে ৪ মাত্রার একাধিক ভূমিকম্প সংগঠিত হয়েছে যা নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে।
গতকাল যে স্থানে ভূমিকম্প হয়েছে সেই স্থানটি উচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকি-সম্পন্ন স্থান। ঐ স্থানে নিয়মিত ভাবে ভূমিকম্প হয়। গতকালের ভূমিকম্প হওয়া স্থানে ১৯৫৬ সালে ৬ দশমিক ২ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল যা গতকালের ভূমিকম্পটি অপেক্ষা প্রায় ১২৫ গুন বড় ভূমিকম্প ছিল (ভূমিকম্পের মান লগ স্কেল অনুসরণ করে)। গতকালের ভূমিকম্পটি থেকে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়েছে তা অপেক্ষা ৬৭ বছর পূর্বের ৬ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পটি থেকে ১৪০০ গুন বেশি শক্তি নির্গত হয়েছিল।
কোন স্থানে ভূমিকম্প হয় কিংবা ভবিষ্যতে ভূমিকম্প হবে সেই সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিকরা খুব ভালো ভাবে জানেন। কোন স্থানে কত বড় মানের ভূমিকম্প হতে পারে কোন স্থানে সেই বিষয়েও বৈজ্ঞানিকরা অনেক ভালো করে জানেন। তবে ঠিক কোন সময়ে ভূমিকম্পটি হবে সেই সম্বন্ধে পূর্বাভাস করার কোন প্রযুক্তি পৃথিবীতে এখনও আবিষ্কার হয় নি।
ফলে ভূমিকম্পের সম্ভব্য স্থান ও মান এবং জান ও সম্পদের উপর ভূমিকম্পের ঝুঁকি সম্বন্ধে দেশের মানুষকে যত বেশি সচেতন করা যাবে ভূমিকম্পের কারণে ক্ষয়-ক্ষতি তত বেশি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
বাঁচতে হলে জানতে হবে (পর্ব ২):
বাংলাদেশের কোন বিভাগ ও জেলায় ভূমিকম্প ঝাঁকুনি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি যদি বাংলাদেশ-মায়ানমার কিংবা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বড় মাপের ভূমিকম্প সংগঠিত হয়?
স্কুল জীবনে বিজ্ঞান বই এ গতিবেগ ও ত্বরণ সম্বন্ধে জেনেছি যা হয়ত অনেকের মনে নাই তাই আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে। গতিবেগ হলও সময়ের সাথে দূরত্বের পরিবর্তনের হার। আর ত্বরণ হলও সময়ের সাথে গতিবেগ বৃদ্ধি হার। নিচে সংযুক্ত মানচিত্রে বিভিন্ন রং নির্দেশ করতেছে ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট তরঙ্গের কারণে কোন স্থানের ভূমিতে কেমন ত্বরণ এর সৃষ্টি হবে (উ-লম্ব বরাবর কিংবা অনুভূমিক বরাবর ভূমির গতিবেগ বৃদ্ধির পরিমাণ)।
ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট তরঙ্গ বা ঢেউ যখন ভূ-পৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন ভূ-পৃষ্ঠে কম্পনের সৃষ্টি হয়; ভূপৃষ্ঠের উপর অবস্থিত বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা সহ ভূ-পৃষ্ঠের সংস্পর্শে থাকা সকল বস্তু কম্পিত হয়। কোন বস্তু কতটুকু কম্পিত হবে তা নির্ভর করছে ঐ বস্তুর নিচে অবস্থিত মাটির গঠনের উপর।
ভূ-পৃষ্ঠের নিচের মাটি যদি কঠিন পাথুরে হয় তবে কম্পন অপেক্ষাকৃত কম হবে। মাটি যদি আলগা হয় তবে কম্পন হবে মাঝারি মানের। মাটি যদি পানিযুক্ত ও কর্দমাক্ত হয় তবে সেই মাটির নিচ দিয়ে ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট তরঙ্গ প্রবাহিত হলে ভূমির কম্পন হবে সর্বোচ্চ পরিমাণ। ঠিক এই কারণে নদী-নালা, জলভূমি ভরাট করে তৈরি করা বিল্ডিং অন্যান্য প্রকারের মাটিতে তৈরি বিল্ডিং অপেক্ষা বেশি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকে।
ছবি: বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝঁকি মানচিত্র। রং যে স্হানে যত বেশি গাড় হলুদ সেই স্হানে তত বেশি ভূু-কম্পন সৃষ্টি হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ছবিতে কোন জেলার নাম উল্লেখ থাকুক কিংবা না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না। ভূমিকম্প ঝুঁকি নির্দেশ করতেছে আপনার জেলা শহরটি কোন রং দিয়ে চিহ্নিত তার উপর। যদি আপনার জেলা শহরটি গাড় হলুদ রং এর কোন এলাকার মধ্যে পড়ে থাকে তবে আপনার জেলাশহরটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে যেমন সিলেট ও খাগড়াছড়ি জেলা।
পক্ষান্তরে আপনার জেলাটি যদি সবুজ রং এর এলাকার মধ্যে অবস্থান করে তবে সেই জেলায় অপেক্ষাকৃত কম ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে পাবনা জেলা পুরো বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কম ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে যেখানে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে।
এখানে উল্লেখ্য যে আমরা জানি স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে পাবনার রুপপুরে এই পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্হানপন করা হচ্ছে। তবে আমাদের বেশিভাগ মানুষই জানেনা যে রূপপুরে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই অর্থাৎ পুরো বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কম ভূমিকম্প ঝুঁকি সম্পন্ন স্থানটি স্বাধীনতার পূর্বের চিহ্নিত করা হয়েছিল।
বাঁচতে হলে জানতে হবে (পর্ব ৩):
ভূমিকম্প নিরোধক বিল্ডিং তৈরি করতে বিল্ডিং তৈরির একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভূমিকম্প বিষয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কিংবা স্থাপত্য প্রকৌশলীর তত্বাবধানে বিল্ডিং তৈরি করতে হবে।
নিচের সংযুক্ত যে ছবিটি দেখিতেছেন তা হলও সেই বিল্ডিং যার নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে ঘানার জাতীয় ফুটবল দলের ফুটবলার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল নিউ ক্যাসেল ইউনাইটেড এর ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ান আতৎসু। ১২ তলা এই বিল্ডিংটি ২০১১ সালে তৈরি শুরু হয়ে ২০১৩ সালে উদ্ভোদন হয়।
এই বিল্ডিংটির দৈর্ঘ্য ছিলও ১৩৪ মিটার ও উচ্চতা ছিলও ৬৪ মিটার। মোট ২৪৯ টি এপার্টমেন্ট ছিলও এই বিল্ডিং এ। এই একটি মাত্র বিল্ডিং ধ্বসে চাপা পড়ে ৭৫০ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
৭ দশমিক ৮ মাত্রার প্রথম ভূমিকম্পটি কারণে ১ মিনিট ৫ সেকেন্ড ধরে ঝাঁকুনি হয়। এই বিল্ডিংটি মাত্র ৪৫ সেকেন্ড পড়েই ধ্বসে পড়ে। তার মানে পুরো বিল্ডিং এর কোন মানুষই রুম থেকে নিচে নামার সময়টুকুও পায় নি।
এখানে উল্লেখ্য যে এই বিল্ডিংটিকে গণ্য করা হতো ঐ এলাকার সবচেয়ে আধুনিক ও এলিট বিল্ডিং। তুরস্কে ২০০০ সালের পরে যে বিল্ডিং কোড তৈরি হয়েছে সেই বিল্ডিং কোড অনুসারে কোন স্থানে বিল্ডিং তৈরি করতে হবে ঐ স্থানে ২৫০০ বছরের মধ্য সর্বোচ্চ যে মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেই ভূমিকম্পে টিকে থাকতে পারে এমন বিল্ডিং।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কিংবা স্বপত্য প্রকৌশলীরা রা যখন বহুতল বিল্ডিং এর নকশা প্রণয়ন করেন তখন বিল্ডিং এমন ভাবে ডিজাইন করেন যে প্রত্যেকটি বিল্ডিং এর একটি নির্দিষ্ট দোলন মান থাকে। কোন স্থানে ভূ-পৃষ্টের নিচে দিয়ে ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট তরঙ্গ প্রবাহিত হওয়ার সময় ঐ স্থানের মাটিতে দোলনের সৃষ্ট হয়।
বিল্ডিং এর নিজস্ব দোলন ও ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট দোলনের মান একই পরিমাণ হলে বিল্ডিংটি সর্বোচ্চ পরিমানে দুলতে থাকবে ও বিল্ডিংটির সর্বোচ্চ পরিমাণ ক্ষতি হবে।
খুব সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করি। ধরুন আপনি একটি দোলনাতে দুলিতেছেন। এমন সময় আপনার কোন বন্ধু এসে পিছন থেকে দোলনাটিকে চাপ দেওয়া শুরু করে প্রতিবার কাছে আসার সময়। আপনার কি মনে পড়েছে আপনার বন্ধুটি কয়েকবার পিছন দিকে থেকে নিয়মিত ভাবে ঐ রকম চাপ দেওয়ার পরে আপনার দোলনাটি সামনে ও পিছনে অনেক দূরে যাওয়া শুরু করে ও খুব দ্রুত সামনে ও পিছনে যাওয়া আসা করে।
অনেক সময় দুলনি সহ্য করতে না পেরে অনেকে দোলনা থেকে ছিটকে পড়ে যায়। ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটে ১২ তলা এই বিল্ডিং এর ক্ষেত্রে ৬ ই ফেব্রিয়ারীর ভূমিকম্পের সময়।
আপনার বন্ধুর সাহায্য ছাড়াই আপনি যখন দুলতে থাকেন সেই রকম দোলন বিল্ডিং এরও থাকে। কিন্তু ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট তরঙ্গের দোলন মান যখন বিল্ডিং এর প্রাকৃতিক দোলন মানের সময় হয় ও একই দশায় মিলিত হয় (পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় constructive interference) তখন বিল্ডিং এর ঝাঁকুনির মান তার প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ঝাঁকুনির সর্বচ্চ সহ্য সীমা অতিক্রম করে যায় ও বিল্ডিংটির ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয় কিংবা পুরো বিল্ডিংটি ধ্বসে পড়ে।
ইতালির ট্রিয়েস্তে শহরে The Abdus Salam ICTP: International Centre for Theoretical Physics এ পোষ্ট-গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করতে গিয়ে প্রথম সেমিস্টারে প্রথম যে কোর্সটা শুরু হয়েছিল সেটার নাম ছিলও Wave Physics বা তরঙ্গ পদার্থবিদ্যা। এই কোর্সটি পড়িয়েছেন ইতালির ট্রিয়েস্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প বিজ্ঞানী অধ্যাপক ফ্যাবিও রোমানেলী। আমার জীবনে যত শিক্ষক পেয়েছি প্রাইমারী স্কুল থেকে আজ পর্যন্ত সেই সকল শিক্ষকের মধ্যে যে সকল শিক্ষকের ক্লাসে পড়ানোর স্টাইল আমার পছন্দ হয়েছে তাদের শীর্ষ ৫ জনের মধ্যে একজন হলও অধ্যাপক ফ্যাবিও।
পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করার পরেও কেন আবারও ইতালিতে এসে তরঙ্গ পদার্থবিদ্যা পড়তে হচ্ছে প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাকে দ্বিতীয় সেমিস্টার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত না অধ্যাপক ফ্যাবিও দ্বিতীয় সেমিস্টারে Seismology বা ভূকম্পনবিদ্যা কোর্সটি পড়ানো শুরু করে নি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে Seismology বা ভূকম্পনবিদ্যার প্রায় ৫০% হলও তরঙ্গ পদার্থ বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ।
ভূমিকম্প সহ্য করে টিকে থাকতে পারবে এমন বিল্ডিং ডিজাই কারার জন্য সর্বাগ্র প্রয়োজন তরঙ্গ পদার্থ বিজ্ঞান সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান। প্রত্যেকটি ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্টি ভূ-কম্পন তরঙ্গ আকারে পৃথিবীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়। আগামীকাল ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্টি বিভিন্ন তরঙ্গ নিয়ে লিখবো। ও কোন ধরনের তরঙ্গ বিল্ডিং এর জন্য সর্বোচ্চ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বহুতল বিল্ডিং তৈরির একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞ ও দক্ষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কিংবা স্বপত্য প্রকৌশলীর তত্বাবধান প্রয়োজন ভূমিকম্প নিরোধক বিল্ডিং তরী করার জন্য তাও বুঝতে পারবেন আগামীকালের লেখা প্রকাশের পরে।
দ্বিতীয় ছবিতে হলুদ রং এর উপরের পুরো অংশটি ছিটকে পরেছে যেমন করে দোলনা হতে মানুষ ছিটকে পড়ে একসময় প্রচণ্ড দুলুনি সহ্য করতে না পারে।
বিল্ডিং এর ফাউন্ডেশন ও উপরের অংশ ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট দোলনের সাথে তাল মিলাতে পারে নি।
বাঁচতে হলে জানতে হবে (পর্ব ৪): ভূমিকম্পের কারণে বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে পড়ে কেন বা বাড়ি-ঘরে ফাটল সৃষ্টি হয় কেন?
আপনি কখনও চিন্তা করেছেন কি, ভূমিকম্প যে স্থানে সংঘটিত হয় সেই স্থান থেকে অনেক দূরে কোন স্থানের বাড়ি-ঘড় এর ক্ষতি করে কেন?
ভূমিকম্পের সময় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলে ফল্ট প্লেনে জমা হওয়া স্থিতি শক্তি seismic waves এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভূ-পৃষ্ঠ নাকি ভূ-অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে seismic waves কে প্রধানত ২ ভাগে ভাগ করা হয়।
ভূ-অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত হলে তাকে বলা হয়ে থাকে Body waves ও ভূ-পৃষ্ঠ এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে তাকে বলা হয়ে থাকে Surface waves.
Body waves আবার দুই প্রকার: ১) Primary waves (p wave) ও ২) Secondary waves (s wave)। Body waves (Primary waves ও Secondary waves তরঙ্গ দুইটি যখন ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছে তখন তার নতুন নাম হয় Surface waves।
এই Surface waves আবার দুই প্রকার ১) Love waves ও ২) Rayleigh waves। তরঙ্গের নাম ভালবাসা হলেও কাজটা কিন্তু করে ঘৃণার।
Love waves ও Rayleigh waves তরঙ্গ দুইটি বাড়ি-ঘর এর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। নিচে সংযুক্ত ভিডিওতে দেখতে পারবেন ভূমিকম্পের ভলে সৃষ্ট কোন ধরনের তরঙ্গ এর কারণে একটি ঘরে কেন ফাটল সৃষ্ট হয় কিংবা ঘরটি পড়ে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আপনি যদি প্রশ্ন করেন ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট প্রধান ২ টি তরঙ্গকে কেন Primary waves ও Secondary waves নাম করন করা হয়েছে?
আমরা জানি ভূমিকম্পের কারণে ভূমিতে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তা যে যন্ত্র দিয়ে মাপা হয় তার নাম সিসমোমিটার। ভূ-কম্পন যে কাগজে লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে সিসমোগ্রাম বলে।
কোন স্থানে ভূমিকম্প হওয়ার পড়ে সিসমোমিটারে সর্বপ্রথম যে seismic waves টি পৌছায় তার নাম দেওয়া হয়েছে Primary waves বা প্রাথমিক তরঙ্গ ও এর পরে যে তরঙ্গ পৌছায় তার নাম দেওয়া হয়েছে Secondary waves বা দ্বিতীয় তরঙ্গ।
এখানে উল্লেখ্য যে Primary waves (p wave) ও Secondary waves (s wave) এর ভূকম্পন পরিমাপক যন্ত্রে পৌঁছানোর সময়ের পার্থক্য জানার মাধ্যমে ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্র থেকে ভূমিকম্পটি কত দূরত্বে হয়েছে তা নির্ণয় করা যায়।
ভূকম্পন যন্ত্রে সবার শেষে পৌছায় Love waves ও Rayleigh waves। অর্থাৎ, ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট ৪ প্রকার তরঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে অলস তরঙ্গ হলও ভালোবাসা তরঙ্গ ও রেইলিঘ তরঙ্গ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এই অলস তরঙ্গ দুইটি সবার শেষে পৌঁছালেও সবচেয়ে বেশি জান ও মালের ক্ষতি করে এই দুইটি তরঙ্গ।
নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে ভূমিকম্পের ফলের সৃষ্ট তরঙ্গ ৪ প্রকারের তরঙ্গ আকারে প্রবাহিত হচ্ছে ও ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থিত বৈদ্যুতিক সরবরাহ লাইনের ক্ষতি সাধন করছে। Primary waves বা প্রাথমিক তরঙ প্রবাহিত হওয়ার সময় বিল্ডিং এর নিচের মাটিতে সংকোচন ও সম্প্রসারণ করে।
প্রাইমারি তরঙ্গের প্রবাহকে সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় হারমোনিয়াম এর বেলো এর মাধ্যমে। বেলো যখন ছেড়ে দেওয়া হয় তখন তা সম্প্রসারণ করে; আবার যখন আঙ্গুল দিয়ে টেনে নেওয়া হয় তখন সংকোচন করে। কিংবা তুলনা করা যেতে পারে স্প্রিং এর সংকোচন ও প্রসারণ এর সাথে।ভূ-অভ্যন্তরের মাটিও ঠিক ঐ রকম সংকুচিত ও সম্প্রসারিত হয়ে যখন প্রাইমারি তরঙ্গ প্রবাহিত হয়।
তবে এই সংকোচন ও সম্প্রসারণ এত কম পরিমাণে হয় যে কারণে প্রাইমারি তরঙ্গ থেকে বিল্ডিং এর ক্ষতি হয় খুবই কম পরিমাণে।
পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় প্রাথমিক তরঙ্গের প্রবাহকে অনুদৈর্ঘ্যও বলা হয়ে থাকে।
Secondary waves ( প্রকৃত বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নাই) বা দ্বিতীয় তরঙ্গ (ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্রে ধরা পরা দ্বিতীয় তরঙ্গ) প্রবাহিত হয় সমুদ্রের ঢেউ এর মতো। পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় Secondary waves বা দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রবাহকে তির্যক তরঙ্গ বলা হয়ে থাকে।
Love waves বা ভালোবাসা তরঙ্গটির প্রবাহকে তুলান করা যেতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিনে কেরু কোম্পানির বাংলা মদ খেয়ে কনসার্ট দেখতে যাওয়া বন্ধুর ছন্দ-হীন নৃত্যের নামে হাত-পাছ ছোড়া-ছুড়ির সাথে। যে বন্ধুটি নেশার ঘোরে একবার সামনের জনকে লাথি মারে, একবার পিছনের জনকে লাথি মারে; একবার ডানের জনকে ঘুষি মারে; একবার বামের জনকে ঘুষি মারে।
কিংবা তুলনা করা যেতে পারে একই সাথে সাপের চলার পথ (আঁকা-বাঁকা) ও সমুদ্রের ঢেউ এর (উঁচু-নিচু হয়) সাথে। অর্থাৎ, ভালবাসা তরঙ্গ সাপের মতোও চলে আবার সমুদ্রের ঢেউ এর মতোও চলে। Love waves বা ভালোবাসা তরঙ্গটি ঠিক একই ভাবে সামনে-পিছনে ও ডানে-বামে বিস্তার লাভ করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
এই কারণে এই তরঙ্গটি থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষতির সাধিত হয় বিল্ডিং এর।
Rayleigh waves যখন প্রবাহিত হয় তখন বিল্ডিং এর নিচের মাটির কণাগুলোকে ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরায়। এই কারণে ৪ প্রকারের তরঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে Rayleigh waves।
এই তরঙ্গটিকে তুলনা করতে পারেন মুড়ির টিন বাসের সাথে। মুড়ির টিন বাসে বসে যাত্রা করলে যেমন পেট থেকে নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে আসতে চায় ঠিক একই ঘটনা ঘটায় এই তরঙ্গটি যখন বিল্ডিং এর নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে।
ছবি কৃতজ্ঞতা: আমেরিকান ভূ-ত্বাত্তিক অধিদপ্তর।