আজ ইন্টারস্টেলার নিয়ে লিখছি। সবথেকে জটিল, স্নায়ুক্ষয়ী, রোমহর্ষক অনুভূতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি এই এক্সপ্লেনেশান লিখতে গিয়ে। সেই অনুভূতি গুলোই সহজভাবে তুলে ধরছি আপনাদের সামনে!
*** Spoiler and PHYSICS LESSON alert***
প্রথমেই বলে নিই, সিনেমার গল্প সমসাময়িক না।
২০৫০-৬০ সালের ঘটনা এগুলো।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং সহ বিভিন্ন মানবসৃষ্ট কারণে পৃথিবী তখন বিপর্যস্ত। ধান, গম কোনকিছুই আর জন্মায় না মাটিতে। ধুলিঝড় যেন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। পৃথিবীর বায়ুমন্ডল কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত নেই আর।
পৃথিবী সাইন্স-টেকনোলজি তে খুব একটা পিছিয়ে না থাকলেও, পিছিয়ে গেছে খাদ্যশস্য উৎপাদনে। খাদ্যাভাব প্রকট দেখে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার সহ অন্যান্য পেশার মানুষও কৃষিকাজ করছে। বেশিরভাগ মানুষই ভুট্টার ফার্ম তৈরী করে খাদ্যচাহিদা মেটাচ্ছে।
নাসার এমনই এক অবসরপ্রাপ্ত পাইলট হলেন আমাদের ইন্টারস্টেলারের মূল চরিত্র ‘জোসেফ কুপার’। ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিগ্রী আছে তার। অবসর নিয়ে এখন সে ফার্মিং এ ব্যস্ত। তার স্ত্রী মারা গেছে বেশ ক’দিন হল। ছেলে টম, মেয়ে মার্ফ এবং শ্বশুর ডোনাল্ড কে নিয়ে কুপারের সংসার।
মার্ফের রুমে একটা বইয়ের লাইব্রেরী ছিল। আর সেই লাইব্রেরীতেই অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটত প্রতিনিয়তই। মার্ফ বলতো তার বুক সেল্ফে নাকি ভূত আছে। আপনা-আপনিই বই পড়ে যেত তাক থেকে। কুপার এই ঘটনাকে প্রথমে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু একদিন ধূলিঝড়ের পর মার্ফের ঘরে জমে যাওয়া ধুলোর মধ্যেও একটা প্যাটার্ন লক্ষ্য করে সে।
একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ায়, তার বুঝতে সময় লাগেনি যে সেটা এক ধরনের বাইনারি কোড। এই কোড গুলোকে ডিকোড করে সে ম্যাপে একটা লোকেশনের কো-অর্ডিনেট পায় সে। উৎসাহী কুপার আর মার্ফ রওয়ানা দেয় সেই অচেনা লোকেশনের উদ্দেশ্যে।
সেখানে পৌঁছাতেই তারা বুঝতে পারে যে এটা ছিল নাসার গোপন হেডকোয়ার্টারের লোকেশন। সেখানকার হর্তাকর্তা… ডা. ব্র্যান্ড কুপারের কাছে কিছু নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরে। বলে যে কুপারের মেয়ে মার্ফের জেনারেশনই হয়তো এই পৃথিবীর শেষ জেনারেশন হবে। কয়েকদিন পর ভুট্টা উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাবে আর তারপর এই পৃথিবী হয়ে যাবে বসবাসের অযোগ্য।
তবে এই সমস্যা সমাধানে কিছু আশার আলোও দেখতে পেয়েছিল নাসা। বেশ কয়েক বছর আগে, তারা শনি গ্রহের কাছে একটা ওয়ার্মহোলের সন্ধান পায়।
_________________
এখন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে ওয়ার্মহোল কী?
একটু বিস্তারিত ভাবে বলি। আমাদের সৌরজগতের মতো জগত পুরো মহাকাশ জুড়ে রয়েছে অগণিত সৌরজগত, রয়েছে অগণিত গ্যালাক্সি! আকাশে তাকালেই তো লক্ষ লক্ষ তারা দেখতে পাই আমরা।
আমরা হয়তো কয়েকবছরের ভ্রমণে মহাকাশযানে করে আমাদের সোলার সিস্টেমের এক গ্রহ থেকে আরেকগ্রহে যেতে পারছি। কিন্তু আমরা যদি অন্য গ্যালাক্সিতে যাত্রা করতে চাই, তাহলে সেটাতে লক্ষ লক্ষ বছর অথবা তার চাইতেও বেশি সময় লাগবে।
এখানেই কাজে আসে ওয়ার্মহোল। ওয়ার্মহোল Space Time এর মধ্যে একটা টানেল এর মতো তৈরী করে।
মনে করুন, একটা ফুটবল মাঠের একপ্রান্তের গোলবার এ আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, আরেকপ্রান্তের গোলবার এ দাঁড়িয়ে আছে আপনার বন্ধু। এখন আপনি যদি দৌড় দিয়ে আপনার বন্ধুর কাছে যেতে চান তাহলে বেশ সময় লেগে যাবে। তবে এখন যদি আমি ফুটবল মাঠটাকে মাঝ বরাবর ভাঁজ করি এবং একটা গোলবারের নিচে একটি গর্ত বা টানেল তৈরী করে দেই, তাহলে আপনি নিমেষেই সেই গর্তে লাফ দিয়ে অপর গোলবারে সেই বন্ধুর কাছে পৌঁছে যাবেন। এটাই হচ্ছে ওয়ার্মহোল।
তেমনি Space Time নামক অসীম সাইজের একটা ফুটবল মাঠের মধ্যে অবস্থান করছে সবগুলো গ্যালাক্সি। আমরা যদি এমন একটা ওয়ার্মহোল বা গর্ত ব্যবহার করি যেটার এক প্রান্তে আছে আমাদের গ্যালাক্সি এবং অপর প্রান্তে আছে অন্য একটি গ্যালাক্সি… তাহলে নিমেষেই আমরা আমাদের গ্যালাক্সি থেকে সেই অপর গ্যালাক্সিতে প্রবেশ করতে পারব। লক্ষ বছরের পথ পাড়ি দেয়া লাগবে না। ]
____________
আচ্ছা এখন সিনেমার গল্পে ফিরে আসা যাক।
শনি গ্রহের পাশে নাসা একটি ওয়ার্মহোলের সন্ধান পেলেও কে বা কারা এই ওয়ার্মহোল সৃষ্টি করেছে তারা জানে না।
হয়তো অন্য জগতের কোন সত্ত্বার কাজ এটি! এই সত্ত্বারাই যেন অন্য কোন জগত থেকে নাসাকে ডিরেকশন দিয়ে যাচ্ছে, সাহায্য করে যাচ্ছে… যাতে কোনমতে পৃথিবীর মানুষদের বিলুপ্ত হওয়া আটকানো যায়! এই সত্ত্বারাই হয়তো মার্ফের বইয়ের লাইব্রেরীর মাধ্যমে নাসার হেডকোয়ার্টারের লোকেশন কুপারকে জানায়। যাতে কুপারও নাসার ভবিষ্যত মিশনের অংশীদার হতে পারে।
তবে এই সত্ত্বা কে বা কারা সেটা নিয়ে গবেষণা করার সময় এখন নাসার নেই। Lazarus(মৃত্যুঞ্জয়ী) মিশন কে সাকসেসফুল করাটাই এখন মুখ্য উদ্দেশ্য তাদের। এই মিশন শুরু হয়েছিল দশ বছর আগেই!
১০ বছর আগে এই ওয়ার্মহোলে ১২ টা রেঞ্জার(মহাকাশযান) পাঠিয়েছিল তারা। ১২ টা রেঞ্জারে ছিল ১২ জন নভোচারী এবং তাদের গন্তব্যস্থল ছিল ওয়ার্মহোল ভেদ করে সেই নতুন গ্যালাক্সির ১২ টি ভিন্ন ভিন্ন গ্রহ।
উদ্দেশ্য হল যদি এই ১২ টি গ্রহের কোনোটি মানুষের বসবাসের জন্য যদি উপযুক্ত হয় তাহলে নভোচারীরা নাসাকে সেই গ্রহ থেকে সংকেত পাঠাবে।
ল্যাজারাস মিশনের প্রথম অংশ সাকসেসফুল ছিল। ১২ টি গ্রহের মধ্যে তিনটি গ্রহ থেকে পজিটিভ সিগন্যাল পাওয়া যায়। ১২ জন নভোচারীর মধ্যে ড. মিলার, ড. ম্যান এবং ড.এডমন্ড পজিটিভ সিগন্যাল পাঠান।
এইবার নাসার ল্যাজারাস মিশনের দ্বিতীয় ধাপ শুরুর পালা। এই দ্বিতীয় ধাপ শুরুর আগেই কুপার আর মার্ফ সেই গোপন হেডকোয়ার্টারের সন্ধান পেয়েছিল।
দ্বিতীয় ধাপে আবার কিছু নভোচারী পাঠাতে হবে সেই নতুন গ্যালাক্সিতে। তারা পজিটিভ সিগ্নাল আসা তিনটি গ্রহের মধ্যে যে কোন একটিকে মানব জাতির নতুন ঠিকানা হিসেবে বেছে নেবে। তারপর তারা ফিরে এলে, পৃথিবীর সব মানুষ সমেত উড়াল দেয়া হবে সেই নতুন গ্রহের উদ্দেশ্যে। তবে এক্ষেত্রে কিছু ঝামেলাও আছে। এতো মানুষ নিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করতে গেলে, গ্র্যাভিটিকে পরাভূত করতে হবে।
এই গ্র্যাভিটিকে পরাভূত করার জন্যই এক জটিল ইকুয়েশন সলভ করছেন বৃদ্ধ ড.ব্র্যান্ড। তার বিশ্বাস নভোচারীদের ফিরে আসার আগেই সে এই ইকুয়্যেশন সলভ করবে। এজন্য দু’টি প্ল্যান করা হয়:
Plan A: যদি ড. ব্র্যান্ড এই ইকুয়েশন সলভ করতে পারেন অর্থাৎ সত্যি সত্যিই গ্র্যাভিটিকে হার মানাতে পারেন, তাহলে মানুষ সমেত নতুন গ্রহে যাওয়া হবে। এজন্য বিশাল স্পেস স্টেশনও তৈরী করে রাখা আছে।
Plan B: কিন্তু যদি ড. ব্র্যান্ড এই ইকুয়েশন সলভ করতে না পারেন তাহলে নভোচারীরাই হবেন মানব জাতির ভবিষ্যত। তারা নিজেদের সাথে বেশ কিছু সংখ্যক মানব ভ্রূণ নিয়ে যাবেন.. আর তারাই তৈরী করবে কলোনি। পৃথিবীর বর্তমান মানুষরা টিকে না থাকলেও দূরে কোথাও টিকে থাকবে মানবজাতি।
তো নতুন এই প্রোজেক্টের নাম দেয়া হল প্রোজেক্ট “এন্ডুরেন্স”।
এন্ডুরেন্স হচ্ছে একটি বিশাল স্পেসশিপ যা প্রতিনিয়ত ঘুরতে থাকে, যাতে সে কৃত্রিমভাবে পৃথিবীর মতো গ্র্যাভিটি তৈরী করতে পারে। এই এন্ডুরেন্সের সাথে ডক(পার্ক) করা থাকে রেঞ্জার-১, রেঞ্জার-২, ল্যান্ডার-১, ল্যান্ডার-২ নামের স্পেসক্রাফটগুলো। রেঞ্জার আর ল্যান্ডার দিয়ে বিভিন্ন গ্রহে অবতরণ করা হয় । অর্থাৎ এন্ডুরেন্স হচ্ছে একটা ভ্রাম্যমাণ পার্কিং স্টেশনের মতো।
তো যাইহোক এন্ডুরেন্স মিশনের নভোচারীরা হল,
কুপার, এমিলিয়া, ডয়েল এবং রমিলি। নেতৃত্বে আছে.. কুপার নিজেই। ড.এমিলিয়া হল ড. ব্র্যান্ড এর মেয়ে। সাহায্যকারী হিসেবে দুটি রোবটও আছে, কেইস এবং টার্স। আমার গল্প বলার সুবিধার্থে এদের ছয়জনের নাম দিচ্ছি ‘টিম এন্ডুরেন্স’।
কুপারের এই মিশনে যাওয়াতে মার্ফ খুবই মর্মাহত হয় এবং সে ঠিকভাবে তার বাবাকে বিদায়ও জানায় না। বাবা-মেয়ের এই বিচ্ছেদ পুরো ফিল্ম জুড়েই অনেক ইমোশনাল মোমেন্ট তৈরী করেছে যা ইন্টারস্টেলারকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে।
টিম এন্ডুরেন্স সফলতার সাথেই ওয়ার্মহোল ক্রস করল, অন্য গ্যালাক্সিতে গেল এবং এইবার গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিতে প্রকট হল আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি!
নতুন যেই গ্যালাক্সিতে তারা প্রবেশ করল সেখানে রয়েছে একটা ব্ল্যাকহোল। ব্ল্যাকহোলটির নাম গার্গ্যাঞ্চুয়া। সমস্যা টা হচ্ছে যেই তিনটা প্ল্যানেট তাদের ভ্রমণ করার কথা তিনটিই গার্গ্যাঞ্চুয়ার দিগন্তরেখা(সীমানা) এর আশেপাশেই।
আর এক্ষেত্রে তাদের সবথেকে বড় শত্রু হল সময়!
ব্ল্যাকহোল হচ্ছে এমন একটা জিনিস, যেখানে গ্র্যাভিটি অনেক অনেক বেশি থাকে। এতোটাই বেশি যে সে সবকিছুকেই সে নিজের ভেতরে গ্রাস করে নেয় এবং সেখান থেকে আলোও বের হতে পারে না।
অপরদিকে, সময় আর গ্র্যাভিটি অনেকটা স্রোতস্বিনী নদী আর নৌকার মতো বিপরীত।
আপনি যদি অনেক বেশি স্রোতের বিপরীতে নৌকা বাইতে যান, তাহলে অবশ্যই নৌকাটা অনেক ধীর গতিতে চলবে। তেমনি যে স্থানে অনেক বেশি গ্র্যাভিটিতে থাকে সেখানে সময় অত্যন্ত ধীরে প্রবাহিত হয়। ব্ল্যাকহোলে কাটানো কিছু মুহূর্ত, পৃথিবীতে কাটানো কয়েক বছরের সমান।
এইজন্যই টিম এন্ডুরেন্স বিপদে পড়ে যায়। ডা.মিলারের প্ল্যানেটটি ব্ল্যাকহোল গার্গ্যাঞ্চুয়ার দিগন্তরেখার সবচাইতে কাছাকাছি হওয়ায়, সেখানে কাটানো একটা ঘন্টা পৃথিবীর সাত বছরের সমান।
তবুও মিশনের স্বার্থে কুপার, এমিলি ও ডয়েল রেঞ্জারে করে পাড়ি জমায় ড.মিলারের প্ল্যানেটে। রমিলি থেকে যায় এন্ডুরেন্সেই।
তারা তিনজন মিলারের প্ল্যানেটে পৌঁছে দেখে সেখানে শুধু পানি আর পানি। স্পেসক্রাফট আর রাডারের কিছু ভাঙা অংশও দেখতে পায় তারা।
তবে হঠাৎ বিশাল একটা জলস্রোত ভেসে আসে তাদের দিকে। প্রাণ হারায় ডয়েল। কুপার আর এমিলিয়া কোনমতে বেঁচে গেলেও পানির ওভারফ্লো তে ইঞ্জিন কাজ করা বন্ধ করে দেয় রেঞ্জারের। তারা বুঝতে পারে জীবনের মূল্য দিয়েও হয়তো এই মিশন সাকসেসফুল করা সম্ভব হবে না। আরও কিছু নির্মম সত্য প্রকাশিত হয় তাদের কাছে।
সময়ের আপেক্ষিকতার কারণে তারা পৃথিবীতে বছরের পর বছর ধরে ড. মিলারের সংকেত পেয়ে আসছিল। কারণ এই গ্রহের এক ঘন্টা পৃথিবীর সাত বছরের সমান। ড. মিলার হয়তো কিছুক্ষণ আগেই মারা গিয়েছেন। সিগন্যালও পাঠিয়েছেন কিছুক্ষণ আগেই। আর সেটাকে নাসা ভেবেছে যে, “কয়েক বছর ধরে ডা. মিলার সিগন্যাল পাঠাচ্ছেন।”
কারণ এই গ্রহে এক ঘন্টা ধরে যেই সিগন্যাল দেয়া হবে, পৃথিবীতে সেই সিগন্যাল পাওয়া যাবে টানা সাত বছর।
তো যাইহোক, পানি ঝড়িয়ে রেঞ্জারের ইঞ্জিন রিস্টার্ট হতে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা লেগে যায় এবং এন্ডুরেন্সে ফিরে কুপার এবং এমিলিয়া বুঝতে পারে যে সেখানে ২৩ বছর কেটে গেছে! অর্থাৎ তাদের জীবনের গত তিন ঘন্টা, এন্ডুরেন্সে অবস্থান করা রমিলির জীবনের ২৩ বছরের সমান! রমিলির দাঁড়ি পেকে গিয়ে রীতিমতো বুড়ো হয়ে গেছে সে।
কুপার গত ২৩ বছরের ভিডিও ম্যাসেজ গুলো দেখে জানতে পারে যে তার ছেলে টম এর বৌ-বাচ্চা হয়ে গেছে, মার্ফ এর বয়স হয়ে গেছে তার বয়সের সমান। এসময় ম্যাথিউ ম্যাককনাহে এর অনবদ্য অভিনয় দেখা যায়।
নিজের সন্তানদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো কুপার দেখতে পারল না বেঁচে থেকেও! এই কষ্ট যে একজন বাবার জন্য কতোটা তীব্র তা কুপারের এক্সপ্রেশনগুলোতে, কান্নামাখা হাসিগুলোতে নির্মমভাবে ফুটে ওঠে।
আইনস্টাইন হয়তো উপর থেকে তখন এসব দেখে দুষ্টু হাসি হাসছিলেন। তখন কী তার চোখেও দু’ফোঁটা অশ্রু এসেছিল?
এবার এন্ডুরেন্সে আর খুব বেশি জ্বালানি অবশিষ্ট নেই। থাকবেই বা কেন? গত ২৩ বছর ধরে প্রতিনিয়ত ঘুরে চলেছে সে।
আরও দুইটি গ্রহ পরীক্ষা করা বাকি।
ড. ম্যান এর গ্রহ এবং ড. এডমন্ডের গ্রহ। তবে ফুয়েল আছে মাত্র একটিতে যাওয়ার। তাই কুপার, এমিলিয়া ও রমিলি কে চুজ করতে হবে। এখানে বলে নেই যে, ড.এডমন্ড আর ড. এমিলিয়া একে অপরকে ভালোবাসত।
স্বভাবতই এমিলিয়া চাচ্ছিল এডমন্ডের গ্রহে যেতে। কিন্তু কুপার এটাতে রাজি হতে চায় না।
সে বলে, “তুমি এডমন্ডকে ভালোবাসো, তাই এক্ষেত্রে তোমার মন এডমন্ডের প্রতি সারা দিচ্ছে। তোমার ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে আমরা কোন ডিসিশন নিতে পারিনা।”
এরপর এমিলিয়া খুবই অর্থবহ কিছু কথা বলে। তার মতে,
ভালোবাসা এই বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোর চাইতেও অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। আমরা মৃত মানুষদেরও ভালোবাসি, তারা মৃত জেনেও তাদের একবার দেখার জন্য পাগল হয়ে যাই। ডা. এমিলিয়াও শুধুমাত্র তার ভালোবাসার টানেই মহাকাশযাত্রা করে এতোদূর এসেছে। হয়তো ভালোবাসার এমন কোন অর্থ আছে যেটা মানুষ এখনও বের করতে পারেনি। ভালোবাসাই হচ্ছে এমন একটা জিনিস যেগুলো স্পেস-টাইমের জটিল ডাইমেনশন গুলো দিয়ে যাত্রা করতে পারে। ঘটাতে পারে মানুষে মানুষে কানেকশন। তাই এমিলিয়ার ইচ্ছা করছে তার হৃদয়ের ডাক শুনতে। ইচ্ছা করছে ড. এডমন্ডের গ্রহে পাড়ি জমাতে।
কুপার আর রমিলি এগুলো শুনে কিছুক্ষণের জন্য ইমোশনাল হয়ে গেলেও, শেষ পর্যন্ত এগুলোকে পাত্তা দেয় না। তারা ড. ম্যান এর প্ল্যানেটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কারণ তারা বিশ্বাস করতো ড. ম্যান হচ্ছে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মহাকাশচারী। তাঁর ভুল হবার কথা না।
রেঞ্জার-১ ও ল্যান্ডার-১ নিয়ে তারা ড. ম্যানের প্ল্যানেটে অবতরণ করল। নিদ্রা থেকে ড. ম্যান কে জাগিয়ে তোলা হল।
ড. ম্যান শোনালেন আশার বাণী! তার মতে এই প্ল্যানেট মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত। একটু নিচে গেলেই এখানে সার্ফেস পাওয়া যায়। নিঃশ্বাস নেয়ার মতো বাতাস পাওয়া যায়। এই প্ল্যানেটই হবে মানবজাতির নতুন ঠিকানা।
____________
এবার আবার পৃথিবীর ঘটনায় ফিরে আসি।
কুপারের মেয়ে মার্ফ হয়ে গেছে একজন সাইন্টিস্ট। সে ড. ব্র্যান্ডের সাথে সেই গ্র্যাভিটির ইকুয়েশনটা সলভ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। যাতে পৃথিবী ধ্বংস হবার আগেই মানুষকে নিয়ে স্পেস এ পাড়ি দেয়া যায়। গ্র্যাভিটিকে পরাভূত করা যায়।
ড. ব্র্যান্ড তার মৃত্যুশয্যায় কিছু কনফেশন দিয়ে যান মার্ফের কাছে।
তিনি স্বীকার করেন যে, এই ইকুয়েশনের রেজাল্ট আসলে ভুল আসে সবসময়। সময়কে মাত্রা হিসেবে ধরে তিনি অনেক আগেই এই ইকুয়েশন সলভ করে ফেলেছেন। আর রেজাল্ট অনুযায়ী এই গ্রাভিটিকে পরাভূত করা সম্ভব না। যদি ইকুয়েশনের রেজাল্ট পজিটিভ আনতে হয় তাহলে কিছু কোয়ান্টাম ডাটা প্রয়োজন। এই ডাটা শুধুমাত্র ব্ল্যাকহোলের ভেতরেই পাওয়া সম্ভব, তাছাড়া নয়! তবে ব্ল্যাকহোলের ভেতরে এই ডাটা কালেক্ট করে ফিরে আসা অসম্ভব। সেখানে আলো-ই সুবিধা করতে পারে না। মানুষ কীভাবে করবে?
অর্থাৎ প্ল্যান A কখনই কার্যকর হতে পারবেনা। প্ল্যান B ই ছিল নাসার একমাত্র প্ল্যান। পৃথিবীর মানুষদের রক্ষা করতে না পারলেও মানবজাতিকে রক্ষা করাই ছিল নাসার উদ্দেশ্য। অন্য কোন গ্রহে মানুষের কলোনি গড়ে তোলাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
মার্ফ এটা শুনে একদম ভেঙে পড়ে। তার মনে হয়, কুপার তাদেরকে একা ফেলে চলে গেছে। সে রাগে ক্ষোভে একটা ভিডিও বার্তা পাঠায় এন্ডুরেন্সে। ড. ব্র্যান্ড যে আসলে পৃথিবীর মানুষদেরকে বাঁচানোর কোন প্ল্যানই করেননি এটা জানায় সে ভিডিও বার্তায়। তার পাশাপাশি নিজের বাবা কুপারকেও তিরষ্কার করে।
_________________
কুপার, এমিলিয়া আর রমিলি তখন ড. ম্যানের গ্রহে। মার্ফের পাঠানো এই ভিডিওবার্তা তাদের কাছেও বজ্রপাতের মতোই আঘাত হানে।
কুপার বিশ্বাস করতে পারে না যে সে আসলে তার ছেলে আর মেয়েদেরকে একা ফেলে এসেছে। সে তাদেরকে চাইলেও হয়তো আর বাঁচাতে পারবে না। প্ল্যান A কখনই কার্যকর হবার নয়, প্ল্যান B ই একমাত্র উপায়।
তাই সে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেন মরলেও সে তার সন্তানদেরকে সাথে নিয়েই মরবে। তার সন্তানরা যেন কখনও না ভাবে যে কুপার তাদেরকে একা ফেলে চলে এসেছে।
এবার ড. ম্যানের আসল রূপ প্রকাশ পায়। আসলে ড. ম্যানের প্ল্যানেটে নিঃশ্বাস নেবার মতো বাতাস কিংবা বসবাসের জন্য মাটি… কোনটাই ছিল না। সে মিথ্যা বলেছিল। সে শুধু এইজন্যই পজিটিভ সিগন্যাল পাঠিয়েছিল যাতে কোন এক সময় নভচারীরা তাকে বাঁচাতে আসে। উদ্দেশ্য ছিল সেই নভোচারীদের মেরে ফেলে তাদের রেঞ্জার নিয়ে সেই গ্রহ ছেড়ে উড়াল দেবে ড. ম্যান।
সেই লক্ষ্যেই কুপারের ওপর হামলা করে সে। তাকে মেরে ফেলতে যায়। অপরদিকে ড. ম্যানেরই প্ল্যান করা এক বিষ্ফোরণে মৃত্যু ঘটে রমিলির। কুপার কোনমতে বেঁচে যায়। এমিলিয়া তাকে উদ্ধার করে।
তবে ড. ম্যান একটি রেঞ্জার নিয়ে পালিয়ে যায়। ল্যান্ডারে করে তার পিছু নেয় কুপার ও এমিলিয়া। ম্যানের লক্ষ্য হল এন্ডুরেন্সের সাথে ডক করা এবং এন্ডুরেন্সের কন্ট্রোল নিয়ে নেওয়া। তবে ডক করার জন্য যেই কোডের প্রয়োজন সেই কোড ড. ম্যানের জানা নেই। তাই সে ম্যানুয়ালি ডক করতে যায়। এটিতে এয়ার প্রেশারের তারতম্য ঘটে এবং বিষ্ফোরণে মারা যায় ড. ম্যান!
ওদিকে কোনমতে ল্যান্ডার নিয়ে এন্ডুরেন্সে ডক করতে সফল হয় কুপার ও এমিলিয়া। এবার পড়তে হয় আসল বিপদে। বিষ্ফোরণের কারণে জ্বালানি তো নষ্ট হয়েছেই… সাথে সাথে নষ্ট হয়ে গেছে নেভিগেশন সিস্টেম। পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার মতো জ্বালানি তো অবশিষ্ট নেই- ই, জ্বালানি নেই ড. এডমন্ডের প্ল্যানেটে যাবার মতোও!
এবার কুপার প্ল্যান করে ব্ল্যাকহোলের গ্র্যাভিটি কে কাজে লাগানোর।
যেহেতু গার্গ্যাঞ্চুয়ার গ্র্যাভিটি এতোটাই বেশি যে সে যেকোন কিছুকে নিজের দিকে টেনে নিতে পারবে… তাই ইঞ্জিনের ফুয়েল খরচ না করে “গ্র্যাভিটেশনাল স্লিংশট” এর মাধ্যমে ব্ল্যাকহোলের দিগন্ত রেখার কাছে যাওয়া সম্ভব। যেমন, একটা ক্রিকেট বলকে নিচে ফেলে দিলে সে গ্র্যাভিটির টানে আপনা আপনিই নিচে পড়ে যায়। তেমনি ব্ল্যাকহোলের গ্র্যাভিটির টানে এন্ডুরেন্স আপনা আপনিই ব্ল্যাকহোলের দিকে ধাবিত হবে। গার্গ্যাঞ্চুয়াই তাকে টেনে নিবে। কোন ফুয়েল লাগবে না।
তবে ব্ল্যাকহোলের একেবারে ভেতরে তো প্রবেশ করা যাবে না। তাহলে তো বের হওয়া অসম্ভব। কুপার প্ল্যান করে, ব্ল্যাকহোলের সীমানার কাছাকাছি আসতেই ল্যান্ডার-১ আর রেঞ্জার-২ এর রকেট বুস্টার ব্যবহার করে তারা ব্ল্যাকহোলের গ্র্যাভিটির টানকে ছিন্ন করে ড. এডমন্ডের প্ল্যানেটের দিকে পাড়ি জমাবে। মানে ব্ল্যাকহোলের ভেতরে প্রবেশের আগেই বের হয়ে আসবে সেখান থেকে। এতে অনেক ফুয়েল বেঁচে যাবে।
___________
একটু পরিষ্কার করি বিষয়টা।
মনে করুন পাহাড়ী ঢালু রাস্তার উপরে আপনি মালামাল ভর্তি ট্রাক নিয়ে যাত্রা করছেন। এখন সেই ট্রাকের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেও তো গাড়ি আপনা আপনিই নিচে নামবে। কোন তেল খরচ করতে হবে না। গ্র্যাভিটিই আপনাকে নিচে নিয়ে যাবে। ইঞ্জিন বন্ধ করে ঢালু রাস্তা বরাবর নিচে নামতে নামতে হঠাৎ আপনি দেখলেন সামনে একটা খাদ। খাদে তো পড়া যাবে না। এখন তো আপনাকে উপরে উঠতে হবে। উঠার জন্য আপনাকে পূর্ণ শক্তিতে ইঞ্জিন চালু করতে হবে এবং ট্রাকের মালামালও কিছুটা ফেলে দিতে হবে যাতে উপরে উঠতে পারেন। কারণ মাল ভর্তি ট্রাক নিয়ে গ্র্যাভিটির বিপরীতে ভ্রমণ করা অনেক কষ্টকর।
____________
এখন আপনার ট্রাকটিকে চিন্তা করুন এন্ডুরেন্স হিসেবে। আপনার মালামালগুলোকে চিন্তা করুন রেঞ্জার-২, ল্যান্ডার-১ এবং ল্যান্ডার-২ হিসেবে।
আর ব্ল্যাকহোল গার্গ্যাঞ্চুয়াকে চিন্তা করুন ট্রাকের সামনের খাদ হিসেবে।
খাদের সীমানা পর্যন্ত তো আপনি আসলেন, এবার তো আপনাকে উপরে উঠতে হবে। মানে গার্গ্যাঞ্চুয়ার সীমানা বরাবর আসলেন, এবার তো আপনাকে গ্র্যাভিটির টান ছিন্ন করে.. অন্যদিকে যাত্রা করতে হবে। ডা. এডমন্ডের প্ল্যানেটের দিকে যেতে হবে।
এন্ডুরেন্স যদি গার্গ্যাঞ্চুয়ার গ্র্যাভিটিকে জয় করতে চায় তাহলে তাকে দুইটা জিনিস করতে হবে..
১/ রেঞ্জার আর ল্যান্ডার কে রকেট বুস্টার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। যাতে গ্র্যাভিটির বিপরীতে পুরো এন্ডুরেন্স মোমেন্টাম তৈরী করতে পারে। (যেমনটা আপনি ট্রাকের ইঞ্জিনের পুরো ক্ষমতা দিয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন)
২/ আপনি যেমন ট্রাকের মাল ফেলে দিয়েছিলেন এবার এন্ডুরেন্সকেও অনেক কিছু ফেলে দিতে হবে। এতো ভর নিয়ে গ্র্যাভিটির টান ছিন্ন করা যাবে না। এইজন্য কুপারের নির্দেশে টার্স রোবটটি ল্যান্ডার-১ নিয়ে এন্ডুরেন্স থেকে আলাদা হয়ে যায়।
এবার ড. এমিলিয়াকে অবাক করে দিয়ে, কুপারও রেঞ্জার-২ নিয়ে আলাদা হয়ে যায় এন্ডুরেন্স থেকে।
ল্যান্ডার-১ এর টার্স এবং রেঞ্জার-২ এর কুপার দুইজনই ব্ল্যাকহোল গার্গ্যাঞ্চুয়ার ভেতরে প্রবেশ করে। The ultimate sacrifice!
কুপারের উদ্দেশ্য ছিল একটাই। ড.এমিলিয়া যাতে তার ভালোবাসার ড.এডমন্ডের সাথে একবার দেখা করতে পারে!
অসীম অন্ধকারে পতিত হতে থাকে কুপার!
সে ভাবে এটাই হয়তো তার জীবনের শেষ কিছু মুহূর্ত। সে মনে হয় ব্ল্যাকহোলের ভেতরে প্রবেশ করতে চলেছে!
এরপর হঠাৎ সে একটা অদ্ভুত জায়গায় চলে আসে।
এই জায়গা ব্যাখ্যা করার আগে আমি ডাইমেনশন নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই!
_________________
আমরা এখন তিন ডাইমেনশনের জগতে বসবাস করি।
জিরো/শুণ্য ডাইমেনশন হচ্ছে যার কোন মাত্রা নাই। যেমন: একটা বিন্দু!
ফার্স্ট ডাইমেনশন সেই ছোট ছোট বিন্দুগুলো পাশাপাশি বসালে পাওয়া যায়। যেমন:একটা রেখা।
সেকেন্ড ডাইমেনশন হচ্ছে, রেখাগুলো পাশাপাশি বসালে একটা তল পাওয়া যাবে, সেটা। মনে করেন একটা সাদা কাগজ।
আর থার্ড ডাইমেনশন হচ্ছে অনেকগুলো তল কে একটির উপর আরেকটি করে সাজালে যেটা পাওয়া যাবে সেটা। যেমন অনেকগুলো কাগজ একটার উপর একটা করে রাখলে ঘনকের মতো তৈরী হয়ে যায়। মানে 3D ব্যাপার আরকি!
এই থার্ড ডাইমেনশন কে আমরা বলি স্পেস।
আমাদের চারপাশে যাই আচ্ছে সেটাই হচ্ছে স্পেস।
গাছপালা থেকে শুরু করে.. গ্রহ নক্ষত্র সবই স্পেস এর অংশ।
ফিজিক্স বলে, আমরা যতো ডাইমেনশনে বসবাস করি, দেখতে পাই তার থেকে এক ডাইমেনশন কম! মানে আমরা 3D জগতে বাস করি। কিন্তু দেখতে পাই 2D!
এই যে গাছ গাছালি সহ যা ই আমরা দেখিনা কেন আমরা কিন্তু তার ভেতরে দেখতে পারি না। দেখতে পারি শুধু তার বাইরের তল।
একটা ঘনকের দিকে তাকালেও আপনি শুধু তার তলগুলোই দেখতে পারবেন। ভেতরের 3D অবস্থা দেখতে পারবেন না।
যদি আমরা চারটা ডাইমেনশনের জগতে বাস করতাম তখন হয়তো সবকিছু থ্রিডি দেখতে পারতাম!
_______________
তো যাই হোক, কুপার যেই জায়গায় প্রবেশ করে সেটা হল এক ধরনের টেস্যার্যাক্ট!
এখন প্রশ্ন আসবে টেস্যার্যাক্ট কি জিনিস!
একটা রেখা যদি 1D হয়, বর্গক্ষেত্র হয় 2D এবং ঘনক যদি তার 3D অবস্থা হয়, তাহলে টেস্যার্যাক্ট হল তার 4D অবস্থা! মার্ভেলের এভেঞ্জার্স মুভিতেও আমরা টেস্যার্যাক্ট দেখতে পাই।
এখানে ফোর্থ ডাইমেনশন হিসেবে টাইম কে কল্পনা করা হয়েছে!
তো যাই হোক, কুপার চলে আসল সেই টেসার্যাক্ট এর ভেতরে। তার সাথে আছে রোবট টার্স। এটা আসলে একটা ইন্টার ডাইমেনশনাল লাইব্রেরী। সে কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারল সে আসলে মার্ফের ঘরের যে বইয়ের সেল্ফটির ভেতরের দিকে আছে!
বইগুলোর মাঝ দিয়ে সে অপরপ্রান্তে ছোট্ট মার্ফ কে দেখতে পাচ্ছে। যেন সে সময়ের মধ্য দিয়ে যাত্রা করছে! যেন সে অতীতে ফিরে গেছে!
সে বুক শেল্ফের অপরপ্রান্তে নিজেকেই দেখতে পারছে, নিজের অতীতকে দেখতে পারছে। দেখতে পারছে যে কুপার মার্ফ কে ছেড়ে এই মিশনে যাচ্ছে।
সে চিৎকার করে বলতে চাইল যাতে কুপার মিশনে না যায়! যাতে মার্স কে ছেড়ে না দেয়!
কিন্তু অন্য প্রান্তের কুপার আর মার্ফ তার ডাক শুনতে পায় না!
সে মোর্স কোডের মাধ্যমে বইগুলো ফেলে দিয়ে একটা বার্তা দেয়,
“STAY”
কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয় না!
কিন্তু সে সময় টার্স কিছু বিষয় উপলব্ধি করে এবং বলে, “সেই অদৃশ্য সত্ত্বারাই আমাদেরকে এখানে এনেছে। তারা পাঁচটা ডাইমেনশনে চলাফেরা করতে পারে। তারাই কুপারের সাথে মার্ফের কানেকশন ঘটিয়েছে এই ইন্টার ডাইমেনশনাল লাইব্রেরীর মাধ্যমে। তারাই আমাদের ব্ল্যাকহোলে পতিত হতে দেয়নি, নিয়ে এসেছে এই টেস্যার্যাক্ট এর ভেতরে। তারা নিশ্চয়ই আমাদেরকে অতীতকে পরিবর্তন করতে পাঠায়নি। বরং আমাদেরকে এখানে পাঠানো হয়েছে ভবিষ্যতে ভূমিকা রাখতে। আবার এই সত্ত্বারাই শনি গ্রহের কাছে সেই ওয়ার্মহোলটি বানিয়ে রেখেছিল। যাতে এই মিশনগুলো সাকসেসফুল হতে পারে।”
কুপার বুঝতে পারে সে এখন যেই জায়গায় আছে তা দেখতে 3D হলেও এটি আসলে 5D এর মানুষদের দ্বারা তৈরী। সেই অদৃশ্য সত্ত্বা আসলে আর কেউ নয়। তারা মানুষেরই উত্তরসূরী। আমাদেরই ভবিষ্যত প্রজন্ম।
এরা পাঁচটা ডাইমেনশনে বিচরণ করতে শিখে গেছে এবং এই মহাজগতের অনেক রহস্যই উদ্ধার করতে পেরেছে।
তারা যে কোন সময়ের সাথে, যে কোন স্থানের সাথে অন্য স্থানের কানেকশন ঘটাতে পারে ঠিকই, কিন্তু অতীতের মানুষদের সাথে কমিউনিকেট বা যোগাযোগ করতে পারে না!
কুপারকে এজন্যই এখানে আনা হয়েছে। যাতে সে মার্ফের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। যাতে কোয়ান্টাম তথ্যগুলো মার্ফের কাছে পৌঁছাতে পারে।
শব্দ কখনও এক ডাইমেনশন থেকে আরেক ডাইমেনশনে যেতে পারে না। তাই কুপার চিৎকার করলেও অপর প্রান্তের মার্ফ তা শুনতে পাচ্ছিল না।
হঠাৎ করেই সব রহস্য কুপারের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়! এই লাইব্রেরীটা আসলে একটা টাইমলাইন এর মতো। এখানে সময় আরেকটা ফিজিক্যাল ডাইমেনশনের মতো। সে চাইলে অতীতের ঘটনাগুলোও দেখতে পারবে, চাইলে দেখতে পারবে ভবিষ্যতও!
সে এটিও বুঝতে পারে বিভিন্ন ডাইমেনশনের মধ্যে শুধু একটা জিনিসই বিচরণ করতে পারে। সেটা হচ্ছে গ্র্যাভিটি! তাই চিৎকার করে নয়, তাকে যোগাযোগ করতে হবে গ্র্যাভিটির মাধ্যমে।
তাই প্রথমে সে আরও অতীতে যায়, অতীতে গিয়ে ধুলিঝড়ের মধ্যে গ্র্যাভিটিকে ব্যবহার করে বাইনারি নাম্বার দিয়ে দেয় অপর প্রান্তে সে নাসার হেডকোয়ার্টারের কো অর্ডিনেট গুলো পাঠায়। এরফলে অপরপ্রান্তের কুপার সেটি ডিকোড করে নাসার হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ কুপার নিজেই নিজের পথপ্রদর্শক ছিল।
এবার সে চলে যায় ভবিষ্যতে। সে দেখে মার্ফ বড় হয়ে গেছে। সে ড. ব্র্যান্ডের ইকুয়েশন সলভ এর প্রাণপন চেষ্টা করছে.. কিন্তু পারছে না। তার দরকার ব্ল্যাকহোলের ভেতরের কোয়ান্টাম ডাটা।
টেস্যার্যাক্ট এর ভেতরে থাকা কুপার টার্স কে সেই ডাটা মোর্স কোডে কনভার্ট করতে বলে। তারপর সেই বুক শেলফে থাকা ঘড়ির সেকেন্ডের কাটায় কুপার মোর্স কোডের মাধ্যমে কোয়ান্টাম ডাটা গুলো এনকোড করে দেয়!
অপরদিকে মার্ফও বুঝে ফেলে, তার রুমের ভূত আর কেউ নয়, সেটা তার বাবা কুপার নিজেই। তাই সে বড় হয়ে আবার তার রুমে ফিরে যায় এবং বাবার দেয়া ঘড়িটা নিয়ে আসে। ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা থেকে সে মোর্স কোডটি ডিকোড করে ফেলে এবং কোয়ান্টাম ডাটা পেয়ে যায়!
এই কোয়ান্টাম ডাটা দিয়ে সে সলভ করে ফেলে ড. ব্র্যান্ড এর ইকুয়েশন!
পৃথিবীর মানুষ জেনে যায় গ্র্যাভিটিকে কীভাবে পরাভূত করতে হবে! ধ্বংসের মুখে থাকা পৃথিবীকে ছেড়ে, গ্র্যাভিটিকে ছিন্ন করে মানুষ পাড়ি জমায় মহাশুণ্যে! বেঁচে যায় মানবজাতি!
এখন এখানে সবথেকে বড় একটা প্রশ্ন আসবে,
“ভবিষ্যতের মানবজাতি কীভাবে কুপারকে গাইড করল? যদি এই ইকুয়েশন সলভ না করে মানবজাতিকে বাঁচানো অসম্ভব ছিল.. তাহলে ভবিষ্যতের মানুষদের এক্সিস্টেন্সই তো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়! বর্তমানই যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে কিসের ভবিষ্যত?”
এই প্রশ্নের উত্তর মুভিতে ডিরেক্টলি দেয়া হয়নি! তবে এর উত্তর খুবই অনুমেয় এবং অনেক সাইন্স ফিকশনেই আমরা এটা দেখেছি!
সময় আর স্থান এখানে একটা “বুটসট্র্যাপ প্যারাডক্সের” মতো। অনেকটা “মুরগি আগে নাকি ডিম আগে” এর মতো ব্যাপারটা।
বুটসট্র্যাপ প্যারাডক্সের মতে, মুরগিই তার ডিমকে অতীতে পাঠায়, যাতে সেখান থেকে মুরগি তৈরী হতে পারে! মানে সময় এখানে একটা ফিজিক্যাল ডাইমেনশনের মতো।
আর আইনস্টাইন তো বলে গিয়েছেনেই, “একজন ফিজিসিস্টের কাছে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত সবকিছুই কানেক্টেড! সবকিছুই একই সাথে অবস্থান করে!
অর্থাৎ ভবিষ্যতের মানুষই অতীতের মানুষকে হেল্প করেছে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে! মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে।
তাহলে…
ইন্টারস্টেলার দেখে আপনার কী মনে হল? এই সাইন্টিফিক ইকুয়েশন, বিজ্ঞানের উৎকর্ষ, হাবিজাবি এগুলো মানব জাতিকে বাঁচিয়েছে?
নাহ! শেষ পর্যন্ত মানব জাতিকে বাঁচিয়েছে ভালোবাসা! বাবা ও মেয়ের ভালোবাসাই এখানে মুখ্য কারণ!
বাবা ও মেয়ের ভালোবাসার জন্যই ভবিষ্যতের মানুষরা সেই ছোট্ট মেয়ের লাইব্রেরীর সাথে টেস্যার্যাক্টের মাধ্যমে কুপারের কানেকশন ঘটায়! কারণ ঘড়িটা যদি বাবার শেষ স্মৃতি না হতো তাহলে কখনই মার্ফ সেটি নিজের সাথে রাখত না। মোর্স কোড পাঠানোও সম্ভব হতো না।
এমিলিয়া ব্র্যান্ড ঠিকই বলেছিল, ভালোবাসার একটি বৃহত্তর অর্থ আছে। যেটা আমরা এখনও অনুধাবন করতে পারিনাই! কখনও পারব কিনা এটাও জানি না!
তো শেষ পর্যন্ত সেই ভবিষ্যত মানুষরা কুপারকে এমন একটা জায়গায় রেখে দেয়, যাতে স্পেস স্টেশনে থাকা মানুষরা তাকে খুঁজে পায়!
কুপার শেষ পর্যন্ত ফিরে আসে সেই স্পেস স্টেশনে। যার নাম কুপার স্টেশন! তার মেয়ে মার্ফি কুপারের নামে নামকরণ করা হয়েছে স্টেশনটির।
এরপর আসে ফিল্মের সবচাইতে ইমোশনাল মুহূর্ত! বাবা আর মেয়ের দেখা হওয়া! মার্ফ এখন একদম বৃদ্ধ। যেন তার মৃত্যুশয্যায় আছে সে। আর কুপার এখনও আগের বয়সেই আছে!
সেই ব্ল্যাকহোলে গ্র্যাভিটেশনাল স্লিংশটের জন্য যেটুকু সময় লেগেছিল, পৃথিবীর মানুষদের কাছে সেটুকু সময়ে পেরিয়ে গেছে ৫১ বছর!
সময় কতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে, ভেবে দেখেছেন?
এখন শেষ প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে এই বিশাল পোস্টের ইতি টানব!
“ড. এমিলিয়া ব্র্যান্ডের কী হয়েছিল?”
উত্তর: ড. এমিলিয়া ব্র্যান্ড শেষ পর্যন্ত ড. এডমন্ডের গ্রহে পৌঁছাতে পেরেছিল। সেখানে পৌঁছে সে দেখল ড. এডমন্ড আর বেঁচে নেই। তবে সেই গ্রহে শ্বাস নেয়া যায়!আছে বসবাসের উপযুক্ত সার্ফেসও!
আর মুভির শেষে দেখা যায় যে ড. এমিলিয়ার উদ্দেশ্যে কুপার আবার যাত্রা করছে!
হয়তো সেই গ্রহটিই হতে যাচ্ছে মানবজাতির নতুন ঠিকানা। নতুন পৃথিবী!
IMDB Rating: 8.6
Personal Rating: <3
লেখক: অর্ঘ্য রায়