হ্যালুসিনেশন নামে একটা মানসিক রোগ (Disorder) আছে।
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এমন আজব আজব জিনিস দ্যাখে, বা শোনে, বা অনুভব করে, যা অন্য স্বাভাবিক মানুষরা দেখতে বা শুনতে পায়না।
হ্যালুসিনেশনের রোগীর লক্ষনের উপর নির্ভর করে Hallucination কে বেশ কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন–
১. ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন ( Visual Hallucination)
এই রোগ হলে রোগী চোখের সামনে ভূত পেত্নী জোম্বি ভ্যামপায়ার ওয়ারউল্ফ এলিয়েন লাইকেন এমনকি মৃত ব্যক্তিদের দেখা শুরু করে। অন্য সূস্থ মানুষরা এগুলা কিছুই দেখতে পায়না।
চঞ্চল চৌধুরী আর জয়া আহসান অভিনীত দেবী নামক সিনেমায় নায়িকা জয়ার ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন হত। সে জানালায় অচেনা এক তরুনকে দাড়িয়ে থাকতে দেখত। কিন্তু তার স্বামী,আনিস,কাউকে দেখতে পেত না।
ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন এর ক্ষেত্রে, রোগী যখন ভূত দেখা শুরু করে, তখন যদি মোবাইলের ক্যামেরায় রেকর্ড করার চেষ্টা করা হয়,তাহলে কিছুই ধরা পড়েনা। মানুষের চোখের ভুল হতে পারে,মানুষের ব্রেইন হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হতে পারে,কিন্তু ক্যামেরার তো হ্যালুসিনেশন হয়না। তাই ক্যামেরায় এসব ভূত পেত্নী ধরা পড়েনা
২. অডিটরি হ্যালুসিনেশন ( Auditory Hallucination)
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক গায়েবী আওয়াজ শুনতে পায়। আশেপাশের অন্যরা এসব শব্দ শোনেনা।
দেবী সিনেমায় রানু নুপুরের শব্দ শুনত, অর্থাত তার অডিটরি হ্যালুসিনেশন হত। আনিস বা অন্যরা এই শব্দ শুনতে পেত না।
আসলেই নুপুরের শব্দ হচ্ছে নাকি হ্যালুসিনেশন, এটা বোঝার জন্য মোবাইলে রেকর্ড করা যেতে পারে। রেকর্ডে যদি কোনো সাউন্ড শোনা না যায়, তাহলে ওটা অডিটরি হ্যালুসিনেশন ছিল।
৩. ট্যাকটাইল হ্যালুসিনেশন ( Tactile Hallucination)
এই রোগে আক্রান্ত রোগী আজব কোনো জিনিস তার স্কিনে অনুভব করে। ( যেমন- স্কিনের উপর সারাদিন ত্যালাপোকা হাটার ফিলিংস) আশেপাশের আর কেউ এমন কিছু ফিল করেনা।
চরম পর্যায়ে, রোগী মনে করে তার সাথে জিন/ভূত/পেত্নী/এলিয়েন/কোনো মৃত মানুষ এসে শারীরিক সম্পর্ক করছে। বা করার চেষ্টা করছে।
এটা ধরার খুব সহজ উপায় হচ্ছে, ফিংগারপ্রিন্ট টেস্ট। রোগীর শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্যাম্পল নিয়ে টেস্ট করতে হবে,অন্য কারো ফিংগারপ্রিন্ট পাওয়া যায় কিনা। যদি দেখা যায়, শরীরে শুধু রোগীর নিজেরই ফিংগারপ্রিন্ট, নিজের নখেরই আচড়ের দাগ শুধু, তাহলে বোঝা যাবে, বাইরের কেউ আসেনি। রোগী ট্যাকটাইল হ্যালুসিনেশন এর শিকার।
৪. অলফ্যাক্টরি হ্যালুসিনেশন ( Alfactory Hallucination)
এই রোগে আক্রান্ত রোগী আজব, কাল্পনিক কোনো গন্ধ লায়, যে গন্ধটা বাস্তবে সেখানে নেই। আশেপাশের অন্য কেউ সেই গন্ধ পায়না।
দেবী সিনেমায় রানু বেলী ফুলের গন্ধ পেত, আর কেউ সেই গন্ধ পেত না।
শব্দ কিংবা ছবি যেভাবে রেকর্ড করা যায় মোবাইলে, সেভাবে গন্ধ রেকর্ড করার মত সহজসাধ্য কোনো টেকনোলজি নাই। বাতাসের কিছু অংশ ( air sample) কালেক্ট করে ল্যাবে টেস্ট করে বের করা সম্ভব, তবে সেটা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যাপক দামী প্রযুক্তি।
আশেপাশের অন্য সূস্থ স্বাভাবিক মানুষরা যদি কোনো গন্ধ না পায়, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, ওই কয়েকজন রোগীই শুধু অলফ্যাক্টরি হ্যালুসিনেশন এর শিকার। সত্যিকারে সেখানে কোনো গন্ধ নাই।
এর বাইরে আরো অনেক প্রকারের হ্যালুসিনেশন আছে। একজন রোগী একইসাথে একাধিক হ্যালুসিনেশন এ আক্রান্ত হতে পারেন,আবার কেবলমাত্র একটি হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হতে পারেন।
গতরাত থেকে সিলেটের কানাইঘাট থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে , স্থানীয় মাওলানা মুশহিদ বায়মপুরী (রা) এর কবর থেকে আতরের সুগন্ধ বের হচ্ছে।
খবর পেয়ে অনেকে তার কবরে ভীড় করছেন। বেশ কিছু নিউজ মিডিয়াতেও ছাপা হয়েছে সেই খবর। ইন্টারভিউ তে যাদের কথা শোনা গেছে,তারা কেউই নিজে গন্ধ পান নি, কেবলমাত্র অন্যদের গন্ধ পাওয়ার কথা শুনেছেন।
এমনকি কোনো রিপোর্টার ও বলছেন না যে “এই মুহর্তে আমি মাজার থেকে খুসবু পাচ্ছি” ।
এই বায়মপুরী হুজুর কওমী মাদ্রাসা কারিকুলামে বেশ কিছু একাডেমিক টেক্সট বই লিখেছেন তিনি। সেগুলা এখনো বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়ানো হয়।
জানা যায়, মাওলানা মুশহিদ বায়মপুরী ১৯৬২ সালে ইউনাইটেড পাকিস্তানের নির্বাচনে অংশ নেন, এবং এমপি মনোনীত/নির্বাচিত হন। ( ওই সময় দেশে “মৌলিক গনতন্ত্র” নামে একটা বিতর্কিত সিস্টেম চালু ছিল। এই সিস্টেমের কারনে শুধুমাত্র মুসলিম লীগ/সরকার পক্ষের লোকজন ছাড়া আর কারো ভোটাধিকার ছিলনা।)
১৯৭১ এ তিনি মারা যান। দাফনের পর তার কবর থেকে আতরের ঘ্রান বের হতে থাকে কিছুদিন।
দাফনের ৩ মাস পরে আবারো সুঘ্রান বের হয় কিছুদিন কবর থেকে,
২০১১ সালে আবারো কবর থেকে সুঘ্রান বের হয় কিছুদিন।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর আবার কবর থেকে সুগন্ধ বের হচ্ছে।
এটাকে অলৌকিক ঘটনা দাবি করে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসা অথরিটি এবং এলাকাবাসী ব্যাপক পাবলিসিটি করতেছে।
ঘটনাটা আসলে কি হতে পারে? সম্ভাব্য কয়েকটি হাইপোথিসিস দেওয়ার চেষ্টা করছিঃ
- বায়মপুরী (রা) এর অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। তিনি একজন বড় মাপের আলেম। এ কারনে মৃত্যর পর তার কবর এর মাটির উপরে কোনো এক অজানা উপায়ে সুগন্ধী এ্যারোমেটিক কণা তৈরি হচ্ছে, এবং ব্যাপন প্রক্রিয়ায় সেই কণিকাগুলা বাতাসে ভেসে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে কবর থেকে সুগন্ধ বের হচ্ছে।
( এখানে একটা কথা থেকে যায়। মহানবী (সা) বা ইসলামের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রসিদ্ধ ওলি আউলিয়াদের কবর থেকে সুগন্ধ বের হওয়া বা অন্য কোনো অলৌকিক ঘটনার কথা কিন্তু শোনা যায়না । উনাদের কবর/মাজারে গেলে ম্যাক্সিমাম আগরবাতি/গোলাপজলের গন্ধ পাবেন, যেগুলা ছিটানো হয়েছে। সেখানে অলৌকিক কিছু নাই।
মধ্যপ্রাচ্য বা বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম অধ্যূষিত এলাকার কবরগুলায় যেখানে কোনো অলৌকিকতার কথা শোনা যায়না, সেখানে ৩৬০ আউলিয়ার এই দেশে এত এত অলৌকিকতার খবর পাওয়া যায় কেন? গভীর সন্দেহজনক ব্যাপার!!)
- ১৯৭১,২০১১ বা সাম্প্রতিক সময়ে মাজারের খাদেমরা হয়তো অলফ্যাক্টরি হ্যালুসিনেশন এর শিকার হয়েছেন। এ কারনে তারা অদ্ভূত গন্ধ পেয়েছেন। গন্ধ পাওয়ার কথাটা ‘গুজব’ হিসেবে এলাকায় ছড়িয়েছে। এলাকাবাসী সেটা বিশ্বাস করেছে, নিজেরা গন্ধ না পেলেও মাজারের গন্ধ পাওয়ার খবর ফলাও করে প্রচার করছেন।
- সিলেট / সুনামগঞ্জ এলাকার মাটির নিচে অনেক গ্যাসের খনি আছে। মাঝে মাঝে মাটির কোনো ওপেনিং দিয়ে এসব গ্যাস উপরে বের হয়ে এসে আজব আজব কর্মকান্ড করে ( যেমন – টিউবওয়েল দিয়ে অনবরত পানি পড়া, পুকুরের পানির মধ্যে আগুন জ্বলা,ডোবার মধ্য থেকে বালি কাদা উঠে আসা ইত্যাদি)। ওই মাজারের আশেপাশ থেকে মিষ্টি গন্ধযুক্ত কোনো গ্যাস উপরে উঠে আসতে পারে।
(যদিও তার চান্স খুব কম। অধিকাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসে মিথেন থাকে, কটু গন্ধযুক্ত এটা । মিষ্টি গন্ধযুক্ত কোনো প্রাকৃতিক গ্যাসের কথা জানিনা। আপনি জানেন কি? কমেন্ট করুন)
- এই মাজারের খাদেমরা পুরাটাই মিথ্যা বলছে। পাবলিসিটির জন্য, মাজারের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য তারা হয়তো আতর বা গোলাপজল ঢেলে দিয়েছে কবরে। অথবা আতর ঢালা ছাড়াই সুগন্ধ বের হওয়ার গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে। এলাকাবাসী সরল বিশ্বাসে তাদের ছড়ানো গুজব বিশ্বাস করছে।
( মাজারের ব্যবসা কিভাবে করতে হয় তার বিস্তারিত বর্ননা আছে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এর লালসালু উপন্যাসে। এটা নিয়ে সিনেমাও বানানো হয়েছে। লালসালু গল্পের নায়ক মজিদ এক গ্রামে হাজির হয়ে পুরনো একটা গর্ত দেখে দাবি করে, “এটা মোদাচ্ছের পীরের কবর। আপনারা এমন করে ফেলে রেখেছেন কেন? পীর সাহেব আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছেন, কবর সংস্কার করে মাজার বানাতে হবে, আমাকে খাদেম বানাতে হবে। ” তার কথামত এলাকাবাসী মাজার বানিয়ে দিল।
লিখাঃজহিরুল ইসলাম
রেফারেন্সঃ