বাংলা ভাষায় আবহাওয়া বিজ্ঞান চর্চা: পর্ব ১৭
স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ কি? আবহাওয়া ও পরিবেশ সম্পর্কিত কাজে কোন ধরণের কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ ব্যবহার করা হয়? বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট এর কাজ কি?
কৃত্রিম উপগ্রহকে আপনি তুলনা করতে পারেন একটি মাইক্রো-বাসের সাথে। এই মাইক্রবাস আুন্জুমানে মফিদুল ইসলাম নামক দাতব্য সংস্থাটি ব্যবহার করে মৃত মানুষের লাশ পরিবহনের কাজে যখন মাইক্রোবাসের ভেতরে ড্রাইভারের পিছনে কোন সিট থাকে না মৃত দেহ পরিব হনের সুবিধার্থে।
একই মাইক্রবাস ব্যবহার করা হয় যাত্রী পরিবহনের কাজে। মাইক্রোবাসে করে শহর বা গ্রাম অঞ্চলে বিয়ে বাড়ির বৈরাতী যাওয়া হয় কিংবা বনভোজনে ও বিনোদন ভ্রমণের কাজে। মাঝে মাঝে পত্রিকায় সংবাদে যানা যায় যে কে বা কাহারা মাইক্রো-বাস ব্যবহার করে প্রতিবাদী মানুষও গুম করার কাজে।
একই ভাবে কৃত্রিম উপগ্রহ গুলোকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করার জন্য ভিন্ন-ভিন্ন যন্ত্র বা সেন্সর বসানো হয় যে যন্ত্র গুলোকে বলা হয়ে থাকে পেলোড (The equipment carried into space by a space vehicle. The payload of a satellite includes all of the instruments and science experiments – anything that is not essential to basic functioning of the satellite, but used for science, data collection, or tools.) নিচে কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহে থাকা উল্লেখযোগ্য কিছু যন্ত্রের কাজের বর্ণনা দেওয়া হলও।
ট্রান্সপোন্ডার: যোগাযোগ উপগ্রহে পেলোড হিসাবে যে যন্ত্র থাকে তার নাম ট্রান্সপোন্ডার (transponder: An instrument used on communications satellites that receives a signal from a station on Earth at one frequency, amplifies it, and shifts it to a new frequency.) এই যন্ত্র শুধুমাত্র পৃথিবী পৃষ্ঠে অবস্থিত; বা অন্য কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাঠানো কোন সিগনাল প্রথমে গ্রহণ করে এর পরে তা বিবর্ধিত করে ও সব শেষে তা আবারও পৃথিবী পৃষ্ঠে অবস্থিত কোন স্টেশনে বা অন্য কৃত্রিম উপগ্রহে পাঠিয়ে দেয়। এটাই হলও যোগাযোগ উপগ্রহের একমাত্র কাজ।
পক্ষান্তরে আবহাওয়া উপগ্রহগুলোতে পেলোড হিসাবে রেডিও-মিটার (রেডিয়েশন বা বিকিরণ মাপার যন্ত্র), স্কেটারোমিটার (এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত বিভিন্ন গ্যাস যেমন কার্বনডাই অক্সাইড, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি থেকে প্রতিফলিত আলোকরশ্নী পরিমাপ করার জন্য), লাইটিং ইমেজার (মেঘের মধ্যে সংঘটিত বজ্রপাতের ছবি তুলার যন্ত্র) ইত্যাদি নামক বিভিন্ন প্রকার মনিটরিং যন্ত্র ও ক্যামেরা থাকে।
রেডিওমিটার (রেডিয়েশন মাপার যন্ত্র): পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু যার তাপমাত্রা মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রী অপেক্ষা বেশি সেই বস্তু শক্তি নির্গত করে ভিজিবল অথবা ইনফ্রারেড রশ্নি (infrared camera: An instrument that measures heat. Infrared cameras are often used to detect weather patterns or volcanic erruptions.) হিসাবে।
রেডিও-মিটার সেই শক্তি পরিমাপ করে প্ল্যাঙ্ক এর সূত্র ব্যবহার করে ঐ বস্তুর তাপমাত্রা নির্ণয় করে থাকে। [radiometer: An instrument to measure the changing levels of radiation as well as visible and infrared light. They can produce cloud images even at night.]
স্কেটারোমিটার: পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত বিভিন্ন গ্যাস যেমন কার্বনডাই অক্সাইড, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি পরিমাপ করে ঐ সকল গ্যাস আলোকরশ্মি বিচ্ছুরণ পরিমাপ করার মাধ্যমে।
স্পেকট্রেমিটার: spectrometer: An instrument used to study the electromagnetic spectrum. স্পেকট্রেমিটার সাধারণত ব্যবহার করা হয়ে থাকে কোন বস্তু কোন-কোন পদার্থ দ্বারা গঠিত তা নির্ণয় করতে। মঙ্গল গ্রহে বা চাঁদে পা ঠানো প্রত্যেকটি কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহে একটি করে স্পেকট্রেমিটার রয়েছে। প্রধান উদ্দেশ্য হলও মঙ্গল গ্রহের মাটি কোন-কোন পদার্থ দ্বারা গঠিত যা জানা।
কিংবা মঙ্গল গ্রহে পানির অস্তিত্ব আছে কি না তা জানা। কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহে এই স্পেকট্রেমিটার স্থাপন করে তা ব্যবহার করে কোন দেশের ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন ধরনের খনিজ সম্পদের উপস্থিতি সম্পর্কে জরিপ চালিয়ে একটি দেশের বিভিন্ন স্থানে খনিজ সম্পদের উপস্থিতির মানচিত্র তৈরি করা যায়।
আলটি-মিটার: উচ্চতা মাপার যন্ত্র; যে যন্ত্র একটা সিগনাল পাঠায় পৃথিবীর দিকে ও প্রতিফলিত সিগনাল গ্রহণ করে। এই সিগনাল পৃথিবীর দিকে যাওয়া ও পৃথিবী থেকে ফেরত আসার যে সময় লাগে সেই সময়কে আলোর গতি বেগ দিয়ে গুন করে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে বিভিন্ন বস্তুর দূরত্ব পরিমাপ কর. আল্টিমিটার সাধারণত থাকে সেই সকল উপগ্রহে যা উপগ্রহ গুলো সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতার পরিবর্তন পরিমাপ করে থাকে যেমন জেসন-১, ২, ৩ নামক কৃত্রিম উপগ্রহ.
লাইটিং ইমেজার (বজ্রপাত মাপার যন্ত্র): এই যন্ত্রের প্রধান কাজ মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানো মনিটর করা। যেমন আমেরিকার Geostationary Earth Observation Satellite 17 and 18 এ স্থাপিত Geostationary Lightning Mapper সেন্সর বা ক্যামেরা। যে ক্যামেরা দিয়ে সাধারণ ক্যামেরার মতোই পৃথিবী পৃষ্ঠের ছবি তুলা হয় যখন বিদ্যুৎ চমকানো শুরু করে।
যাই হউক নাসার বৈজ্ঞানিকরা সমুদ্র পর্যবেক্ষণের জন্য এক প্রকার; বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণের জন্য এক ধরনের; বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্রিনহাউজ গ্যাস পর্যবেক্ষণের জন্য এক ধরনের; যোগাযোগের জন্য এক ধরনের; ভূমির ব্যবহারের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের জন্য এক ধরনের স্যাটেলাইট ভূ-পৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন উচ্চতার কক্ষ পথে পাঠিয়ে থাকে।
অর্থাৎ, প্রতিটি কাজের জন্য ভিন্ন-ভিন্ন স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠিয়েছেন বিলিয়ন-বিলিন ডলার খরচ করে।
যেমন, ২০১৮ সালের মে মাসের শেষের দিকে জার্মানি ও আমেরিকা মিলে একটা স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠাবে যার নাম Gravity Recovery and Climate Experiment Follow-On (GRACE-FO)। এই স্যাটেলাইটের কাজ শুধু পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে বা ভূ-অভ্যন্তরে পানির পরিমাণের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা।
Gravity Recovery and Climate Experiment বা GRACE নামে ২০০৩ সালে একটা যমজ (এক সাথে দুটা) স্যাটেলাইট পাঠিয়েছিল কক্ষপথে যে স্যাটেলাইট এর অপারেশনাল লাইফ শেষ হয়ে গেছে ২০১৭ সালে। ফলে আবারও একই ধরণের দুইটা স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠানো হয় মে মাসের শেষের দিকে।
যেহেতু এই স্যাটেলাইট পূর্বের GRACE স্যাটেলাইটের পর্যায়ক্রমে তাই নামকরণ করা হয়েছে GRACE Follow-On।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা European Space Agency একটা প্রোগ্রাম চালু করেছে যার নাম Copernicus (the most ambitious Earth observation programme to date)। এই প্রোগ্রামের আওতায় ৬ প্রকার স্যাটেলাইট প্রতিটি ২ টি করে মোট ১২ টি স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠাবে যে স্যাটেলাইট গুলোর কাজ ভিন্ন-ভিন্ন।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসেও তারা একটা স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠিয়েছে যার নাম Sentinel-3B। Sentinel-3A পাঠিয়েছিল ২০১৬ সালেই। একই ধরনের দুইটা স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠানোর কারণ হলও একটি স্যাটেলাইট পৃথিবীর সকল স্থানের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না।
কিছু গ্যাপ থেকে যায়। ঠিক যেমন করে ইট দিয়ে দেয়াল তৈরির সময় কোন-কোন স্থানে একটি পুরো ইট লাগে না; তখন ইট ভেঙ্গে সাইজ করে বসানো হয়। Copernicus প্রোগ্রামের ২ নম্বর স্যাটেলাইটের কাজও তেমনি প্রথম স্যাটেলাইটের গ্যাপ পূরণ করা।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে শুধুমাত্র ট্রান্সপন্ডার নামক যন্ত্রটি আছে এছাড়া উপরে বর্ণিত আর কোন যন্ত্র নাই যে কারণে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট দিয়ে ভারতীয় হিন্দি সিরিয়াল ও বাংলাদেশের দুর্গম কিছু এলাকায় দুর্যোগকালীন সময়ে যোগাযোগ সুবিধা ছাড়া আর কোন সেবা পাওয়া সম্ভব না।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের তৈরি থেকে ১৫ বছর পরিচালনার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও এই কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ এর পুরো লাইফ-টাইমে ৫০০ কোটি টাকার বেশি সার্ভিস পাওয়া সম্ভব হবে না এটা আমি হলফ করে বলতে পারি।
অর্থাৎ, দেশের মানুষর করের ৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ৪৫০০ কোটি টাকার একটি লস প্রজেক্ট হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহটি। সাম্প্রতিক কালে সংবাদ প্রকাশ বাংলাদেশ সরকার কোন প্রকার টেন্ডার ছাড়া সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার একটি গোপন চুক্তি রাশিয়ান সরকার পরিচালিত একটি কোম্পানির সাথে বঙ্গবন্ধু-২ নামক আবহাওয়া বিষয়ক একটি কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ তৈরির জন্য চুক্তি করেছে।
আমি জানিনা বঙ্গবন্ধু-২ নামক কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহটিও অবস্থাও বঙ্গবন্ধু-১ নামক কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের অবস্থা হবে কি না (সরকারি মাল দরিয়া মে ডাল)। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ দেশের মানুষের করের টাকাগুলো পুরোটাই নষ্ট না করে সামান্যতম অংশ যেন দেশের মানুষের কল্যাণে লাগে সেই ব্যবস্হা টি নিশ্চিত করে।