‘আলো’কে পিস পিস করলে অনেক সাইজ পাওয়া যাবে। আমাদের কাছে এক্কেবারে আদর্শ, এক্কেবারে মিডিয়াম সাইজ হলো সবুজ আলো। মিডিয়াম সাইজ থেকে আলো যত বড়ো হবে, ততই রং চেইঞ্জ হতে থাকবে।
মিডিয়াম থেকে সাইজ একটু বড়ো হলে হলুদ, আরেকটু বড়ো হলে কমলা, কমলার চেয়ে বড়ো হলে লাল। লালের চেয়ে বড়ো হলে সেই সাইজ আমরা দেখতে পাবো না।
আবার, মিডিয়াম সাইজ থেকে ছোটো হলেও রং বদলাবে, সবুজ থেকে একটু ছোটো সাইজ হলে আকাশী, এরচেয়ে ছোটোটা নীল, এরচেয়েও ছোটোটা বেগুনি।
আবার বেগুনির চাইতে ছোটো সাইজ ও আমরা দেখতে পাবো না। তার মানে আমরা যে আলো দেখি এরমধ্যে সবচেয়ে বড়ো সাইজ হচ্ছে লাল, এবং সবচেয়ে ছোটো সাইজ হচ্ছে নীল। আশা করি সহজে বোঝাতে পেরেছি।
আলো তরঙ্গ আকারে চলে, এতক্ষণ যে “সাইজ” এর কথা বললাম এগুলো একেক দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ। তরঙ্গের সাথে আরেকটা ব্যাপারও এখানে জড়িত, সেটা হলো ফ্রিকোয়েন্সি।
এখানে একটা আরেকটার বিপরীত। মানে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমলে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ে, আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়লে ফ্রিকোয়েন্সি কমে।
একটা আলোর উৎস আমাদের থেকে দূরে সরতে থাকলে সেখান থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো লম্বা হবে, মানে ফ্রিকোয়েন্সি কমবে, কীভাবে?
ধরি একটা আলোক উৎস আমাদের দিকে ৫০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকিরণ করছে, এবং বিকিরণ করা অবস্থায় সে আরও ২০০ ন্যানোমিটার দূরে সরছে।
তাহলে আমরা পাবো ৫০০+২০০=৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো। উল্লেখ্য, ৫০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো হচ্ছে সবুজ, এবং ৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো হচ্ছে লাল।
একইভাবে ধরি আরেকটা আলোক উৎস ৫০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকিরণ করছে, আবার আলোক উৎসটাও একইসাথে ১০০ ন্যানোমিটার এগিয়ে আসছে, তাহলে সেখান থেকে বিকিরিত তরঙ্গদৈর্ঘ্য আমরা দেখব ৫০০-১০০=৪০০ ন্যানোমিটার, অর্থাৎ এর ফ্রিকোয়েন্সি থাকবে ঘন। আর ৪০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো হচ্ছে নীল আলো। আমরা যদি শব্দতরঙ্গের ব্যাপারটাও ধরি, এখানেও ওই একই ব্যাপার। কোনো চলমান উৎস থেকে আপনার কানে শব্দ এলে প্রথমে শব্দটা তীক্ষ্ণ মনে হবে, উৎসটা আপনার দিকে যতই এগিয়ে আসবে শব্দটা ততই জোড়ালো হতে থাকবে। এবং উৎসটা আপনাকে ক্রস করে যতই দূরে সরতে থাকবে শব্দটা আপনার কানে ততই ভোঁতা অনুভূত হবে। তাহলে এসব থেকে কী বোঝা গেল?
আলোক উৎসের ক্ষেত্রে :
• আলোক উৎস দূরে সরতে থাকলে আমরা লাল তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বা রেড শিফট বেশি পাবো। কাছে আসতে থাকলে নীল তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বা ব্লু শিফট বেশি পাবো।
• আলোর কালার বিশ্লেষণ করে আমরা বলে দিতে পারব আলোক উৎস স্থির, নাকি দূরে সরছে, নাকি কাছে আসছে।
• এটাকেই বলে ডপলার ইফেক্ট। ১৮৪২ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান ডপলার এই ঘটনাটির বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
আমেরিকান জ্যোতির্বিদ এম. এল. হিউমাসন এই ডপলার ইফেক্ট ব্যবহার করে অনেকগুলো মহাজাগতিক বস্তু পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। পরে বিজ্ঞানী এডউইন হাবল জোরালোভাবে প্রমাণ করেন, এই আবছা বস্তুগুলোর বেশিরভাগ নিজেই একেকটা আস্ত গ্যালাক্সি। এরকম একেকটা গ্যালাক্সির মাঝে বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের বাস। গ্যালাক্সিগুলো আমাদের থেকে খুব দূরে অবস্থান করছে, তাই আমরা এগুলোকে আবছা দেখি।
এত গ্যালাক্সি কী করছে মহাবিশ্বে? এর শেষ কোথায়? বিজ্ঞানীরা ভেবে কূল পেলেন না। বসানো হলো শক্তিশালী অপটিক্যাল আর রেডিয়ো টেলিস্কোপ। বিজ্ঞানীরা নিরন্তর টেলিস্কোপে চোখ রেখে আর ডাটা বিশ্লেষণ করে খুঁজে ফিরলেন মহাবিশ্বের সীমানা! ফলাফল? যেদিকে দুচোখ যায় অথই গ্যালাক্সি আর গ্যালাক্সি। যতদূর চোখ পড়ল, গ্যালাক্সি বৈ অন্য কিছু দেখা যায় না। তখন বোঝা গেল, সমস্ত মহাবিশ্বটাই গ্যালাক্সিতে পরিপূর্ণ। এরা কিন্তু একসাথে এঁটে নেই। একটা আরেকটার থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। দ্বীপের মতো ছড়িয়ে আছে আরকি।
যাইহোক, বাকি আলোচনা শুরুর আগে “মহাবিশ্ব” নিয়ে একটা ইন্ট্রো দিয়ে দিই। “মহাবিশ্ব” আসলে কী?
দৃষ্টিসীমার শেষ পর্যন্ত গ্যালাক্সিই খুঁজে পেলাম, দৃষ্টিসীমার ওপারেও তাহলে গ্যালাক্সিই ধরে নিচ্ছি, না কি? এখন, এই যে প্রায় অসীম আলোকবর্ষ দূরের পথ, সেই পথের বহুদূরের কোনো বাঁকে, আমাদের মতোই কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীরা হয়তো, গ্যালাক্সির জঞ্জালের ফাঁকফোকরে টেলিস্কোপ তাক করে “এলিয়েন” খুঁজে বেড়াচ্ছে! বেচারারাও তো মনে হচ্ছে আমাদের মতোই হতাশ! ধ্যাৎ, আলোচনা ছেড়ে তো বাইপাসে চলে যাচ্ছি…
যা বলছিলাম, এই যে অগণিত গ্যালাক্সি। ধরে নিই এই গ্যালাক্সিগুলোর সমষ্টিই মহাবিশ্ব। তাহলে এখন থেকে মহাবিশ্ব বলতে আমরা বুঝব গ্যালাক্সিগুলোর সমষ্টি। আর গ্যালাক্সি বলতে বুঝব মহাবিশ্বের একক, ঠিকাছে? তাহলে এটাকে যদি এখন মহাবিশ্বের সংজ্ঞা ধরে নিই, তখন সামনে একটা জটিল প্রশ্ন চলে আসে! এমন কোনো গ্যালাক্সি থাকতে পারে কি? যা এই সমষ্টির বাইরে! থাক, আপাতত এদিকে আর যাচ্ছি না! এতটা কনফিউশন দেখলে পাঠকরা অধৈর্য হয়ে গালি দিয়ে বসতে পারে!
বাকিটা থাকবে পরের পর্বে।
(প্রয়াত নন্দিত বাংলাদেশী বিজ্ঞানী স্যার জামাল নজরুল ইসলামের (১৯৩৯-২০১৩) “The ultimate fate of the universe” অবলম্বনে।)