আজ ব্রেন্টন ট্যারান্ট কে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে নিউজিল্যান্ডের আদালত। এই খৃষ্টান জংগী গত বছরের ১৫ই মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে ঢুকে কম্পিউটার গেমস খেলার মত করে গুলি চালিয়েছিল।
জুম্মার নামাজ পড়া অবস্থায় গুলি খেয়ে মারা যায় ৫১ জন মুসল্লি। গোলাগুলি টা সে আবার ফেসবুক লাইভে দেখিয়েছিল।
তার টার্গেট ছিল,আরো অনেকগুলা মসজিদে আক্রমন চালানো এবং সেগুলা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা।
কিন্তু সেই কাজে সে সফল হয়নি। ক্রাইস্টচার্চের দুইটা মসজিদ – আল নুর মসজিদ এবং লিনউড মসজিদে হামলার পরেই পুলিশ তাকে এ্যারেস্ট করে ফেলে ।
ব্রেন্টন ট্যারান্ট বিশ্বাস করত, সব মুসলমান মেরে ফেলা উচিত। কারন মুসলমানরা বাইরে থেকে এসে নিউজিল্যান্ডের শ্বেতাঙ্গ খৃষ্টানদের কালচার নষ্ট করে ফেলছে।
এ কারনে তাদেরকে খুন করা হলে সেটা খুব ভাল একটা কাজ হবে।
[Statement]ব্রেন্ডন এর বিশ্বাস টা বেশ অদ্ভূত হলেও, একই ধরনের বিশ্বাস নিয়ে বেচে আছেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে জিরো নয়।
নিচে যে লোকের ছবি দেখছেন, তার নাম সনসারি ওঝা। বয়স ৭২. দীর্ঘদিন ধরে ভারতের উড়িষ্যার ( ওড়িয়া) রাজধানী কটকের নরসিংপুর থানার বান্ধাহুদা গ্রামের মা ব্রাহ্মনী দেবীর মন্দিরে পুরোহিত হিসেবে কাজ করছেন।
গত ২৭ শে মে এই সনসারী ওঝা তার গ্রাম থেকে সরোজ প্রধান নামের ৫০ বছর বয়সী এক কৃষক কে মন্দিরে ডেকে আনেন। এই সরোজ ও ব্রাহ্মনী দেবীর ভক্ত।
এবং সনসারী ওঝার এক ধরনের শিষ্য। ওঝার প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ছিল। মাঝে মাঝেই সে মন্দিরে এসে ওঝার সাথে ধর্ম বা অন্য বিভিন্ন বিষয়ে গল্প করত।
কিন্তু সেদিন রাতের আড্ডাটা নিছক আড্ডায় শেষ হয়নি। রাতের কোনো এক পর্যায়ে ওঝা সরোজ কে দেবীর সামনে এনে তার মাথা ধারালো রামদা দিয়ে কেটে ফেলেন।
তারপর সেই কাটা মুন্ডু নিয়ে দেবীর সামনে সারারাত ধরে পূজা করেন।
পরদিন সকালে তিনি শান্তভাবে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশকে বলেন, দেবী আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে নরবলি দিতে বলেছেন।
দেবী বলেছেন, এইভাবে মন্দিরে আমার মূর্তির সামনে এনে একটা মানুষকে বলি দিয়ে তার মুন্ডু দিয়ে যদি পূজা করি, তাহলেই পৃথিবী থেকে করোনা রোগ চলে যাবে ।
দেবীর কথামত আমি কাজ করেছি। বিশ্বকে করোনামুক্ত করার জন্য,অর্থাত মানবজাতির কল্যানের জন্যই আমি এই মানুষটাকে খুন করেছি।
ব্রেন্টন ট্যারান্ট এবং সনসারী ওঝার মধ্যে মিল খুজে পাচ্ছেন? দুই জনেই কোনো একটা জিনিস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছেন। তাদের এই বিশ্বাসের বাইরে অন্য পক্ষের কথা শোনেন নি।
তেমন কারো সাথে তাদের আইডিয়া নিয়ে আলোচনাও করেন নি। নিজে যা তথ্য পাচ্ছেন,যা দেখেছেন, যা শুনেছেন, সেটা সঠিক নাকি ভুল তা যাচাই করেন নি।
অন্ধভাবে নিজের কাছে যা ভাল মনে হয়েছে, সেটাই করেছেন। সেই “ভাল কাজ” করতে গিয়ে অন্য মানুষের ক্ষতি হলে, কিংবা সে খুন হয়ে গেলেও তারা ভ্রুক্ষেপ করেনি।
করোনাভাইরাস এর মতই এরাও এক প্রকার কাল্পনিক ভাইরাসে আক্রান্ত।
স্টুপিডিটির ভাইরাস, কিংবা বিশ্বাসের ভাইরাস নাম দিতে পারেন আপনি একে।
সত্যিকার ভাইরাস আক্রমন করে দেহে,কিন্তু এই বিশ্বাসের ভাইরাস আক্রমন করে মনে। করোনা, বা যেকোনো সংক্রামক ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী যেমন বিপজ্জনক, বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও সেইরকম খুবই বিপজ্জনক।
কোভিডিয়ট -পর্ব ৫ এ আমি দেখিয়েছিলাম, কিভাবে একজন করোনা পজিটিভ রোগী পুরা একটা দেশে অনেক মানুষের ক্ষতি করতে পারে।
দক্ষিন কোরিয়ার একজন রোগী ( পেশেন্ট ৩১) স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঘুরে বেড়ানোর কারনে দেশে এখন ১৮ হাজার রোগী।
অস্ট্রেলিয়ায় মাত্র দুইজন রোগী ( রুবি প্রিন্সেস জাহাজের যাত্রী) কোয়ারেন্টাইনে না থেকে ঘুরে বেড়ানোর কারনে অস্ট্রেলিয়া তে এখন ২৫ হাজার করোনা রোগী।
তেমনিভাবে, একজন বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি একটা বড় কমিউনিটির অনেক ক্ষতি করতে পারে। ব্রেন্টন ট্যারান্ট একাই ৫১ জন মুসলিম খুন করেছে, আরো ৫০ জনকে আহত করেছে। এইরকম উদাহরন খুজলে আরো অনেক পাবেন।
২০১৯ সালের ৩রা আগস্ট আমেরিকার টেক্সাসের এল পাসো শহরের ওয়ালমার্ট শপিং মলে এলোপাতাড়ি গোলাগুলি শুরু করে প্যাট্রিক ক্রুসিয়াস নামের এক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান।
তার বিশ্বাস ছিল, হিস্পানিক এবং ল্যাটিনোরা দলে দলে আমেরিকায় ঢুকে আমেরিকা দখল করে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। সুতরাং, যত বেশি হিস্পানিক খুন করা যাবে, তত ভালো।
[ 2019 El Paso shooting]২০১৫ সালের ১৭ই জুন ড্যানিয়েল রুফ নামের এক শ্বেতাঙ্গ খৃষ্টান সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লসটন চার্চে ঢুকে সেখানে প্রার্থনারত ইথিওপিয়ান দের খুন করে।
[Charleston church shooting]কৃষ্ণাঙ্গ বা আফ্রিকান দের কে মাস কিলিংনের ঘটনা তো গুনে শেষ করা যাবে না। ক্লু ক্লাক্স ক্লান নামের গ্রুপটা এই কাজের জন্য খুবই কুখ্যাত। সাম্প্রতিক জর্জ ফ্লয়েড এর ঘটনা তার লেটেস্ট উদাহরন।
বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত এইরকম সিংগেল একজন বা কয়েকজনের আক্রমনের কারনে অনেক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা একটু খুজলেই পাবেন।
সকল সম্প্রদায়ে,সকল ধর্মেই এইরকম বিশ্বাসের ভাইরাস আক্রান্ত লোক দেখা যায় , যারা এইরকম ভয়ংকর ক্ষতি করে বেড়াচ্ছে ।
আচ্ছা, সনসারী ওঝার স্বপ্নের আদেশ বাদ দেই । করোনাভাইরাস থামানোর জন্য আসলে কি করা উচিত?বিজ্ঞানীরা কি বলছেন।
ওষুধ কিংবা ভ্যাক্সিন দিয়ে বিশ্বের সব জায়গা থেকে একসাথেই করোনাভাইরাস মেরে ফেলতে হবে। মাত্র একজন সিংগেল করোনা রোগীও যদি থাকে, তাইলে সেই একজনের কাছ থেকেই আবার পুরা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে ( পেশেন্ট ৩১ এর মত)
কাজেই, বিশ্বের সবাইকে একসাথে ওষুধ দিলেই এটা দূর হবে। ১৯৮০ সালে এইভাবে বিশ্বের সবাইকে একসাথে স্মল পক্স এর টীকা দেওয়ার কারনে আজ বিশ্বে এই রোগ নাই।
পোলিও থেকেও মুক্তির অনেক কাছাকাছি রয়েছে বিশ্ব। পাকিস্তান আর আফগানিস্তান বাদে বিশ্বের বাকি সব দেশ পোলিওমুক্ত হয়েছে।
“বাদ যাবে না একটি শিশুও” এই স্লোগান দিয়ে বিশ্বের প্রায় সব বাচ্চাকে এই টীকা খাওয়ানো হয় নিয়মিত । কিন্তু পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের তালেবান তাদের দেশে পোলিও টীকার ক্যাম্প চালাতে দেয় না।
তাই ওই দুইটা দেশ পোলিও মুক্ত হচ্ছে না। তাই বিশ্ব ও পোলিও মুক্ত হচ্ছে না। একবার বিশ্ব পোলিওমুক্ত হয়ে গেলে বছর বছর আর পোলিও ক্যামপেইন করতে হত না।
করোনার ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হলে, বিশ্বের সব দেশেই সেটা যদি দেওয়া যায়, তাহলেই বিশ্ব করোনামুক্ত হবে।
একটা সিংগেল দেশেও যদি করোনা রোগী থেকে যায়, তাহলে সেখান থেকেই পুরা বিশ্বে আবার করোনা রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিশ্বকে ভাইরাস মুক্ত করার জন্য আমরা অনেক চেষ্টা – তদবির করছি। কিন্তু মানুষের মাথার মধ্যের “বিশ্বাসের ভাইরাস” কে দূর করার জন্য আমরা কি কোনো প্লান করছি?
ব্রেন্টন ট্যারান্ট বা সনসারী ওঝার মত বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত রা কি এইভাবেই থাকবে আমাদের সমাজের মধ্যে?
এইভাবেই, মাঝে মাঝেই তারা আক্রমন করে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে যাবে?
কিভাবে এদেরকে থামানো যেতে পারে?
এনি আইডিয়া ?
———
COVID+ IDIOT = COVIDIOT, শব্দটা ইদানিং বেশ পপুলার হচ্ছে।যে লোকটা নিজে স্বাস্থ্যবিধি মানে না, এবং অন্যকেও করোনার ঝুকির মধ্যে ফেলে দেয়, সে ই হল কোভিডিয়ট।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কোভিডিয়ট এর গল্প ধারাবাহিকভাবে লেখার চেষ্টা করছি
কোভিডিয়টের অন্যান্য পর্ব —
- পর্ব ১ – জার্মানিতে লক ডাউন বিরোধী ১৭,০০০ কোভিডিয়টের মিছিল
- পর্ব ২- মায়ানমারের পাদ্রী রেভারেন্ড ডেভিড লাহ
- পর্ব ৩- ভারতের মন্ত্রী
- পর্ব ৪- ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট
- পর্ব ৫- কোরিয়া আর অস্ট্রেলিয়ার পেশেন্ট ৩১