পর্ব-৩১: জীবের জীব সেবাঃ
আমরা সার্ভিস-রিসোর্স জেনেছি, রিসোর্স-রিসোর্স জেনেছি, এখন বাকি সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশনশিপ জানার। মানে এখানে উভয় সিম্বায়োন্টই একে অপরের সেবা করবে। আসলে প্রকৃতিতে এমন সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশন খুব একটা দেখা যায়না।কিন্তু কেন? তা আমরা এখনো জানিনা। তবে এর কয়েকটা সুন্দর উদাহরণ দেয়া যায়।
Sea anemones নামের Actiniaria বর্গের আর নিডারিয়া জগতের প্রাণীরা সমুদ্রে বাস করে , এরা শিকারি স্বভাবের। এদের সাথে সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশন গড়ে তুলেছে Pomacentridae গোত্রের Anemone fish বা Clownfish নামে খ্যাত মাছেরা।
তো এই সি এনিমোনিস নামের প্রাণীরা দেখতে একটু অদ্ভুত।এদের দেহ হলো মূলত একটা ফাঁপা টিউবের মতো অংশ যা নিচে কোনো শক্ত ভিত্তির সাথে লেগে থাকে।এই টিউবের ওপরের অংশে থাকে কতগুলো Tentacle ,বাংলায় সম্ভবত কর্ষিকা, আর এই টেন্ট্যাকলের মাঝে থাকে এদের মুখ।
এই টেন্ট্যাকলগুলো দেহের ভেতরে সংকুচিত হতে পারে, আবার দেহের বাইরে প্রসারিতও হতে পারে শিকার ধরার জন্য। আর এই টেন্ট্যাকলের মধ্যে থাকে নিডোসাইট নামের সেল, যা হলো একপ্রকার দংশনকারী কোষ।
কিন্তু, এনিমোনি ফিশ নামের ওই মাছেরা এই টেন্ট্যাকলের বিরুদ্ধে সহনশীলতার বিবর্তন ঘটিয়েছে [ নিশ্চই সিম্বায়োটিক কো ইভোলুশনের মাধ্যমে ], ফলে শিকারি থেকে রক্ষা পেতে এই ক্লাউনফিশরা সি এনিমোনিস এর কাছে চলে আসে, এতে শিকারি কাছে আসলে ওি টেন্ট্যাকলের নিডোসাইটের আক্রমণে সে চলে যায় আর ক্লাউনফিশ শিকারি থেকে রক্ষা পায়।
বিনিময়ে সি এনিমোনিসরা কী পায়?
আসলে সি এনিমোনিসদের এই টেন্ট্যাকল দেখে সবাই ভয় পায়না, বাটারফ্লাই ফিশ নামের মাছেরা তো এদের ধরে খেয়েই ফেলে!
কিন্তু ব্যাপারটা হলো, এই বাটারফ্লাই ফিশ আবার ক্লাউনফিশদের ভয় পায়! তাই ক্লাউনফিশ গৃহীত সেবার বিনিময়ে সি এনিমোনিসদের এই বাটারফ্লাই ফিশ থেকে রক্ষা করে! এভাবে এদের মধ্যে সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশনশিপ গড়ে উঠেছে একে অপরকে রক্ষা করার মাধ্যমে, নিরাপত্তা দেয়ার মাধ্যমে।
কিন্তু এখানে আরেকটা মজার ঘটনা ঘটে, সি এনিমোনিসের টেন্ট্যাকলে একধরনের শৈবাল বাস করে।আর ক্লাউনফিশ নিজ দেহ থেকে বর্জ্য হিসেবে যে এমোনিয়া ত্যাগ করে, তা আবার গ্রহণ করে এই শৈবালরা। মানে এখানে এনিমোনিস-এনিমোনির সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশনের একটা বায়-প্রোডাক্ট হিসেবে কিছুটা পরোক্ষ সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশন গড়ে উঠেছে। কারণ দেখা গেছে যে এই শৈবালরা আবার সি এনিমোনিসের নানা উপকারে আসে! অদ্ভুত ব্যাপার না?
দ্বিতীয় উদাহরণ হলো Acacia জেনাস এর গাছ [ যাকে বাংলায় বাবলা বলে ] আর Pseudomyrmex জেনাসের পিপড়াদের মধ্যে সিম্বায়োসিস।
বাবলার কাটার মধ্যে এই পিপড়া বাসা বানায়, মানে আশ্রয় নেয় , আর বিনিময়ে এরা গাছকে রক্ষা করে বিভিন্ন উদ্ভিদভোজী প্রাণী থেকে [ অবশ্যই সাধ্যের মধ্যে থেকে, কারণ গরু-ছাগলের মত বড় প্রাণী থেকে নিশ্চই রক্ষা করবেনা। এই, ছোট-খাট বিভিন্ন পোকা-মাকড় থেকে রক্ষা করে আরকি ]।
আবার, এই পিপড়ারা আবার অনেক সময় সেই উদ্ভিদভোজীদের হত্যার পর খেয়ে ফেলে,পাশাপাশি বাবলা গাছে বিদ্যমান Beltian Body নামের একধরনের স্নেহ-সমৃদ্ধ খাদ্য-অঙ্গের ওপরও এই পিপড়ারা আহার করে। তাই এইটা একইসাথে সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশনশিপ।
Lemon Ant নামের এক প্রজাতির পিপড়া আর এমাজন জঙ্গলের একটা গাছ, Duroia hirsute, এদের মধ্যে সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশনশিপের বেশ মারাত্মক রূপ দেখা যায়। এই পিপড়ারা ওই গাছে বাসা বানায়, আর সেই এলাকায় অন্য যত প্রজাতির গাছ আছে, সবগুলোকে ফর্মিক এসিড প্রয়োগ করে হত্যা করে।
ফলে দেখা যায় কি, জঙ্গলের ভেতর বিশাল এলাকা জুড়ে শুধু এই এক প্রজাতির গাছ আর সেগুলো সব এই লেমন এন্টদের দ্বারা কলোনাইজ করা। এই বিশাল এলাকাগুলকে স্থানীয়রা বলে Devil’s Garden. এই ডেভিল’স গার্ডেন এর সর্বোচ্চ রেকর্ড হলো, ৬০০ গাছ আর প্রায় ৩ মিলিয়ন পিপড়া!
কিন্তু, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিপড়াদের থেকে এই সাহায্য নেয়ার বিনিময়ে গাছদের চড়া দাম দিতে হয়।
এমাজনেরই আরেক প্রকার সপুষ্পক উদ্ভিদ কর্ডিয়া, আর তাদের সিম্বায়োন্ট এলোমেরাস নামের পিপড়া। এই পিপড়ারাও গাছকে নিরাপত্তা দেয়, বিনিময়ে গাছের বিশেষ ধরনের পাতায় বাসা বানায়। কিন্তু, যাতে পিপড়াদের বাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় সেজন্য এরা গাছের ফুল কেটে ফেলে , ফলে সেখানে নতুন পাতা জন্মে এদের বা বৃদ্ধি পায়!
কিন্তু গাছেরাও কোনো অংশে কম না। হিরটেলা নামের একধরনের গাছও এই এলোমেরাসদের দখলে থাকে, কিন্তু এই হিরটেলায় ফুল ফোটার আগে গাছের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা শুকিয়ে ঝড়ে যায়,ফলে পিপড়ারা গাছ ছাড়তে বাধ্য হয় আর ফুল ফোটে, পরে আবার শাখা গজালে পিওড়ারা বাসা বানায়।
তো,এভাবেই মূলত প্রকৃতিতে সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশনশিপ টিকে আছে।
আমাদের মিউচুয়ালিজমের পড়ালেখা শেষ করবো আরেকটা জিনিস জানিয়ে,কীভাবে মিউচুয়ালিজম গড়ে ওঠে তার অনেকগুলো উদাহরণ আমরা দেখেছি, কিন্তু এই মিউচুয়ালিজম শেষও হতে পারে, বা সম্পর্ক ছিন্নও হতে পারে। কীভাবে ?
- ১.একটা সিম্বায়োন্ট যদি হঠাৎ কোনো কারণে প্যারাসাইটের মতো আচরণ করে, মানে নিজে উপকার নিয়েও অপরকে কোনো উপকার করে না বা ক্ষতি করে, তখন সেটা আর মিউচুয়ালিজম থাকবেনা।
- ২.একজন সিম্বায়োন্ট যদি স্বতন্ত্রভাবে থাকা শুরু করে।
- ৩.একটা সিম্বায়োন্ট নানা কারণে বিলুপ্ত হতে পারে।
- ৪.একটা সিম্বায়োন্ট প্রজাতির বিবর্তন হয়ে সে অন্য প্রজাতিতে পরিণত হতে পারে।
এভাবে, মিউচুয়ালিস্টিক রিলেশনশিপ শেষ হয়ে যেতে পারে। আর আমাদের মিউচুয়ালিজম নিয়ে জানা-শোনাও এখানেই শেষ!
পর্ব-৩২:একপাক্ষিক বিবর্তন
কুদ্দুস আর হোসুইনের বাড়ি পাশাপাশি। দুইজনেরই বাপের জমি আছে, সেখানে চাষ-বাষ করে দুইজনের সংসার চলে। কিন্তু, কুদ্দুস আবার কয়দিন আগে গরুর খামার করেছে।এখন খামারটা হলো একেবারে হোসুইনের জমির পাশে। ফলে গরু যখন গোবর ত্যাগ করে, তা গড়াতে গড়াতে গিয়ে হোসুইনের জমিতে চলে যায়।
হোসুইন আবার জেএসসি তে জিপিএ ফাইভ পাওয়া লোক, ও জানে যে গরুর গোবর উৎকৃষ্ট মানের সার। তাই ও ফ্রিতে এত ভালো জিনিস পেয়ে ভালোই দিন কাটাতে লাগলো। কুদ্দুস এদিকে আর খেয়াল করলো না। হোসুইনের জমি কুদ্দুসের গরুরু গোবর পেয়ে ভালো ফসল দিতে লাগলো, হোসুইনের লাভের ওপর লাভ হলো।
এখানে, কুদ্দুসের না হলো লাভ, না হলো ক্ষতি। কিন্তু কুদ্দুসের কারণে হোসুইনের ঠিকই লাভ হচ্ছে। এখন কুদ্দুস আর হোসুইনকে দুইজন সিম্বায়োন্ট ধরলে আর তাদের মধ্যকার এই ঘটনাকে সিম্বায়োসিস ধরলে একে ইভোলুশনারী বায়োলজিতে বলা হয় কমেনসালিজম।এক পক্ষ আরেক পক্ষ দ্বারা উপকৃত হবে, কিন্তু আরেক পক্ষের উপকার-অপকার কিছুই হবেনা।
যে উপকৃত হয়, তাকে বলা হয় কমেনসাল। আর যে উপকার করে, কিন্তু নিজে অপরিবর্তিত থাকে, তাকে বলা হয় হোস্ট।
কমেনসালিজমের হোস্টের কোনো ট্রেইটের পরিবর্তন হয়না, মানে তার ওপর কোনো বিবর্তনীয় চাপ কাজ করেনা। কিন্তু যে কমেনসাল, তার মধ্যে বিভিন্ন এডাপশন দেখা যায়, বা বিবর্তন লক্ষ্য করা যায় কমেনসালিজমের প্রভাবে। কেন?
কুদ্দুসের গরুর গোবর যাতে ভালো ভাবে সংগ্রহ করে ভালো ভাবে কাজে লাগানো যায়, সেজন্য হোসুইন বিভিন্ন কাজ করতে পারে। কিন্তু কুদ্দুসেরতো খেয়ালই নাই এদিকে, ও কেন কিছু করবে?
একইভাবে, উপকার আরো ভালো করে নেয়ার চিন্তা কমেনসালের, সে নিজেকে এডাপ্ট করবে, মোডিফাই করবে হোস্টের থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নেয়ার আশায়।কিন্তু হোস্টের এখানে কী করার? সে না পাচ্ছে উপকার, না অপকার, তার কী প্রয়োজন পরিবর্তন আনার?
কমেনসাল তার হোস্ট থেকে বিভিন্ন উপকার নিতে পারে, খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপত্তা অথবা চলাচল। হ্যা, চলাচলের জন্য কমেনসাল তার হোস্টের গায়ে চেপে বসে, তারপর হোস্ট যখন ঘুরতে ঘুরতে একেক জায়গায় যায়, তখন কমেনসাল সুবিধামতো জায়গায় আবার নিজেই লাফ দিয়ে নেমে যায়। এই যে কী উপকার নেয়া হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে কমেনসালিজমকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলো হলো – ফোরেসি, ইনকুইলিনিজম আর মেটাবায়োসিস।
মানুষের সাথে বিভিন্ন প্রাণীর কমেনসালিজম ধীরে ধীরে প্রাণীদেরকে গৃহপালিত প্রাণীতে রূপান্তরিত করেছে।মানুষ প্রাচীনকালে শিকার করে উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলে দিতো, সেই উচ্ছিষ্ট খেতে আসতো কিছু বন্য প্রাণী। তারা এখানে কমেনসাল,মানুষের ফেলে দেয়া খাবার খেয়ে তাদের উপকার হচ্ছে, কিন্তু মানুষের উপকার-অপকার কিছুই হচ্ছেনা।
কিছু কিছু অহিংস্র প্রাণী লোকালয়ের প্রতি আকর্ষিত হতো, আর সেই অহিংস্র প্রাণীদের ওপর আহার করতো বিভিন্ন বন্য প্রাণী। মানে লোকালয় তাদের কাছে খাবারের উৎস্যে পরিণত হয়েছিলো। এমনই একটা প্রাণী হলো কুকুর।
কুকুরদের আদিপিতা ছিলো নেকড়ে। এখন মানুষ তার খাবারর উচ্ছিটাংশ ফেলে দিতো, ফলে এক শ্রেণির নেকড়ে তা খেতে লোকালয়ে চলে আসতো। এই এক শ্রেণি কোন শ্রেণি? স্বাভাবিক চিন্তা করুন, কারা আসতে পারে ? যারা হিংস্র বেশি, যারা অন্য প্রাণীদের প্রতি আক্রমণাত্মক বেশি, তারা?
নিশ্চই না ! যাদের হিংস্রতা কম ছিলো, যারা দলের অন্যান্যদের থেকে একটু বলদ টাইপের ছিলো, তারাই লোকালয়ের এত কাছে আসতো। ফলে তারা ছিলো ডমেস্টিকেটেড হওয়ার জন্য উপযুক্ত। এভাবে তারা বারবার মানুষের অঞ্চলে আসতে লাগলো, একসময় তারা খাদ্যের জন্য প্রায় পুরোপুরি মানুষের ওপর নির্ভর হয়ে গেল। কিন্তু এইযে বন্যতা থেকে গৃহপালিত হও্যা, এটা ঠিক কেন আর কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে এখনো ডিবেট আছে।
যাই হোক, মানুষ কিন্তু তখনো সেই নেকড়েদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেনি, ততদিনে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, যেমন- দেহের আকৃতি ছোট হওয়া, দাঁতের আকার ছোট হওয়া, হিংস্রতা প্রায় লোপ পাওয়া, ইত্যাদি। এসব পরিবর্তন কমেনসালিজমের প্রথম দিকেই হয়েছিলো, ডমেস্টিকেশন শুরুর আগেই।
গবেষণা করে দেখা গেছে এই শ্রেণির নেকড়েরা এই সময়ে তাদের প্রজাতির অন্যান্যদের সাথে, মানে যে নেকড়েরা পরিবর্তন হয়নি, তাদের সাথেই বসবাস করেছে, তাদের মধ্যে জিন ফ্লো ও হয়েছে। কিতু তাদের খাদ্যাভাস আর আচরণগত পরিবর্তন তাদের মধ্যে ভিন্ন প্রজাতিকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
এভাবে চলতে চলতে একসময় মানুষ এই বিশেষ শ্রেণির নেকড়েদের প্রতি খেয়াল করেছে, তাদের সাথে ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে,তাদেরকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেছে। আর যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়ার পর সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে নানান প্রজাতির কুকুর তৈরি করেছে।
মোরগ,শুকোর,বিড়াল ইত্যাদি প্রাণীর ডমেস্টিকেশনও এরকম একটা প্রক্রিয়ায় হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া আর ছত্রাকের সাথেও মানুষের এমন কমেনসালিস্টিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যারা আমাদের দেহে বসবাস করে ঠিকই, কিন্তু আমাদের উপকার-অপকার কিছুই করেনা।
এবার কমেনসালিজমের প্রকারভেদগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
ফোরেসি হলো একটা “ অস্থায়ী “ কমেনসালিস্টিক রিলেশনশিপ যেখানে কমেনসাল প্রাণী শুধুমাত্র ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বা যাতায়াতের উদ্দেশ্যে নিজেকে হোস্টের দেহে “ হান্দায় দেয়” । এখানে কমেনসালকে, মানে যে হোস্টের দেহে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে , তাকে বলে ফোরন্ট।
সিড ডিসপার্সাল ( উদ্ভিদের বীজ ছড়ানো ),সিজনাল মাইগ্রেশন ( বিশেষ কিছু ঋতুতে বিভিন্ন প্রাণীর নতুন জায়গায় স্থানান্তর ) , এফিমেরাল হ্যাবিটেট ত্যাগ ( স্বল্পস্থায়ী আবাস ত্যাগ ), আর ইনব্রিডিং ডিপ্রেশন (আপনজনদের মধ্যে তাদের সাথেই প্রজনন ঘটানোকে বলে ইনব্রিডিং, আর এই ইনব্রিডিং এর ফলে সৃষ্ট কোনো সমস্যার কারণে যখন কোনো প্রাণীর ফিটনেস কমতে থাকে তখন তাকে বলে ইনব্রিডিং ডিপ্রেশন ) থেকে রক্ষা পেতে সাধারণত বিভিন্ন প্রাণী এই ফোরেসি করে থাকে।
ভিন্ন ভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে নতুন নতুন প্রাণী আমদানির ফলে ফোরেসির মাধ্যমে ইকোলজিকাল ডাইভার্সিটি আর কমপ্লেক্সিটি বৃদ্ধি পায়।
ফোরেসির সংজ্ঞায় পরিষ্কার করে বলা আছে যে এই সম্পর্কটা হবে অস্থায়ী আর কমেনসাল। মানে কোনো জীব যদি আজীবনের জন্য তার হোস্টের দেহের সাথে লেগে থাকে বা হোস্টের কোনো রকম উপকার বা অপকার করে, তখন সেটা আর ফোরেসি থাকবেনা।
ফোরন্ট যদি কোনোভাবে তার হোস্টের উপকার বা অপকারের পথ পেয়ে যায়, তখন সেটা আর কমেনসালিজম থেকে যথাক্রমে মিউচুয়ালিজম বা প্যারাসিটিজম হয়ে যাবে।যদি দেখা যায় যে ফোরন্ট হোস্টের দেহে চড়ে ট্রাভেলের পর হোস্টের ক্ষতি করছে বা উপকার করছে, তখনও তাকে ফোরেসিসই বলা হবে।
কারণ ট্রাভেলের সময় সে কিছু করেনি, ট্রাভেলের পরে করেছে, এই সময়ের ব্যবধান সংজ্ঞায় প্রভাব ফেলে।পরিবেশের ওপর নির্ভর করে ফোরেসি ঐচ্ছিক বা বাধ্যতামূলক হতে পারে।
প্রধানত আর্থ্রোপডরা ফোরন্ট হয়, যেমন-বিভিন্ন mite, beetle, flies, bee. আবার স্তন্যপায়ীদের দেহে চড়ে বসে স্যুডোস্কর্পিয়ন নামের এক প্রাণী, যাকে স্কর্পিয়ন বা বিচ্ছুর মতো দেখতে, এজন্যই নামের আগে স্যুডো বা ভুয়া। পাখিদের দেহে ফোরন্ট হয় মিলিপেডরা ( সেসব আর্থ্রোপড যাদের দেহের অংশগুলোতে দুইজোড়া করে যুক্ত পা থাকে)।
ইনকুইলিনিজম হলো বাসস্থানের কমেনসালিজম। এখানে একটা প্রাণী অন্য একটা প্রাণীর দেহে বা আবাসস্থলে বাস করে। যে বাস করে, মানে কমেনসাল, তাকে ইনকুইলিন বলে। একটা হোস্টের সাথে অনেকগুলো প্রজাতির ইনকুইলিনের সম্পর্ক থাকতে পারে।এর উদাহরণ দেয়া যায় এপিফাইট, বা পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ, যেমন- অর্কিড, এরা অন্য গাছের ওপর বেঁচে থাকে। আবার গাছে বসবাসকারী পাখিরাও ইনকুইলিন। মানুষের ঘরে বাসকারী বিভিন্ন পোকা-মাকড়, ইঁদুর বা এমন প্রাণীরাও ইনকুইলিন।
মেটাবায়োসিস হলো একটু পরোক্ষ কমেনসালিজমের মতো। এখানে একটা জীব আরেকটা জীবের বেঁচে থাকার মতো পরিবেশ তৈরি করে দেয়, অথবা এমন কিছু করে যাতে আরেকটা জীবের উপকার হয়,তারপর সেই কমেনসাল জীবটা সেখানে জন্ম নেয় বা বসবাস করে বা সেই উপকার গ্রহণ করে।এতে যে জীবটার দ্বারা উপকার হচ্ছে, তার আলাদা করে কিছু করা লাগেনা, প্রাকৃতিকভাবেই তার সাথে কিছু ঘটনা ঘটে, ফলে কমেনসাল জীবটা এসে সেই ঘটনার ফলাফলকে উপকার হিসেবে গ্রহণ করে।
মেটাবায়োসিসের উদাহরণ হলো ম্যাগট বা মাছির লার্ভা, যারা মৃতদেহে জন্ম নেয়। আর হার্মিট ক্র্যাব নামের কাকড়া, যারা মৃত গ্যাস্ট্রোপড নামের শামুকদের খোলসকে আত্মরক্ষার্থে ব্যবহার করে। এখানে মৃতদেহ কিন্তু প্রাকৃতিক কারণেই তৈরি হয়, মৃত্যুর কারণে, আর তার ফল ভোগ করে ম্যাগটরা কমেনসাল হিসেবে। একইভাবে এই শামুকের মৃত্যুও প্রকৃতিরই নিয়ম, আর তার মৃত্যুর পর তার খোলস ব্যবহার করে হার্মিট ক্র্যাব।
এবার, সর্বশেষে, মানুষের পরিপাকতন্ত্রে বসবাসকারী বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের সাথে মানুষের সম্পর্ক কমেনসালিস্টিক কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে। কিছু কিছু বায়োলজিস্ট এইও বলেন যে দুইটি জীবের মধ্যে সম্পর্ক হলে কোনো এক পক্ষের বা উভয় পক্ষেরই নিউট্রাল থাকা অসম্ভব, মানে সামান্যতম উপকার বা অপকার হলেও হবেই। কিছুই হবেনা, এ অসম্ভব।
তারা বলেন যে কমেনসালিস্টিক বলে খ্যাত রিলেশনশিপ গুলোতেও সূক্ষ্ম উপকার-অপকার জড়িত, যা আমরা খেয়াল করিনা। যেমন- পরগাছা, যেসব জীব গাছের ওপর জন্মে গাছ থেকে পুষ্টি শুষে নেয়। এদের পরিমাণ কম হলে গাছের কিছু যায় আসেনা, কিন্তু বেশি হলে সমস্যা। গাছের ডাল ভাঙতে পারে, খাদ্যসংকট হতে পারে।
আবার ফোরন্টরা যখন হোস্টের দেহের ওপর চড়ে বসে ,তখন তা হোস্টের ওজন বাড়িয়ে তার চলাচল, শিকার , প্রভৃতিকে বিঘ্নিত করতে পারে।তাই, কমেনসালিজম আদও আসল কিনা, ত নিয়ে কিছুটা তর্ক-বিতর্ক চলমান।
আজ আমাদের আলোচনা এতটুকুই, পড়তে থাকুন………
(ম্যাগট আর মিলিপেডের ছবি দেখে আমার সহ্য হয়নি, আধা ঘণ্টা ধরে শরীর ঘিন ঘিন করেছে, তাই আর এগুলোর ছবি দিলাম না)
পর্ব-৩৩: এমেনসালিজম
এতদিন সিম্বায়োসিসের মাধ্যমে শুধু ভালো ভালো জিনিস হয়েছে, একে অন্যের উপকার করেছে, নিজের ফিটনেস বাড়িয়েছে, ভালো সম্পর্ক স্থাপন করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সবসময় যে ভালো হবে এমন কথা নেই। আজকের পর্ব এমনই একটি সিম্বায়োটিক রিলেশন নিয়ে, যার নাম এমেনসালিজম।কমেনসালিজমের বিপরীত।
কমেনসালিজমে একজনের কিছুই হয়না, কিন্তু আরেকজনের উপকার হয়। আর এমেনসালিজমেও একজনের কিছুই হয়না, কিন্তু আরেকজনের ক্ষতি হয়, মারাও যেতে পারে। এখানে আরেকটু সূক্ষ্ম হওয়া প্রয়োজন, একজনের প্রভাবে বা কাজে আরেকজন মারা যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর আরেকজনের দ্বারা সেই একজন প্রভাবিত হয়না।
এমেনসালিজমকে ভাগ করা হয় দুই ভাগে। কম্পিটিশন আর এন্টিবায়োসিস ।
আগে কথা বলি কম্পিটিশন নিয়ে। এখানে সামগ্রিকভাবে বৃহত্তর ( হতে পারে আকারে, শক্তিতে ইত্যাদি ) একটা জীব তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর জীবের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সাধারণত বড়টার কারণে ছোটটা বিভিন্ন রিসোর্স থেকে বঞ্চিত হয়,খাদ্য, আবাসস্থল ইত্যাদির মতো রিসোর্স থেকে। এখানে লক্ষণীয় যে, বড়টা কিন্তু অতিরিক্ত রিসোর্স পায়না , মানে আলাদা করে কোনো সুবিধা পায়না। সে স্বাভাবিকই থাকে। কিন্তু তার নিতান্ত উপস্থিতি, তার এই নিছক স্বাভাবিক জীবন-যাপনই ছোট জীবটার ক্ষতি করে।
একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে আরো, এই ধরুন কুদ্দুস নিজের জমির সীমানা বরাবর কতগুলো বড় বড় গাছের চারা বুনলো। আর হোসুইনও শখ করে একটা ছোট-খাট বাগানের মতো করলো কিউট কিউট ছোট ছোট গাছ নিয়ে। দেখা গেল যে কুদ্দুসের গাছগুলো এত বড় হয়েছে যে হোসুইনের জমিতে সূর্যের আলো মাটি ছোয় না। কুদ্দুসের গাছের ছায়ায় হোসুইনের বাগান অন্ধকার। আবার কুদ্দুসের গাছ বড় বলে মাটি থেকে সব পুষ্টিও টেনে নেয়। ফলে হোসুইনের গাছগুলো দিন দিন শুকাতে শুকাতে বিভৎস রূপ ধারণ করলো। এখানে কুদ্দুসের গাছ কী অতিরিক্ত কিছু পেয়েছে ? না।
কুদ্দুসের গাছ তার স্বাভাবিক কাজকর্মই করেছে, কিন্তু তাতেই হোসুইনের গাছের হাল বেহাল, এখানে হয়েছে কম্পিটিশন। (আসলে সম্পর্কটা ঠিক প্রতিযোগিতার মতো না, কিন্তু তাও নাম কম্পিটিশন)
এবার এভাবে চলতে চলতে কী হবে ? হোসুইনের গাছ একদিন মারা যাবে। ফলে সেই গাছ মাটিতে ডিকম্পোজ হতে শুরু করবে, আর ডিকম্পোজ হওয়ার পর নিশ্চই মাটিতে পুষ্টি উপাদান ত্যাগ করবে। এই পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে কুদ্দুসের গাছ। মনে হতে পারে যে এখানেতো কুদ্দুদের গাছের উপকার হয়েছে; আসলে না, উপকার হয়েও হয়নি ঠিক।ছোট গাছগুলো উপকার করতে মারা যায়নি বা কুদ্দুসের গাছও উপকার নিতে মেরে ফেলেনি। যা হয়েছে পুরোটাই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।
কিন্তু এই ঘটনা ঘটাকালীন হোসুইনের গাছগুলোর ক্ষতি হয়ে গিয়েছে আপনা আপনিই, তারা রিসোর্স থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এটাই কম্পিটিশন।
আরেকটা বাস্তব উদাহরণ দেয়া যায়। স্প্যানিশ ওয়াইল্ড গোট বা বন্য ছাগল আর উইভিল নামের এক প্রকার Beetle এর সম্পর্ককে। এরা উভয়ে একই ধরনের ঘাস-লতাপাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। যেখানে এই উইভিল আর বন্য ছাগলরা একসাথে থাকে, সেখানে ছাগলরাই সব খাদ্য খেয়ে ফেলে, উইভিলদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা বলা যায়।ফলে ছাগলদের অতিরিক্ত কোনো বেনিফিট হয়না, কিন্তু উইভিলদের রিসোর্সের অভাব দেখা দেয়।
আবার অনেকসময় ঘাসের সাথে লেগে থাকা উইভিলও ছাগলের পেটে গিয়ে হজম হয়ে যায়, ফলে এখানেও মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে, তবে তাতেও ছাগলের কোনো উপকার হয়না। তাই, এটা কম্পিটিশন।
আরেকটা সবচেয়ে পরিচিত আর দৈনন্দিন উদাহরণ দেবো? আপনি যখন সবুজ মাঠের ওপর ফুটবল খেলেন, তখন মাঠের ঘাসের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু আপনার কিছুই হয়না।
এবার, এন্টিবায়োসিস।এন্টিবায়োসিসে একটা জীবের রাসায়নিক ক্রিয়ার কারণে অপর একটা জীব মারা যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পেনিসিলিয়াম ছত্রাক পেনিসিলিন নামক রাসায়নিক উৎপন্ন করে, যা এন্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে। এখানে পেনিসিলিয়ামের লাভ-ক্ষতি কিছুই নেই। কিন্তু তার রাসায়নিক ক্রিয়ায় বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়র ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাচ্ছে।
আবার, ব্লাক ওয়ালনাট , যাকে বাংলায় আখরোট বলা হয়, এই গাছরা জুগলোন নামের এক বিশেষ রাসায়নিক নিঃসরণ করে মূল থেকে, যা আশেপাশের গাছের বৃদ্ধি, প্রজনন ইত্যাদিতে বাধা দেয়। কখনো কখনো মেরেও ফেলে।
এন্টাগনিজম নামের আরেকটা সম্পর্ককেও এমেনসালিজমের উদাহরণে টেনে আনা হয়। এন্টাগনিজমের নানান ক্ষেত্রে নানান অর্থ আছে, তবে এমেনসালিজমের উদাহরণ হিসেবে ফাইটোপ্যাথলজির এন্টাগনিজমকে বোঝানো হয়। ফাইটোপ্যাথলজি হলো উদ্ভিদের রোগ-ব্যাধি নিয়ে গবেষণা, বিশেষ করে প্যাথোজেন(রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব)দ্বারা সৃষ্ট রোগ।
এই প্লান্ট প্যাথোজেনদের স্বাভাবিক কাজকর্মে( যেটা উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর) অন্য কোনো অর্গানিজমের সাহায্যে ব্যাঘাত ঘটানোকে বলে এন্টাগনিজম। আর এই ঘটনাকে বলে বায়োকন্ট্রোল, মানে একটা জীব ব্যবহার করে উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর আরেকটা জীব কন্ট্রোল করা।যাকে ব্যবহার করা হয়, তাকে বলে বায়োলজিকাল কন্ট্রোল এজেন্ট।
এক্ষেত্রে সেই ক্ষতিকর জীবের ক্ষতি হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। কিন্তু এজেন্টের কিছুই হচ্ছেনা, লাভ-ক্ষতি কিছুই না।
এমেনসালিজমের আরো অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। আপনি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যদি একটা পিপড়ার ওপর পা দিয়ে ফেলেন, সে মারা যাচ্ছে, আপনার কিছুই হচ্ছেনা।
যাই হোক, কিন্তু এই এমেনসালিজমের বিবর্তন হয় কীভাবে? আসলে এর আলাদা করে বিবর্তিত হবার কোনো প্রয়োজনই নেই। একইসাথে যখন একটা শক্তিশালী আরেকটা দুর্বল জীব বাস করবে, এটাই স্বাভাবিক যে দুর্বলটা কোনো না কোনো ভাবে বঞ্চিত হবে।
আর একজনের স্বাভাবিক ক্রিয়ায় আরেকজনের ক্ষতি হওয়া প্রকৃতিতে অত্যন্ত স্বাভাবিক।কিন্তু এমেনসালিজমের ফলে বিবর্তন ত্বরান্বিত হতে পারে। কারণ যে প্রজাতিটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার মধ্যে কোনো জীবের যদি এমন কোনো মিউটেশন হয়, যা তাকে তার প্রজাতির অন্যান্যদের থেকে কম ক্ষতিগ্রস্ত হতে সাহায্য করছে, তাহলে তার ফিটনেস বাড়বে, এই মিউটেশন পরের প্রজন্মে পাস হবে, একসময় পুরো প্রজাতিতে ফিক্স হবে, ফলে তারা বিবর্তনের দিকে একধাপ এগিয়ে যাবে।
এভাবে, একই স্থানে যদি দীর্ঘকাল ধরে দুইটি প্রজাতির মধ্যে এমেনসালিস্টিক সম্পর্ক বিরাজ করে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রজাতির মধ্যে বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক মিউটেশন ফিক্স হতে থাকবে, যা তাদের ভিন্ন প্রজাতিকরণের দিকে নিয়ে যাবে।
পর্ব-৩৪:পরজীবীদের কথা
আজকে আমরা অনেক বিস্তৃত একটা টপিকে ঢুকবো, সেটা হলো প্যারাসাইটিজম। টপিকটা অনেক বিশাল, এ নিয়ে প্রচুর কথা বলা যায়, তবে আমি চেষ্টা করবো কম কথায় কাজ সারতে।
তো, শুরু করা যাক!
একেবারে সোজা ভাষায়, যেই সিম্বায়োটিক রিলেশনশিপে একজনের উপকার হয়, আরেকজনের ক্ষতি হয়, তাকে বলে প্যারাসাইটিজম। যার উপকার হয় , তাকে বলে প্যারাসাইট। যার ক্ষতি হয়, মানে যার থেকে উপকার নেয়া হয়, তাকে বলে হোস্ট।এই প্যারাসাইট হোস্টের সাথে, ওপরে, ভেতরে, বাইরে বাস করতে পারে।
প্যারাসাইট জিনিসটা নতুন কিছু না, সেই মান্ধাতের আমলেও লোকজন এদের সম্পর্কে ভালোই ধারণা রাখতো। হরেক রকম কৃমি, মশা, উঁকুন,ভাইরাস, নানান রকম ছত্রাক সহ বিভিন্ন ছোট-বড় প্রাণী প্যারাসাইট হয়। প্যারাসাইটরা তাদের হোস্ট থেকে ছোট হয়, হোস্টকে মেরেও ফেলে না (ব্যাতিক্রম হলো প্যারাসাইটয়েড, পরে আলোচনা করবো)।
বড় বড় হোস্টের প্যারাসাইটরা খুবই স্পেশালাইজড, মানে এরা শুধু নির্দিষ্ট ধরনের পরিবেশে বাঁচে আর নির্দিষ্ট ধরনের জীবন-যাপন করে , এদের ডায়েটও নির্দিষ্ট ।এরা নতুন পরিবেশে মানাতে পারেনা।আবার কিছু প্যারাসাইট আছে জেনারেলিস্ট, মানে বিভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে আর বিভিন্ন হোস্টকে আক্রান্ত করতে পারে।সকল প্যারাসাইটদের প্রজননের গতি মারাত্মক দ্রুত, অন্তত তাদের হোস্টের সাপেক্ষে।
প্যারাসাইটরা নানারকম ফন্দি-ফিকির করে হোস্টের থেকে উপকার শুষে নেয় আর নিজের ফিটনেস বাড়িয়ে হোস্টের কমিয়ে দেয়।এরা আবার এক হোস্ট থেকে আরেক হোস্টে যেতে ইন্টারমিডিয়েট বা সেকেন্ডারী হোস্টের ওপর চড়ে বসতে পারে।
অধিকাংশ প্যারাসাইট জীবিত হোস্টের ওপর থাকে, কিন্তু কিছু কিছু ছত্রাক এর ব্যতিক্রম, তারা হোস্টকে হত্যা করার পরেও তার ওপর থেকে যায় আর তার দেহ ভক্ষণ করে।প্যারাসাইটরা ডিজিজ ভেক্টর বা রোগ-জীবাণুর বাহন হিসেবে কাজ করে, আর এই কাজে তারা অনেকটাই দক্ষ।যেমন, মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু,ম্যাল্যারিয়া ছড়ায়।
প্যারাসাইটদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়।
অব্লিগেট প্যারাসাইট হলো তারা, যারা হোস্ট ছাড়া বাঁচতে পারেনা বা প্রজনন করতে পারেনা। জীবনের অন্তত একটা ধাপে হলেও এদের হোস্ট প্রয়োজন।যেসব প্যারাসাইট জীবদ্দশায় মাত্র একটা হোস্ট ধরে, তাদের জীবনচক্রকে বলে ডায়রেক্ট। আর যারা একাধিক ধরে, তাদেরটাকে বলে ইনডায়রেক্ট বা কমপ্লেক্স।
এই ইনডায়রেক্ট জীবনের প্যারাসাইটরা তাদের প্রাইমারি বা ফাইনাল হোস্টের ওপরেই জীবনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় অতিবাহিত করে, তবে বিশেষ প্রয়োজনে কিছু সময় সেকেন্ডারি বা ইন্টারমিডিয়েট হোস্টের ওপর আশ্রয় নিতে পারে।
আবার কিছু প্যারাসাইট জীবনের একটা সময় প্যারাসাইটিক আচরণ করে, বাকি সময় করেনা, এদের বলে টেম্পোরারি প্যারাসাইট। আর যারা আজীবন প্যারাসাইট, তারা পার্মানেন্ট।
হোস্টের দেহের বাইরে বাস করলে তাকে বলে এক্টোপ্যারাসাইট,যেমন উঁকুন। আর ভেতরে বাস করলে বলে এন্ডোপ্যারাসাইট, যেমন কৃমি।এরা উভয়েই পার্মানেন্ট আর অব্লিগেট।
আর অব্লিগেটের বিপরীত হলো ফ্যাকাল্টেটিভ প্যারাসাইট, এরা অবলম্বন হিসেবে হোস্ট ধরে , কিন্তু এদের বেঁচে থাকার জন্য হোস্ট অত্যাবশ্যকীয় না।মানে হোস্ট ছাড়াও বাঁচতে পারে।
অব্লিগেট প্যারাসাইটের বিবর্তন কীভাবে হলো তা নিয়ে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত হলো,প্যারাসাইটের দ্বারা ছড়ানো প্রাণঘাতী কোনো রোগে হোস্টের মৃত্যু হলে হোস্টও মারা যায় আর প্যারাসাইটও আবাস হারায়।যেসব হোস্ট এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তাদের দেহে প্যারাসাইট রয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তারা রোগে মারা যায়নি।
ফলে প্যারাসাইটেরও তাদের দেহ ত্যাগের প্রয়োজন হয়নি। তাই এটা হলো একটা বিশেষ ইকুইলিব্রিয়াম অবস্থা। হোস্ট মারাও যাচ্ছে না ,আবার প্যারাসাইট থেকে মুক্তও হচ্ছেনা।
এটা টিকে আছে কেন? হোস্ট কী প্যারাসাইটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারেনা?
অন্যভাবে ভাবুন, এতে হোস্টের ক্ষতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মৃত্যুর মতো সর্বনাশ হচ্ছেনা। মারা যাওয়া থেকে ক্ষতি হওয়া ভালো। তাই এটা টিকে আছে।
আবার আছে মেসোপ্যারাসাইট, এরা হোস্টের দেহের অল্পেক্টু অংশ কেটে নিজের দেহের কিছু অংশ সেখানে ঢুকিয়ে দিয়ে বাস করে।যেসব অতিক্ষুদ্র এন্ডোপ্যারাসাইটরা ডায়রেক্ট ,তাদের বলে মাইক্রোপ্যারাসাইট।আর যাদের সাইজ একটু বড় আর এক্টোপ্যারাসাইট,তাদের বলে ম্যাক্রোপ্যারাসাইট। আবার যাদের আচরণ প্যারাসাইটের মতো,তবে আবার পুরোপুরি আদর্শ প্যারাসাইটও না, তাদের বলে সেমিপ্যারাসাইট।
প্যারাসাইটদের সুবিশাল শ্রেণিবিভাগ মোটামুটি জানা শেষ।
প্যারাসাইটরা তাদের পোটেনশিয়াল হোস্ট খুঁজে বের করতে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিশেষ কিছু ইঙ্গিত বা চিহ্ন চিনে নেয়, যেগুলো সাধারণত হোস্টরা তাদের আচরণে প্রকাশ করে থাকে। যেমন- কম্পন, নিশ্বাস, উত্তাপ, আর্দ্রতা, গন্ধ ইত্যাদি। আবার প্যারাসাইটিক উদ্ভিদ আছে, তারা আলো, হোস্টের ফিজিওকেমিস্ট্রি ইত্যাদি চিনে নেয়। এইযে ইঙ্গিত বা চিহ্নগুলো, এদেরকে বলে হোস্ট কিউ (Host Cue)।
আজ এইটুকুই। আগামী পর্বে প্যারাসাইটিজমের আরো ইন্টারেস্টিং কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলবো।
পর্ব-৩৫:পরজীবীদের কথা(২)
গতপর্বে প্যারাসাইটদের নিয়ে কিছু বেসিক আলোচনা করেছিলাম। আজকে আমরা একটু গভীরে প্রবেশ করবো।
প্যারাসাইটরা তাদের হোস্টকে আক্রমণ করার জন্য নানা ধরনের ফন্দি করে, দেখা গেছে যে এই নানান ধরনের ফন্দি বা পদ্ধতিগুলোকে প্রধানত ছয় ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমেই আসে, Parasitic Castration. Castration মানে জননশক্তি নষ্ট করা ,যাকে খাটি বাংলায় “ খোজা করা “ বা “ খাসি করা “ বলা হয়। হ্যা, ঠিক ধারণাই করেছেন, এখানে প্যারাসাইটটা তার হোস্টকে খোজা করে দেয়।ফলে জননকার্যে যে শক্তি ব্যয় হও্য়ার কথা, তা হোস্টের অন্যান্য কাজে ব্যয় হয়।এতে হোস্টের ক্ষতি হয়েও অন্যান্য উপকার হয়,মানে তার দেহের আকার, শক্তি, টিকে থাকা ইত্যাদি বেড়ে যায়। আর তার ফলে প্যারাসাইটেরও স্থায়ীত্ব বেড়ে যায়।কিন্তু হোস্টের সামগ্রিক ফিটনেস মারাত্মক কমে যায়, কারণ সে বিবর্তনের প্রধান একটা ভিত্তি, প্রজনন করতে পারেনা।
অনেক সময় হোস্টের দেহ মাত্রাতিরিক্ত বড় হয়ে যায়, যাকে Gigantism বলে।
এই জননকার্য ধ্বংসের কাজ বিভিন্নভাবে হতে পারে, প্যারাসাইট অনেক সময় সরাসরি হোস্টের জননাংগের ওপর আহার করে, অনেক ক্ষেত্রে কিছু কেমিক্যাল নিঃসরণ করে যা প্রজননের বাধা দেয়, কখনো বা জননকার্যের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিজে শুষে নেয়, ফলে জননকার্য এমনিই বন্ধ হয়ে যায়।
জননকার্য সম্পর্কিত সরাসরি লিঙ্গের সাথে। তাই ,যখন জননকার্যে ব্যাঘাত ঘটে, তখন এই লিঙ্গেও সমস্যা দেখা দেয়। সেক্সুয়াল ডায়মর্ফিজম কমে যায়, আর অনেক সময় বিপরীত লিঙ্গের সেকেন্ডারী সেক্স ক্যার্যাক্টারিস্টিক্স নিজের দেহে ডেভেলপ হতে পারে।
সেকেন্ডারী সেক্স ক্যার্যাক্টারিস্টিক্স হলো সেসব সেক্সুয়াল ডায়মর্ফিজম, যা প্রজননে কাজে লাগেনা। মানুষের বয়ঃসন্ধিকালে আর বিভিন্ন প্রাণীর যৌন পরিপক্বতা এলে এই বৈশিষ্টগুলো প্রকাশিত হয়। যেমন-ময়ুরীর পেখম, সিংহের কেশর।
প্যারাসাইটিক কাস্ট্রেশনের শিকার হলে এক শ্রেণির পুরুষ কাকড়া তাদের প্রজাতির নারীদের মতো এসব সেকেন্ডারী সেক্স ক্যার্যাক্টারিস্টিক্স ডেভেলপ করে।
এরপর আসে ডায়রেক্টলি ট্রান্সমিটেড প্যারাসাইট। এদের ছড়ানোর জন্য কোনো ভেক্টর বা মাধ্যম প্রয়োজন হয়না। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো উকুন।তাছাড়া বিভিন্ন ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস আছে।
এই ডায়রেক্টলি ট্রান্সমিটেডদের একটা বিশেষ ঘটনা হলো এগ্রিগেটেড ডিস্ট্রিবিউশন, মানে পুঁজিত বিন্যাস।এসব প্যারাসাইটদের একটা নির্দিষ্ট হোস্ট প্রজাতি থাকে, মানে এরা স্পেশালাইজড। আর সেই হোস্ট প্রজাতির মধ্যে অধিকাংশ প্রাণীর দেহেই প্যারাসাইট সংখ্যা খুব কম, আর খুব কম প্রাণীর দেহে প্যারাসাইট সংখ্যা মারাত্মক বেশি। এইযে অসম বিন্যাস, মানে কম লোকদের বেশি প্যারাসাইট, এইটাকে বলে এগ্রিগেটেড ডিস্ট্রিবিউশন।
ট্রফিকালি ট্রান্সমিশন, মানে খাওয়ার মাধ্যমে ছড়ানো।এসব প্যারাসাইটদের জীবনচক্র অনেক জটিল, কারণ এরা দুই বা ততোধিক হোস্টের দেহে পরপর বাস করে।অনেকসময় এরা নিজেদের অপরিপক্বকালে সিস্ট গঠন করে (সিস্ট হলো এদের বিশ্রামের অবস্থা, সিস্ট গঠন করলে এদের সহজে মারা যায়না)। সিস্ট গঠনের ফলে এরা হোস্টের হজমক্রিয়ায় বেঁচে যায়, তারপর এরা হোস্টের দেহের ভেতর, অধিকাংশ সময় অন্ত্রে, বাসা বাধে, প্রজনন করে।
আর হোস্টের বিহেভিয়র মোডিফিকেশন করে বা আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে( এ নিয়ে পরে লিখবো )। মানে হোস্টকে দিয়ে এমন আচরণ করায় যাতে সে শিকারির দ্বারা আকৃষ্ট হয় ও শিকার হয়, এতে সেই প্যারাসাইটটা আবার নতুন হোস্টের দেহে চলে যায়।এভাবে চলতে থাকে।
এরপর ভেক্টর ট্রান্সমিটেড প্যারাসাইট। এদের ছড়ানোর জন্য একটা থার্ড পার্টি বা ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট প্রয়োজন। তবে মূল কথা হলো, প্যারাসাইটরা সর্বদা তাদের ডেফিনিটইভ হোস্ট বা প্রধান হোস্টের ওপরের প্রজনন করবে, কখনোই ইন্টারমিডিয়েটের ওপর প্রজনন করেনা। মশা-মাছি-ইদুরের মতো প্রাণীদের দ্বারা ছড়ানো বিভিন্ন রোগ এর উদাহরণ হতে পারে।
এবার প্যারাসাইটয়েড, এরা নিজেদের হোস্টকে হত্যা করে ফেলে, ফলে এদের এই আচরণের সম্পর্ক প্রিডেশন বা শিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।এদেরকে দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে, ইডিওবায়োন্ট আর কয়নোবায়োন্ট।
ইডিওবায়োন্টরা তাদের হোস্টকে রাসায়নিক প্রয়োগের মাধ্যমে সরাসরি হত্যা বা প্যারালাইজ করে ফেলে, তারপর তার দেহ নিয়ে নিজের বাসায় যায় , সেখানে সেটা রেখে তার ওপর ডিম পাড়ে আর বাসাটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে রেখে যায়।
ডিম থেকে লার্ভা বের হয়, আর সেই লার্ভা ওয়ি হোস্টের দেহ খেয়ে বেঁচে থাকে।তারপর বড় ও পরিপক্ব হওয়ার পর তারা ওয়ি বাসা থেকে বের হয়ে আসে। এখানে প্যারাসাইটটির প্রজনন ঠিকই হোস্টের ওপর ঘটছে আর জীবনের একটা সমও এরা প্যারাসাইটের ওপর নির্ভর করেই কাটাচ্ছে।
কয়নোবায়োন্টরা হোস্টের দেহের ভেতর ডিম পাড়ে বা ডিম পেড়ে তা হোস্টের দেহের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দেয়, ফলে দীর্ঘ সময় ধরে এই ডিম , ডীমের লার্ভা আর হোস্টের বৃদ্ধি একসাথে হয়। লার্ভা ধীরে ধীরে হোস্টের দেহের ভেতরের অংশ খেতে থাকে আর হোস্ট ধীরে ধীরে মারা যেতে থাকে। একসময় এই প্যারাসাইটয়েড লার্ভা হোস্টের ফাঁপা দেহ ছেড়ে পরিপক্ব হয়ে বেরিয়ে যায়।
সর্বশেষে, মাইক্রোপ্রিডেটর।এরা একাধিক হোস্টকে আক্রমণ করে, আর প্রত্যেক হোস্টের ফিটনেস অতি সামান্য পরিমাণে কমিয়ে দেয়। একবারে এরা একটা হোস্টকেই ধরে। অতি পরিচিত উদাহরণ হলো মশা। অধিকাংশ মাইক্রোপ্রিডেটররা রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে।
এই গেল প্যারাসাইটদের প্রধান ছয়টি আক্রমণের স্ট্রাট্যাজি। এছাড়াও এদের আচরণ, ছড়ানোর পদ্ধতিসহ অন্যান্য নিয়ামকের ওপর ভিত্তি করে এদেরকে আরো বেশ কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলো নিয়ে আগামী পর্বে আলোচনা করবো।
শেষে আরো দুইটি জিনিস মনে আসলো, সুপারপ্যারাসাইটিজম হলো একই হোস্ট যখন একাধিকবার একই প্রজাতির প্যারাসাইট দ্বারা আক্রান্ত হয়। আর কোইনফেকশন বা মাল্টিপ্যারাসাইটিজম হলো একই হোস্ট যখন একাধিক প্রজাতির প্যারাসাইট দ্বারা আক্রান্ত হয়।
পর্ব-৩৬:পরজীবীদের কথা(৩)ঃ
পরজীবীদেরকে তাদের আচরণ, প্রকৃতি, স্বভাব ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে আরো কয়েকভাগে ভাগ করা হয়, আজ সেগুলো নিয়েই আলোচনা করবো।
প্রথমেই হাইপারপ্যারাসাইটিজম। প্যারাসাইটের প্যারাসাইটকে সহজ কথায় হাইপারপ্যারাসাইটিজম বলে।হাইপারপ্যারাসাইটরা তাদের হোস্ট , যে নিজেই কিনা প্যারাসাইট, তার ওপর বসবাস করে। মানে অনেকটা চোরের ওপর বাটপারি আরকি।
হাইপারপ্যারাসাইটিজমের সর্বোচ্চ পাঁচটি পর্যন্ত স্তর আবিষ্কার হয়েছে, ছত্রাকের মধ্যে। মানে হোস্টের উপর প্যারাসাইট, তার ওপর প্যারাসাইট, তার ওপর প্যারাসাইট,তার ওপর প্যারাসাইট,আবার তারও ওপর প্যারাসাইট।
হাইপারপ্যারাসাইটরা তাদের হোস্টের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে।তাই কৃষিতে কীতপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর ব্যবহার আছে।
সোশ্যাল প্যারাসাইটিজম। এটা পুরোটাই প্রায় মিমিক্রির সাথে সম্পর্কিত, যা নিয়ে আমি এখনো কিছু লিখিনি, সামনে লিখবো। তাই মিমিক্রি নিয়ে কয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন।
মিমিক্রিতে একটা প্রজাতির প্রাণী, যেকোনো সুবিধা পাও্যার জন্য আরেকটা প্রজাতির প্রাণিকে নকল করে, মানে তার আকার-আকৃতি, গঠন, রঙ ইত্যাদি নকল করে। উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে একে এগ্রেসিভ, প্রোটেক্টিভ ইত্যাদি ভাগ করা হয়। যাই হোক, আপাতত এতটুকু বুঝলেই হবে যে মিমিক্রি মানে অন্য কারো মতো ছদ্মবেশ ধরা। সোশ্যাল প্যারাসাইটিজমে প্যারাসাইটরা বিভিন্ন সামাজিক প্রাণীদের ইন্টারস্পেসিফিক রিলেশনের সুযোগ নেয়।
সামাজিক প্রানী কারা? যারা সামাজিক গোত্র হিসেবে বেঁচে থাকে, যারা নিজের সমাজের প্রতি কোঅপারেটিভ আচরণ প্রদর্শন করে। যেমন- পিপড়া, বিভিন্ন মৌমাছি।
একধরনের প্রজাপতি আছে যারা লার্ভা অবস্থায় পিপড়াদের মিমিক্রি করে, তাই এই প্রজাপতিদের ডিম থেকে লার্ভা বের হলে সেগুলোকে পিপড়াদের অঞ্চলের রেখে আসে, আর সেগুলো দেখতে পিপড়াদের মতো হয়, মিমিক্রি করে, তাই পিপড়ারা সেগুলোকে নিজেদের প্রজাতির মনে করে পালন-পোষণ করে।
কারণ তারা সামাজিক জীব। এতে সেই প্রজাপতির ঠিকই উপকার হচ্ছে, কিন্তু পিপড়া নিজের খাদ্য,বাসস্থান আর শক্তি ওই লার্ভার পিছনে ব্যয় করে নিজের ক্ষতি করছে। এভাবে সোশ্যাল প্যারাসাইটিজম হয়।
ব্রুড প্যারাসাইটিজম। Brood মানে শাবক বা সন্তান-সন্ততি। কাকের বাসায় কোকিল ডিম পাড়ে এ কথা কে না জানে? এইটাই ব্রুড প্যারাসাইটিজম। এই ঘটনাটা আরো অনেক প্রজাতির মধ্যে দেখা যায়। যার ডিম, সে হলো প্যারাসাইট, আর যার বাসায় ডিম পাড়ছে সে হোস্ট।
এখানে প্যারাসাইটরা তাদের হোস্টের ডিমের মিমিক্রি করে, ফলে হোস্ট সেই ডিম চিনতে না পেরে তার পালন পোষণ করে যায়, এমনকি অনেকসময় বড় হয়ে গেলেও চিনতে পারেনা! কিন্তু মাঝে মাঝে যদি বুঝে ফেলে, তখন ডিমকে বাসা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, অথবা বাচ্চাকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলে।
এজন্য কিছু প্রজাতির ব্রুড প্যারাসাইটরা শক্ত ডিমের খোলস ডেভেলপ করেছে, যাতে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমে যায়। এখানে হোস্ট বেচারা দীর্ঘদিন ধরে প্যারাসাইটের ডিমকে পালন-পোষণ করে বাসস্থান,খাদ্য,শক্তির দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর প্যারাসাইটের ঠিকই উপকার হচ্ছে।
ক্লেপ্টোপ্যারাসাইটিজমঃ প্যারাসাইট হোস্টের সংগ্রহ করা খাবার চুরি করে। তাই একে অনেকসময় প্যারাসাইটিজম বায় থেফট ও বলে। সাধারণত একই গণ বা জেনাসের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতিদের মধ্যে এটা বেশি দেখা যায়। নিজের প্রজাতির মধ্যেও সবসময়ই দেখা যায়।
সেক্সুয়াল প্যারাসাইটিজমঃ এখানে সাধারণত পুরুষটা ফ্যাকাল্টেটিভ প্যারাসাইট হিসেবে স্ত্রীদের দেহে লেগে থাকে। স্ত্রীটা পুরুষের থেকে অবিশ্বাস্য রকমের বড় হয়। পুরুষটা এখানে স্ত্রীকে বীর্য দিয়ে সন্তান উৎপাদনে সাহায্য ছাড়া আর কিছু করেনা। কিন্তু স্ত্রীটা নিজে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েও পুরুষের জীবন-যাপনের সবকিছুর ব্যবস্থা করে।
এডেলফোপ্যারাসাইটিজমঃ গ্রীক ভাষায় এডেলফোস শব্দের অর্থ ভাই। এখানে হোস্ট আর প্যারাসাইট খুবই নিকট সম্পর্কের হয়, একই গোত্র ও গণ বা ফ্যামিলি ও জেনাসের ।
এখানেই আমাদের প্যারাসাইটিজমের ভাগ-বিভাগ নিয়ে পড়া শেষ।
হোস্ট-প্যারাসাইট দীর্ঘদিন একত্রে থাকার ফলে তাদের মধ্যে কোইভোলুশন ঘটে। হোস্ট-প্যারাসাইট কোইভোলুশন নিয়ে অনেক কথা আছে, সেগুলো এখানে লিখবো না, কিছু সাধারণ আলোচনা করবো।
প্যারাসাইট কখন বেশি বেনিফিট পাবে? যখন তার হোস্ট বেনিফিট পাবে বা হোস্টের ফিটনেস বাড়বে, তখন। এজন্য মাঝে মাঝে দেখা যায় কী প্যারাসাইট ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দেয় ( বুঝাচ্ছি যে বিবর্তনের বিভিন্ন মেকানিজমের মাধ্যমে কমে যায়)।ফলে হোস্ট বেনিফিট পায়, আর পরোক্ষভাবে প্যারাসাইটও বেনিফিটই পায়। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে দেখা যায় যে ক্ষতির পরিমাণ কমতে কমতে ঋণাত্মক হয়ে যায়, মানে প্যারাসাইটটা এখন আর প্যারাসাইট নেই, তারা প্যারাসাইটিজম থেকে মিউচুয়ালিজমে বিবর্তিত হয়।
অনেকসময় হোস্টের মধ্যে প্যারাসাইটের ক্ষতি থেকে বাঁচার বিভিন্ন মেকানিজম বিবর্তিত হয়, মানে একপ্রকার মানিয়ে নেয়। আর এই মানিয়ে নেয়া যদি চরম মাত্রায় চলে যায়, তাহলে দেখা যায় যে প্যারাসাইট ছাড়া আর হোস্ট থাকতে পারছেনা।মানে ওই, মিউচুয়ালিজম গড়ে উঠেছে।
আবার প্যারাসাইটদের মাঝেও প্রতিযোগিতা হয়।হবেনা কেন? বিবর্তন মানেই এই, টিকে যাবার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় সেই প্যারাসাইটরা টিকে যায় যারা হোস্টের ক্ষতি করতে পারে বেশি, যারা প্রজনন করতে পারে বেশি আর দ্রুত।এখানে প্রধানত ন্যাচারাল সিলেকশন ক্রিয়া করে। তাই এর মাধ্যমে প্যারাসাইট প্রজাতি আরো ক্ষতিকর হয়ে বিবর্তিত হতে পারে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে হোস্ট আর প্যারাসাইট একইসাথে নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়। এই ঘটনাকে বলে কোস্পিসিয়েশন। অবাক হবার কিছু নেই, হওয়াটা একেবারেই স্বাভাবিক।হবে নাইবা কেন? প্যারাসাইট যদি ক্ষতির মাত্রা বাড়ায়, তাহলে হোস্টের মধ্যেও সেটা সহ্য করার মেকানিজম বিবর্তিত হবে।
আবার হোস্ট যদি ক্ষতির হাত থেকে বাচার মেকানিজম আয়ত্ত করে, তাহলে প্যারাসাইটেও নতুন ক্ষতিকর ট্রেইট আসবে। এভাবে চলতে চলতে একে অন্যের ট্রেইট “কাটাকাটি” করবে,আর সাথে সাথে কোস্পিসিয়েশন হওয়া অসম্ভব না।
তাহলে, এভাবেই, প্যারাসাইটিজমের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাণীর বিবর্তন ঘটে থাকে।
আমাদের প্যারাসাইটিজম নিয়ে কথাবার্তা আজকে এখানেই শেষ।
পরের পর্বঃ বিবর্তন তত্বঃ অনুকরণের বিবর্তন/পর্ব ৩৭-৪০
আগের পর্বঃ বিবর্তন তত্বঃ ক্লিনিং সিম্বায়োসিস/পর্ব ২৬-৩০